সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩৬

পুজোর ছুটিতে স্কুল বন্ধ। প্রতি বছর পুজোর সময় বড়মামা আমাদের বাড়িতে আসতেন। সেদিনই বিকেলে তিনি এসেছেন। বড়মামা ছিলেন ভবঘুরে ধরনের মানুষ। দেশবিদেশে ঘুরে বেড়ানাের বাতিক ছিল তার। পুজোর সময় এসে ভাগনে-ভাগনিদের সেই ভ্রমণ-বৃত্তান্ত শােনাতেন।

তা যেমন অদ্ভুত, তেমনই রােমাঞ্চকর। এসেই তিনি ঘােষণা করতেন কোন-কোন দেশে গিয়েছিলেন। তারপর সন্ধেবেলায় তার গল্পের আসর বসত। এবার এসে বড়মামা বলেছিলেন, খুব রহস্যজনক একটা দেশ থেকে তিনি আসছেন। তবে না—আগেভাগে কিছু ফঁস করবেন না। সন্ধেবেলায় সবিস্তারে সেই দেশের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করবেন। তখন যদি কেউ ভয় পেয়ে ভিরমি খায়, তার দোষ নেই কিন্তু।

ভৌতিক গল্পসমগ্র 

ছােটরা ভয় পেতে তাে ভালােই বাসে। আমরা কখন সূর্য ডুববে, সেই প্রতীক্ষায় চঞ্চল। এমন সময় বড়মামা হঠাৎ আমাকে বললেন,—পুটু! তােদের এখানকার ছানাবড়া খুব বিখ্যাত। এই নে টাকা। পাঁচ টাকার ছানাবড়া নিয়ে আয় শিগগির! | মা বললেন,-হারুর দোকানে যা। আজকাল হারুর মতাে ছানাবড়া তৈরি করতে কেউ পারে না। 

আমাদের গ্রামের শেষে পিচরাস্তার ধারে ছােট একটা বাজার ছিল। পাশে ছিল 

হাটতলা। সপ্তাহে দুদিন হাট বসত। বিকেলের দিকে ওখানটা বেশ ভিড়ভাট্টা হতাে। হারু-ময়রার দোকান ছিল সেই বাজারে। 

 হারুই বড্ড দেরি করিয়ে দিল। অবশ্য ওর দোষ ছিল না। পুজোর সময় তার দোকানে খদ্দেরের খুব ভিড় হয়। তখনকার দিনে পাঁচ টাকা অনেক টাকা। টাকায় চারটে করে মােটাসােটা ছানাবড়া। মাটির হাঁড়িতে কুড়িটা ছানাবড়া আমার পক্ষে বেশ ভারী। হাঁড়ির মুখে শালপাতা চাপানাে এবং মিশি পাটের দড়ি দিয়ে আঁটো করে বাঁধা। দুহাতে দড়ি আঁকড়ে ধরে কুঁজো হয়ে হাঁটলাম। টাল খেয়ে পড়লে হাঁড়ি ফেটে যাবে। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩৬

এদিকে আঙুলও যেন কেটে যাচ্ছে মিহি দড়িতে। 

অগত্যা শর্টকাট করার জন্য সিঙ্গিমশাইদের আমবাগানে ঢুকলাম। বাগান পেরুলেই ষষ্ঠীতলা। একটা প্রকাণ্ড বটগাছ। তারপর কঁাচারাস্তায় একটুখানি হাঁটলে আমাদের বাড়ি। 

ষষ্ঠীতলায় গেছি, হঠাৎ চোখে পড়ল একটা রােগা-ভােগা লােক। বটগাছের একটা ঝুরির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ভেঁড়া খাকি হাফ-প্যান্ট, খালি গা, মাথার চুল খুঁটিয়ে ছাঁটা। কেমন জুলজুলে চাউনি লােকটার। মুখে কিন্তু মিষ্টি হাসি। তাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। সে কাছে এসে মিষ্টি মিষ্টি হেসে বলল,“ওতে কী আছে খােকাবাবু? রসগােল্লা নাকি? 

বললাম,না। ছানাবড়া। 

—বাঃ ছানাবড়া রসগােল্লার চেয়ে ভালাে। কার দোকান থেকে কিনলে? 

হারুময়রার। —বাড়িতে কেউ এসেছে বুঝি? -হ্যা। বড়মামা এসেছেন। 

বলাে কী! খুব ভালাে! তা তুমি যে দেখছি হাঁড়িটা বইতে পারছ না। কষ্ট হচ্ছে। দেখা দিকি। এতটুকু ছেলে। আহা রে! 

 লােকটার কথাবার্তা ও হাবভাব অমায়িক। শুধু চাউনিটা কেমন যেন 

তাে সে আমার হাত থেকে হাঁড়িটা সাবধানে ধরে বলল, চলাে! আমি পৌঁছে দিয়ে আসি। এতটুকু ছেলে এত ভারী জিনিস বইতে পারে? 

লােকটাকে বাধা দিতে পারলাম না। কিংবা সে পৌঁছে দিলে কষ্টটা থেকে বেঁচে যাই। যে কারণেই হােক, হাঁড়িটা আমার হাতছাড়া হল এবং সে নিমেষে বটগাছের অন্য পাশে অদৃশ্য হয়ে গেল। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৩৬

হতভম্ব হয়ে একটুখানি দাঁড়িয়ে থাকার পর ভঁা করে কেঁদে বাড়ির দিকে দৌড়লাম। 

পরে বাড়ির সবাই আমার মুখে লােকটার চেহারার বর্ণনা শুনে সাব্যস্ত করেছিলেন তাহলে এটা পাঁচুরই কাজ।.. 

বছর দুই পরের কথা। আমি তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। বুদ্ধিসুদ্ধি হয়েছে বইকী! 

তা না হলে কেমন করে বুঝব, আমি কী বােকাই না ছিলাম। অমন নিরিবিলি জায়গায় সন্ধ্যার মুখে অচেনা লােককে ছানাবড়ার হাঁড়ি বইতে দেয় কেউ? 

তবে পাঁচু চোর ছিল বটে, কিন্তু নেহাত ছিচকে চোর। সে কোনও বাড়িতে সিঁদ কেটে চুরি করেছে বলে শুনিনি। দাদু আরও বুড়াে হয়েছেন তখন। লাঠি হাতে কষ্টেসৃষ্টে হাঁটাচলা করেন।

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র শেষ খণ্ড

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *