সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩

খন খয়রা মাছ কিনলে সস্তায় পেতুম। যাক গে। যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন আর ও নিয়ে ভেবে লাভ নেই। কিন্তু—বলেই ছােটমামা থমকে দাঁড়ালেন।

ভৌতিক গল্পসমগ্র 

জিগ্যেস করলুম, কী হল ছােটমামা? 

—আরেকটা ভুল করে বসে আছি রে পুঁটু! টর্চ আনিনি যে! 

এতক্ষণে আমিও একটু ভাবনায় পড়ে গেলুম। ছােটমামার সঙ্গে রাতবিরেতে গেলেই কী সব বিদঘুটে কাণ্ড হয়। এতক্ষণ মনে ছিল না। 

ছােটমামা বললেন,—চাঁদ উঠতে দেরি আছে। অতক্ষণ অপেক্ষা করলে তাের ঠাকুরদার পাতে রাত্রিবেলা এই খয়রা মাছ পড়বে না। বরং এক কাজ করা যাক। হাটে দেখছিলুম, একটা লােক বেতের ছড়ি বিক্রি করছে। আয় তাে দেখি। একটা ছড়ি-টড়ি সঙ্গে থাকলে সাহস বাড়ে। বুঝলি পুঁটু ? 

মাত্র দুটাকায় একটা বেতের ছড়ি পাওয়া গেল। ছাতার বাঁটের মতাে বাঁকানাে হাতল আছে। ছড়িটা বগলদাবা করে মাছভর্তি থলে ঝুলিয়ে ছােটমামা হাঁটতে থাকলেন। আমি তাঁর কাছ ঘেঁষে হাঁটছিলুম। কিছুক্ষণ চলার পর অন্ধকার স্বচ্ছ মনে হল। শরৎকালের আকাশে নক্ষত্ররা উজ্জ্বল হয়। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩

ছােটমামা একটু হেসে বললেন,-বুঝলি পুঁটু! ঠিক এমনি একটি ছড়ি সিঙ্গিমশাইয়ের আছে। দেখিসনি তুই? 

বললুম, সিঙ্গিমশাই সবসময় ছড়ি হাতে নিয়ে হাঁটেন কেন ছােটমামা? 

—ওটা স্টাইল! বুঝলি পুঁটু! সব মানুষ বুড়াে হলেই ছড়ি নিয়ে হাঁটে না। তাের ঠাকুরদা তাে বুড়ােমানুষ। তার হাতে ছড়ি দেখেছিস? 

না ছােটমামা! 

—তাহলেই বুঝে দ্যাখ পুঁটু! সিঙ্গিমশাইয়ের ছড়ি হাতে হাঁটাটা আসলে স্টাইল! আমিও সেইরকম স্টাইলে হাঁটছি, দ্যাখ! 

বলে ছােটমামা বাঁ-হাতে মাছের থলে নিয়ে ডানহাতে ছড়ির হাতল ধরে অবিকল সিঙ্গিমশাইয়ের মতাে মাটিতে ছড়ির ডগা ঠেকালেন। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন। 

একটু পরে দেখি, ছােটমামা মাটির রাস্তায় জোরে হাঁটতে শুরু করেছেন। আমি দৌড়ে তাঁর নাগাল পাচ্ছি না। রাগ করে চেঁচিয়ে বললুম,—ছােটমামা! অত জোরে হাঁটছেন কেন? 

ছােটমামা সামনের দিক থেকে কেন যেন কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,আমি কি জোরে হাঁটছি রে পুঁটু? ছড়িটা আমাকে হাঁটাচ্ছে। মানে, ছড়িটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে! এই! এই ছড়ি! আস্তে! আস্তে! 

আমি যথাসাধ্য দৌড়ে গিয়ে বললুম,—ছােটমামা! ছােটমামা! আমি দৌড়ুতে পারছিনে। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩

—ওরে পুঁটু! ছড়িটা-সর্বনাশ! এই! এই ব্যাটাচ্ছেলে! রাস্তা ছেড়ে এদিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস? 

বলে ছােটমামা চঁাচাতে থাকলেন,—পুঁটু! পুঁটু! আমাকে ছড়িটা ধানক্ষেতের আলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে রে! 

ততক্ষণে পিছনে চঁাদ উঁকি দিয়েছে আবছা, জ্যোৎস্নায় দেখলুম, ছােটমামা বাঁ-দিকে ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে চলেছেন। চেঁচিয়ে বললুম,—ছােটমামা! ছড়িটা ফেলে দিচ্ছেন না কেন? এক্ষুনি ছড়িটা ফেলে দিন! 

ছােটমামার করুণ চিৎকার শােনা গেল,—ওরে পুঁটু! ছড়ির হাতল থেকে হাত ছাড়াতে পারছি না যে! 

আতঙ্কে, দুর্ভাবনায় আমি এবার চেঁচিয়ে বললুম,—ছােটমামা! গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুকে ডাকুন। 

কথাটা আমার মাথায় কেমন করে এসেছিল কে জানে! আমার কথাটা শুনেই বাঁ-দিকে খানিকটা দূরে ধানক্ষেতের মধ্যে ছােটমামা এবার হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ওরে গঙ্গারাম! গঙ্গারাম তাের কাটামুণ্ডুটা নিয়ে আয় তাে! ছড়ি ব্যাটাচ্ছেসের মুন্ডু কেটে তাের মতাে করে ফেলবি গঙ্গারাম! ওরে কাটিহারের গঙ্গারাম। শিগগির আয় রে! 

তারপরই ছােটমামার হাসি শুনতে পেলুম। আবছা জ্যোৎস্নায় ছােটমামাকে কাটিহারের গঙ্গারাম হাসতে-হাসতে ফিরে আসতে দেখলুম। তিনি বলছিলেন—কেমন জব্দ? আঁ? গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুকে ডাকতে ছড়িটা আমার হাত থেকে খসে ডিগবাজি খেতে খেতে পালিয়ে গেল! 

 ছােটমামার প্যান্টের নিচের দিকটা শিশিরে আর ঘাসের কুটোয় নােংরা হয়ে গেছে। ভিজে জবজব করছে। তিনি আমার কাছে এসে হাঁপাতে-হাঁপাতে বললেন, ওঃ, কী সর্বনেশে ছড়ির পাল্লায় পড়েছিলুম রে পুঁটু! ভাগ্যিস, তুই বুদ্ধি করে গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলি। 

বললুম,—ছােটমামা! কিন্তু গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুকে ছড়ির ভূত অত ভয় পেল কেন? 

ছােটমামা বললেন, বুঝতে পারিসনি পুঁটু? ছড়ির ভূত নিশ্চয় ম্যাজিকের 

এরপর ছােটমামা আমাকে মাছের থলে দিয়ে জুতােদুটো খুললেন তারপর প্যান্ট গুটিয়ে জুতাে বাঁ-হাতে নিয়ে হাঁটতে থাকলেন। ততক্ষণে জ্যোত্সা উজ্জ্বল হয়েছে। জিগ্যেস করলুম,ছড়িটা অমন করে আপনাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল কেন? 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩

ছােটমামা বললেন,—সেটাই তাে বুঝতে পারছি না রে পুঁটু! ভূত কি ছড়ি হতে পারে? আমার মনে হচ্ছে, ওটা কোনও ভূতের ছড়ি! বুঝলি? ছড়িওয়ালা কোনও মরা মানুষের ছড়ি সস্তায় কিনে আমাকে বেচেছিল। 

কথাটা বলেই ছােটমামা থমকে দাঁড়ালেন। জিগ্যেস করলুম,কী হল ছােটমামা? 

—ওই দ্যাখ! দেখতে পাচ্ছিস? ছড়ি ব্যাটাচ্ছেলে আমাদের আগে-আগে খুটখুট শব্দ করে হেঁটে চলেছে। 

ভয় পেয়ে বললুম,—ছােটমামা। ছড়ি হাঁটছে না। ভূত ছড়ি হাতে নিয়ে হাঁটছে। 

এবার ছােটমামা হুংকার দিয়ে বললেন,আয় তত পুঁটু! দেখি ব্যাটাচ্ছলেকে। এখনও এত সাহস! 

ছােটমামা বােকামিই করে ফেলতেন, কারণ ছড়িটা ডিগবাজি খেতে-খেতে তার দিকে আসছিল। আমি চেঁচিয়ে উঠলুম,—গঙ্গারাম! গঙ্গারাম! তােমার কাটামুণ্ডু নিয়ে এসাে শিগগির! 

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৪

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *