তর্কাতর্কি বেধে গেল। অন্যেরা চুপ! চুপ! বলে থামানাের চেষ্টা করলেন। কিন্তু সিঙ্গিমশাইকে থামানাে শক্ত। শেষপর্যন্ত ফকিরবাবাকে ষষ্ঠীতলায় ফিরতে দেখে তর্কাতর্কি থেমে গেল। ফকিরবাবার কঁাধের তাপ্লিমারা রংবেরঙের ঝুলিটি এখন প্রায় পুঁটুলি হয়ে উঠেছে। সামনে এসে তিনি বললেন,-চললাম এবার পদ্মাপারে। ফিরে এসে আবার ফলার খাব।
মুখে ঝলমলে হাসি। প্রকাণ্ড পুঁটুলি হয়ে ওঠা ঝুলিটি খুব নড়ছিল। মিছিল করে গাঁয়ের লােকেরা ওঁর পেছন-পেছন চলল। গাঁয়ের শেষে মল্লিকদের আমবাগানের ধারে পিচরাস্তা। ফকিরবাবা পিচরাস্তায় উঠলে আমার চোখে পড়ল, ওঁর পিঠের দিকে তাপ্লিমারা ঝুলি ফুঁড়ে কালাে কুচকুচে তিনটে আঙুল বেরিয়ে আছে। খুব নড়ছে আঙুল তিনটে। টা-টা বাই-বাই’ করছে কি তিন-আঙুলে দাদা?
দেখে কষ্ট হল। বেশ তাে ছিল তিন-আঙুলে। বেচারামকে জব্দ করেছিল। কাতুকুতুকে জব্দ করেছিল। ঠাকুমা কী যে করেন! ভ্যাট!
কিছুদিন পরে এক সকালে মাস্টার আমাকে আঁক কষাচ্ছেন। ঠাকুমা ফুলগাছের সেবাযত্ন করছেন। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন,“অ্যাই হতচ্ছাড়া! ভালাে হবে
বলছি! রেখে যা। রেখে যা।।
ভত্তমাস্টার বললেন,কী হল মাসিমা ?
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২৫
ঠাকুমা বাগানের বেড়ার দিকে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। অ্যাই বাঁদর! খুরপি দিয়ে যা। নইলে আবার ফকিরবাবাকে খবর পাঠাব।
ভন্তুমাস্টার আবার বললেন, কী হল মাসিমা?
ঠাকুমা ঘুরে প্রায় আর্তনাদ করে বললেন,—ও ভন্তু, ও পুঁটে, আমার খুরপি নিয়ে পালাচ্ছে। ধরাে, ধরাে!
—কে খুরপি নিয়ে পালাচ্ছে মাসিমা ? —তিন-আঙুলে। শিগগির ওকে ধরাে।
ভন্তুমাস্টার দৌড়ে গেলেন। আমিও দৌড়লাম। বাগানের বাইরে খুরপিটা পড়ে থাকতে দেখা গেল। ভন্তুমাস্টার খুরপিটা কুড়ােত গিয়েই উঁহু হু হু করে পিছিয়ে এলেন। তারপর কানে হাত বুলােতে-বুলােতে বললেন,“উঁহু হু হু, বড় জ্বালা করছে যে। ও পুটু, আমার কানটা আছে না নেই দ্যাখ তাে বাবা!
হাসি চেপে বললাম,—আছে মাস্টারমশাই!
ভত্তমাস্টার কানে হাত চাপা দিয়ে বললেন,—কোবরেজমশাইয়ের কাছে মলম লাগিয়ে আনি। উঁহু হু হু! তারপর টাটুঘােড়ার মতাে উধাও হয়ে গেলেন।
তিন-আঙুলে ফকিরবাবার ঝুলি ফুঁড়ে পালিয়ে এসেছে জেনে আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল। বললাম,—তিন-আঙুলে দাদা! ঠাকুমার খুরপিটা আমি কুড়ােচ্ছি। আমার কান মুলে দেবে না তাে?
তিন-আঙুলে আমার কান মলে দিল না। খুরপিটা কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ঠাকুমাকে দিলাম। ঠাকুমা খুশি হয়ে বললেন,—তিন-আঙুলে ফিরে এসেছে যখন, তখন থাক। গাঁ-গেরামে দু-একটা ভূত না থাকলে চলে? তবে নাককাটাটা বড্ড বােকা। সেও পালিয়ে আসতে পারত। তাই না পুঁটু?
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২৫
সেই সব ভূত মাদের গায়ে একসময় প্রচুর ভূত ছিল। শুধু রাতবিরেতে নয়, দিনদুপুরেও তারা একলা-দোকলা মানুষকে বাগে পেলে ভয় দেখিয়ে দুষ্টুমি করত। দুষ্টুমিই বলা উচিত। কারণ কখনও তারা কারুর ঘাড় মটকেছে বা ঠ্যাং ভেঙেছে সেই সব ভূত বলে শুনিনি। তবে ভয়ের চোটে কেউ ভিরমি খেয়ে মারা পড়লে কিংবা দৌড়ে পালাতে গিয়ে কারুর ঠ্যাং ভাঙলে সেজন্য তাে আর ভূতকে দায়ী করা চলে না। যার যা কাজ! ভূতের কাজটাই হল মানুষকে ভয় দেখানাে। যে ভূত ভয় দেখায় না, সে আবার কীসের ভূত?
কথাটা বলতেন আমার বড়মামা।
বড়মামা রেলে চাকরি করতেন। ছুটিছাটায় আমাদের বাড়ি আসতেন। সাংঘাতিক সব ভূতের গল্প বলে আমাদের রক্ত জল করে ফেলতেন। গল্প শােনার পর আমরা যারা ছােট তাদের অবস্থা তখন শােচনীয়! কিন্তু তারপরই বড়মামা হাে-হাে করে হেসে বলতেন,ওরে। ভূতকে কখনও ভয় পাবি না। কারণ কী জানিস? মানুষ যেমন ভূতকে ভয় পায়, ভূতও মানুষকে খুব ভয় পায়। ভূত যদি ভয় দেখায়, তােরাও তাকে ভয় দেখাবি। দেখবি, ব্যাটাচ্ছেলে তক্ষুনি কেটে পড়েছে।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২৫
সে-কথা শুনেও যে খুব একটা সাহস পেতাম, তা নয়। আমার তাে খালি ভাবনা হতাে, ভূত বড়দের ভয় পেতেও পারে, কিন্তু আমাদের মতাে ছােটদের কি আর ভয় পাবে?
আমাদের বাড়ির পিছন দিকটায় ছিল একটা বাগান! তার ওধারে একটা ঝিল। ঝিলের ওধারে ছিল ঘন জঙ্গল। ঠাকুমা বলতেন, ঝিলের জঙ্গলে থাকে এক কন্ধকাটা। আর ঝিলের ধারে থাকে এক শাকচুন্নি। শাকচুনিটা রােজ রাত্তিরে আলাে জ্বেলে ঝিলের ধারে কী যেন খুঁজে বেড়ায়। কন্ধকাটা আলাে সইতে পারে না। তাই সে এসে শাঁকচুন্নির সঙ্গে খুব ঝগড়া বাধায়। ঝগড়ার চোটে সারারাত্তির ঘুমােত পারিনে।।
ঠাকুমা থাকতেন বাড়ির পিছনের ঘরে। কখনও কখনও রূপকথা শােনার লােভে আমি ঠাকুমার কাছে শুতে যেতাম। রূপকথা বলতে বলতে ঠাকুমা হঠাৎ থেমে গেলে বলতাম, তারপর কী হল বলল না?
ঠাকুমা আস্তে বলতেন,ওই আবার বেধেছে।
কী বেধেছে? কন্ধকাটার সঙ্গে শাঁকচুন্নির ঝগড়া। শুনতে পাচ্ছিস না তুই? কই না তাে!
Read More