যশমশাই জলে ঝাপ দিতে যাচ্ছিলেন। তাকে দুহাতে চেপে ধরে বললুম, বরং মােনাওঝাকে ডাকুন যশমশাই!
উনি এবার চেঁচিয়ে উঠলেন,—মােনাওঝা কোথায় আছিস রে? ওরে মােনা, শিগগির আয় রে।
পেছনে কালাচঁাদের ডাক শােনা গেল। যশমশাই। কী হয়েছে?
—আমার সর্বনাশ করেছে গােরাচঁাদ ব্যাটাছেলে! দেখে যা কালাচঁাদ!
কালাচাদ ঘাটে এল। তার সঙ্গে একজন জটাজুটধারী লােক। তার হাতে ত্রিশূল। কপাল সিঁদুরে লাল। কালাচাদ বলল, বাজার করে মােনাকে ডেকে নিয়ে এলুম। কেননা হতচ্ছাড়া হনুমান গােরাটাদ কলকাতার বাবুমশাইকে জ্বালাতন করতে পারে। মােনা। শীগগির ওকে সেদিনকার মতাে দাঁড়কাক করে দাও।
মােনা-ওঝা লাল চোখে ওপারের তালগাছের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে
যন্ত্র পড়তে থাকল। তারপর কী অদ্ভুত ব্যাপার, সত্যিই একটা দাঁড়কাক একটা তালগাছের ডগায় উড়ে এসে বসল। তারপর কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল—এ্যা! খ্রা! খ্রাক! ব্র্যাক! গ্র্যা! এঁ! গ্র্যাক! গ্র্যাক!
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২২
মােনা ত্রিশূল তুলে গর্জন করল,-চো-ও-প! মুখ খুললেই আবার অক্কা হয়ে যাবি।
এবার দাঁড়কাকটা স্থির হয়ে বসে রইল। বললুম,—যশমশাই! বাড়ি গিয়ে আবার পদ্য লিখতে বসুন। অন্তত মাস দেড়েক ধরে লিখতে থাকুন। তারপর আমার কাছে নিয়ে আসবেন। শুধরে দেব। আমি এখানে দুটো মাস থাকব।
তারাচরণ যশ খালি সুটকেস হাতে চুপচাপ চলে গেলেন। আমি দোতলার ঘরে গিয়ে এবার নিশ্চিন্ত মনে লিখতে বসলুম। তবে হ্যা-সন্দীপ নতুনরকমের ভূতের কথা বলেছিল। মিলে গেল। ওকে বরং এই ভূত নিয়ে একটা বড় গল্প লিখে দেব। ভূত নিয়ে উপন্যাস লেখা কি সম্ভব আমার পক্ষে? সেটা পেরেছিলেন একমাত্র ত্রৈলােক্যনাথ মুখােপাধ্যায়।…
তিন-আঙুলে দাদা।
সচারাম এসে ঠাকুমাকে গড় করে বলল,-এবার একটা কিছু করুন
দিদিঠাকরুন। ব্যাটাছেলে বড্ড বেশি জ্বালাচ্ছে। আমি যে এর পর ফতুর হয়ে যাব।
আমি বারান্দায় শতরঞ্চিতে বসে ভমাস্টারের ধমক খাচ্ছিলাম। ঠাকুমা কাছাকাছি থাকলেই দেখেছি ওঁর তর্জনগর্জন বেড়ে যায়। কিন্তু এই সাতসকালে বিস্কুটওয়ালা বেচারামের হঠাৎ মুখ চুন করে এসে ঠাকুমাকে গড় এবং ওই নালিশ। ভন্ডুমাস্টার আমাকে ভুলে গিয়ে চোখ টেরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
ঠাকুমা ফুলবাগানের সেবাযত্ন করছিলেন। হাতে একটা খুরপি। বললেন, নাককাটা না তিন-আঙুলে?
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২২
বেচারাম করুণমুখে বলল, আজ্ঞে তিন-আঙুলে। নাককাটা তাে মানুষজনের সাড়া পেলেই লজ্জায় লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু তিন-আঙুলে মহা ধড়িবাজ। গাছের ডালে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। তলা দিয়ে কেউ গেলেই হয় চুল টেনে দেয়, নয়তাে কানে খিমচি কাটে। মিত্তিরমশাইয়ের জামাইয়ের কানে—
ঠাকুমা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,কখানা বিস্কুট নিয়েছে তাই বল।
তিনখানা খাস্তা, একখানা কিরিমকেক, আড়াইখানা নিমকি। বেচারাম ফেঁাস করে শ্বাস ছেড়ে ফের বলল,—এখনও পুরাে হিসেব করে দেখিনি। মাথার ঝাকায় পেলাস্টিক মােড়া ছিল। সেই পেলাস্টিক তুলে, কীরকম হাতসাফাই ভাবুন!
তিনআঙুলে দাদা
ঠাকুমা গম্ভীরমুখে বললেন,—প্লাস্টিক তুললেই তাে শব্দ হবে। তাের ভুল হচ্ছে তাে বেচু ?
বেচারাম জোরে মাথা নেড়ে বলল,—তিন-আঙুলে কে ছিল মনে নেই দিদিঠাকরুণ?
শুনেছি পকেটমার ছিল। বাবুগঞ্জের হাটে ধরা পড়ে নাকি ওই অবস্থা।
ভন্তুমাস্টার বলে উঠলেন, আমি স্বচক্ষে দেখেছিলাম মাসিমা। মারের চোটে একখানা হাত ভেঙে গিয়েছিল। অন্য হাতের আঙুলের দুটো হাড় গুঁড়াে হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে সেই হাতখানা আর অন্য হাতের দুটো আঙুল কেটে বাদ দিয়েছিলেন ডাক্তারবাবুরা। সেইজন্যই তাে তিন-আঙুলে নাম হয়েছিল।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২২
ঠাকুমা চোখ কটমটিয়ে বললেন, “ভন্তু, পুঁটুকে আঁক কষাও। হাফইয়ারলিতে আঁকে গােল্লা পেয়েছে।
ভন্তুমাস্টার ঘুরে গর্জন করলেন। একটা বানর ছয় ফুট উচ্চ খুঁটিতে উঠিবার চেষ্টা করিতেছে। মিনিটে ছয় ইঞ্চি উঠিয়া দুই ইঞ্চি নামিয়া যাইতেছে। এইরূপে ছয় ফুট উঠিতে তাহার কতক্ষণ সময় লাগিবে?
আমার কান ঠাকুমা এবং বেচারামের দিকে। বেচারাম বলল,—মাথার আঁকায় যে টান পড়েছিল দিদিঠাকরুন!
ঠাকুমা বললেন,—তুই ওকে দেখতে পেলি?
নাহ। ঘুরঘুটে আঁধার। তার ওপর টিপটিপিয়ে বিষ্টি। ষষ্ঠীতলা কেমন জায়গা তা তাে জানেন।
তুই এখন আয় বেচু। আমি দেখছি কী করা যায়। বলে ঠাকুমা একটা ফুলগাছের মাটিতে খুরপির কোপ বসালেন। বেচারাম তুষােমুখে চলে গেল।
বানরটাকে খুটির ডগায় ভমাস্টার চড়াতে পারলেও আমি পারলাম না। ষষ্ঠীতলার পর একটা খাল আছে। খালের ওপর কাঠের সাঁকো। ওই পথেই আমাকে রােজ স্কুল যেতে-আসতে হয়। ছুটির পর স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলে বাড়ি ফিরতে আঁধার ঘনিয়ে আসে। খালটা গ্রামের শেষদিকটায়। এ পাড়ায় আমার স্কুলের সঙ্গী বলতে কেতাে আর টোটো। টোটো ব্যাকে খেলে। কেতাে গােলে। আমি কোনও কোনওদিন হাফব্যাকে চান্স পাই।
Read More.