মাতব্বররাও বলে উঠলেন, হ্যা। প্রমাণ চাই। সাক্ষী চাই, সিঙ্গিমশাই, কই আপনার সাক্ষীদের ডাকুন।
সাক্ষী পাওয়া গেল না। আমাদের গাঁয়ের লােকেরা বলল,ভূতগুলাে বাড়াবাড়ি করলে বরং মােনা-ওঝাই এসে বুঝিয়ে–সুঝিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেয়। কাজেই মােনা তাদের আস্কারা দেয় বলা চলে না। তা ছাড়া আজ অব্দি মােনা-ওঝা কারুর পেছনে ভূতকে লেলিয়ে দিয়েছে বলেও জানা নেই।
‘পঞ্চগেরামি’ বিচারসভায় মােনা-ওঝা বিলকুল খালাস পেয়ে গেল।
কিন্তু খোঁড়াসিঙ্গির রাগ পড়েনি। কিছুদিন পরে উনি কোখেকে এক সাধুবাবাকে নিয়ে এলেন। সাধুবাবা ঠাকরুনতলায় ত্রিশূল পুঁতে মড়ার খুলির সামনে ধুনি জ্বেলে ধ্যানে বসলেন। গা-সুষ্টু ছােট-বড় সবাই ভিড় জমাল সেখানে। আমরা, ছােটরাও ব্যাপারটা দেখতে গেলাম।
সাধুবাবা একসময় ধ্যান ভেঙে লালচোখে চারদিকে দেখে নিয়ে মড়ার খুলিটা তুলে নিলেন। মন্তর আওড়ে গর্জন করলেন,—আয়-আয়! যে যেখানে আছিস, চলে আয়। এই খুলির মধ্যে ঢুকে পড় সবাই। বেম্মদত্যি, কন্ধকাটা, শাঁকচুন্নি, মামদো, পেঁচো . গােদানাে, হাঁদা, নুলাে, ভুলাে, কেলাে, ক্যাংলা-খ্যাংলা দুই ভাই, জট-জটি, পিশাচ, গলায় দড়ে, যখবুড়াে সব্বাই আয়! সব্বাই এসে ঢুকে পড় এই খুলির ভেতর।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২৭
এই বলে সাধুবাবা মড়ার খুলিটা দুহাতে চেপে ধরে ঝুলিতে ঢোকালেন। ত্রিশূল তুলে হুঙ্কার দিতে দিতে এগিয়ে গেলেন ঝিলের দিকে। ঝিলের জলে মড়ার খুলিটা বের করে ছুড়ে ফেলে বললেন,-থাক তােরা জলের তলায়। আর বলে দিচ্ছি, যে এই খুলি তুলবে, তার মুখে রক্ত উঠে মারা পড়বে।..
এরপর বেশ কিছুদিন আমাদের গায়ে আর ভূতের সাড়াশব্দ ছিল না। মােনা ওঝা নাকি মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াত। লােকেরা রাত-বিরেতে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করত। মাঝে–মাঝে দেখতাম, রামুখােপার গাধাটা ঝিলের ধরে ঘাস খেতে-খেতে হঠাৎ মুখ তুলে তাকাত! ওর দৃষ্টিটা খুব করুণ মনে হতাে। তার খেলার সঙ্গীরা জলের তলায় খুলির ভেতর বন্দি। বেচারার দুঃখ হতেই পারে।
হঠাৎ একদিন হইচই পড়ে গেল।
রামুধােপা গিয়েছিল ঝিলের জলে কাপড় কাচতে। সে দেখেছে সেই মড়ার খুলিটা ঝিলের ধারে পড়ে আছে। জল থেকে নিশ্চয় কেউ ভূতবােঝাই খুলিটা তুলেছে।
সারা গাঁ ভেঙে পড়ল ব্যাপারটা দেখতে। খোঁড়াসিঙ্গিও ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁফাতে-হাঁফাতে সেখানে হাজির হলেন। আমারও দেখার ইচ্ছে করছিল। কিন্তু বড়রা কিছুতেই ছােটদের যেতে দিলেন না। জলের তলার খুলি থেকে খালাস পাওয়া ভূতগুলাে খাপ্পা হয়েই আছে। কাজেই অবােধ আর দুর্বল ছােটদের ওপর তাদের নজর পড়ার সম্ভাবনা আছে।
পরে শুনলাম, দায়টা চেপেছে মােনা-ওঝারই কাধে। মােনাও তন্ত্রমন্ত্র জানে। কাজেই সাধুবাবার ফেলে দেওয়া খুলি সে ছাড়া জল থেকে তুলবে সাধ্য কার? তা ছাড়া মােনা নিশ্চয় কোনও বড় ওঝার কাছে নতুন বিদ্যে রপ্ত করে এসেছে। তবে শেষপর্যন্ত এতে মােনা-ওঝারাই জয়-জয়কার পড়ে গেল। মুখে রক্ত উঠে সে মারা পড়েনি। তার মানে, আমাদের গাঁয়ের এই ওঝা সেই সাধুবাবার চেয়ে এখন আরও ক্ষমতাশালী। সিঙ্গিমশাই কেঁচো হয়ে ঘরে ঢুকলেন। কদাচিং বাইরে বেরুতেন তিনি। বেরুলেই দিনদুপুর ছাড়া নয়। মােনা-ওঝার এতে দাপট বেড়ে গেল।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২৭
এদিকে আবার ভূতের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল সেদিন থেকেই। পণ্ডিতমশাই পাঠশালার ছুটির পর বাড়ি ফিরছেন। হঠাৎ গাছ থেকে টুপটাপ করে ঢিল পড়ল। পণ্ডিতমশাইয়ের বেলায় এ কোনও নতুন ঘটনা নয়। বরং ঢিল পড়া বন্ধ হওয়াতে তঁার খারাপ লাগত। আবার ঢিল পড়ায় খুশি হয়েছিলেন। বললেন,কীরে তােরা সব কেমন আছিস?
গদাই মােড়ল সন্ধেবেলা মাঠ থেকে ফিরছেন। একটা কালাে বেড়াল তাঁর সঙ্গ নিল। মােড়ল খুব খুশি হয়ে বললেন,ভালাে আছিস তাে বাবা ? জলবন্দি হয়ে নাকি খুব কষ্টে ছিলিস?
এইসব ঘটনা সন্ধেবেলায় ছােটকাকা খুব জমিয়ে বর্ণনা করতেন। আমি কিন্তু তখনও ভূত দেখিনি বা সে–রকম কোনও সাড়াশব্দও পাইনি। বড়রা বলতেন, ভূত আছে। আমরা ছােটরাও মেনে নিতাম, ভূত আছে। তাছাড়া বড়মামা এসে ভূতের স্বভাবচরিত্র, কীর্তিকলাপ শুনিয়ে ভূতের ব্যাপারটাকে আরও পাকাপােক্ত করে ফেলতেন।
তাে অমন একটা ঘটনার কিছুদিন পরে ঠাকুমার মুখে ঝিলের ধারের শাঁকচুন্নি
Read More