পােকামাকড়ের ডাক বেড়ে গেল এতক্ষণে। জোনাকি জ্বলতে দেখছিলাম এখানে ওখানে। কেতাে ফিসফিস করে বলল,-“টু, বেচুদা এখনও ফিরতে না কেন রে?
সেই সময় ষষ্ঠীতলার গাছের ওপর টোটোর চেঁচানি শােনা গেল। অ্যাই! কী হচ্ছে?..হি হি হি হি…আরে, মরে যাব!..হি হি হি..ওরে বাবা। হি হি হি হি…
তারপর ধপাস শব্দ। চেঁচিয়ে উঠলাম,—টোটো। টোটো।
-হি হি হি হি..মরে যাব! সত্যি! হি হি হি হি..ওরে বাবা! হি হি হি হি… বললাম,—কেতাে! আয় তাে দেখি।
কেতাে পাছে আমাকে জাপটে ধরে, তার সঙ্গে দূরত্ব রেখে দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি, টোটো হি হি হি হি করে হাসতে-হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কেতাে বলল,
—সর্বনাশ। টোটো কাতুকুতুর পাল্লায় পড়েছে। পালিয়ে আয় পুঁটু!
কেতাে পালানাের আগেই গাছ থেকে পাতা খসে পড়ার মতাে কেউ পড়ল এবং কেমন বিচ্ছিরি গলায় বলে উঠল,-চোখ গেলে দেব! কান মলে দেব। ছাড় হতভাগা!
টোটোর হাসি থেমে গেল। সে ফেঁস-ফেঁস করে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়াল। তারপর সটান উধাও হয়ে গেল। কেতাে আমাকে জাপটে ধরে বলল—পুটু, এবার কী হবে?
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২৪
গাছ থেকে সদ্য লাফিয়ে পড়া ছায়ামূর্তি তেমনই বিদঘুটে গলায় বলল, তিন-আঙুলে থাকতে ভয় কী খােকাবাবুরা ? কাতুকুতু ব্যাটাচ্ছেলে আমাকে দেখেই পিঠটান দিয়েছে।
কেতাে কঁপাকাপা গলায় বলল, তু-তুমি তি-তিনআঙুলে ? | ছায়ামূর্তি একটা হাত তুলল। আঁধারে স্পষ্ট দেখলাম তার হাতে মােটে তিনটে আঙুল। সে সেই তিনটে আঙুল নেড়ে বলল,-শিগগির কেটে পড়াে ােেমরা, বেচারাম আসছে। আমার বড় খিদে পেয়েছে।
খালের দিকে টর্চের আলাের ঝলক। কেতাে বলল,—পুঁটু, চলে আয়। বেচুদা জব্দ হােক। ও বিস্কুটের ডবল দাম নেয়, তা জানিস? তিন-আঙুলে দাদা, আজ ওর ঝকাসুদ্ধ তুলে নিয়ে।
তা আর বলতে? —বলে তিন-আঙুলে তড়াক করে গাছে উঠে গেল।
আমরা হনহন করে হাঁটতে থাকলাম। বাড়ির আশেপাশে কাতুকুতু গিয়ে লুকিয়ে থাকলে কী করব, সে একটা ভাবনা। তবে সে কাতুকুতু দিলেই ঠাকুমাকে চেঁচিয়ে ডাকব। নয়তাে তিন-আঙুলে দাদা তাে আছেই।
কেতাে চাপা গলায় বলল,-তিন-আঙুলে দাদা কিন্তু খুব ভালাে। তাই না রে? টোটোকে কাতুকুতুর হাত থেকে না বাঁচালে কী হতে বল ? | সায় দিতে যাচ্ছি, কাছাকাছি কেউ হচ্চো করে হেঁচে উঠল। তারপর আর সেই হাঁচি থামতে চায় না। চেঁচিয়ে ডাকলাম,ঠাকুমা, ঠাকুমা!
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২৪
অমনি হাঁচি থেমে গেল। ঠাকুমাকে ওরা এত ভয় পায় কেন?
পরদিন সকালে পড়তে বসেছি, এমন সময় দেখি, কেনারাম-বেচারাম দুই ভাই এক আলখাল্লাধারী ফকিরকে সঙ্গে নিয়ে হাজির। ঠাকুমা হাসিমুখে ডাকলেন,—এসসা! বাবা এসাে! তােমার জন্য কতদিন থেকে পথ চেয়ে বসে আছি। আসছ না দেখে কিনু আর বেচুকে পাঠিয়েছিলাম।
বেচারাম বলল,—তিন-আঙুলে কাল সন্ধ্যায় আমার আঁকাসুদ্ধ তুলে নিয়েছে। আগে ওই ব্যাটাচ্ছেলেকে জব্দ করুন ফকিরবাবা!
কেনারাম বলল,না। আগে নাককাটাকে।
ফকিরবাবা বিড়বিড় করে মন্তর আওড়াতে-আওড়াতে বাগানের মাটিতে বসলেন। তারপর একটু হেসে ঠাকুমাকে বললেন, বেটি, সেবার তােকে বলেছিলাম শয়তানদের এই ঝুলিতে ভরে পদ্মার ওপারে ফেলে দিয়ে আসি। তুই বললি, না, তিনআঙুলে দাদা , গঙ্গা পার করে দিলেই যথেষ্ট। এখন দ্যাখ বেটি, ওরা গঙ্গা পেরিয়ে আবার ফিরে এসেছে। পদ্মাপারে দেশের বর্ডার। বর্ডার পেরনাের ঝক্কি আছে। বুঝলি কিছু? পাসপাের্ট-ভিসার হাঙ্গামা আছে না?
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২৪
ঠাকুমা হাসলেন। বুঝেছি বাবা, খুব বুঝেছি। এবার তুমি ওদের পদ্মাপার করেই দিয়ে এসাে।।
মুচকি হেসে ফকিরবাবা বললেন,—আগে দই-চিড়ে-কলা দে বেটি! ফলার করি। তারপর হচ্ছে।
ভন্তুমাস্টার বললেন, কিন্তু ফকিরবাবা, শুনেছি বর্ডারে ঘুষ দিলে নাকি পেরনাে যায়।
ঠাকুমা চোখ পাকিয়ে বললেন,—ভন্তু, পুঁটুকে আঁক কষাও।
ভদ্ভমাস্টার গর্জন করলেন,-একটি চৌবাচ্চায় দশ গ্যালন জল ধরে। সেই চৌবাচ্চায় একটি ছিদ্র আছে। ছিদ্র দিয়া ।
ফকিরবাবার খবর ততক্ষণে রটে গেছে। একজন-দুজন করে লােকের ভিড় জমতে শুরু করেছে। কলার পাতায় ফলার সেরে ফরিবাবা যখন ভূত ধরতে বেরােলেন, তখন তার পেছনে বিশাল মিছিল। ভন্তুমাস্টারকে খুঁজে পেলাম না আর। সেই ফঁাকে আমিও দৌড়ে গিয়ে মিছিলে ঢুকে পড়লাম। দেখলাম কেতাে আর টোটোও এসে গেছে কখন।
ষষ্ঠীতলার কিছু আগে, রাস্তায় ফকিরবাবা তার প্রকাণ্ড লােহার চিমটে দিয়ে দাগ এঁকে বললেন,“খবরদার, খবরদার, এই দাগ পেরিয়ে কেউ যেন আসবে না। দাগ পেরিয়েছ কী মরেছ। খবরদার, খবরদার!
ফকিরবাবা ষষ্ঠীতলার পেছনের জঙ্গলে উধাও হয়ে গেলেন। সবাই চুপ করে আছে। শুনলাম, মিত্তিরমশাই মুচকি হেসে চুপিচুপি ভেঁটুবাবুকে বলছেন,—রামবাবুর বাঁশবনের বেহালাদারকে পেলে হয়। মহা ধূর্ত। খাল পেরিয়ে হয়তাে সিঙ্গিমশাইয়ের বাঁশবনে গিয়ে ঢুকে পড়েছে।
সিঙ্গিমশাই পেছনেই ছিলেন। বলে উঠলেন, বাজে কথা বােলাে না মিত্তির! আমার বাঁশবনে কে আছে তা জানাে?
Read More