সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ -চাঁদের অমাবস্যা – ৬

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ -চাঁদের অমাবস্যা – ৬
চাঁদের অমাবস্যা – সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চাঁদের অমাবস্যা – ৬

ছয়

প্রধান শিক্ষকের কামরার পাশে শিক্ষকদের বিশ্রামঘর। অসমতল মেঝের মধ্যখানে একটি সাধারণ কাঠের টেবিল। তার চারপাশে বিভিন্ন ধরনের কয়েকটা কুর্সি। তবে একটি কুর্সির ওপর সর্বদা সকলের নজর। বুনটের ফাঁকে-ফাঁকে সংখ্যাতীত পুষ্টাঙ্গ ছারপোকা, তবু সেটি বেতের তৈরি বলে আরামদায়ক। পিঠটা একটু হেলানো, দু-পাশে হাতলও আছে। আরামের বিনিময়ে রক্ত দিতে কেউ দ্বিধা করে না। আজ সে কুর্সিতে আরবির শিক্ষক মোহাম্মদ আফাজউদ্দীন এক হাঁটু তুলে আসনাধীন। মুখে সচেতন আয়েশী ভাব।

টিফিনের সময় শিক্ষকরা গাম্ভীর্য-কর্তৃত্বের মুখোশ খুলে প্রায় ছাত্রদের মতোই হট্টগোল করে। খবরাখবরের আদান-প্রদান করে, নানা বিষয়ে ব্যক্তিগত মতামতের ঢাকঢোল বাজায়, শ্রোতা না পেলেও কেউ-না-কেউ শুনবে এ আশায় একতরফা বকে যায়। না শুনলেও পরওয়া নাই যেন। বিশ্রামঘরে শ্রোতারা সব সময়ে সংখ্যালঘিষ্ঠ।

অভ্যাসমতো যুবক শিক্ষক এককোণে নির্বাক হয়ে বসে। সামনে একটি পুরোনো মাসিক পত্রিকা। সেটি পড়ার ভান করে। সহযোগীদের কথা কখনো কখনো কানে লাগে, কিন্তু তাও ভাসা-ভাসা ভাবে। তার কানের সীমানায় ধরবার কিছু না পেয়ে তাদের কথা পিছলে খসে যায়। কিছুক্ষণ সময় কাটে। যুবক শিক্ষক পাতা ওল্টায় না।

এক সময়ে কোলাহলের মধ্য থেকে একটি শব্দ ছিটকে বেরিয়ে আসে। তারপর, অব্যর্থলক্ষ্য শব্দটি সরাসরি চাঁদমারি বিদ্ধ করে। নিমেষে সমস্ত কোলাহল, তাল-বেতাল দুর্বোধ্যপ্রায় বাক্যস্রোত স্তব্ধ হয়। সচকিত হয়ে যুবক শিক্ষক কান খাড়া করে।

‘শুনেছেন?’

প্রশ্নকারের উচ্চকণ্ঠে গুরুত্বভাব। একটি শব্দের প্রশ্নই বিশেষ জরুরি ঘোষণার ভূমিকার মতো শোনায়।

‘শুনেছেন?’

দ্বিতীয় বার কথাটি জিজ্ঞাসা করে প্রশ্নকার তৃপ্ত না হয়ে পারে না। তারই কণ্ঠ বিশৃঙ্খল কোলাহলের মধ্যে জয়লাভ করেছে। কারো মুখে টু শব্দ নাই। সে মনস্থ করে, তার জয় সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করবে সে।

‘বলতে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। স্মরণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে।’

আকস্মিক বিনয়ের সঙ্গে এমন অসম্ভব বিস্মৃতিশীলতার দোষ স্বীকার করে প্রশ্নকার সাড়ম্বরে নিশীথরাতে নদীপথ-স্টিমারের পটভূমিকায় তার বক্তব্য শুরু করে। অবনতমুখে যুবক শিক্ষক তার কথা শোনে। যা শোনে তার চেয়ে বেশি মনশ্চক্ষুতে দেখে, কারণ তার মনে হয় ঘটনাটি তার অজানা নয়। সে দেখে শীতকালের নিস্তেজ শান্ত নদী, তার বুকে স্টিমারের অত্যুজ্জ্বল সাদা সন্ধানী-আলো। জনমানবশূন্য নদীপাড়, গাছপালাঘেরা ঘুমন্ত গ্রাম। নদী কোথাও চওড়া, কোথাও সরু; কোথাও তার বুকে উলঙ্গ চর চাঁদের আলোয় ধবধব করে। কোথাও প্রাচীন দুর্গ-দেয়ালের মতো পাড় খাড়া, কোথাও স্থলের সঙ্গে প্রায় সমতল। বাঁক কোথাও ক্রমিক, কোথাও আকস্মিক। রাতের গভীর নীরবতায় জলযানের যান্ত্রিক হৃৎপিণ্ড উচ্চস্বরে আওয়াজ করে। ওপরে, লম্বা সাদা কোর্তার ওপর আলোয়ান জড়িয়ে সারেঙ্গ দূরগামী চোখে, সন্ধানী-আলোর মতোই অহরহ এধার-ওধার তাকায়। মাথায় কিস্তি টুপি, মুখে ধার্মিক ব্যক্তির সৌম্যশুদ্ধভাব। সেখানে তাকে বড়ই একা এবং কিছুটা বেমানানও মনে হয়। যেন তারই পরিচালিত যান্ত্রিক জলযানের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নাই। তার দৃষ্টি যেন নদীতে নয়, দূরদিগন্তে, তারাতে বা ছায়াপথে নিবদ্ধ।

নদীপথ-স্টিমারের এ-নিরীহ বিবরণেই যুবক শিক্ষকের বুক কাঁপতে শুরু করে। সে বোঝে, বক্তা এখনো আসল কথা পাড়ে নাই। সে নদীরই মতো এঁকে-বেঁকে সর্পিল গতিতে অগ্রসর হচ্ছে কেমন উদ্দেশ্যহীনভাবে, কিন্তু উপযুক্ত মুহূর্তে গন্তব্যস্থলে পৌঁছুবে। তার গন্তব্যস্থল যুবক শিক্ষক জানে। তবু তা শোনবার বাসনা এমন তীব্র হয়ে ওঠে যে সে শীঘ্র শ্রান্তিবোধ করতে শুরু করে।

নিঃসন্দেহে ভণিতায় বক্তা মাত্রাতিরিক্ত সময় নিচ্ছে। একজন শ্রোতা বলে ওঠে, ‘ঠিকই বলেছেন। সারেঙ্গ নয়, মোল্লা যেন। ভুল করে মসজিদের মিম্বর ছেড়ে জাহাজের পুলে দাঁড়িয়েছে।’ হঠাৎ সে গলা উঁচু করে এধার-ওধার তাকায়। বলে, ‘ভালো কথা। এক চোখ কানা মুয়াজ্জিন কী করেছে শুনেছেন?’ তার বিবেচনায়, বক্তার সময় পেরিয়ে গেছে। আশান্বিতভাবে উৎসাহের জন্যে আবার এধার-ওধার তাকায় সে। উৎসাহ পেলে নিঃসন্দেহে কথার স্রোত অন্যপথে চালু করে দেবে। বলা বাহুল্য, দাঁড়ে থাকবে সে-ই। আলোচনার গতি-পরিবর্তনের ব্যাপারে সবারই মতো সে বিশারদ।

দুঃখের বিষয়, এ-সময়ে আরামদায়ক কুর্সিটির পাশে দু-একজন শিক্ষক হঠাৎ সজোরে নাকে শব্দ করে ওঠে, মুখে তাদের বিষম বিরক্তির ভাব। একটা বদগন্ধ উঠেছে। খোলাখুলিভাবে তারা আরবির মৌলবীর দিকে তাকায়। মৌলবীর চোখ নিমীলিত। মুখে আয়েশী ভাবের ওপর এবার একটা আধ্যাত্মিক ভাবের অস্পষ্ট আভাস যেন।

বক্তার বুঝতে দেরি হয় না, বিজয়ের উল্লাসে সে অসাবধান হয়ে পড়েছে, হাতের লাগাম ঢিলে করে দিয়েছে, প্রধান নদীপথ ছেড়ে খালে-বিলে কালক্ষেপ করেছে। শীঘ্র সে স্টিমারের সারেঙ্গের মতোই দক্ষতার সঙ্গে তার বক্তব্য সঠিকপথে চালিত করে।

হঠাৎ মোল্লাসদৃশ সারেঙ্গ দেখতে পায়, নদীতে কিছু একটা ভাসছে। যুবক শিক্ষকও দেখতে পায় এবং বিবরণ শোনবার আগেই ভাসমান বস্তুটিকে চিনতে পারে। নিশ্বাস বন্ধ করে তবু সে শোনে।

স্টিমার তখন বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তির মতো থরথর করে কেঁপে পূর্ণবেগে চলছে। সারেঙ্গের নির্দেশে এখানে-সেখানে নানারকম ঘণ্টা বাজে, স্টিমারের পার্শ্বদেশ থেকে প্রভূত বাষ্প নির্গত হয়, রাত্রির নীরবতার মধ্যে লস্করদের গলার আওয়াজ জেগে ওঠে। বিশাল তেলেপোকা যেন পথে-পড়ে-থাকা একটি বিন্দুবৎ ক্ষুদ্র দ্রব্য পরীক্ষা করে দেখবার জন্যে থামে।

নদীর বুকে ভেসে যাওয়া বস্তুটি একটি নারীর মৃতদেহ। ফেঁপে-ফুলে কলাগাছ। দেহটি যে একটি যুবতী নারীর তা কেবল ডাক্তারই বলতে পারে। গলায় একটি রূপার হার আঁট হয়ে আছে। তাছাড়া সম্পূর্ণ বিবস্ত্র।

‘বিবস্ত্র?’ একটি শিক্ষক সশঙ্ক নীতিবিদের কণ্ঠে উক্তি করে। কলাগাছের মতো ফাঁপা-ফোলা ভাসমান প্রাণহীন নারীদেহের পক্ষেও বিবস্ত্র হওয়া যেন দূষণীয়।

তখন যুবক শিক্ষকের হাতও কাঁপতে শুরু করেছে। সে-বিষয়ে সচেতন হয়ে মাসিক পত্রিকাটি আস্তে টেবিলের ওপর রেখে সে কম্পমান হাত লুকিয়ে ফেলে।

‘একেবারে বিবস্ত্র। রূপার হারটা ছাড়া গায়ে কিছুই নাই।’

সে-বিষয়ে যুবক শিক্ষকও যেন চিন্তিত হয়। মনে-মনে বলে, পাছাপেড়ে সাদা শাড়িটার কী হল? পরক্ষণে সে স্বীকার করে, শাড়ির রঙ সে জানে না।

‘বয়স বেশি না। বড়জোর, বিশ একুশ। ডাক্তার তাই বলে। ফেঁপে-ফুলে কলাগাছ হলেও ডাক্তাররা ঠিক ধরতে পারে।’

‘পানির কলাগাছ না স্থলের কলাগাছ?’ কেমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটি শিক্ষক রসিকতা করার চেষ্টা করে। তার কাছে কলাগাছের সঠিক বিবরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।

নীতিবিদের মুখ লাল হয়ে ওঠে। হয়তো তার কল্পনায় বাধা পড়েছে। সে হয়তো দেখছিল, একটি বিবস্ত্র সুন্দরী নারী কলাগাছের ভেলায় চড়ে নদীতে ভেসে যাচ্ছে, এমন সময় স্টিমারের অত্যুজ্জ্বল আলো তার ওপর পড়ে। হীরার ওপর যেন আলো পড়ে, কারণ সে-আলোতে তার রূপ বিচ্ছুরিত হয়। তার দেহ যদি কিছু স্ফীত হয়ে থাকে, তার কারণ দুর্দমনীয় যৌবনভার।

তারই কল্পনা-অগ্নিতে ইন্ধন যুগিয়ে বক্তা আবার বলে, ‘এমন অবস্থা, তবু বোঝা যায়, জীবিতকালে দেখতে-শুনতে মন্দ ছিল না।’

আরবির মৌলবী নিমীলিত চোখে এতক্ষণ নীরব হয়ে ছিল। এবার উচ্চস্বরে মন্তব্য করে, ‘তওবা তওবা! নীচজাতীয় মেয়েমানুষ হবে।’

এ-সব মন্তব্য যুবক শিক্ষকের কানে প্রবেশ করে না। সে অনুভব করে, একটি গভীর বিষাদে তার মন ভরে উঠেছে। দুঃখের সঙ্গে সে ভাবে, –যুবতী নারী অদৃশ্য হয়ে স্বপ্নাকাশের অম্লানকুসুমে পরিণত হতে পারল না। তবে কিছু বিস্ময়ের সঙ্গে এ-কথাও উপলব্ধি করে, তার দুঃখটা যুবতী নারীর জন্যে নয়, কাদেরের জন্যেই যেন। কাদেরের পরিকল্পনা সাফল্যমণ্ডিত হল না, তার সমস্ত শ্রম ব্যর্থ হল। খবরটা জানতে পেলে হয়তো তার দুঃখের সীমা থাকবে না।

‘আরো শুনুন।’ বক্তা উচ্চ নাটকীয় স্বরে বলে।

সবাই উদগ্রীব হয়ে তার দিকে তাকায়।

‘মেয়েলোকটি আমাদেরই গ্রামের মানুষ।’

না, বিবস্ত্র হয়েও দেহ বিপুলাকার এবং মুখমণ্ডল কদাকার করেও যুবতী নারী তার পরিচয় ঢাকতে পারে নাই। শনাক্তকারের দৃষ্টির সামনে কোনো ছদ্মবেশই নিখুঁত নয়।

‘মাঝির বউ!’ গ্রাম থেকে নিরুদ্দিষ্ট যুবতী নারীর কথা স্মরণ করে একজন শিক্ষক আবিষ্কারকের উল্লাসে ঘোষণা করে।

গ্রামের করিম মাঝির বউ। স্বামীর নাম কী? নামটা ছমিরুদ্দীন, ছলিমউদ্দীন না করিমউদ্দীন, সে-বিষয়ে কিছু তর্ক হয়।

নাম যা-ই হোক, সে লম্বা পাড়িতে ঘরছাড়া। ঘরে বিধবা মা, চোখে কম দেখে, বাতের ব্যথায় সব সময়ে গোঙায়। তার অবিবাহিতা মেয়েও ঘরে। কানা, বিয়ে হবে না। বাড়ির পেছনে পুকুর, নদীটাও কাছে। দুটি গরু, একটি ছাগল, উঠানের কোণে মোরগ-মুরগির খাঁচা। মাঝি বড় গতর খেটে কাজ করে।

‘নদীতে পড়ল কী করে?’

প্রশ্নটি সকলকে বুদ্ধির যুদ্ধে যোগদান দিতে আহ্বান করে। অবিলম্বে নানারকম মতামতে বিশ্রামঘরটি মুখরিত হয়ে ওঠে।

নীতিবিদ অবশেষে নিশ্চিত কণ্ঠে রায় দেয়, ‘এর মধ্যে নিশ্চয় কোনো কথা আছে। বলে দিলাম, মেয়েলোকটির ক্ষেতখামারে যাবার অভ্যাস ছিল।’

‘নিশ্চয়ই কথা আছে। এমনি পানিতে ডুবে কেউ মরে না।’

‘বললেন না বাজা মেয়েলোক? সে-ই হচ্ছে আসল কথা। বিয়ে-থার পর মেয়েমানুষের ছেলেপুলে না হলে পুরুষ-মরদের জন্যে মন খামখাম করে। জানা কথা।’

‘না, নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো কথা আছে।’

যুবক শিক্ষক কোলাহলে সচেতন হয়ে বিহ্বলভাবে এধার-ওধার তাকায়। এত হট্টগোল কেন? তারপর সে লক্ষ করে, ভয়ানকভাবে তার হাত কাঁপছে। সভয়ে সে হাতদুটি টেবিলের তলে ঢাকে। তারপর কখন বিশ্রামঘরে একটি অস্বাভাবিক নিঃশব্দতা নেবে ক্রমশ তা গাঢ় হয়ে ওঠে। যুবক শিক্ষকের শিরদাঁড়া টনটন করতে শুরু করে। এ-নিঃশব্দতা তার পছন্দ হয় না। ইচ্ছা করে চোখ তুলে তাকায় একবার কিন্তু সাহস হয় না।

অবশেষে দূর থেকে একটি গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে ওঠে।

‘আরেফ মিঞা?’

এবার যুবক শিক্ষক চমকিত হয়ে চোখ তোলে কিন্তু কারো চেহারা স্পষ্টভাবে দেখতে পায় না। আবার কয়েক মুহূর্তব্যাপী অপ্রীতিকর নিঃশব্দতা।

‘শরীর ভালো নয়?’

সাপের মতো ক্ষিপ্রভঙ্গিতে জিহ্বাগ্র দিয়ে সে ঠোঁট ভেজায়, কিন্তু শুষ্ক জিহ্বার তালু কাঠ-কাঠ মনে হয়। শরীরে অসীম দুর্বলতা। অসুস্থতারই লক্ষণ। অস্পষ্টকণ্ঠে সে উত্তর দেয়, ‘শরীরটি ভালো বোধ হচ্ছে না।’ তারপর পেটে হাত বুলিয়ে বলে, ‘হয়তো হজমটা ঠিক হয় নাই।’

তার একজন সহযোগী তাড়াকণ্ঠে হেসে ওঠে।

‘বড়বাড়ির উত্তম খাবার হজম হয় নাই? তাজ্জব কথা!’ শিক্ষকদের মধ্যে যুবক শিক্ষকই বিনাখরচে বড়বাড়িতে থাকে খায়দায় বলে তার প্রতি সকলের মনে একটু লুকানো ঈর্ষা। সুযোগ পেলেই সে—ঈর্ষা প্রকাশ পায়।

‘ঠিক জানি না। জ্বরটর আসছে বোধহয়।’

অন্য এক সহযোগী চোখ টিপে বলে, ‘অবিবাহিত যুবক মানুষ। জ্বর-ব্যাধি ছাড়াও নানা রোগ ঘাড়ে চাপে।’

যুবক শিক্ষকের রক্তহীন মুখে এক ঝলক রক্ত দেখা দেয় তা লক্ষ্য করে উক্তিটি যথাস্থানে বিদ্ধ হয়েছে ভেবে সহযোগীটি ইঙ্গিতে অন্যান্য শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেদিকে।

রক্তঝলকের কারণ লজ্জা নয়, সহযোগীদের প্রতি তীব্র ঘৃণাবোধ। সে-ঘৃণা ক্রমশ এত প্রচণ্ড রূপ ধারণ করে যে তার দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। সে-পীড়াদায়ক ভাব থেকে রেহাই পাবার জন্যেই হয়তো সে বিপরীত চরিত্রের সন্ধান করে—এমন চরিত্র যার দয়ামায়া উদারতার শেষ নাই। বেশি সন্ধান করতে হয় না। তার মনশ্চক্ষুতে কাদের এসে দাঁড়ায়। সঙ্গে-সঙ্গে সারা অন্তর অতি স্নিগ্ধ মধুর শীতল হাওয়ায় জুড়িয়ে যায়, চারপাশে দেয়াল ধসে পড়ে বলে উন্মুক্ত দিগন্তের দিকে তাকাতে আর বাধা থাকে না। তার মনে হয়, উন্নতচরিত্র দয়াশীল স্নেহশীল কাদেরের তুলনায় তার সহযোগীরা সব অতি নীচমনা কলুষজর্জরিত মানুষ। এখন এই ভেবে তার পরম দুঃখ হয়, কাদের যাকে গভীর অপমান হতে বাঁচাতে চেয়েছিল, সে তাদেরই হাতে ধরা পড়েছে। এবার তারা তাকে নির্দয়ভাবে টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে।

যুবক শিক্ষকের আর সন্দেহ থাকে না, কাদেরের অভিপ্রায় সে সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু সে-কথা তাদের মধ্যেই লুকানো থাকবে, কারণ অন্যেরা তার মর্ম বুঝবে না। তাদের দয়ামায়াশূন্য কুণ্ডলিত বিকৃত মনে যুবতী নারীর দেহটি নিশ্চিহ্ন করে দেবার চেষ্টাই অতি বিচিত্র ঠেকবে। প্রতিশোধ নেবার শক্তি যার নাই, এমন দুর্বল অসহায় মানুষের মৃত্যুর মধ্যে যে-চরম অপমান সে-অপমানের তাৎপর্য কি তাদের কূপের মতো অন্ধকার বায়ুহীন মস্তিষ্কে প্রবেশ করবে? পরিত্যক্ত হতভাগিনী যুবতী নারীর প্রতি যে গভীর স্নেহ-মমতা জেগেছিল কাদেরের মনে, তার মূল্য কি তারা বুঝবে? দীপ্ত উজ্জ্বল সূর্যের সঙ্কেত, কনকপ্রভা চন্দ্রালোকের আহ্বান, ঘূর্ণাবর্তের অস্থিরতার অর্থ তারা যেমন বুঝবে না, তেমনি এ-সব কথাও বুঝবে না। বোঝানোর চেষ্টা পণ্ডশ্রম হবে। কুণ্ডলীকৃত মনের পক্ষে সরল হওয়া বা দূরগামী হওয়া দুষ্কর।

যুবক শিক্ষকের মনে কাদেরের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি আরো গাঢ় হয়। একটু অবাক হয়ে সে আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করে। সে যেন স্বচ্ছ, শঙ্কাভীতিশূন্যদৃষ্টিতে যুবতী নারীর দিকে তাকাতে পারছে। শুধু তাই নয়। যাকে সে জীবিতকালে কখনো দেখে নাই, মৃত্যুর পরও যার দিকে চোখ খুলে তাকাতে পারে নাই, তারই প্রতি কেমন একটু মমতাও বোধ করতে শুরু করেছে। অবশ্য সে বোঝে, কাদেরের মনের মমতার তুলনায় তা নগণ্য অংশ মাত্র। তবু তা দু-জনের মধ্যে বন্ধন করে যেন।

‘যান, ছুটি নিয়ে নেন আজ। হেডমাস্টারকে বলুন গিয়ে।’

এ-উপদেশটা আসে আরবির মৌলবীর কাছ থেকে। যুবক শিক্ষক দেখে, উপদেশদাতা তারই দিকে তাকিয়ে আছে। অন্যান্য শিক্ষকের দৃষ্টিও তার ওপর।

‘পেটের ব্যথাটা একটু কমেছে যেন।’ গলায় সুস্থতার আভাস জাগাবার চেষ্টা করে সে উত্তর দেয়।

সে-বিষয়ে তর্কের কোনো অবকাশ থাকে না। ইস্কুলের ঘণ্টা বেজে ওঠে। টিফিনের সময় উত্তীর্ণ হয়েছে।

চাঁদের অমাবস্যা – সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চাঁদের অমাবস্যা – ৭

সাত

সে-রাতে পড়ানোর অধিবেশন শেষ হলে যুবক শিক্ষক কুদ্দুসকে বলে, ‘কাদের মিঞাকে ডেকে দেবে?’

