আর এই ভাষার নামও খুঁজে পেয়েছেন ভবভূতি। শ্বান’ ভাষা। শ হল কি না কুকুর। তাদের ভাষার নাম ‘শ্বান’ ভাষা।
যে গােয়াল রােজ ‘সরমা অর্থাৎ ভবভূতিবাবুর বাড়িতে দুধ দিতে যায় সে অবাক হয়ে শোনে, ভবভূতি বলছেন—ঘেী ঘৌ ঘঃ ?
কালীপদ জবাব দিচ্ছে—ঘরররর ঘ্যাঃ।
—ভেঁক্ ভেঁক্। –ভেউ-উ–উ। —গঃ গ গাও!
গ —এ) এ্যা। গােয়ালা কালীপদকে চুপিচুপি বলে ব্যাপারটা কী ভাই কালীপদ ?
কালীপদ মুচকি হেসে বলে–গরগরর! ঘেউ !
গােয়ালা বেচারা ঘাবড়ে যায়। বাইরে ব্যাপারটা রটায় সে। তাই ‘সরমার গেটে কৌতূহলী লােকেরা ভিড় জমায়। বিরক্ত ভবভূতি তাড়া করে বলেন—ঘরররর ঘেউ ঘেউ। ঘা।
লোকেরা ভাবে নির্ঘাৎ পাগল এই ভদ্রলােক। তারা হাে হো করে হাসে এবং ভেংচি কেটে কুকুরের মতো ভেউ ঘেউ করতে থাকে। তখন ভৰভতি বন্দুক বের করেন। তারা পালিয়ে যায়।
এই খবর গিয়েছিল গজপতির কাছে। শুনে গজপতি তাে ভাবনায় পড়ে গেলেন। হাজার হলেও তার ছেলেবেলার বন্ধু ভবভূতি। বুড়াে বয়সে হঠাৎ পাগল হয়ে যাওয়াটা মােটেও কাজের কথা নয়।
বুদ্ধি খাটিয়ে একদিন গজপতি এক সর্ববিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে নিয়ে ঘুঘুডাঙায় হাজির হলেন। ইনি কুকুর সম্পর্কেও জ্ঞানী। হণ্ডুরাসে তিনবছর কুকুর বিদ্যা শিখে এসেছেন। ‘সরমা’র গেটে গিয়ে ডাকলেন—ভব! ভবী। ভবু! আছ নাকি ভায়া?
ভবভূতি কিন্তু গজপতির জন্যে মনে মনে ছটফট করছেন। আহা, কত কালের বন্ধুত্ব। তার ওপর এমন শ্বান ভাষায় তাঁর কৃতিত্ব গজ পতির কাছে জাহির না করলে কি চলে?
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৫
গজপতির ওপর সব রাগ ভুলে হাসিমুখে গেটে গিয়ে সম্ভাষণ করলেন—গর গর । | গজপতি ডাক্তারবাবুকে চিমটি কেটে দিলেন। অর্থাৎ দেখছেন এবং শুনছেন তো ? ডাক্তার মুচকি হেসে ফিসফিস করে বললেন
এই রােগের কুকুরামি। দেখেছি হণ্ডুরাসে অনেকেরই আছে। ‘ গজপতিকে গেট খুলে ভবভূতি ডাক্তারবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন—গ: গ! ডাক্তারবাবু জবাব দিলেন-ঘ-খ-অ-অ! ঘা! গজপতি অকি। আরও অবাক হলেন ঘরে গিয়ে। ডাক্তার ভদ্রলােকও ভবভূতির মতাে পাগল হয়ে গেলেন নাকি?
ভবভূতি আর ডাক্তার কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ গর গর করে যাচ্ছেন সমানে। সেই সময় কালীপদ চা নিয়ে এসে বলল—ভৌ ভৌ ভঃ। গজপতির এতক্ষণে রাগ হল। আর রাগের চোটে ভেংচি কেটে বলে উঠলেন-ভৌ ভৌ ভ্যাও। অমনি কালীপদ তাঁর পায়ের ধুলাে নিল। আর ভবভূতি তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে একগাল হেসে বলে উঠলেন—ঘরর গরররর গাঁ।
এবার অসহ্য লাগল গজপতির। বললেন—কী ব্যাপার বল তাে ভায়া ভব? তােমরা সবাই কুকুরের মতাে ঘেউ ঘেউ করছ কেন ?
ভবভূতি মুচকি হেসে তার খেরাের খাতাটি সামনে খুলে ধরলেন। . চোখ বুলিয়ে গজপতি সব টের পেলেন এতক্ষণে। একের পর । এক পাতা উল্টে গােটাটা দেখে নিলেন। তারপর হাসিমুখে ভবভূতির দিকে তাকিয়ে বললেন—ঘউউ! ঘঃ ।
গজপতির সঙ্গে ভবভূতির আবার ভাব হয়ে গিয়েছিল। তার ফলে গজপতি প্রায়ই ‘সরমা’তে বন্ধুর কাছে এক এক বেলা কাটিয়ে যান এবং শ্বান’ ভাষায় কথাবার্তা বলেন। আর সেই কুকুর বিশেষজ্ঞ ভদ্রলােকের নাম ডাঃ লম্বােদর হােড়। সংক্ষেপে ডাঃ এল হাউর। তাঁকে মােটা মাইনেতে বহাল করেছেন ভবভূতি। কুকুর গুলের মাথাধরা, কান কটকট, পেট ফঁাপা ইত্যাদি অসুখবিসুখ তাে হয়। এতদিন নিজে তঁার সাধ্যমতাে চিকিৎসা করতেন ভবভূতি।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৫
এখন ডাঃ হাউর তা করেন। উনি হারাসী পদ্ধতিতেই চিকিৎসাটা করেন। তাঁরই পরামর্শে কুকুর বাহিনীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে । তবে তারা খাচায় এতদিন বাস করে অভ্যস্ত হয়েছে। তাই বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে চায় না। খাচায় গিয়ে ঢোকে। বাইরে যতক্ষণ থাকে, চুপচাপ উদাস চোখে শুধু আকাশ দেখে আর হাই তোলে।
এতে একটা দারুণ রকমের কাজ হয়েছে। লােকেরা এই বাড়িটা পাগলাগারদ ভেবে পাগল দেখবার জন্যে ইদানীং গেটের পাশে উকিঝুকি মারত। এখন বাড়ির ত্রিসীমানায় এলেই সতেরটা কুকুর নিজ-নিজ কণ্ঠস্বরে গর্জন করে ওঠে। আর গ্ৰেহউণ্ড কী সাংঘাতিক কুকুর, সবাই জানে।
আর কেউ বাড়ির আনাচে–কানাচে আসতে সাহস পায় না। বিকেলে দেখা যায় ভবভূতি আর ডাঃ হাউর সতেরটা দেশী–বিদেশী কুকুর নিয়ে বাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণে বেরিয়েছেন এবং কুকুরগুলােকে হাডুডু খেলা শেখাচ্ছেন। বিদেশী কুকুরগুলাে দিব্যি হা-ডু–ডু–ডু হাঁকতে পারে। কিন্তু দিশি বাঘা-নেড়ি–ঘেঁকিরা ওই ইংরিজি বলতেই পারে না। তারা দিশি ভাষাতেই বঙ্গে—চু কিট কিট কিট ।••
সূর্য ডুবে যায় গাছপালার আড়ালে । ধীরে ধীরে সন্ধ্যা আসে। তখন ডাঃ হাউর কুকুরদের নিয়ে কুকুরশালায় ঢােকেন। আর ডঃ ভবভূতি চুপচাপ পায়চারি করেন কতক্ষণ। চারদিকে নিঝুম। মনে কত কী। আশা জেগে ওঠে। এবার নােবেল প্রাইজ ঠেকায় কে?
সেদিন সন্ধ্যায় ভবভূতি একা পায়চারি করছেন। মনে একটা নতুন ভাবনা গজিয়েছে। কুকুরগুলােকে রাষ্ট্রভাষা শেখালে কেমন হয় ? অন্য ভাষার চাইতে ওটা খুব তাড়াতাড়ি শেখারই কথা। একটু রাগিয়ে দিয়ে শেখাতে শুরু করলেই ঝটপট শিখে নেবে। রাগ হলেই তাে মুখ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বেরিয়ে যায়।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৫
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে সেই বেলতলায় গেছেন ভবভূতি। হঠাৎ মাথার ওপরে ডালপালার আড়াল থেকে কে ভারী গলায় বলে উঠল— ঘর ঘু-উ!
চমকে উঠলেন ভবভূতি। কথাটার মানে—কী ভায়া? ঘুরে বেড়াচ্ছ নাকি।অন্ধকারে ভবভূতি কাকেও দেখতে পেলেন না। বললেন—গঃ গঃ ঘেউ-উ। কে হে তুমি? গাছে কী করছ ?
জবাব এল-ঘ্যা-এ-এক্ ঘরর•• কী? ভবভূতি খাপ্পা। বলছে কিনা, আমি যাই করি, তাতে তােমার কী হে! ভবভূতির বেলগাছে বসে ভবভূতিকেই চোখ রাঙাচ্ছে—তাও এই রাতবিরেতে ? তিনি রেগেমেগে চেচিয়ে উঠলেন মানুষের ভাষাতেই। , এবং রাগ হলে বাঙালি ভদ্রলােক যা করেন, তাই করলেন—অর্থাৎ গেট ডাউন। গেট ডাউন ইউ ব্লাডি ফুল!
অমনি ধপ করে তাঁর সামনে কে লাফিয়ে পড়ল। অন্ধকার গাঢ় হয়নি ততটা। আবছা দেখলেন, বেঁটেখাটো মােটাসােটা একটা লােক। খালি গা। পরনে খাটো ধুতি কেঁচা করে পরা। পায়ে যেন খড়মও আছে। গলায় পৈতেও ঝকমক করছে। অবিকল সেই জ্যোৎস্নারাতে ব্রহ্মদৈত্যবেশী গজপতির মতাে।
Read More