সেই বছর হঠাৎ আমাদের গ্রামে শুধু নয়, এলাকা জুড়ে সিঁদ কেটে চুরি শুরু হল। দাদুর মতে, এ কক্ষনও পাঁচুর কাজ নয়। পাঁচু যা ভিতু সিঁদকাঠি দিয়ে ঘরের দেয়াল ফুটো করতে গেলে যেটুকু শব্দ হবে, তাতেই সে ভয়ে দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যাবে। পাঁচু রাতবিরেতে এতটুকু শব্দ হলেই ভয় পায়।
একদিন বাবা বাইরে থেকে এসে বললেন,-সিঁদেল চোরের খোঁজ পাওয়া গেছে। দারােগাবাবুর মুখে শুনে এলাম, লােকটার নাম কি। কঁপুইহাটির দাগি চোর। সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরেছে।
দাদু বললেন,ঋপুইহাটির কি?
-চেনেন নাকি তাকে?
চিনি বইকী।দাদু ফোকলা মুখে খুব হাসলেন। একেই বলে চোরে-চোরে মাসতুতাে ভাই। আমাদের গ্রামের পাঁচুর মাসির ছেলে হল কিনু। কাজেই পাঁচুর মাসতুতাে ভাই। তবে আমার সন্দেহ হচ্ছে, পাঁচুকে কিনু ট্রেনিং দিয়ে তার চেলা করেনি
পরদিন সকালে লালু-গয়লা দুধ দিতে এসে বলল,—গত রাত্তিরে সিঙ্গি মশাইয়ের বাড়িতে সিঁদ কাটছিল কিনু। সিঙ্গিমশাই জেগেই ছিলেন। জানালা দিয়ে টর্চের আলাে ফেলে কিনুকে পালাতে দেখেছেন। তবে কিনুর সঙ্গে কে ছিল জানেন? হতচ্ছাড়া পাঁচু।
ভৌতিক গল্পসমগ্র শেষ খণ্ড
দাদু বললেন, তাহলে যা বলেছিলাম, মিলে গেল।
লালু বলল,বন্ধুদারােগা থাকলে এক্ষুনি এর বিহিত হতাে। শুনেছি উনি মন্তর তস্তর জানতেন। রাতবিরেতে বেরিয়ে মন্তর পড়লেই চোরেরা এসে শেয়ালের মতাে ফঁদে পড়ত।
দাদু বললেন, আচ্ছা লালু, তুমি তাে ঝিলের ওদিকে গােরু-মােষের পাল চরাতে যাও। পাঁচুর সঙ্গে দেখা হয় না?
-“আজ্ঞে, রােজই যাই। কিন্তু পাঁচুকে আর দেখতে পাইনে। আগে কখনও সখনও দেখা হতাে। তবে সেটা নেহাত চোখের দেখা। আপনি তাে জানেন কর্তাবাবু, পাঁচু যা ভিতু। চোখে চোখ পড়তেই হাওয়া হয়ে যেত।
-পাঁচুর বাড়িটার কী অবস্থা এখন?
লালু হাসল। বাড়ি মানে তাে একটা কুঁড়েঘর ছিল। কবে ওটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। জঙ্গল গজিয়েছে।
বলল কী! তাহলে পাঁচু এখন থাকে কোথায়?
লালু গম্ভীর হয়ে চাপাগলায় বলল,—গত রাত্তিরে সিঙ্গিমশাই ওকে কিনুর সঙ্গে দেখেছেন। কাজেই পাঁচু কঁপুইহাটিতে কিনুর বাড়িতে থাকে।
চোরে-চোরে মাসতুতাে ভাই। বলে দাদু আবার একচোট হাসলেন।
লালু-গয়লা চলে যাওয়ার পর বাবা বললেন, কিন্তু পাঁচুকে তাহলে সত্যি ট্রেনিং দিয়েছে। তা না হলে সিঙ্গিমশাইয়ের বাড়ির আনাচে কানাচে পা বাড়ানাের সাহস ছিল না পাঁচুর। সিঙ্গিমশাইয়ের বন্দুক আছে না? লালু শুনতে পায়নি। কাল রাত্তিরে আমি কিন্তু বন্দুকের গুলির শব্দ শুনেছিলাম। ট্রেনিং না পেলে পাঁচু গুলির শব্দ শুনে কোথাও ভিরমি খেয়ে পড়ে থাকত।
দাদু সায় দিয়ে বললেন,—ঠিক বলেছ। তবে আমাদের চিন্তার কারণ নেই। পাঁচু আমার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল, আর কক্ষনও আমাদের বাড়িতে চুরি করতে ঢুকবে না। বলেছিলাম না সেই যে তালগাছের ডগায় চড়ার ঘটনাটা! মনে পড়ছে?
ভৌতিক গল্পসমগ্র শেষ খণ্ড
বাবা চুপ করে গেলেন। আমরা ছােটরা দাদুকে হইহই করে ঘিরে ধরলাম। বলুন না দাদু আবার সেই গল্পটা!
সেবার পুজোর সময় যথারীতি বড়মামা এলেন। এসেই ঘােষণা করলেন, সদ্য এমন একটা দেশ থেকে আসছেন, যেখানে খালি ভূত আর ভূত। রাজা মন্ত্রী সেনাপতি সব্বাই ভূত। সৈন্যেরাও ভূত। প্রজারাও ভূত। পণ্ডিতমশাইরা ভূত। ছাত্ররাও ভূত। দোকানদাররাও ভূত। খদ্দেররাও ভূত। অর্থাৎ ভূতে-ভূতে ছয়লাপ। তবে সেটা যে ভূতের দেশ, তা এমনিতে বােঝা যায় না। কিছুদিন থাকার পর ক্রমে ক্রমে টের পাওয়া যায়।
সন্ধ্যার পর বারান্দায় বড়মামার গল্পের আসর বসল। মা সকাল-সকাল রান্না সেরে আসরে এলেন। বাবা এ আসরে যােগ দিতেন না। কারণ নবমীর রাত্তিরে ক্লাবের থিয়েটার। তাই রিহার্সালের তাড়া থাকত। আমাদের বাড়ির কাজের লোেক হারাধন বড়মামার গল্পের আসর শেষ হলে তবেই লণ্ঠন হাতে বাড়ি ফিরত। এমনকী কাজের মেয়ে সৌদামিনী, যার ডাকনাম ছিল সাদু, সে-ও আসরের একপাশে বসে অবাক চোখে তাকিয়ে গল্প শুনত। আসর ভাঙলে সে হারাধনকে কাকুতি-মিনতি করত তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। কারণ বড়মামার সব গল্পই ছিল সাংঘাতিক এবং গা–ছমছম করা।
ওই সময়টা দাদু তার ঘরে বসে লণ্ঠনের আলােয় ধর্মকর্মের বই পড়তেন। | তাে বড়মামা সেই আজব দেশে গিয়ে কীভাবে টের পেলেন এটা ভূতেরই দেশ, সেই ঘটনা সবে শুরু করেছেন, এমন সময় দাদু চাপাগলায় ডাক দিলেন, হারাধন! হারু!
হারাধন সাড়া দিল,আজ্ঞে!
দাদু তেমন চাপাগলায় বললেন,—দেখে আয় তাে! কোথায় যেন কেমন একটা শব্দ হচ্ছে।
হারাধন বলল,—ও কিছু না। বাতাসের শব্দ কর্তামশাই! দাদু ধমক দিলেন। বাড়ির পেছনটা দেখে আয় না একবার। গল্পে বাধা পড়ায় আমরা বিরক্ত। বললেন,-বেড়াল-টেড়াল হবে।
চোর নামভূত
Read More