সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩৪

ছােটমামা খাপ্পা হয়ে বললেন, না। জানি না। আমরা মানুষ। আমরা তােমার মতাে রাত-বিরেতে গাছে কাটাই না। -হি হি হি! প্রথম-প্রথম এই ভুলটা হয়। —কী ভুল হয়?

ভৌতিক গল্পসমগ্র 

মানুষ-মানুষ ভুল। -কী অদ্ভুত। 

—অদ্ভুত তাে বটেই। অদটুকু বাদ যেতে কয়েকটা দিন দেরি, এই যা। তা তােমরা কি ডেরা খুঁজে বেড়াচ্ছ? বােকা আর কাকে বলে? ভুতাের রিকশতে চেপে হি হি হি! ভুতােটা এক নম্বর ধড়িবাজ। সাবধান করে দিচ্ছি কিন্তু! 

 ছােটমামা রিকশ থেকে নেমে ঘুষি পাকিয়ে দাঁড়ালেন।—কে হে তুমি! গাছ থেকে নেমে এসাে তাে দেখি। 

আমিও নামতে দেরি করলাম না। ছােটমামার মারামারি করার অভ্যাস আছে। কিন্তু রাতবিরেতে গাছের লােকটার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবেন কি না আমার সন্দেহ। রিকশওয়ালাও আসছে না। মারামারি বাধলে থামাবে কে, এটাই আমার ভাবনা। 

ছােটমামা ঘুষি বাগিয়ে এবার হুঙ্কার দিলেন, কাম অন! কাম অন! 

গাছের লােকটা বিদঘুটে হাসলা-হি হি হি হি! ইংরেজির কী ছিরি! কাম অন কী হে ছােকরা? গেট ডাউন! কিন্তু গেট ডাউন করি কী করে? একটা ঠ্যাং-ই যে নেই। থাকলে পরে এতক্ষণ নেমে কানটি ধরে স্ট্যান্ড আপ অন দা বেঞ্চ করিয়ে দিতাম। 

পাশের একটা গাছ থেকে কেউ বলল, কী হে পণ্ডিতমশাই? ছাত্র জোটাতে পারলেন নাকি?

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩৪ 

নাহ। গাধা পিটিয়ে ঘােড়া করা যায় না। | ছােটমামা আর সহ্য করতে পারলেন না। রাস্তার ধারে পাথরকুচির স্তুপ থেকে পাথর কুড়িয়ে ছুড়তে শুরু করলেন। আমাকেও বললেন, হাত লাগা পুটু। আমাকে গাধা বলছে! আমাকে ইংরেজি শেখাচ্ছে পাঠশালার পণ্ডিত! 

ওদিকে পণ্ডিতমশাইয়ের চেঁচামেচিতে চারদিকে সাড়া পড়ে গেছে। হইহই-রইরই করতে-করতে কালােকালাে কারা সব গাছ থেকে ঝুপঝাপ করে নেমে দৌড়ে আসছিল। আমি ভয়ে প্রায় কেঁদে ফেললাম,ছােটমামা! এবার ছােটমামার চোখে পড়ল ব্যাপারটা। তারপর যা ভেবেছিলাম এবং বরাবর যা ঘটে আসছে তাই হল। ছােটমামা চলে আয় পুঁটু’—বলে রিকশওয়ালা যেদিকে গিয়েছিল, সেই দিকে দৌড়লেন। আমিও দৌড়লাম। 

কিন্তু ভাগ্যিস ছােটমামা হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন, তাই সঙ্গ পাওয়া 

ভৌতিক গল্পসমগ্র 

গেল। জ্যোৎস্নায় একটা ভাঙাচোরা দালানবাড়ি দেখা যাচ্ছিল। বাড়ির দরজায় ছােটমামা ধাক্কা দিতে লাগলেন। একটু পরে ভেতর থেকে সাড়া এল,কে? 

ছােটমামা ব্যস্তভাবে বললেন,আমরা খুব বিপদে পড়েছি। দয়া করে দরজা খুলুন। 

কী বিপদ? কারা আমাদের তাড়া করেছে। —তারা কারা? —গাছে-গাছে যারা থাকে। —গাছে থাকে ভূত বনে থাকে বাঘ। জলে থাকে মাছ মনে থাকে রাগ। 

কী বিপদ! আপনি পদ্য বলছেন নাকি? ঠিক ধরেছ। কেমন হয়েছে পদ্যটা বলল? —খুব ভালােদয়া করে এবার দরজা খুলুন। ওরা আসছে। ঘােড়ার যদি পাড়ে ডিম জলে যদি জ্বলে পিদিম। বলাে তবে অতঃ কিম? 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩৪ 

ছােটমামার পদ্য লেখার বাতিক ছিল। বলে দিলেন,জাম গাছে ফলবে শিম। খাসা! খাসা! স্বাগত! সুস্বাগত! 

দরজা খুলে গেল। ছােটমামা বললেন,আলাে নেই কেন? আলাে জ্বালুন। যতবড় কবি তুই হােস না। যদি না বাসিস ভালাে জোসনা থেকে যাবে কত আফসোেস না! তাই বলি চুপ করে বােস না। 

ভদ্রলােক বাইরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। জানালা গলিয়ে জ্যোৎস্না এসে ঘরে ঢুকেছিল। আবছা দেখা যাচ্ছিল—ওঁকে। ঢ্যাঙা, বড়বড় চুল, পরনে পাঞ্জাবি পাজামা। হাতে একটা বই বা মােটা খাতা। পাতা ওল্টাতে শুরু করলেন। তারপর বললেন,—এই পদ্যটা আরও ভালাে।। 

-একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল সারস পাখি লম্বা ঠোটে হাড় তুলিয়া দিল পুরস্কার চাইলে পরে বাঘ রাগিয়া কহে, মুভুখানা ফেরত পেলি তাই যথেষ্ট নহে? 

পাশের ঘর থেকে কেউ বিটকেল গলায় ডাকল,-ঘেতনা। অ্যাই ঘােতনা! কাকে পদ্য শােনাচ্ছিস? 

মানুষকে। কয় জন মানুষ? রাতের মানুষ —দেড়জন। 

ধুস! পোেষাবে নাছােটমামা বললেন,কে উনি? 

কবি ভদ্রলােক বিরক্ত হয়ে বললেন, আমার দাদার ওই এক স্বভাব। খালি খাই-খাই

খাই-খাই মানে? 

দাদার খুব খিদে আর কী! যাক গে। এই পদ্যটা পড়ি। সেই সময় বাইরে ডাকাডাকি শােনা গেল,—ছােটবাবু! ছােটবাবু! ছােটবাবু! কবি খাপ্পা হয়ে দরজা খুলে বললেন,কী হয়েছে? চেঁচাচ্ছিস কেন রে ভুতাে

—আমার প্যাসেঞ্জার হারিয়ে গেছে। খুঁজে বেড়াচ্ছি। 

কয় জন? —আজ্ঞে দেড়জন। ছােটমামা আমার হাত ধরে হ্যাচকা টান দিলেন। চলে আয় পুঁটু! 

রিকশাওয়ালা আমাদের দেখেই বলে উঠল,সর্বনাশ! কোথায় ঢুকেছিলেন আপনারা! চলে আসুন! চলে আসুন! এ বাড়ির বড়বাবুর বেজায় খিদে। 

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩৫

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *