সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৫

একটু পরে দূর থেকে দেখলুম, ফকির আলখাল্লা খুলে রেখে জলে ঝাপিয়ে পড়লেন। ওখানে জল খুব গভীর। ফকির সেই জলে সাঁতার কাটছেন দেখে অবাক লাগল। একটা ঝােপের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাঁকে লক্ষ করছিলুম। কিছুক্ষণ পরে ফকির জল থেকে উঠে ভিজে গায়েই কালাে আলখাল্লা পরে নিয়ে চিমটেসহ গিয়ে গেলেন। তারপর ধ্বংসস্তুপের আড়ালে অদৃশ্য হলেন।

ভৌতিক গল্পসমগ্র

ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল। ওঁকে অনুসরণের সাহস হল না। শুধু জায়গাটা চিনে রাখলুম। তারপর প্যালেস হােটেলে ফিরে গেলুম। 

স্নান করার পর নিচের ডাইনিং হলে খেতে গেলুম। ডাইনিং হলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে লাঞ্চ খাচ্ছিলেন জনাচারেক বাের্ডার। ম্যানেজারের কাছে শুনেছিলুম, তাঁরা। নানা জায়গা থেকে এসেছেন এবং বিত্তবান ব্যবসায়ী। সায়েব-মেমদের দলটি তখনও বাইরে থেকে ফেরেননি। পরিচারক আসলাম খান আমাকে সেলাম দিয়ে খাদ্য।

পরিবেশন করল। সেই সুযােগে তাকে কেল্লাবাড়ির সেই ফকিরের কথা বললুম। আসলাম খান একটু হেসে বলল,—ও তাে পাগলাবাবা স্যার। ওখানে পিরের দরগা আছে। সেখানে থাকে। একেবারে পাগল। খিদে পেলে তখন কিন্তু বেরিয়ে আসে। শহরের রাস্তায় বসে শাপ দেয়, তাকে কেউ খেতে না দিলে তার বিপদ হবে। আবার। খেতে দিলেও শাপশাপান্ত করে। ওকে কখনও ভয় করবেন না। শুধু বলবেন, সঙ্গে পিস্তল আছে। গুলি করে মারব। দেখবেন, তখন কীভাবে দৌড়ে পালায়। একেবারে শেয়ালের মতাে কেল্লাবাড়ির জঙ্গলে লুকিয়ে যাবে।… 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৫

আসলামের কাছে এ কথা শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলুম। তাই খাওয়ার পর ঘন্টাটাক বিশ্রাম করে আবার কেল্লাবাড়িতে গেলুম। ফকির যেখানে ধ্বংসস্তুপের ফঁাকে উধাও হয়েছিলেন, সেখানে গিয়ে সংকীর্ণ একফালি পায়ে-চলা পথ খুঁজে পেলুম। দুধারে ঝােপঝাড় আর পাথর।

আঁকাবাঁকা গােলকধাঁধার মতাে পথে হাঁটতে হাঁটতে একসময় থমকে দাঁড়ালুম। সামনে একটা কাঠের বেড়া। বেড়াতে একটা ফলক আঁটা আছে। তাতে ইংরেজিতে লেখা আছে, নিষিদ্ধ এলাকা। তার নিচে একটা মড়ার খুলি এবং খুলির তলায় আড়াআড়িভাবে দুটো হাড় আঁকা। এই চিহ্নের অর্থ সাংঘাতিক। 

আজমগড়ের অশরীরী 

নিষেধাজ্ঞার তলায় ছােট অক্ষরে লেখা আছে, কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ। ভারত সরকার। 

বুঝতে পারছিলুম না কেন সরকারি পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই বিপদজ্ঞাপক নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছেন। 

বেড়ার ফাঁকে পা দিয়ে উঠে উঁকি মেরে ওদিকটা দেখতে পেলুম। খানিকটা ফঁকা জমির পর নিচে গঙ্গার বুকে বালির চড়া। চড়াটা বহুদূর অবধি বিস্তৃত। বিকেলের রােদে চড়ার শেষপ্রান্তে কাঁটাতারের বেড়া চোখে পড়ল। এবার বুঝতে পারলুম, ওই চড়ায় চোরাবালি আছে। তাই এই সতর্কতা।

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৫

কাঠের বেড়া থেকে নেমে যে পথে এসেছি, সেই পথে ফিরে চললুম। একটু পরে দেখি, ডানদিকে একটা সংকীর্ণ রাস্তা চড়াইয়ে উঠে গেছে। রাস্তাটা লাল ধুলােয় ভরা। এটা কেন চোখে পড়েনি তখন? 

আসলে লাল রাস্তাটা ঝােপের আড়ালে থাকায় লক্ষ করিনি। তা ছাড়া একটা প্রকাণ্ড চৌকো কালাে পাথর রাস্তাটাকে আড়াল করেছিল। পাথরটাতে নকশার মতাে আঁকা লিপি দেখে বুঝলুম আরবি হরফে কিছু লেখা আছে। তখনই ক্যামেরায় কালাে পাথরটার কয়েকটা ছবি তুললুম। 

তারপর পাথরের একপাশ দিয়ে এগিয়ে লাল রাস্তায় পৌঁছলুম। কিন্তু সংকীর্ণ রাস্তাটার লাল ধুলােয় জুততা প্রায় ডুবে যাচ্ছিল। প্যান্ট একটু গুটিয়ে নিতে হল। সাবধানে পা ফেলে একটুখানি এগিয়েছি, হঠাৎ চমকে উঠলুম।

আমার প্রায় ফুটছয়েক দূরে চোখের সামনে এইমাত্র কার জুতাের ছাপ ফুটে উঠেছে। প্রথমে ভাবলুম চোখের ভুল। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা, আমি আবার পা ফেলে এগােতেই আমার সামনে একই দূরত্বে বারবার আগে-পিছে জুততার ছাপ ফুটে উঠছে। বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হিম হয়ে গেল। 

 কোনও এক অশরীরী আমার সামনে হেঁটে চলেছে, এতে কোনও ভুল নেই। তার জুততার ছাপগুলি আমার জুতাের ছাপের তুলনায় ছােট। কিন্তু কে সে? 

ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৫

চোখের ভুল কি না জানার জন্য দুঃসাহসী হয়ে আবার কয়েক পা এগিয়ে গেলুম। আবার আমার সামনে একই দূরত্বে সেই অশরীরীর জুতাের স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠল। 

এবার আমার সব সাহস উবে গেল। শেষবেলার রােদে এই অবিশ্বাস্য ঘটনা দেখে আমার বােধবুদ্ধি গুলিয়ে গেল। আমি দ্রুত পিছু ফিরে লাল ধুলােয় টলতে টলতে কালাে পাথরটার পাশ দিয়ে বেরিয়ে এলুম। তারপর বিভ্রান্তভাবে ধ্বংসস্তুপের ভেতর দিয়ে দৌডুতে থাকলুম। একটু পরে গঙ্গার ধারে খােলা জায়গায় পৌঁছে পিছু ফিরে দেখে নিলুম কেউ আমাকে অনুসরণ করছে কি না। 

এরপর কী করে যে হােটেলে ফিরেছিলুম, মনে পড়ে না।

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৬

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *