জীবনে বহু ঐতিহাসিক ধ্বংসস্তুপ এবং দুর্গম স্থানে গেছি। কিন্তু এমন অদ্ভুত ঘটনা কোথাও ঘটতে দেখিনি। হােটেলের লাউঞ্জে বসে ইশারায় একজন ওয়েটারকে ডেকে কফি আনতে বললুম।
সে কফি এনে দিল। কফি খেতে-খেতে ঘটনাটা ঠান্ডা মাথায় বােঝবার চেষ্টা করছিলুম। এমন সময় দেখি, লাউঞ্জের অন্যপ্রান্তে একজন ভদ্রলােক দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে জিনস এবং টি-শার্ট। মুখে গোঁফ। বেশ বলিষ্ঠ গড়ন। গায়ের রং শ্যামবর্ণ হয়েও নয়, ভদ্রলােকের মুখে যেন একটা একটা বিরক্তির ছাপ এবং চোখদুটোও কুতকুতে। এরকম চেহারার মানুষ দেখলে অস্বস্তি জাগে।।
ভদ্রলােক সম্ভবত প্যালেস হােটেলের লাউঞ্জে এসে কারও জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাঁকে না পেয়ে হয়তাে বিরক্ত এবং অধৈর্য হয়ে উঠেছেন।
আমার চোখে চোখ পড়লে তিনি এগিয়ে এলেন। তারপর বাংলায় বলে উঠলেন,—আপনি কি বাঙালি?
বললুম,-হ্যা।
ভদ্রলােক অমায়িক হেসে আমার মুখােমুখি বসে পড়লেন। বললেন,—মশাই! বাঙালির চেহারা দেখলেই চেনা যায়। আমার ঠাকুরদা ওকালতি করতে আজমগড়ে এসেছিলেন। তারপর আর দেশে ফেরেননি। বাবাও ওকালতি করতেন। আমি কিন্তু ব্যবসা করি। আমার নাম অশােক রায়। আপনার পরিচয় পেলে খুশি হব।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৬
অশােকবাবুকে প্রথমে দেখে যা ভেবেছিলুম, তাঁর অমায়িক হাবভাব এবং কথাবার্তা শুনে সেই ধারণা কেটে গেল। আমার পরিচয় পেয়ে তিনি খুব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। বললেন, কেল্লাবাড়ির ধ্বংস্তুপের মধ্যে কোথায় কী ছিল, তা আমার নখদর্পণে। আমার ছেলেবেলায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়নি।
ওয়েটারকে আবার ডেকে ওঁর জন্য কফি আনতে বললুম। তারপর অশােকবাবু আজ গড়ের পুরনাে ঐতিহাসিক কাহিনি বলতে শুরু করলেন। ম্যানেজারের কাছে এসব গল্প শুনেছি। ওয়েটার কফি দিয়ে গিয়েছিল। কফি খেতে-খেতে অশােকবাবু বললেন,আজ বিকেলে কলকাতা থেকে আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধুর আসার কথা।
তার জন্য অপেক্ষা করে অস্থির। ছটা বেজে এল। সে এল না। কাজেই ধরে নিচ্ছি, আর সে আসবে না। না আসুক। আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে কী যে আনন্দ পেলুম, বােঝাতে পারব না। তা আপনি হােটেলে থাকবেন কে? খামােক একগাদা টাকা খরচ! বরং আমার অতিথি হােন। আপনাকে দেখলে আমার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরাও খুব খুশি হবে।
এত অন্তরঙ্গতার পর বিকেলে কেল্লাবাড়ির ভেতরে সংকীর্ণ লাল রাস্তায় যে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটতে দেখেছি, তা অশােকবাবুকে না বলে থাকতে পারলুম না।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৬
অশােকবাবু ঘটনাটা হেসে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, আপনি ঐতিহাসিক পণ্ডিত। ইতিহাসের ভেতর ডুবে থাকেন। বাস্তব জগতে ভুলভাল দেখা আপনার পক্ষে স্বাভাবিক। দেখুন মশাই! আমি কত রাতদুপুরে ওই এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি। কখনও কিছু দেখিনি। হা—ওখানে এক পাগলা ফকির থাকে। আমাকে দেখলেই সে লেজ তুলে পালিয়ে যায়। তাকে নিশ্চয় দেখতে পেয়েছেন?
বললুম, হঁা। দুপুরে ফকিরকে গঙ্গায় স্নান করতে দেখেছি। আমাকে সে ভয় দেখাচ্ছিল।
আজমগড়ের অশরীরী অশােকবাবু হেসে উঠলেন। বললেন,-পরশু দোলপূর্ণিমা গেছে। আজ কিছুক্ষণ পরে চাঁদ উঠবে। কোনও ভয়ের কারণ নেই। আমার সঙ্গে কেল্লাবাড়িতে চলুন। দেখবেন, কোনও অলৌকিক ব্যাপার ঘটছে না। আর পাগলা ফকিরের ডেরাতেও আপনাকে নিয়ে যাব। দেখবেন, আমাকে দেখে ব্যাটাচ্ছেলে কী করে।
এতক্ষণে সায়েব–মেমদের দলটি এসে পড়ল। অন্যান্য বাের্ডাররাও ততক্ষণে। এসে গেছে। কেউ লাউঞ্জে, কেউ ডাইনিং হলে ঢুকে চাকফি খাচ্ছে। অশােকবাবু বললেন,“চলুন! জ্যোৎস্নারাতে আজমগড়ের গঙ্গার ধারে বসে গল্প করা যাবে। তারপর সেই লাল রাস্তায় যাব। আমার কাছে টর্চ আছে। আপনাকে আমি রেশমা বেগমের কবরও দেখিয়ে দেব। উঠে পড়ুন।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৬
একটু অনিচ্ছা–অনিচ্ছা করে অশােকবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে গেলুম। তারপর মনে। হল, ইনি বাঙালি এবং এখানেই বড় হয়েছেন। তা ছাড়া, তার বলিষ্ঠ গড়ন দেখেও শেষপর্যন্ত ভয়টুকু ঘুচে গেল..
কেল্লাবাড়ি এলাকায় ঢুকে গঙ্গার ধারে একটা পাথরের ওপর পাশাপাশি দুজনে বসলুম। অশােকবাবু কলকাতার সাম্প্রতিক খবরাখবর জেনে নিচ্ছিলেন। বহুবছর তঁার। কলকাতা যাওয়া হয়নি।
কিছুক্ষণ পরেই চঁদ উঠল। জ্যোৎস্নায় গাছপালা, ঝােপঝাড় আর ধ্বংসস্তুপ রহস্যময় মনে হচ্ছিল। অশােকবাবু বললেন, আপনি যে লাল রাস্তাটা দেখেছিলেন, . ওর পাশেই নাকি ইংরেজরা বিদ্রোহীদের ফাঁসি দিয়েছিল। তবে আপনি যে অশরীরী জুতাের ছাপ দেখার কথা বললেন, ওটা চোখের ভুল। ওই রাস্তা দিয়ে পাগলা ফকির যাতায়াত করে।
ভৌতিক গল্পসমগ্র খণ্ড-৬
আপনাকে আড়াল থেকে ভয় দেখানাের জন্য ব্যাটা নিশ্চয় কোনও কারচুপি করেছিল। এও হতে পারে পুরু ধুলাের তলায় লম্বা কোনও জিনিস লুকিয়ে রেখেছিল। তার ওপর আপনি পা ফেললেই সামনের দিকটা উঁচু হয়ে ধুলাে ঠেলে তুলবে। স্রেফ ম্যাজিক! চলুন। পরীক্ষা করা যাক।
অশােকবাবু আমার হাত ধরে ওঠালেন। একটু দ্বিধার সঙ্গে বললুম,কিন্তু আমি সত্যি জুতাের ছাপ দেখেছিলুম!
আরে মশাই! আমি তাে সঙ্গে আছি আসুন না। বলে অশােকবাবু হাঁটতে শুরু করলেন। আমার কাধে তার হাত চেপে বসল।
জ্যোৎস্নার জন্য ধ্বংসস্তুপের চকরাবকরা ছায়ার ভেতর দিয়ে আমাকে তিনি নিয়ে চললেন। একটু পরে দেখলুম, সেই আরবি লিপি খােদাই করা কালাে পাথরটার কাছে এসে গেছি! অশােকবাবু টর্চের আলাে ফেলে বললেন,—চলে আসুন। দেখা যাক কী হয়।।
সংকীর্ণ চড়াই রাস্তায় কিছুটা উঠে টর্চের আলাে ফেলে অশােকবাবু বললেন, কই? কোনও ভুতুড়ে জুতাের ছাপ দেখতে পাচ্ছেন?
Read More