সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১২

না, ব্ৰহ্মদৈত্যের জন্যে নয়। গাছটা ইয়া মােটা, বেলে ভর্তি। ভৰভূতি বেলের সরবত পেলে আর কিছু খেতে চান না। একগাল হেসে গজপতিকে বললেন–গজু, প্রতিদিন বেলের সরবতের নেমতন্ন রইল। এলেই পাবে।

নিঝুম রাতের আতঙ্ক 

গজপতি মুখে হঁ্যা বললেন বটে, কিন্তু মনে মনে বললেন -মাথা খারাপ ? বেলের সরবতের জন্যে রােজ ট্রেনে চেপে ব্ৰহ্ম দৈত্যর আখড়ায় আসব ? আমি তাে ভবুর মতো পাগল নই। ঐ বেলে হাত দিলে ব্ৰহ্মদৈত্যমশাই খড়মপেটা করবে না? 

ভবভূতিকে গৃহস্থ করতে এসেছিলেন সেই প্রথমদিন। তারপর আর তিনি আসেননি। তবে দৈনিক একটি করে চিঠি লেখেন । লিখেই আশা করেন, এ চিঠির জবাব ভবভূতির বদলে তার রাঁধুনী কাম-চাকর নরহরিই লিখবে বড় দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি–কতবাবু গতরাতে বেলতলায় পটল তুলেছেন। অর্থাৎ ব্ৰহ্মদৈত্য তার ঘাড়টি মটকে দিয়েছে। 

কিন্তু কোথায় কী ? দিব্যি ভবভূতিরই জবাব আসে। নিজের হাতে লেখা। প্রিয় গজু, তুমি কি সম্প্রতি ন্যাড়া হইয়াছ? নতুবা আসিতেছ কেন ? প্রচুর বেল পাকিয়াছে। তােমার ব্ৰহ্মদৈত্য ভদ্রলােকটি বেজায় ভদ্র। তাহার সঙ্গে ভাব জমিয়াছে। তিনি ন্যাড়া বলিয়াই কদাচ বেলতলায় অবতরণ করেন না। মগডালে বসিয়া পাকা বেল পাড়িয়া দেন। আমি লম্বা বাঁশের ডগায় বাঁধিয়া এলুমিনিয়ামের জগভর্তি সরবৎ পাঠাই।

তিনি সরবত পান করিয়া জগটি নামাইয়া দেন। হঁা—গতকাল লিখিতে ভুলিয়াছি, তিনি তােমার কথা জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন। বলিলেন, আহা! বালকটিকে দেখিলে বড় আনন্দ পাইতাম ।••• | এই চিঠি পেয়ে গজপতি রেগে লাল। চালাকি ? ঠাট্টা করা হয়েছে ‘বালক’ বলে ? আমার বয়স পঁয়ষট্টি হয়ে গেল। আমাকে বালক বলা হচ্ছে ? আমার গাল টিপলে দুধ বেরােয়, না আমি এখনও দুধুভাতু খাই যে আমাকে বালক বলেছে ? 

নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১২

একটু পরে রাগ পড়ে গেল। না, হয়তাে ঠিকই লিখেছে। ব্ৰহ্মদৈত্য মশায় আমাকে সেই ছেলেবয়সে দেখেছেন। তাই বালক বলাটা স্বাভাবিক। হয়তাে সত্যিসত্যি ভবভূতি ওনার দর্শন পেয়েছে। এবং পেয়ে এতদিনে ভূতপ্রেতে বিশ্বাসও হয়েছে। 

তাহলে ভয়ের কথা, ব্ৰহ্মদৈত্য এখনও মনে রেখেছেন গজপতিকে ? ওরে বাবা, এযে সাংঘাতিক কথা। আজই কালিঘাটে পুজো দিয়ে আসতে হবে । হে মা কালী, যেন ‘বেলগাছিয়াবাসী’ কালো কুচকুচে, সর্বাঙ্গে লােমওয়ালা এবং খড়ম-পরা ভদ্রলােকটি আমাকে ভুলে যান। ওনার স্মৃতিভ্রংশ করিয়ে দাও মা! 

না ভুললেই বিপদ। হয়তাে ভবভূতিই তাঁকে প্ররােচিত করবেন গজপতির বাড়ি আসতে এবং তিনি নিছক স্নেহ-প্রদর্শনেই খড়ম পায়ে চট চট করে রাতদুপুরে হাজির হয়ে হেঁড়ে গলায় ডেকে বলবেন-গজু। কেমন আছিস বাবা? 

গজপতি আঁতকে উঠে তক্ষুণি কালিঘাট ছােটেন। ওদিকে ভবভূতি চমৎকার কাটাচ্ছেন ঘুঘুডাঙার বাড়িতে। বাড়ির নাম দিয়েছেন : ‘সরমা। ঋগ্বেদের সেই কুকুর জননী সরমা। তলায় ব্রাকেটে ইংরেজিতে লেখা আছে : দি ডগ রিসার্চ সেন্টার। 

পূর্ব দক্ষিণের একটা ঘরে থাকেন ভবভূতি। তাঁর পাশের ঘরে নরহরি ঠাকুর। তার ওপাশে রান্নাঘর। উত্তর পশ্চিমের মস্তো ঘরে রেখেছে পাঁচটা অ্যালসেশিয়ান, দুটো গ্ৰেহাউণ্ড, তিনটে টেরিয়ার, আর সাতটা দিশি কুত্তা। এই সাতটা দিশি কুত্তার মধ্যে দুটো বাঘা, দুটো খেকি আর বাকি তিনটে নেড়ী। রীতিমতাে আন্তর্জাতিক বাহিনী। 

ক’দিনের মধ্যেই ইঞ্জিনিয়ার ডেকে এনে ওই ঘরটা সাউণ্ড প্রুফ করে নিয়েছেন। তার ফলে যতই চঁচামেচি করুক, বাইরে থেকে একটুও শােনা যাবে না। 

মােট সতেরটা কুকুরের জন্যে সতেরটা কাঠের খাঁচাঘর আছে। সামনে লােহার গরাদ। চিড়িয়াখানায় যেমন বাঘের খাঁচা দেখা যায়, ঠিক তেমনি। | দেখাশোনা, খাওয়ানাে, স্নান করানাে—সবকিছুর ভার ভবভূতি নিজে নিয়েছেন। নরহরি কুকুর দেখলেই উল্টোদিকে দৌড়ায়। তাই পারতপক্ষে এ ঘরে ঢােকে না। 

নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১২

ভবভূতি একটা প্রকাণ্ড নোটবইতে দুবেলা কুকুরগুলাের হাবভাব টুকে রাখেন। টেপ রেকর্ডারও আছে। কুকুরদের ডাক রেকর্ড করেন । পরে নিজের ঘরে গিয়ে টেপ বাজিয়ে শােনেন! গম্ভীর মুখে ভাবনা চিন্তা করেন। লেখেন। রীতিমতে গবেষণা কি না! 

বেশ চলছিল এই রকম। রাতে কুকুরশালায় টেপরেকর্ডার চালিয়ে রাখছিলেন এবং সকালে নিয়ে এসে বাজিয়ে শুনেছিলেন। নােট কর ছিলেন কোন বৈশিষ্ট্য আছে নাকি। জীবজন্তুর ভাষা শেখা তত সহজ কথা নয়। টেপের একটা জায়গা বারবার বাজিয়ে শুনে তবে না কিছু বােঝা যাবে ! 

হঠাৎ একদিন সকালে টেপ বাজিয়ে শুনতে শুনতে ভবভূতি অবাক হলেন। | টেপে সতেরটা কুকুরের নানান হাঁকডাক অন্যদিন যেমন শােনেন, তেমনি শুনতে পাচ্ছিলেন। তারপর কী একটা ঘটল। আচমকা ওরা চুপ করে গেছে। কোন ডাক নেই। না ঘড়ঘড়, গরগর গাগো, 

খ্যাক খ্যাকা, ঘেউঘেউ, কিংবা ভ্যাভ্যা। হঠাৎ বেড়ালের মতাে যেন মিউ গােছের মিহি নরম ডাক ডেকেই সবাই থেমে গেছে। গেছে ততা গেছেই। 

তারপর একটা কেমন শনশন শব্দ হল। তারপর ঘট ঘটাং । তারপর খট্ খট্ খট্ খট্ খট্ খটু— 

শব্দটা ক্রমে ক্ষীণ থেকে জোরালো হয়ে বাজতে থাকল টেপে। তারপর থেমে গেল । কিসের শব্দ হতে পারে ? 

তারপর চচ্চ চকাম্ চকাম-কুকুরগুলাে খাবার সময় যেমন শব্দ করে, সেইরকম! বেশ তালে তালে শব্দগুলাে বাজছে। ভােজের আসরে শেষপাতে চাটনির সময় চোখ বুজলে যেমন শােনা যায়। এ তাে ভারি অদ্ভুত ব্যাপার! কুকুরগুলাের তােল এত রাতে কিছু খাবার কথা নয়! খাবে যে, তা পাবেটা কোথায় ? 

অথচ শােনা যাচ্ছে, গত রাতে। ( হিসেব মতে তখন প্রায় বারােটা) ওরা খুব খাচ্ছে। খাচ্ছেটা কী? চাটনি ? অসম্ভব। কুকুর তাে চাটনি খায় না। চেটেপুটে খায় অবশ্য। কিন্তু চাটবেই বা কী ? নিজের নিজের লেজ ? মনে হয় না তা। ভবভূতি কুকুরের লেজ চেটে না দেখলেও জানেন, মােটেও সুস্বাদু নয়।। | ভবভূতি টেপ বন্ধ করে কুকুরশালায় ঢুকলেন। তাকে দেখে কুকুর গুলো কিন্তু অদ্ভুত আচরণ শুরু করল। ঘণ্টাটাক আগে এ ঘরে ঢুকেছেন ! খাইয়েছেন।

নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১২

টেপ রেকর্ডারটা তুলে নিয়ে গেছেন। তখন ওরা স্বাভাবিক ছিল। অথচ এখন ওঁকে দেখে প্রত্যেকটা কুকুর গরগর করে উঠেছে। কুকুরের ভাষা এতদিনে যতটা বুঝেছেন, ওদের এই শব্দে রীতিমতাে রাগ আছে। সবচেয়ে বেশি আদরের অ্যালসেশিয়ানটার খাচার সামনে যেতেই সে দাত বের করে কামড়াতে এল। গ্ৰেহাউণ্ড দুটো শরীর লম্বা করে গ গ করতে থাকল। 

তারপরই প্রত্যেকটি খাঁচায় প্রত্যেকটি কুকুর লাফালাফি জুড়ে দিল। যেন খাঁচা ভেঙে ফেলবে। তাকে পেলে যেন ওরা টুকরাে টুকরাে করে খেয়ে ফেলবে। সে কি হিংস্র হাঁকরানি ! 

ভবভূতি বিলিতিগুলােকে ইংরিজিতে এবং দেশীগুলােকে বাংলায় তর্জন-গজন সহকারে ধমক লাগালেন। একটা লাঠি নিয়ে এসে খুব ঠোকাঠুকি করলেন খাঁচার সামনে। কিন্তু কেউ ভয় পেল না বরং আরও ক্ষেপে গেল। ভবভূতির কানে তালা ধরে যাচ্ছিল ওদের চঁচামেচিতে।হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন কিছুক্ষণের জন্যে। এমন তাে করে না ওরা। ব্যাপার কী? 

অসহ্য লাগলে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। খুব রাগ হয়েছে। বেই মান নেমকহারাম। এত যত্ন করে রাখা হয়েছে। রােজ কাড়িকাড়ি দুধ, মাংস এইসব খাওয়ানাে হচ্ছে। আর তার বদলে এই ব্যবহার। রােস, আজ সারাদিন খাওয়া বন্ধ। 

নিজের ঘরে ফিরে আবার টেপ বাজিয়ে রাতের রেকর্ড হওয়া শব্দ গুলো শুনতে থাকলেন ভবভূতি। এই খট্ খট্ খট্ খট শব্দটা কিসের হতে পারে ?

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৩

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *