যেই যাবে কাছাকাছি, ডাকিনীটা ওর গলা মটকে রক্ত চুষে খাবে। | হাঁ করে তাকিয়ে ওর কাণ্ড দেখছি, এমন সময় আমাদের কুকুর ভুলাে এসে আমার পা শুকে লেজ নেড়ে কেঁউ কেঁউ করে উঠল। ভুলাের মতাে তেজী কুকুর গাঁয়ে আর দুটো নেই। ওর গায়ের গন্ধ পেলেই মাঠের শেয়ালগুলাে লেজ গুটিয়ে তল্লাট ছেড়ে পালায়।
একবার এক ভালুকওলা এসেছে ভালুকের নাচ দেখাতে । ভুলাে সেই নাচুনে ভালুকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মেরে ফেলে আর কী! অনেক কষ্টে ছাড়ানাে হয়েছিল তাকে। অথচ কুকুর ভালুক দেখলে কী যে ভয় পায়, সবাই জানে।
ভুলােকে দেখে আমার সাহস বেড়ে গেল। ওর গলায় হাত বুলিয়ে, বললুম—এই ভুলো! আমার সঙ্গে যাবি?
ভুলাে লেজ নেড়ে সায় দিয়ে বলল—হুউ।
ভালুক যদি জব্দ হয়, ভুলাের পাল্লায় পড়ে ডাকিনীও নিশ্চয় জব্দ হবে। অতএব তখুনি মাঠের দিকে চলতে থাকলুম। ভুলো আমার সঙ্গে চলল, কখনও পিছনে, কখনও এপাশে ওপাশে সে ছুটোছুটি করে এগােচ্ছিল। এদিকে সারাক্ষণ আমার চোখ রয়েছে, নীলুর দিকে। একটু পরেই দেখলুম, নীলু বটতলায় পৌঁছে গেল।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৫
কিন্তু তারপর ছায়ার আড়ালে তাকে এতদুর থেকে আর দেখা যাচ্ছিল না। আমার মাথায় তখন অনেক ভাবনা জেগেছে। এভাবে নীলু ওখানে গেল কেন? ডাকিনীটা কি গাঁয়ে এসে ওকে ভুলিয়েভালিয়ে নিজের ডেরায় মারতে নিয়ে গেল ? সর্বনাশ! তাহলে তাে ওকে বাঁচাতেই হবে।
ভুলো যখন সঙ্গে আছে তখন আমার ভয় নেই। আমি জোরে হাঁটতে থাকলুম। নির্ঘাৎ বােকা নীলু ডাকিনীর পাল্লায় পড়ে গেছে। * বটতলার কাছাকাছি যেতে না যেতে ভুলাে লেজ তুলে আকাশের দিকে মুখ উচু করে হঠাৎ লম্বা একটানা ‘ঘেউ–উ ঝাড়ল। ভুলো মুখের দিকে তাকিয়ে কুকুরের ভাষায় বলল”
এইতে আমার বুক একটু কেঁপে উঠল। মামার কাছে শুনেছি, জীবজন্তুরা ভূতপ্রেত ডাকিনী সবাইকে দেখতে পায়। তার মানে, আমরা যাদের দেখি না, ওরা তাদের দিব্যি দেখতে পায়। এমনকি দেখেছি, পাঁচিলের ওপাশে অচেনা মানুষ এলে ভুলাে তাও টের পায় এবং বেজায় হাঁকডাক শুরু করে। রাতের আঁধারেও তাে ভুলাে দেখতে পায়—অথচ আমাদের আলাে চাই-ই।
কাজেই ভুলে নিশ্চয় একটা কিছু অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পাচ্ছে। ভয়ে-ভয়ে বললুম—ভুলল! কিছু দেখতে পাচ্ছিস নাকি ? | ভুলে আমার দিকে ঘুরে লেজ নেড়ে কুকুরের ভাষায় বলল হুট। তারপর সে আচমকা বটতলার দিকে দৌড়াতে থাকল। দেখা দেখি, আমিও সঙ্গে নিলুম। তারপর বটতলার কাছে গিয়ে হাপাতে হাঁপাতে ডাকলুম-নীলু ! নীলু!
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৫
বটতলায় কখনও এর আগে যাইনি। কী প্রকাণ্ড গাছ। চারপাশে অনেক ঝুরি নেমেছে। গুড়িটাও পেল্লায় মােটা। শেকড় বাকড়ে ছড়ানাে রয়েছে অগুনতি। শনশন করে বাতাস বইছে। বটের পাতা কঁপছে । ভুলাে মাটি শুকে ঘুরঘুর করছিল। নীলুর কোন সাড়া পেলুম না। চুপচাপ দাড়িয়ে আছি। হঠাৎ মনে হল বাতাসের সুরে কে যেন গান গেয়ে কিছু বলছে। গা শিউরে উঠল। আবার ডাকলুম–নীলু ! নীলু ! কিন্তু কোন সাড়া পেলুম না।
এই সময় ভুলে মুখ তুলে আবার একখানা লম্বা ঘেউ–উ ঝাড়ল। তারপর দৌড়ে গাছের ওপাশে চলে গেল। তখন আমিও গেলুম।
গিয়ে যা দেখলুম, থ বনে দাড়াতে হল। এক বুড়াে বসে রয়েছে। তার পাশেই একটা ময়লা কাপড়ের পুটলি। একটা লাঠি। তার সামনে মাটিতে বসে আছে নীলু। বুড়াে লোকটা চোখ বুজে যেন ধ্যান করছে। তার গায়ে একটা তালিমারা ফতুয়া-খুব নোংরা সেটা। মাথায় একটা পাগড়ি। তার কানে বড় বড় তামার আংটি ঝুলছে। গলায় একটা মস্তো চাদির চৌকো চাকতি আছে।
এইবার মনে পড়ে গেল—আরে ! এ তো সেই ম্যাজিসিয়ান। সেদিন আমাদের পাড়ায় ম্যাজিক দেখাচ্ছিল। আমি আরও অবাক হয়ে গেলুম।
নীলু এতক্ষণ আমাকে দেখেও যেন দেখছিল না। আবার চোখে চোখ পড়তেই সে ঠোটে আঙুল রেখে আমাকে চুপ করতে ইশারা করল। তারপর চোখ নাচিয়ে তেমনি ইশারায় ম্যাজিসিয়ানকে দেখিয়ে তার পাশে বসতে বলল ।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৫
নীলুর পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। ভুলো এসে আমার পাশে একটুখানি দাড়িয়ে থেকে আবার কোথায় চলে গেল।
একটু পরে বুড়াে ম্যাজিসিয়ান চোখ খুলল। বিড়বিড় করে কী “অস্পষ্ট মন্ত্র পড়ল যেন। তারপর একটু ঝুকে নীলু ও আমার ওপর তিনবার ফু দিল। ভয়ে বুক কাপল। এমন কেন করল ও ?
তারপর লােকটা একটু হেসে মিঠে গলায় বলল-এ ছেলেটি কে বাবা ?
Read More