কিন্তু টোটো যতই গোয়ার হােক, ওর ওপর ভরসা রাখা কঠিন। খুব দৌড়বাজ যে! বেগতিক দেখলেই উধাও হয়ে যায়।
আর কেবাের স্বভাব হল ভয় পেলেই আমাকে জাপটে ধরা। ভাবনায় পড়ে
গেলাম।
আমাদের গাঁয়ে অনেকরকম ভূত আছে জানতাম। কিন্তু কখনও তাদের সামনাসামনি দেখতে পাইনি। একজনের নাম ছিল কাঁদুনে। সে নাকি খালের ধারে কেঁদে-কেঁদে বেড়ায়। একজনের নাম ‘হাসুনে’। সে রাতবিরেতে খালি হেসে বেড়ায় হিহি করে। কাতুকুতু’ নামে এক বেজায় দুষ্টু ভূত ছিল। সে একলা-দোকলা মানুষজন পেলেই তাকে কাতুকুতু দিয়ে অস্থির করত। হেঁচো ভূত আমাদের বাগানে এসে
নাকি খুব হাঁচত। আর রামবাবুদের বাঁশবনে ছিল এক ‘বেহালা-বাজিয়ে ভূত। দিনদুপুরেও তার বাজনা শােনা যেত। একবার কেতের সঙ্গে কঞ্চি কাটতে ঢুকে তার
বেহালা শুনে ভয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। তার বাজনার সুর বড় বিচ্ছিরি।
কিন্তু নাককাটা’ আর ‘তিন-আঙুলে’-র কথা সেই প্রথম শুনলাম।
বােঝা গেল এক পকেটমার মরে তিন-আঙুলে হয়েছে। কিন্তু নাক কাটাটা কে? ভত্তমাস্টার চলে যাওয়ার পর ঠাকুমার কাছে জেনে নেব ভাবছি, এমন সময় বেচারামের দাদা কেনারাম এসে গড় করল। ঠাকুমা বললেন,—তাের আবার কী হল রে কিনু? দুধে জল মিশিয়ে সিঙ্গিমশাইয়ের চটি খেয়েছিস নাকি?
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২৩
কেনারাম কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,না দিদিঠাকরুন! সর্বনাশ হয়ে গেছে। নাককাটা আমার এক হাঁড়ি দুধ নাক দিয়ে টেনে নিয়েছে। কাল সন্ধেবেলা দুধটা জ্বাল দিয়ে রেখেছিলাম। সকালে দেখি একটি ফেঁটাও নেই।
—তুই কী করে জানলি নাককাটাই দুধ খেয়েছে?
আজ্ঞে, আমার মেয়ে ইমলি দেখেছে। আমি গিয়েছিলাম রামবাবুদের গরু দুইতে। ইমলির মা পুকুরঘাটে বাসন মাজতে গিয়েছিল। ইমলি একা ছিল। বলল কী, একটা রােগাটে কালাে কুচকুচে লােক পাঁচিল ডিঙিয়ে এসেছিল। তার নাক নেই। ইমলি তাই দেখে তাে ভয়ে কাঠ। লােকটা দুধের হাঁড়িতে মুখ ঢুকিয়ে চেঁ-ঠো করে সব শুষে নিয়ে পালিয়ে গেল।
ঠাকুমা গুম হয়ে বললেন, “। দেখছি।
কেনারাম কাকুতিমিনতি করে বলল,—দেখছি নয় দিদিঠাকরুন। এর একটা পিতিকার আপনি ছাড়া আর কেউ পারবে না। শুনলাম কাল সন্ধেবেলা বেচুরও সর্বনাশ হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না দিদিঠাকরুন, নাককাটা আর তিন-আঙুলে সবাইকে ছেড়ে আমাদের দুভাইয়ের পেছনে লাগল কেন? আমরা ওদের কী করেছি?
ঠাকুমা একটু ভেবে বললেন,—হ্যা রে কিনু, পাঁচুকে তুই তাে দেখেছিস? কেনারাম ভুরু কুঁচকে বলল,-পাঁচু, মানে ঝাপুইহাটির সেই পাঁচু-চোর?
আবার কে? ঠাকুমা একটু কষ্টমাখা হাসি ফোটালেন মুখে। —পঞ্চগ্রামী বিচারে পাঁচুর নাক কেটে দিয়েছিল। তা পাচুর বিরুদ্ধে তুই সাক্ষী দিসনি তাে?
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২৩
কেনারাম প্রথমে হকচকিয়ে গেল। তারপর আস্তে বলল,—সে তাে অনেকদিনের কথা। সাক্ষী দিইনি, তবে পঞ্চগেরামির সময় বারােয়ারিতলায় ছিলাম বটে। সবাই পাঁচুর নাক কাটার বিচারে হইচই করে সায় দিল। তখন আমিও দিয়ে থাকব। কিন্তু কথা হচ্ছে, নাক কেটেছিল তাে নােলে। তার কোনও ক্ষতি আজ পর্যন্ত হয়েছে বলে তাে শুনিনি দিদিঠাকরুন!
ঠাকুমা কেমন রহস্যময় হাসলেন এবার। হবে কী করে? হলেও বা জানবি কী করে? নােলেও তাে কবে মরে গেছে শুনেছি!
কেনারাম আবার ঠাকুমাকে প্রতিকারের নালিশ জানিয়ে চলে গেল। আমার এতক্ষণে অবাক লাগল। আজ বেচারাম-কেনারাম ঠাকুমার কাছে নালিশ জানাতে এল।
সেদিন মিত্তিরমশাই তার জামাইয়ের কানে কে চিমটি কেটেছে বলতে এসেছিলেন। কাল ভেঁটুবাবুও ক্রাচে ভর করে ঠাকুমার কাছে কী যেন বলতে এসেছিলেন। সারারাত নাকি ঘুম হয়নি এবং হাঁচি’ কথাটাও কানে এসেছিল। কিন্তু সবাই ঠাকুমার কাছে ভূতের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে আসছে কেন?
বলে পারলাম না,ঠাকুমা, তুমি বুঝি ভূত জব্দ করতে পারাে? ঠাকুমা চোখ কটমটিয়ে বললেন,—স্কুলের সময় হয়ে এল। চান করতে যাও।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২৩
সেদিনই স্কুলের ছুটির পর ফুটবল খেলে কেতাে আর টোটোর সঙ্গে বাড়ি ফেরার পথে কেনারাম-বেচারামের গল্প শােনাচ্ছিলাম। খালের সাঁকোর কাছে এসে টোটো বলল,“আজ এসপার-ওসপার করে তবে বাড়ি যাব। পুঁটু, আমার বই-খাতা ধর। কেতাে, সেদিনকার মতাে পুঁটুকে জাপটে ধরবিনে বলে দিচ্ছি। এক কিকে তােকে মাঠে ফেরত পাঠাব, হ্যা!
কেতাে ভয়ে-ভয়ে বলল,—তাের প্ল্যানটা কী?
টোটো চাপা গলায় বলল,তােরা ওই শিবমন্দিরের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকবি। আমি ষষ্ঠীতলার গাছে উঠে ওত পাতব। মনে হচ্ছে, তিন-আঙুলে বেচুদার বিস্কুটের লােভে ওই গাছে উঠবে। বেচুদা তাে ওখান দিয়েই যাবে। ক্লিয়ার?
কেতাে বলল,-টোটো, তিন-আঙুলে যদি তােকে গাছ থেকে ঠেলে ফেলে দেয়?
টোটো ঘুসি দেখিয়ে বলল,—একখানা আপারকাট অ্যায়সা মারব যে, তিন আঙুলে এসে খালের জলে পড়বে।
বেলা পড়ে এসেছে। নিরিবিলি খালের দুধারে গাছপালা কালাে হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। পাখিদের হা কমে যাচ্ছে। ভাঙা শিবমন্দিরের আড়ালে কেতের সঙ্গে চলে গেলাম। ষষ্ঠীতলায় একটা ঝাকড়া বটগাছ। টোটো গাছে উঠে গেল। তারপর আর সময় কাটতে চায় না। আঁধারে সব অস্পষ্ট হয়ে গেছে। বুক টিপটিপ করছে অজানা ভয়ে। গোঁয়ার টোটোর পাল্লায় পড়ে কী বিপদ কোনদিক থেকে এসে যাবে, কে জানে!
Read More