সেই সব ভূত আর জঙ্গলের কন্ধকাটার ঝগড়ার কথা শুনেছিলাম। বলেছিলেন,—মােনা-ওঝাকে ডাকতে হবে। মােনা ছাড়া এর বিহিত হবে না।
মােনা-ওঝা পরদিন এসেছিল। ঠাকুমার মুখে সব শুনে সে বলল, বড় সমিস্যে দিদিঠাকরুন। ওদের ঝগড়াঝাটির কথা আমার অজানা নয়। অনেক চেষ্টা করেও মিটমাট করাতে পারিনি। আসলে শাঁকচুন্নিটা আলাে ছাড়া এক পা হাঁটতে পারে না। মেয়েটা রাতকানা। ওদিকে কন্ধকাটার চোখে ঘা। আলাে লাগলেই জ্বালা করে। কাকে দোষ দেব বলুন?
—তুই কন্ধকাটাকে বরং অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে বল মােনা!
যাবে বা কোথায়? সব জায়গাই তাে দখল হয়ে আছে।
খুঁজলে নিশ্চয় কোথাও পাওয়া যাবে। তুই খুঁজে দ্যাখ না।
মােনা-ওঝা একটু ভেবে নিয়ে বলল,-মুসলমানপাড়ার গােরস্থানে একটা শ্যাওড়া গাছ আছে। গাছটাতে একটা মামদো থাকত দেখেছি। কাল রাত্তিরে গিয়ে তাকে ডাকলাম, চাচা আছে নাকি? কোনও সাড়া পেলাম না। আমার সন্দেহ হচ্ছে, মামদোচাচা ডেরা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। প্রায়ই বলত, গাছটা পছন্দ হচ্ছে
রে। হাত-পা ছড়িয়ে বসা যায় না! বড্ড বেশি ডালপালা। হাওয়া-বাতাস ঢােকে ।
ঠাকুমা খুব উৎসাহ দেখিয়ে বললেন, তাহলে তুই কন্ধকাটাকে গিয়ে কথাটা বল মােনা। ওদের ঝগড়ার জ্বালায় সারারাত্তির ঘুমােতে পারিনে।
মােনা-ওঝা কিন্তু-কিন্তু করে বলল,—দেখি, বলেকয়ে। তবে গােরস্থানে কন্ধকাটা যেতে রাজি হবে বলে মনে হয় না।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২৮
-কেন? রাজি হবে বলে মনে হয় না?
বুঝলেন না? কন্ধকাটা হল গিয়ে হিন্দু। মুসলমানদের গােরস্থানে যেতে চাইবে কি?
ঠাকুমা ফোকলা দাঁতে হেসে বললেন,ধুর পাগল! ভূতের আবার হিন্দু মুসলমান কী রে? ভূত হল ভূত। মানুষের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান আছে। ভূতের মধ্যে নেই। তুই কন্ধকাটাকে একবার বলেই দ্যাখ গে না। বলবি, গােরস্থানের তল্লাটে একেবারে শুনশান অন্ধকার। আরামে থাকবে।..
কদিন পরে মােনা-ওঝা এসে বলল,“কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে দিদিঠাকরুন! কন্ধকাটাকে বলেকয়ে রাজি করিয়েছিলাম। কাল সন্ধেবেলায় সে গােরস্থানের শ্যাওড়াগাছে ডেরা বাঁধতে গিয়েছিল। কিন্তু মামদোচাচা আবার ফিরে এসেছে। তাড়া খেয়ে কন্ধকাটা পালিয়ে এল।
ঠাকুমা নিরাশ হয়ে বললেন,—মুখপােড়া মামদোটা ফিরে এল কেন জানিস?
বলতে গেলে সে অনেক কথা। —মােনাওঝা শাস ছেড়ে বলল। বেঁচে থাকতে এক কাবুলিওয়ালার কাছে দেনা করেছিল। এদিকে কাবুলিওয়ালাও যে মরে
ভূত হয়েছে আর মােদিপুরের গােরস্থানের কাছে বাজপড়া তালগাছের ডগায় ডেরা খুঁজে নিয়েছে, মামদোচাচা জানত না। ওকে দেখেই কাবুলিওয়ালা লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিল। তাড়া খেয়ে কঁাহাকঁহা মুল্লুক ঘুরে মামদোচাচা বাড়ি ফিরেছে।
হারে মােনা, তাহলে এক কাজ কর না তুই। ঠাকুমা মিটিমিটি হেসে বললেন,ঘটকালিতে লেগে যা। শাঁকচুনির সঙ্গে কন্ধকাটার বিয়ে দিয়ে দে। তাহলেই মিটমাট হয়ে যাবে।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২৮
মােনা-ওঝা ফিক করে হাসল। সেই চেষ্টাই তাে করছি দিদিঠাকরুন। শুধু একটাই সমিস্যে! কন্ধকাটার চোখের ঘা সারিয়ে দেওয়া দরকার। তাহলে শাঁকচুন্নির পিদিমের আলাে ওর চোখের ঘায়ে খোঁচা দেব না। দেখি, তেমন বদ্যি-কোবরেজ কোথাও পাই নাকি!
মােনা চলে গেলে বললাম,আচ্ছা ঠাকুমা, কন্ধকাটাদের তাে মুন্ডু নেই শুনেছি। ছােটকাকা বলছিলেন। ওদের চোখ কোথায় থাকে তাহলে?
ঠাকুমা বললেন,ধুর বােকা! চোখ থাকে ওদের বুকের ওপর।
কন্ধকাটার বুকে চোখের কথা শুনে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। তারপর থেকে দিনদুপুরেও আর ঝিলের জঙ্গলের দিকে তাকাতে সাহস পেতাম না। বড়মামা বলতেন বটে, ভূতকে কক্ষনও ভয় পাবি না।
কিন্তু কন্ধকাটার একে তাে মুন্ডু নেই, তার ওপর বুকে দুটো চোখ। মুখােমুখি দেখা তাে দূরের কথা, কল্পনা করতেই যে রক্ত হিম হয়ে যায়!
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-২৮
তাে শেষপর্যন্ত মােনা-ওঝা ভূতের কোবরেজ খুঁজে পেয়েছিল। সেই কোবরেজের মলমে নাকি কন্ধকাটার চোখের ঘা সেরে যাচ্ছিল। আগামী কালীপূজার অমাবস্যার রাত্তিরেই কন্ধকাটার সঙ্গে শাঁকচুন্নির বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়েছিল। মােনা রােজই। এসব খবর দিয়ে যেত। বিয়েতে খরচাপাতির ব্যাপার আছে। ঠাকুমা সবই দিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ এক অঘটন ঘটে গেল।
হঠাই বলা চলে। কারণ ইতিমধ্যে আমাদের গায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিকল্পনা হয়েছে এবং খুটি পোঁতার কাজও শেষ, কিন্তু বিদ্যুতের পাত্তা ছিল না। লােকেরা হাল ছেড়ে দিয়েছিল। এতদিনে খবর পাওয়া গেল, সামনের দুর্গাপুজোয় বিদ্যুৎ আসছে। উদ্বোধন করতে আসছেন বিদ্যুত্ৰন্ত্রী। সাজো সাজো রব পড়ে গেল খবর শুনে। শহর থেকে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি আসার হিড়িক পড়ল সঙ্গে সঙ্গে।
ছােটকাকা আমাদের বাড়িতে মিস্ত্রি এনে বিপুল উৎসাহে কাজে নেমে পড়লেন। বাগানের দিকে আলাের ব্যবস্থা করা হল। তারপর ষষ্ঠীর দিন সন্ধেবেলায় খেলার মাঠে জনসভা হল, বিদুষ্মন্ত্রী এসে সুইচ টিপে উদ্বোধন করলেন। চারদিকে উজ্জ্বল আলােয় ভরে গেল।
সে রাত্তিরে আমরা প্রায় জেগেই কাটালাম। এত আলাে, এমন উজ্জ্বল আলাে ছেড়ে কি ঘুমােতে ইচ্ছে করে?
Read More