সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৪

অমনি দেখলুম ছড়িটা পাশের ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে উধাও হয়ে গেল। ছোটমামা বললেন,ধ্যাত্তেরি! কথাটা আমার কিছুতেই মনে থাকছে না। পুঁটু। আমরা দুজনে এবার গঙ্গারামের কাটামুণ্ডুর জয় দিতে-দিতে হাঁটি!

ভৌতিক গল্পসমগ্র 

বলেই ছােটমামা স্লোগানের সুরে হাঁকলেন,–গঙ্গারামের কাটামুণ্ডু কী? 

আমি চেঁচিয়ে বললুম,জয়! 

–গঙ্গারামের কাটামুণ্ডু! 

এমন স্লোগান ওই বয়সে কত শুনতুম, তাই চেঁচিয়ে বললুম,অমর রহে। অমর রহে। 

–গঙ্গারামের কাটামুণ্ডু! —জিতা রহে! জিতা রহে! —কাটিহারের গঙ্গারাম কী ? —জয়! 

বাড়ি ঢােকার মুখে ছােটমামা মুচকি হেসে বলেছিলেন, ভাগ্যিস ছড়ির ভূতটা প্রফেসর বংকারামের ম্যাজিক দেখতে ঢুকেছিল। নইলে তাের ঠাকুরদার খয়রা মাছ আর খাওয়া হতাে না। কাটামুণ্ডু দেখে ভূতটাও ভয় পেয়েছিল। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৪

কিন্তু ম্যাজিক দেখতে আমরা না ঢুকলে আমাদের দুজনের অবস্থাটা কী হতাে, সেটা আর ছােটমামাকে বলিনি। 

আজমগড়ের অশরীরী ৫ 

তখন আমি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহিবিদ্রোহ নিয়ে গবেষণা করছিলুম। সেই কাজে আমাকে আজমগড়ে যেতে হয়েছিল। 

আজমগড় উত্তরপ্রদেশে গঙ্গার ধারে একটা ছােট্ট শহর। সেখানে একটা কেল্লার ধ্বংসাবশেষ আছে। তবে ওটা দেখবার জন্য পর্যটকদের বিশেষ উৎসাহ নেই। ওখানে বিশাল গঙ্গার বুকে একটা চরে পক্ষীনিবাস আছে। পাখি দেখবার জন্যই শীতকালে 

পর্যটকদের ভিড় হয়। ধ্বংসস্তুপ দেখে কেই বা আনন্দ পায় ? | আমি গিয়েছিলুম মার্চের গােড়ার দিকে। তখন আর তত শীত ছিল না। পর্যটকদের ভিড়ও ছিল না। ভাঙাচোরা নবাবি প্রাসাদের পাশে গঙ্গার তীরে প্যালেস হােটেলে উঠেছিলুম। পর্যটন মরশুমের শেষে এই দোতলা থ্রি-স্টারমার্কা হােটেলে তখন ঘরভাড়াও কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। 

হােটেলের ম্যানেজার সুখলাল ঠাকুর খুব অমায়িক মানুষ। আমি সিপাহিবিদ্রোহ সম্পর্কে গবেষণা করছি জেনে খুব খাতির করেছিলেন। সিপাহিবিদ্রোহের অনেক গল্প শুনিয়েছিলেন। এসব গল্প নিছক গল্পই। আমার গবেষণায় তা কাজে লাগবে না। তবে ওঁর এ কথাটি অবশ্যই খাঁটি। এই আজমগড়ে সিপাহিদের সঙ্গে এককাট্টা হয়ে অনেক হিন্দু-মুসলিম সাধারণ মানুষও ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৪

মিঃ ঠাকুর শুধু একটা ব্যাপারে আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। সূর্যাস্তের পর আমি যেন কেল্লাবাড়ি এলাকায় না থাকি। তাঁকে প্রশ্ন করে কোনও যুক্তিসঙ্গত উত্তর পাইনি। তিনি মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটিয়ে শুধু বলেছিলেন, সূর্যাস্তের পর ওই এলাকায় থাকলে বিপদ হতে পারে। 

কী বিপদ? 

আজমগড়ের অশরীরী প্যালেস হােটেলের ম্যানেজার কিছু বলতে যাচ্ছেন, এমনসময় ক’জন সায়েব-মেম দলবেঁধে হােটেলের লাউঞ্জে ঢুকলেন। তিনি তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। 

সেদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমি ক্যামেরায় কেল্লাবাড়ি আর গঙ্গার ছবি তুলে বেড়ালুম। কোথাও কোথাও ধ্বংসাবশেষে ঝােপজঙ্গল আছে। গঙ্গার তীরে একস্থানে খাড়া পাথরের পাঁচিল নেমে গেছে জলের তলায়। কোথাও ভাঙাচোরা পাথরের ঘাট শ্যাওলায় সবুজ হয়ে আছে। আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম সেই ফঁসির মঞ্চটিকে, যেখানে ইংরেজ সেনাধ্যক্ষ জন হকটন বিদ্রোহীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরেছিলেন। সেই বিদ্রোহীদের দলে ছিলেন নবাব আজম খানের কন্যা রেশমা বেগম।

দিল্লির জাতীয় মহাফেজখানার কাগজপত্রে এই পিতা-পুত্রীর নাম খুঁজে পেয়েছিলুম। আর পেয়েছিলুম একটা স্কেচম্যাপ। সেটা এঁকেছিলেন এক আইরিশ শিল্পী—টমাস পিট। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে সেই শিল্পী এ অঞ্চলে বেড়াতে এসেছিলেন। স্কেচম্যাপে কেল্লাবাড়ির সীমানা ছাড়াও খুঁটিনাটি অনেকগুলি স্থান চিহ্নিত করা ছিল। ফঁসির মঞ্চ, বিদ্রোহীদের কবরখানা, রেশমা বেগমের গােপন অস্ত্রাগার—এরকম অনেককিছুই ছিল ওতে। আমি জীর্ণ ম্যাপ থেকে কপি করে এনেছিলুম। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৪

সেই কপি থেকে স্থানগুলি খুঁজে বের করা দেখলুম অসম্ভব ব্যাপার। তবে একটা দৃশ্য আমার কাছে অদ্ভুতই মনে হচ্ছিল। যেদিকে তাকাই, সেদিকেই ধ্বংসস্তুপগুলিতে শুধু লাল রঙের ফুলের সমারােহ চোখে পড়ে। আমি প্রকৃতিপ্রেমিক নই।

ইতিহাসের একজন গবেষক মাত্র। জীবনে কত ঐতিহাসিক স্থানে আমাকে যেতে হয়েছে। কিন্তু কোথাও এমন উজ্জ্বল লালরঙের ফুল চোখে পড়েনি। নানা আকৃতির এইসব ফুলের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, ওগুলি কি ফুল, না চাপ-চাপ রক্ত ? এখানে কি অন্যরঙের ফুল ফোটে না? 

অবশ্য এখন বসন্তকাল। ফুল ফোটে। পাখিরা গান করে। কিন্তু এখানে পাখিরা কেন চুপ করে আছে? 

পাখির কথা ভাবতেই গঙ্গার ধারে পক্ষীনিবাসের কথা মনে পড়ল। তখন ধরে নিলুম, এলাকার সব পাখি সেখানে গিয়েই জুটেছে। কোথায় সেই চর তা জেনে আসিনি। গঙ্গা এখানে প্রশস্ত। উত্তাল বাতাসে বড় বড় ঢেউ উঠে কেল্লার পাথুরে পাঁচিলে অদ্ভুত শব্দ করছে। চোখ বন্ধ করলে মনে হচ্ছে হাজার-হাজার মানুষের কোলাহল। ওপারে দূ-রে ঘন নীল পাহাড়গুলি দেখা যাচ্ছে। কয়েকটি জেলেনৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে। 

অন্যমনস্কভাবে গঙ্গার ধারে জীর্ণ শ্যাওলাধরা ঘাটের মাথায় একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিলুম। এই সময় আমার ডানদিকে ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে একজন ফকির বেরিয়ে এলেন। 

ফকিরের মাথায় জটা, মুখে লম্বা দাড়ি। পরনে পা পর্যন্ত লম্বা কালাে আলখাল্লা।

গলায় মােটা-মােটা রঙবেরঙের পাথরের মালা। তার এক হাতে প্রকাণ্ড চিমটে। 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৪

চিমটেটার গােড়া রুপাে আর তামার তারে বাঁধানাে। ফকির ঘাটের কাছে এসে আমার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললেন,—কৌন হ্যায় তুম? 

আমি যথাসাধ্য হিন্দিতে নিজের পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করলুম। তারপর বললুম,রেশমা বেগমের ফঁাসির জায়গা আর তার কবর কোথায় তা কি আপনি। জানেন? দেখিয়ে দিলে আপনাকে কিছু বখশিস দেব। 

ফকির কিন্তু চটে গেলেন। তিনি ক্রুদ্ধস্বরে বললেন,—কে চায় তােমার বখশিস? শিগগির এখান থেকে চলে যাও | না গেলে তােমার বিপদ হবে। 

|তাঁকে বােঝানাের চেষ্টা করলুম, আমি সিপাহি বিদ্রোহের প্রকৃত ইতিহাস লিখতে চাই। কিন্তু ফকির আমাকে পাত্তা দিলেন না। মস্ত বড় চিমটেটা তুলে তেড়ে এলেন। চিমটের ডগা সূক্ষ্ম এবং ধারালাে। বেগতিক দেখে আমি সরে এলুম।

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৫

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *