সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩০

বস্তু, তর্কে বহুদূর। কাজেই যারা ওকে বিশ্বাস করে, তারা বলে মােনা-ওঝা এবং যারা করে না, তারা বলে মােনা বুজরুক। তবে লােকটাকে যত ভয়ঙ্কর দেখাক, ওপর পার্টির দুটো দাঁত নেই বলে যখনই হাসে, তাকে ভালােমানুষ মনে হয়। কিন্তু মােনা বুজরুক ডনকে ঠকাবে এবং ডন একটা ছােট ছেলে। এতেই মােনার ওপর খাপ্পা হয়েছিলুম। বড়রা বােকামি করে ঠকে। ছােটদের সরলতার সুযােগ নিয়ে ঠকানাে ভারি অন্যায়। ভাবলুম, মােনাকে গিয়ে খুব বকে দিয়ে আসি।

ভৌতিক গল্পসমগ্র 

কিন্তু ডন তক্ষুনি ফিরে এল। তার হাতে একটা ছােট্ট শিশি। শিশিটা দেখিয়ে সে খুশিখুশি মনে বলল,-গােগাে টাকা নিয়ে গিছল মামা! মােনাদা ওকে দিল না। বলল, আগে আমি কিনব বলেছিলুম, তাই আমাকেই সে বেচবে। 

 সে টেবিলে শিশিটা রাখল। শিশিটার ভেতর কিছু নেই। বললাম, হারে, এর ভেতর যে ভূত আছে, কী করে বুঝলি? 

ডন বলল, “আছে মামা! মােনাদা বলল, সন্ধ্যা হলেই দেখতে পাওয়া যাবে। 

—ঠিক আছে। তা এই যে তুই ভূত পুষবি, ভূতকে কিছু খেতে দিতে হবে

—হবে বইকী। ভূতেরা দুধ আর মাছ খায়। তাই খাওয়াব। —কিন্তু খাওয়াতে গেলে যদি ভূতটা পালিয়ে যায়? মােনাদা বলল,“আবার ফাঁদ পেতে ধরে দেবে। 

—ডন চাপা গলায় বলল,আমি একটু দুধ নিয়ে আসি মামা! তুমি যেন ছিপি খুলােলা না। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩০

ডন দুধ আনতে গেল। আমি সেই সুযােগে শিশির ছিপি খুলে ব্যাপারটা পরীক্ষা করার লােভ সম্বরণ করতে পারলুম না। ছিপিটা খুলতেই বোটকা গন্ধ টের পেলুম। তারপর দেখি, জানলা গলিয়ে একটা বেড়াল লাফ দিয়ে উধাও হয়ে গেল। 

ব্যাপারটা এমন আকস্মিক যে, চমকে উঠেছিলুম। কালাে বেড়াল তাে এঘরে দেখিনি। বাড়িতেও কোনও কালাে বেড়াল নেই। ওটা এল কোথেকে? কখন এ ঘরে ঢুকল? ছিপি খােলার পরই বা জানালা গলিয়ে পালাল কেন? 

হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলুম একেবারে। সেই সময় ডনের আবির্ভাব হল। তার। হাতে দুধের বাটি। সে দেখতে পেল আমি ছিপি খুলেছি। অমনি চিকুর ছাড়ল, . মামা! মামা! ছিপি খুললে কেন? তারপরই তার চোখ গেল জানালার ওপারে পাঁচিলের দিকে। পাঁচিলে কালাে বেড়ালটা বসে কেমন জুলজুলে চোখে এদিকে তাকিয়ে আছে। 

 ডন দুধের বাটি রেখে আমার হাত থেকে শিশি আর ছিপি ছিনিয়ে নিয়ে বেরুল। পাঁচিলের কাছে যেতেই বেড়ালটা লাফ দিয়ে ওধারে নামল। ডনকেও বেরিয়েও যেতে দেখলুম। 

এবার জানি কী কী ঘটবে। আমার কাগজ ছিড়ে কুচিকুচি হবে। কলমটা গুঁড়াে হয়ে যাবে। আমিও প্রচুর চিমটি খাব। ডনের নখ যা ধারালাে! 

কাগজ কমল সামলে রেখে আমিও পালানাে ভূতটা ধরার ছল করে বেরিয়ে গেলুম। রাস্তার দাঁড়িয়ে ডন এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। সে কিছু বলার আগেই বললুম, 

—চল! আবার মােনা বুজরুকের কাছে যাই। সে ফাঁদ পেতে পালিয়ে যাওয়া ভূতটাকে ধরুক। টাকা যা লাগে, দেব। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩০

ডন কঁদো কাঁদো মুখে এগােল! খেলার মাঠ পেরিয়ে ঝিল। ঝিলের ধারে শিবমন্দিরের ওখানে ঘন জঙ্গল। সেখানে পৌঁছে ডাকলুম,—মােনা আছে নাকি! ও মােনা! সাড়া এল জঙ্গলের দিক থেকে-কে ডাকে গাে? 

মােনার গলার স্বর কেমন অদ্ভুতুড়ে। বললুম, শিগগির একবার এসে তাে এদিকে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে। 

জঙ্গলের ভেতর থেকে মােনার জবাব এল। আমিও এক কেলেঙ্কারিতে পড়েছি। জায়গা ছেড়ে নড়ি কী করে? অগত্যা মন্দিরের পেছনে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকলুম। বললুম,—তুমি আছােটা কোথায়? শ্যাওড়া গাছের ভেতরে। 

শ্যাওড়া গাছটা দেখা যাচ্ছিল। সেখানে গিয়ে দেখলুম, মােনা গাঢাকা দিয়ে বসে আছে ডালপালার ভেতরে। আমাদের দেখে সে ফিক করে হাসল। ওপর পাটির দুটো দাঁত নেই। তাই তার হাসিটা বেশ অমায়িক দেখাল। বললুম,—ওখানে বসে তুমি কী করছ মােনা? | মােনা বলল,-াদে একটা পেতনি পড়েছে। শিশিতে ঢােকাতে পারছি না। বলেই সে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল,—ওই যাঃ! পালিয়ে গেল। 

সে শ্যাওড়া গাছ থেকে নেমে এল। হাতে একই সাইজের একটা শিশি। হাসি চেপে বললুম,কঁাদ থেকে পেতনি পালিয়ে গেল। আর ডনের শিশি থেকে ভূতটা পালিয়ে গেছে। শিগগির একটা জোগাড় করাে। 

মােনা বলে উঠল,—এঃ হে হে হে! সর্বনাশ! সর্বনাশ! খােকাবাবুকে অমন পইপই করে বলেছিলুম, সাবধান! 

ডন কঁদো কাঁদো মুখে বলল,মামা শিশির ছিপি খুলেছিল। 

মােনা বলল,—ছােটবাবু! কাজটা ঠিক করেননি। খােকাবাবুকে যে ভূতটা বেচেছিলুম, সে খুব ঘােড়েল ভূত। সে কে জানেন! পাঁচু। সেই পাঁচু-চোর। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩০

 পাঁচু নামে একটা চোর ছিল আমার ছেলেবেলায়। পাকা সিঁদেলচোর। কত বাঘা বাঘা দারােগাবাবুকে সে নাকাল করে ছাড়ত। বুড়াে হয়ে সে মারা পড়েছিল অসুখ-বিসুখে। যাই হােক ডনের সামনে মােনার সঙ্গে ভূত নিয়ে তর্ক করা ঠিক নয়। বললুম,যাই হােক, পাচুকে আবার ফাঁদ পেতে ধরে দাও। 

ডন বলল,-মােনাদা! পাঁচু কালাে বেড়াল সেজে পালিয়ে গেছে। 

ডনের ভূত  

কালাে বেড়াল? —মােনা ভুরু কুঁচকে বলল,-“। তাহলে তাে বড় কেলেঙ্কারি হল। ঠিক আছে, দেখছি। ইঁদুর ধরে ফঁদে আটকাতে হবে ওকে। এখন ইঁদুর পাই কোথা দেখি। কই, খােকাবাবু। শিশিটা দাও। 

 শিশিটা নিয়ে সে জঙ্গলের ভেতরে চলে গেল। গেল তাে গেলই। আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। একসময় হঠাৎ ‘ম্যাও’ শব্দ শুনে দেখি, ঝােপের ভেতর থেকে সেই কালাে বেড়ালটা মুখ বের করছে। দেখামাত্র ডন তাকে তাড়া করে গেল। তারপর আর তাকেও দেখতে পেলুম না। কিছুক্ষণ তাকে ডাকাডাকি করে মন্দিরের পেছনে বটতলায় গিয়ে বসে পড়লুম।

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩১

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *