সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩৩

গাছের ভেতর থেকে খ্যানখেনে গলায় কেউ বলল,—ঘুমােব কী রে বাবা! পেট আইঢাই। এত দেরি করলি কেনরে? 

—প্যাসেঞ্জার পেলে তাে আসব। এই নিন হজমিগুলি। —এনেছিস? কই দে-দে। শিগগিরি দে।

ভৌতিক গল্পসমগ্র 

রিকশওয়ালা তাকে হজমিগুলি দিয়ে এসে সিটে উঠল। প্যাডেলে চাপ দিল। রিকশর চাকা গড়াল। ছােটমামা বললে,—ব্যাপার কী হে রিকশওয়ালা? তােমার চক্কোত্তিমশাই কি গাছে থাকেন নাকি? 

রাতের মানুষ 

“আজ্ঞে । —আঁ? গাছ থাকেন কেন? —এটাই তাে তেনার ডেরা। —তার মানে? 

—মানে নিয়ে মাথা ঘামানাের দরকার কি বাবুমশাই? ঝপুইহাটি যাবেন। পৌঁছে দেব। ব্যস। 

ছােটমামা রেগে গেলেন। 

অদ্ভুত তাে তােমার কথাবার্তা! রাতবিরেতে গাছের ওপর রিকশওয়ালা এঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল,চুপ! চুপ! চক্কোত্তিমশাইয়ের কানে গেলেই কেলেঙ্কারি। আমার কাছ থেকে ততক্ষণে ঘুমটা কেটে পড়েছে। বারবার দেখে আসছি, ছােটমামার সঙ্গে কোথাও রাতবিরেতে বেরােলেই গােলমেলে সব ঘটনা ঘটে। বুঝতে পারি না, রাত এলেই কেন পৃথিবীটা অন্যরকম হয়ে যায়? না কি ছােটমামার ভুলেই রাতটা গােলমেলে হয়ে যায়? কিন্তু তারপর তাে ছােটমামা চলে আয় পুঁটু’ বলে শেষপর্যন্ত উধাও হয়ে যান। ধাক্কাটা সামলাতে হয় আমাকেই। এবার কতদূর গড়াবে কে জানে! বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল।

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩৩ 

একটু পরে আবার রিকশ দাঁড়াল এবং রিকশওয়ালা তড়াক করে নেমে গিয়ে ডাক দিল,—ঠাকরুনদিদি! অ ঠাকরুনদিদি! 

একটা শুকনাে গাছের ডাল থেকে নেমে সাদা কাপড় পরা কেউ এগিয়ে এগিয়ে এল। ভুতু এলি? কখন থেকে পথের দিকে তাকিয়ে চোখে ব্যথা ধরে গেল। দোক্তা এনেছিস তাে? 

না আনলে ডাকছি কেন? এই নিন।। | দোত্তা নিয়ে ঠাকরুনদিদি ন্যাড়া গাছটার দিকে চলে গেল। ছােটমামা গুম হয়ে বসে ছিলেন। বললেন,—কোনও মানে হয় ? 

রিকশওয়ালা আবার চুপচাপ রিকশ চালাতে শুরু করল। কিছুদুর গেছি, হঠাৎ কোথেকে কেউ হেঁড়ে গলায় ডাকল,ভুতু! অ ভুতু! আই ভুততা! 

ছােটমামা চাপাস্বরে বললেন,—থেমাে না, যে-ই ডাকুক! 

একটা কালাে বেঁটে লােক ধমক দিল,অ্যাই ব্যাটাচ্ছেলে! কথা কানে যায়

রিকশওয়ালা বলল,-রােজ-রােজ বাকিতে জিনিস দেবে নাকি? 

—দেবে না মানে? ওর বাপ দেবে। এখনও তেষট্টি টাকা সাতষটি পয়সা জমা আছে খাতায়! 

—সে আপনি মামলা করে আদায় করুন গে! | লােকটা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল। –বাজে কথা বলিসনে। আসলে তুই যাসনি দত্তর দোকানে। 

কী ঝামেলা করছেন বাবু? গাড়িতে প্যাসেঞ্জার আছে দেখছেন না ? 

লােটা প্রায় কেঁদে ফেলল। এখন আমি ঘুমােব কি করে? একগুলি আফিং আমাকে এত রাত্তিরে কে দেবে? রিকশওয়ালা পরামর্শ দিল,শ্মশানতলায় চলে যান। দারােগাবাবুর কাছে একগুলি পেতেও পারেন। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩৩ 

–ওরে বাবা! মৌতাত ভাঙলে লকআপে ঢােকাবে। —তা হলে বরঞ্চ পাঁচুর কাছে যান। —সে ব্যাটা তাে চোর।। 

—চোর বলেই বলছি। দারােগাবাবুর কৌটো থেকে দু-একটা গুলি সে-ই হাতাতে পারবে। লােকটা কিন্তু-কিন্তু করে বলল,—তা পাঁচুকে পাচ্ছি কোথায় ? ও তাে ফেরারি আসামী। 

রিকশওয়ালা চাপাস্বরে বলল, সন্ধেবেলা পাঁচুকে একপলক দেখেছি। মােড়লমশাইয়ের তালগাছের কাছে দাঁড়িয়েছিল। মােড়লমশাই গঞ্জের মেলায় গেছেন। কাজেই পাঁচু নিশ্চয় তেনার ডেরায় ঘুমিয়ে নিচ্ছে। 

 বেঁটে কালাে ছায়ামূর্তিটি তখনই উধাও হয়ে গেল। রিকশওয়ালা প্যাডেলে চাপ দিয়ে বলল,—রােজ রাত্তিরে আসার এই এক জ্বালা বাবুমশাই! রাজ্যের লােকের হাজার ফরমাশ।। 

ছােটমামা গুম হয়ে বসে আছেন। আমি ভাবছি, হঠাৎ আমাকে ফেলে পালিয়ে যান। বড্ড বেশি গােলমেলে ঘটনা ঘটছে। কিছু দূর যাওয়ার পর রাস্তা বাঁক নিল। এবার দুধারে ঘন জঙ্গল। রাস্তায় চকরাবকরা জ্যোৎস্না পড়েছে। 

রিকশওয়ালা বলল,“আর এক জায়গায় একটুখানি থামতে হবে। সিঙ্গি মশাইয়ের নস্যির কৌটোটা দিয়েই আমার ছুটি। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩৩ 

একখানে জঙ্গলটা কিছু ফঁাকা। রিকশ সেখানে থামল। রিকশওয়ালা সিট থেকে নেনে রাস্তার ধারে গিয়ে চেঁচাতে থাকল, সিঙ্গিমশাই! সিঙ্গিমশাই। 

তারপর সাড়া না পেয়ে এগিয়ে গেল। আর তাকে দেখতে পেলাম না। ভয়ে ভয়ে ডাকলাম,—ছােটমামা! 

ছােটমামা বিরক্ত হয়ে বললেন,—চুপচাপ বসে থাক। আমাদের বাড়ি পৌঁছনাে নিয়ে কথা। 

এইসময় কাছাকাছি একটা গাছ থেকে কেউ বলল,কারা এখানে? ছােটমামা ভারিক্কি চালে বললেন,“আমরা। 

—আমরা মানে? নাম কী? বাড়ি কোথায়? 

ছােটমামা রেগেই ছিলেন। বললেন,—তা জেনে তােমার কাজ কী? কে তুমি? গাছে কী করছ? 

-আঁ! বলে কী। গাছে কী করছি! হি হি হি হি! ন্যাকা! 

রাতের মানুষ খবররদার! বাজে কথা বলবে না বলে দিচ্ছি। —এটা বাজে কথা হল? জানােনা গাছে কী করছি? 

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩৪

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *