কিন্তু এখন যেমন সহজে বলে যাচ্ছি, আসল ভূতটা দেখার সময়ে মােটও ব্যাপারটা সহজ ঠেকেনি। ওরে বাবা! সে বড় গােলমেলে ব্যাপার। আর সেই দৃশ্য মনে পড়লে আজও গায়ের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
তখন আমার বয়স মােটে বারাে বছর। পড়ি ক্লাস এইটে। আমাদের স্কুলটা ছিলাে দুটো গাঁয়ের মধ্যিখানের মাঠে একেবারে নিরিবিলি জায়গায়। চারপাশে বড় বড় গাছ, আর ঝােপঝাড় ছিল। পিছনের পুকুরপাড়ে কল্কে ফুলের জঙ্গল ছিল। তার মাঝখানে ছিল মুক্তকেশীর মন্দির। ভাঙাচোরা কতকালের পুরনাে মন্দির। সাপের ভয়ে ওদিকটায় ছেলেরা খুবই কমই যেত।
আমার এক সহপাঠী ছিল, তার নাম পােদো। কাল কুচকুচে এই চেহারা। বলিষ্ঠ গড়ন। খেলাধুলোয় খুব ঝোঁক ছিল ওর। কিন্তু পড়াশুনায় তেমন কিছু নয়। কোনরকমে টেনেটুনে পাস করে যেত।
আমার সঙ্গে পােদোর ভাব হবার কারণ, ক্লাসে মাস্টারমশাই পড়া জিজ্ঞেস করলে আমি ওকে ফিসফিস করে বলে দিতুম। পরীক্ষার সময় তাে কথাই নেই। আমার খাতা থেকে ঢুকতে দিতুম। এতে আমারও লাভ ছিল। কারও সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি হলে পােদো আমার ‘পক্ষ নিত ।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৭
তখন পাড়াগাঁয়ে প্রচণ্ড ম্যালেরিয়া জ্বরের উপদ্রব ছিল। মহামারীর মতাে গাঁ উজাড় হয়ে যাচ্ছিল এই রােগে। বার্ষিক পরীক্ষার কয়েকদিন আগে বেচারা পােদো ম্যালেরিয়ায় ভুগে মারা গেল। আমি একেবারে একা হয়ে গেলুম যেন। মন ভেঙে গেল। পড়াশুনাে যা ‘করেছিলম সব ভুলে গেলাম যেন।
ইংরেজি আর বাংলা পরীক্ষা তাে কোনরকমে দিলম। তৃতীয় ১ দিনে ভূগােল আর সংস্কৃত। ভূগােলও মােটামুটি হল। কিন্তু সংস্কৃতের . প্রশ্ন দেখে চড়কগাছ। একে তাে পণ্ডিতমশাইয়ের ক্লাসে বরাবর ফাঁকি দিয়েছি, তার ওপর এই দেবভাষার ব্যাকরণ ব্যাপারটা আমার কাছে প্রচণ্ড হেঁয়ালি ঠেকেছে বরাবর। তখন শীতের বিকেল নেমেছে। স্কুলের পেছনের গাছপালায় ঘন ছায়ায় ঘরের ভেতরটা আবছা হয়ে এসেছে। তখন তাে গায়ে বিদ্যুৎ ছিল না।
আমি জানলার পাশের সিটে বসেছিলম। প্রশ্নপত্র নিয়ে আকাশ পাতাল ভাবছি। হঠাৎ চোখের কোনা দিয়ে দেখলম, হঁা—সেই পােদোই বটে, পরনে খাকি হাফ প্যান্ট, গায়ে ময়লা একটা শার্ট, জানলার বাইরে ঝােপের কাছে দাঁড়িয়ে আছে এবং আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করছে।
হঠাৎ চোখের কোনা দিয়ে দেখলুমহা , সেই••(পৃঃ–৩০)
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৭
প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিলুম আর কী! ভয়ে নয়—আনন্দে। কিন্তু তক্ষুনি মনে-পড়ে গেল, পােদো তাে মারা গেছে। আর অমনি সারা শরীর হিম হয়ে গেল। ভয়ে চোখ বুজে ফেললুম।
. সংস্কৃতের পরীক্ষা। পণ্ডিতমশাই নিজেই গার্ড দিচ্ছিলেন ঘরে। বললেন—ও কী রে তপু। ধ্যান করছিস নাকি? আঁ?
চোখ খুলে কাচুমাচু মুখে বললুম-পাে-পাে-পােদো স্যার।
-পােদো? পােদোর জন্যে শােকপ্রকাশ করছিস? আঁ? এই বলে পণ্ডিতমশাই আকর্ণ হাসতে লাগলেন। ঘরসুদ্ধ ছেলেরাও আমার দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি শুরু করল।
পণ্ডিতমশাই তারপর হাসি থামিয়ে গর্জে বললেন—বন্ধুর জন্যে শােকপ্রকাশ পরে হবে। বুঝেছ ?
পণ্ডিতমপাই কিন্তু ভীষণ রাগী মানুষ। দেয়ালে মাথা ঠুকে দিতেন। নয়তাে কান ধরে মার্চ করাতেন। এমনি সব শাস্তি দিতেন আমাদের। তাই আর ওঁকে কিছু বলার সাহস হল না। লেখার ভান করলুম।
কিন্তু মনে অস্বস্তি। আবার একটু পরে চোখের কোনা দিয়ে জানালার বাইরে তাকালুম। কী আশ্চর্য! পােদোই তাে! ঝোপের মধ্যে দাড়িয়ে আছে এবং চোখ টিপে আমাকে ইশারা করছে। এবার স্পষ্ট দেখলুম, তার হাতে একটা কাগজ। কাগজের দিকে ইশারা করে সে কিছু বলতে চাইছে যেন।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৭
কাঁপতে কাঁপতে বললুমপাে-পাে-পােদো স্যা-স্যার!
পণ্ডিতমশাই এবার সােজা আমার কাছে এসে বাজপড়ার মতাে আওয়াজ দিলেন-রসিকতা হচ্ছে ? রসিকতা? পাষণ্ড! অনান। বলীবর্দ!
তখন গলা শুকিয়ে গেছে। বােবায় ধরেছে যেন। অতিকষ্টে, বললাম-জ-জল স্যার।
ক্লাসে ছাত্রদের জল খাওয়ানাের কোন ব্যবস্থা ছিল না। বাইরে টিউবেলে গিয়ে খেয়ে আসতে হত। টিউবেলটা ছিল খেলার মাঠের
এককোনায়। পণ্ডিতমশাই দাঁত খিচিয়ে বললেন—জল খাবে তাে পােদো-পােদো করছ কেন মূখ ? যাও—গিয়ে জল খেয়ে এস।
বাইরে গেলুম। কোথাও কেউ নেই। পরীক্ষার সময় আজ কালকার মতাে গার্জেনরা তখন স্কুলের আনাচে–কানাচে গিয়ে দাড়িয়ে থাকতেন না। |
Read More