আমরা তিনজনে দৌড়চ্ছি। পেছনে কবির করুণ আর্তনাদ কানে আসছে, অত ভালাে পদ্যখানা শুনে গেল না! আমার যে আবার মরতে ইচ্ছে করছে গাে! ও হাে হাে হাে…
ছােটমামা রাস্তার কাছে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,—ওহে রিকশওয়ালা। ওরা সব নেই তাে?
রিকশওয়ালা হাসল। নাহ! ঘুমিয়ে পড়েছে। ভেস-ভেঁস করে ঘুমােচ্ছে। শুনতে পাচ্ছেন না?
ছােটমামা কান ধরে শুনে বললে, “!
আমি তেমন কোনও শব্দ পেলুম না। তবে বাতাসে গাছপালা খুব নড়ছে। নানারকম শব্দও হচ্ছে বটে। কিন্তু ভোস-ভোঁস নয়। শোঁ শোঁ শন শন সর সর খড় খড়। কে জানে বাবা কী।...
এবার আর কোনও গণ্ডগােল হল না। আমাদের গাঁয়ের মােড়ে পৌঁছে দিয়ে রিকশওয়ালা ভাড়া মিটিয়ে নিল।
ছােটমামা জিগ্যেস করলেন, তুমি কোন গাছে থাকো হে?
রিকশওয়ালা বেজায় হেসে বলল,—আমি কেন গাছে থাকতে যাব বাবুমশাই? আমার কি ঘরদোর নেই? নামটাই না হয় ভুতে। রাতবিরেতে রিকশ চালাই বলেই তেনাদের সঙ্গে চেনাজানা হয়েছে।
ছােটমামার সন্দিগ্ধস্বরে বললেন, তুমি মানুষ?
আজ্ঞে যােলাে আনা মানুষ। বলে সে শেষরাতের জ্যোৎস্নায় রিকশ চালিয়ে কালাে হতে-হতে দূরে মিলিয়ে গেল। আগের দিনে চোরেরা ছিল বেজায় ভিতু। যেমন আমাদের গ্রামের পাঁচু-চোর।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩৫
যাসে নাকি চুরি করতে গিয়ে নিজের পায়ের শব্দে নিজেই ভয় পেয়ে দিশেহারা হয়ে পালাত। দাদুর কাছে শুনেছি, একবার সে আমাদের বাড়ি চুরি করতে এসেছিল। পাঁচিল ডিঙিয়ে উঠোনে নামবার সময় হঠাৎ তার পা পিছলে যায়। তারপর সে ধপাস করে পড়েছে এবং তাতেই যা একটু শব্দ হয়েছে। সেই শব্দেই দিশেহারা পাঁচু উঠোনের কোণে তালগাছের ডগায় তরতর করে উঠে গেছে।
উঠে তাে গেছে। কিন্তু নামতে সাহস পাচ্ছে না। নামতে গিয়ে যদি আবার পা পিছলে পড়ে যায়!
এদিকে রাত পুইয়ে ভাের হতে চলেছে। দিনের আলােয় কেউ-কেউ তাকে দেখতে পাবে। তখন তার কী অবস্থা হবে ভেবে পাঁচু-চোর ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে, কান্না শুনে দাদু টর্চ হাতে বেরিয়ে আসেন। তালগাছের ডগা থেকে কান্না। ভূতপ্রেত নাকি?
তখনকার দিনে পাড়াগাঁয়ের আনাচে কানাচে ভূতেরাও ছোঁকছোঁক করে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু দাদু ছিলেন সাহসী মানুষ। তালগাছের ডগায় টর্চের আলাে ফেলে তিনি অবাক হয়ে যান। জিগ্যেস করেন,“তুই কে রে?
পাঁচু-চোর করুণ স্বরে বলে,“আজ্ঞে আমি পাঁচু।
—তা তুই তালগাছের ডগায় কী চুরি করতে উঠেছিস? এখন তাে আর একটা তালও নেই। নেমে আয় হতভাগা!
—আজ্ঞে বড্ড ভয় করছে।
দাদু বলেন,তােকে মারব না। পুলিশেও ধরিয়ে দেব না। নেমে আয়। তারপর খুলে বল, তালগাছের ডগায় কেন চড়েছিস? | পাঁচু অনেক কষ্টে নেমে আসে এবং সবকথা খুলে বলে। তারপর দাদুর পা ছুঁয়ে বলে,“আর কক্ষনও আপনার বাড়িতে চুরি করতে ঢুকব না।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩৫
দাদু গল্পটা খুব জমিয়ে বলতেন। শুনে আমরা ছােটরা হেসে অস্থির হতাম। তাে সত্যিই আর পাঁচু কখনও আমাদের বাড়িতে চুরি করতে আসেনি। কিন্তু তার কপাল মন্দ। সেবার থানায় এসেছেন এক পুঁদে দারােগা বন্ধুবিহারী ধাড়া। কনস্টেবলরা এতকাল রাতবিরেতে টহল দিতে বেরুত না। চৌকিদার বড়জোর লণ্ঠন আর লাঠি হাতে এক চক্কর ঘুরে ঘরে গিয়ে নাক ডাকাত। বঙ্কুবাবুর তাড়ায় টহলদারি জোরালাে হল।
তার ফলে পাঁচুর অবস্থা হল শােচনীয়। দিনদুপুরে তাে আর চুরি করা যায় । তার ওপর রাত্তিরে গিয়ে কনস্টেবলরা, আবার কখনও চৌকিদার হাঁকডাক করে
জেনে নেয় পাঁচু ঘরে আছে কি না। না থাকলেই তার বিপদ। অন্য কেউ কোথাও সে রাতে চুরি করলে দোষটা পড়বে পাঁচুরই ঘাড়ে। পাঁচু এক দাগি চোর।
এক রাত্তিরে মরিয়া হয়ে পাচু বেরুল। যে বাড়িতে সে চুরি করার ফন্দি এঁটেছে, সেই বাড়ির পেছনে ছিল কয়েকটা গাছ। তলায় শুকনাে পাতার ছড়াছড়ি। পা ফেলতেই সেইসব শুকনাে পাতা মচমচখড়খড় শব্দ করেছে এবং পাঁচুও যথারীতি ভয় পেয়ে দিশেহারা হয়ে দৌড়েছে।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩৫
সেদিন বঙ্কুবাবু নিজে টহলদারিতে বেরিয়েছেন। পাঁচু গিয়ে পড়বি তাে পড় একেবারে বন্ধুবাবুর বুকে। আচমকা রাতবিরেতে দারােগাবাবুর বুকে কে এসে সেঁটে গেছে, এটা বিরক্তিকর ব্যাপার। অন্য কেউ হলে টাল সামলাতে পারত না। কিন্তু তিনি দশাসই বিশাল এক মানুষ। তবে এভাবে কী একটা জিনিস তার গায়ে সেঁটে যাবে, এটা চূড়ান্ত রকমের বেয়াদপিও বটে। বাঁ-হাতে এক ঝটকায় জিনিসটাকে ছাড়িয়ে টর্চ জ্বেলে দেখেন, এটা একটা মানুষ।
সেই সঙ্গে কনস্টেবলরা চেঁচিয়ে উঠেছে,—পাঁচু! পাঁচু!
পাঁচু-চোর ধরা পড়ে গেল। তখনকার দিনে আইনকানুন ছিল কড়া। পাঁচুর নামে অনেকগুলাে চুরির নালিশ ছিল পুলিশের খাতায়। আদালতে তার ছমাসের জেল হল।…
এসব গল্প দাদুর মুখেই শােনা। তখন আমি পাঠশালার পরুয়া। পাঁচু-চোরকে দেখতে ইচ্ছে করত খুব। কিন্তু তাকে পাচ্ছিটা কোথায়?
পরে আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ছি, তখন একদিন দৈবাৎ তার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়। যদিও সেই দেখা হওয়াটা মােটেও সুখের হয়নি।
Read More