তারপর বারান্দার কালো-সাদা বরফি – ছককাটা মার্বেলের মেঝের দিকে তাকিয়ে সে নিশ্চলভাবে দাঁড়ায়। সে বুঝতে পারে, ছেলেমেয়েরা কৌতূহলভরে তার দিকে চেয়ে আছে, কিন্তু তার শীর্ণমুখে কোনো ভাবান্তর ঘটে না। তার আচরণ-ব্যবহার আর তার ক্ষমতাধীন নয় যেন। কেবল কুদ্দুসের যেতে দেরি হচ্ছে দেখে তার চোখে অস্থিরতার ঈষৎ আভাস জাগে।

বারান্দা অবশেষে খালি হলে সে পূর্ববৎ নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। দরজার ওপর দেয়ালঘড়িটা সশব্দে বাজে, ওপরতলা থেকে দাদাসাহেবের খড়মের আওয়াজ আসে। তারপর সে পদধ্বনিও থামে। প্রগাঢ় নীরবতায় তার বুকের স্পন্দন ঘড়ির আওয়াজের মতো জোরালো হয়ে ওঠে।

গতরাতেই সে বুঝতে পারে, দেখার চেষ্টা না করলে হয়তো কাদেরের সঙ্গে বহুদিন দেখা হবে না। এমনিতে দেখা হবার সুযোগ-সুবিধা কম। যুবক শিক্ষক নিজে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শিক্ষকতার কাজে ব্যস্ত থাকে। দীর্ঘ দিনব্যাপী ইস্কুল আছে, দু-বেলা ছেলেমেয়েদের পড়াতেও হয়। অতএব সে স্ব-ইচ্ছায় দর্শন না দিলে তার সঙ্গে সাক্ষাতের সম্ভাবনা দৈবাৎ ঘটনার মতোই অনিশ্চিত। এ ক-দিন সে অপেক্ষায় থেকেছে, কিন্তু তার দেখা পায় নাই। স্পষ্ট বোঝা যায়, কাদেরের মনে তার সঙ্গে দেখা করার কোনো ইচ্ছা নাই। থাকলে সে আসত। কাদেরের এ-নিস্পৃহতার কোনো অর্থ সে বোঝে না। তার রহস্যময় ব্যবহারের ফলে যুবক শিক্ষকের মনে তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে যে- তীব্র ব্যাকুলতার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সযত্নে সাজানো নানা প্রশ্ন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। প্রশ্নগুলি আর দরকারিও মনে হয় না। তার সঙ্গে একবার দেখা হলেই সে যেন তার উত্তর পাবে, মনেরও নিদারুণ বিহ্বলতা কাটবে।

আজ মগরেবের নামাজের সময় দাদাসাহেবের দিকে তাকিয়েই সাক্ষাতের আশায় বসে থাকার নিষ্ফলতা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে সে। বড়বাড়িতে কেবল দাদাসাহেবই কাদের সম্বন্ধে সচেতন। নামাজের আগে তাঁর ঈষৎ অনুসন্ধানী দৃষ্টি চোখে পড়লে যুবক শিক্ষক বোঝে, তিনি তারই সন্ধান করছেন। প্রায় দু-সপ্তাহ সে নামাজে যোগদান করে নাই। তার অনিশ্চিত মতিগতি তিনি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন বটে তবু সে এলে তিনি খুশিই হন। আজ সে আসে নি দেখে তিনি ক্ষুণ্ণ হন। সে ক্ষুণ্ণতা লক্ষ করে যুবক শিক্ষক তাঁর সঙ্গে একটা আন্তরিক যোগাযোগ বোধ করে। ফলে, মনে কেমন সবলতা আসে। সে-মুহূর্তেই সে স্থির করে, আজ রাতেই কাদেরকে ডেকে পাঠাবে। দাদাসাহেব নীরবে দিনের পর দিন তার জন্যে অপেক্ষা করতে পারেন, কিন্তু সে পারে না। আকণ্ঠ নিমজ্জিত মানুষের পক্ষে কারো জন্যে অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ভাঙন ধরেছে, কাদেরের সঙ্গে দেখা না হলে সে ভাঙন জোড়া লাগবে না। তারই নির্দেশে একটি অতিশয় অস্বাভাবিক কাজে সে তাকে সাহায্য করেছে, গভীর রাতে একটি নারীর মৃতদেহ বহন করেছে। বাক্স-পেটরা নয়, মেজ-কুর্সি নয় : মানুষের মৃতদেহ। তাকে কি কাদেরের কিছুই বলার নাই? সে হয়তো ব্যাপারটির অর্থ জানে, কিন্তু যুবক শিক্ষক জানে না। হয়তো তার পক্ষে সে ব্যাপারে বিস্তৃত হয়ে আবার গতানুগতিক জীবনযাত্রায় নির্বিঘ্নে মনোনিবেশ করা সম্ভব, যুবক শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব নয়।

অবশেষে কুদ্দুসের চটির আওয়াজ কানে আসে। এবারও যুবক শিক্ষকের মুখে কোনো ভাবান্তর ঘটে না; কিন্তু উত্তরের তীব্র প্রত্যাশায় তার সমস্ত দেহ পাথরের মতো শক্ত হয়ে ওঠে। তারপর সে-শক্ত আবরণের মধ্যে একটি দুর্বল হৃৎপিণ্ড থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। কুদ্দুস যখন সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন সে তার দিকে তাকায় না। কেবল প্রশ্ন করে, ‘কী?’

‘কিছু বললেন না।’

যুবক শিক্ষক উত্তরটির অর্থ যেন বোঝে না। ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে কুদ্দুসের দিকে তাকায়। সেখানে কোনো ব্যাখ্যা দেখতে না পেলে অকারণে খোলা দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। বারান্দায় অখণ্ড নীরবতা।

‘শুধু বললেন, কেন। বললাম, জানি না।’ একটু ইতস্তত করে কুদ্দুস বলে। একটু থেমে সে আবার বলে, ‘যাই?’

যুবক শিক্ষক কোনো উত্তর দেয় না। প্রশ্নটি হয়তো শোনে না। তারপর সে নিজেই বারান্দা অতিক্রম করে বেরিয়ে যায়।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যুবক শিক্ষকের মনে এ বিশ্বাস জন্মায় যে, কিছু না বলার অর্থ সে আসবে না তা নয়। সাক্ষাতের জন্যে অনুরোধটি তার কানে পৌঁছেছে, এবার সময় করে সে আসবে। হয়তো একটু রাত হলে আসবে। লণ্ঠনের আলোটা কিছু কমিয়ে দরজাটি সামান্য খোলা রেখে চৌকির ওপর বসে যুবক শিক্ষক অপেক্ষা করতে শুরু করে। রাত তখন ইতিমধ্যে গভীর হয়ে উঠেছে।

মধ্যরাত গড়িয়ে গেলেও কাদেরের কোনো চিহ্ন দেখতে না পেলে সে দরজা খুলে একবার বড়বাড়ির দিকে তাকায়। চাঁদ তখন উঠেছে, তবে আজ তার আলো নিস্তেজ। সে-আলোয় অন্ধকারাচ্ছন্ন বড়বাড়ি ফ্যাকাসে দেখায়। সেখানে কেউ জেগে নেই। কতক্ষণ সে বড়বাড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল জানে না, অকস্মাৎ এক সময় সামনের দৃশ্য মুছে গিয়ে তার চোখের সামনে আগুনের নৃত্য শুরু হয়েছে। সে বুঝতে পারে, হঠাৎ একটি দুর্দান্ত ক্রোধ তাকে গ্রাস করেছে। যে-মানুষের প্রতি দু-বছরব্যাপী অস্পষ্ট কৌতূহল, অবিশ্রাম উদাসীনতার পর হঠাৎ শ্রদ্ধা-ভক্তি, এমনকি কেমন একটা বন্ধুত্বের ভাব জেগেছে, সে-ই এ ক্রোধের কারণ। কিছুক্ষণ পর দরজায় খিল দিয়ে সে বিছানায় ফিরে আসে। ক্রোধ তখনো পড়ে নাই। নিষ্ফল ক্রোধ সহজে মিটতে চায় না।

এক সময়ে সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়ে। যখন আবার জেগে ওঠে, তখন সে কান পেতে কিছু শোনবার চেষ্টা করে, কিন্তু রাত্রির গভীরতায় কোনো আওয়াজ শুনতে পায় না। নীরবতা শূন্যতার মতো অন্তহীন মনে হয়। এ-নীরবতা কখনো যেন ভাঙে নাই, ভাঙবেও না। ক্রমশ একটি অবাস্তব ভাব এসে তার সময়-কালের চেতনাবোধ লুপ্ত করে দেয়। সে না ঘুমিয়ে অন্ধকারে চোখ খুলে নিঃসাড় হয়ে শুয়ে থাকে।

অবশেষে সে-চেতনাহীনতা থেকে ক্ষীণভাবে তার মনে একটি প্রশ্ন জাগে। সমস্ত ঘটনাটি কি একটি বিচিত্র দুঃস্বপ্ন? চমকিত হয়ে প্রশ্নটি সে ভেবে দেখে। যত ভাবে ততই তার সত্যাসত্য সম্পর্কে সন্দেহ থাকে না। তাই ঘটনাটি আগাগোড়া একটি অত্যাশ্চর্য স্বপ্ন। কাদেরকে ডেকে পাঠালে সে কুদ্দুসকে জিজ্ঞাসা করেছিল কেন সে দেখা করতে চায়। তার প্রশ্নের অর্থ এবার সে বুঝতে পারে।

এ নোতুন জ্ঞান লাভে প্রথমে সে অস্থির হয়ে উঠে বসে। তার কি মস্তিষ্ক সুস্থ নয়? ঘরের কোণে সুরাহি থেকে পানি ঢেলে সে গলা সিক্ত করে, দু-চারবার পায়চারি করে, তারপর আবার চৌকিতে ফিরে এসে বসে। না, ঘটনাটি দুঃস্বপ্ন, দু-রাতব্যাপী দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন। সে-দুঃস্বপ্নের কথা সে ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি জানে না। জানা সম্ভব নয়। সে জন্যেই কাদের জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন

দুঃস্বপ্ন বাস্তবরূপ ধারণ করলেও তাতে কিছু অবাস্তবতা, কিছু যুক্তিহীনতার ছাপ না থেকে পারে না। ঘটনাটিতে এবার সে যে শুধু অবাস্তবতার সুস্পষ্ট ছাপ দেখতে পারে তা নয়, স্থানে স্থানে অযৌক্তিকতা তার কাছে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

প্রথমত, হত্যাকারীর আচরণ। হত্যাকারী বাঁশঝাড়ে বসে যুবক শিক্ষকের জন্যই অপেক্ষা করে। সে যখন জানতে পারে, বাঁশঝাড়ের বাইরে সে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন সে যুবতী নারীর জীবনাবসান করে। তারপর সে চাঁদের আলোয় হাওয়ার মতো মিলিয়ে যায়। বাইরে কে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে? বড়বাড়ির আত্মভোলা দরবেশ ধরনের মানুষ, কাদের। সে-ও তারই জন্যে অপেক্ষা করে যেন। স্বপ্নে ছাড়া এমন ঘটনা কি সম্ভব? স্বপ্নে কাদেরের আবির্ভাবের কারণও সে বুঝতে পারে! কাদের নাকি দরবেশ। বিস্ময় কী, সে-ই সে স্বপ্নের একটি বিশিষ্ট চরিত্র হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে?

‘সবটাই দুঃস্বপ্ন। অত্যাশ্চর্য দুঃস্বপ্ন।’ যুবক শিক্ষক আপন মনে ঘোষণা করে। স্বপ্নে যে সে প্রায় সারারাত ছুটোছুটি করেছে পাগলের মতো, সে কথা স্মরণ হলে তার একটু হাসিও পায়। না, সে নয়, যুক্তি বিচার-বুদ্ধি থেকে স্বপ্নই পালিয়ে বেড়াচ্ছিল।

‘আষাঢ়ের গল্পের মতো স্বপ্ন।’ এবার সে অস্ফুট কণ্ঠে বলে ওঠে। তারপর সে কৌতুকভরে স্বপ্নটির বিশ্লেষণকার্য নিয়ে অগ্রসর হয়।

দুঃস্বপ্নের সেখানেই কি শেষ! আষাঢ়ে গল্পের শেষ নাই : যার যুক্তি নাই, তার সমাপ্তিও নাই।

বড়বাড়ির কাদের যে নিষ্কর্মা হলেও কারো সাতে পাঁচে নাই, দরবেশ না হোক তব আপন খেয়ালেই থাকে—সে-ই পরদিন রাতে তার ঘরে এসে হাজির হয়। সামাজিকতা বা প্রতিবেশীর সঙ্গে একটু গল্পগুজবের তাগিদে নয়, একটি ব্যাপারে সাহায্যের প্রয়োজন বোধ করে বলে। নিষ্কর্মা হলেও যে-মানুষ সম্ভ্রান্ত বংশজাত এবং ভদ্রলোক, সে বলে, দয়া করে চলুন, বাঁশঝাড়ের মৃতদেহটি নদীতে ফেলে দিয়ে আসি। দু-বছরে তার সঙ্গে কখনো আলাপ-সালাপ হয় নাই, প্রস্তাবটাও অতি বিস্ময়কর, তবু বড়বাড়ির মানুষ তারই সাহায্যপ্রার্থী হয়ে এসেছে, কী করে না করে? দ্বিরুক্তি না করে গায়ে আলোয়ান জড়িয়ে সে কাদেরের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। অবশ্য কার্যান্তে কাদের চন্দ্রালোকের মধ্যে মিলিয়ে যায়। স্বপ্নটি হয়তো তাকে বেশিক্ষণ ধরে রাখা সমীচীন মনে করে না। ধরে রাখলে যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন উঠতে পারে, সে ভয় আছে।

‘অদ্ভুত স্বপ্ন।’ যুবক শিক্ষকের বিস্ময় কাটে না।

সেখানেই স্বপ্নের জের শেষ হয় না। স্বপ্নের ফেনিয়ে গল্প বলার আত্যন্তিক নেশা কাটে না। যুবক শিক্ষকের মতো উর্বরমস্তিষ্ক কল্পনাপ্রবণ খদ্দের পেয়ে সহজে কি তাকে হাতছাড়া করে?

নদীতে দেহটি নিক্ষেপ করার ব্যাপারে সাহায্য-সহায়তার আদর্শ উদাহরণের পর দিন-দুপুরে ইস্কুল পর্যন্ত ছুটে যেতে স্বপ্নটি দ্বিধা করে না। যখন তার সহযোগীর টিফিনের সময় গল্পগুজব করে, তখন বিশ্রাম ঘরের এক কোণে বসে নিদ্রাভিভূত হয়ে সে স্বপ্নে দেখে নদীপথ, স্টিমারের সন্ধানী-আলো, পুলের ওপর দাঁড়িয়ে সারেঙ্গ মোল্লার মতো সারেঙ্গ, এক সহযোগী যার দীর্ঘ বিবরণ দেয়। কিন্তু স্বপ্নের পক্ষে পথভ্রষ্ট হওয়া অতি স্বাভাবিক। একটু ঘুরে-ফিরে আসল কথায় ফিরে আসে নদীবক্ষে যুবতী নারীর দেহটির আবিষ্কার

একটি কথা ভেবে যুবক শিক্ষক কিছু ভাবিত হয়। তার মনে পড়ে, স্বপ্নের শেষভাগে সহযোগীদের প্রতি সে নিদারুণ ঘৃণা বোধ করেছিল। সে জানত না, তার মনের অন্তরালে মানুষের প্রতি এমন ঘৃণা লুক্কায়িত। এ-গোপন ঘৃণার পরিচয় পেয়ে সে ক্ষণকালের জন্যে শঙ্কাই বোধ করে। এ-ঘৃণার উৎপত্তি কোথায়?

প্রশ্নটির উত্তর না পেলে সে স্বপ্ন-বিশ্লেষণকার্যে প্রত্যাবর্তন করে। যুবক শিক্ষক স্বীকার করে, এখানে- সেখানে অযৌক্তিকতা থাকলেও ঘটনার অনুক্রম বিন্যাসের ব্যাপারে এবং বিষয়বস্তুর কাঠামোতে আপাতদৃষ্টিতে স্বপ্নটির মধ্যে কোনো দোষঘাট নজরে পড়ে না। সে জন্যে তার কালোস্রোতে সে ভেসে যেতে পেরেছে, তাকে বাস্তব ঘটনা বলে গ্রহণ করতে তার দ্বিধা হয় নাই। না, সে-সব অযৌক্তিকতা স্বপ্নটির প্রধান দুর্বলতা নয়; তার প্রধান দুর্বলতা অন্যত্র। সে-দুর্বলতাটি এখন সে বুঝতে পারে বলেই স্বপ্নটির অসত্যতা তার চোখে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।

স্বপ্নটির সে চরম দুর্বলতা তার আসল উদ্দেশ্যের মধ্যেই নিহিত। একটি অপঘাত মৃত্যুর কথা বলে দর্শকের মনের ভীতি-আঘাত জাগানোই তার আসল উদ্দেশ্য নয়, কারণ অপরিচিতা একটি নারীর এমন দুর্ভাগ্যের কথায় মনে যতই ভীতি-আঘাতের সঞ্চার হোক না কেন, তা তেমন গভীর বা স্থায়ী হওয়া সম্ভব নয়। অপঘাত-মৃত্যুটি উদাহরণ মাত্র, একটি সাংঘাতিক উপসংহারে পৌঁছাবার উপাদান। উপসংহারটি হল, মানুষের জীবনের প্রতি মানুষের নির্দয় নিষ্ঠুর উদাসীনতা। সেটাই স্বপ্নের মর্মকথা। স্বপ্নটির আসল উদ্দেশ্য যে সফল হয়েছে তার প্রমাণ যুবক শিক্ষকের বিপর্যস্ত মন। যুবতী নারীর মৃত্যুর সঙ্গে যে-নৃশংসতা জড়িত সে-নৃশংসতা নয়, মনুষ্যত্বহীন ভয়াবহ সে-মর্মকথাই তাকে এমন গভীরভাবে বিচলিত করেছে।

যুবক শিক্ষক এখন বুঝতে পারে, সে-মর্মকথাই স্বপ্নটির প্রধান দোষ, প্রধান দুর্বলতা। নানাবিধ গাল্পিক কারুকার্যের মধ্যে কৌশলে লুকানো যে-অসত্যের ওপর স্বপ্নটি স্থাপিত, সেদিকে একবার দৃষ্টি পড়লে স্বপ্নটি স্বপ্নেরই মতো ধূলিসাৎ হয়, যে-বৃক্ষটি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে সত্যরূপ ধারণ করেছিল, মূল নেই বলে সে – বৃক্ষটি নিমেষেই ধরাশায়ী হয়। বাস্তব জীবনে মানুষ মানুষের প্রতি এমন নির্দয়-নিষ্ঠুরভাবে উদাসীন নয়।

যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে না কী করে স্বপ্নটি তাকে এমনভাবে সম্মোহিত করতে পেরেছিল যে সে প্রশ্ন না করে তার হাতে বন্দি হয়ে থেকেছে, দিনের আলোতেও তার হাত কবল থেকে মুক্তিলাভ করতে পারে নাই। এর অর্থ কি এই যে, তার মন অতিশয় দুর্বল? অথবা, মনের অদৃশ্য কোনো অংশে অতি গোপনে সে কি নিজেই এমন অদ্ভুত বিশ্বাস পোষণ করে? তীব্র ঘৃণার পরিচয় পেয়ে সে সামান্য শঙ্কিত হয়েছিল : এবার তার শঙ্কার অবধি থাকে না।

কিন্তু দুঃস্বপ্ন অবশেষে দূর হয়েছে এ-জ্ঞানে তার মনে যে-গভীর স্বস্তির ভাব দেখা দেয়, তাতে সব শঙ্কা ভেসে যায়। একটি কুৎসিত সর্বধ্বংসী জন্তুর শ্বাসরোধ-করা- আলিঙ্গন থেকে অবশেষে সে মুক্তিলাভ করেছে। সে আর কিছু ভাবতে চায় না। সব উৎকণ্ঠা—উদ্বেগ কেটেছে বলে সারা দেহমন কেমন অপরিসীম ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়, তবু সে ক্লান্তি অতি মধুর, অতি সুখদায়ক মনে হয়। না, সে আর কিছুই ভাবতে চায় না। গভীর তৃপ্তির সঙ্গে সে অনুভব করে, একটি আরামদায়ক ক্লান্তি স্রোতের মতো বইছে এবং তাতে তার চিন্তাশক্তি তলিয়ে যাচ্ছে। কেবল তাতে বাষ্পের মতো হাল্কা উষ্ণ একটি কৃতজ্ঞতার ভাব ভেসে থাকে। সে-কৃতজ্ঞতা এই জন্যে যে, মানুষের ভাগ্য খামখেয়ালি এবং নির্মম হলেও মানুষ মায়ামমতাশূন্য নয়, অতি নিস্পৃহের নিকটও অন্যের জীবন মূল্যহীন নয়।

যুবক শিক্ষকের শীর্ণ-শুল্ক দেহের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে আবার মোহময় জীবিতাশা প্রবাহিত হয়। অন্ধকার ঘরে বাঁশের দেয়ালের ছিদ্রে ছিদ্রে বাইরের চন্দ্রালোক চিকন কারুকার্য বিস্তার করেছে। সে-দিকে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তার মনে প্রার্থনার মতো ভাব আসে, সঙ্গে-সঙ্গে তার চোখ একটু সজল হয়ে ওঠে। মনে মনে ভাবে, স্নিগ্ধ-সুন্দর চাঁদের পৃষ্ঠদেশ মানুষ দেখতে পায় না। তার অন্ধকার অংশে যদি কদর্যতা-নিষ্ঠুরতা থাকে, তা যেন কেউ কখনো না দেখতে পায়।

তার মাথার তলে তুলায় ঠাসা ছোট বালিশের এক কোণে রঙিন রঙের সুতায় তৈরি একটি গোলাপ ফুল। তারই পাশে এবার দু-এক ফোঁটা চোখের পানি নিঃশব্দে ঝরে পড়ে। মনে-মনে সে আবার বলে, কোনো দুঃস্বপ্নও যেন কখনো সত্য না হয়।

অবশেষে শ্রান্ত যুবক শিক্ষক ঘুমিয়ে পড়ে।

ঘরের কোণে দড়িতে একটি লুঙ্গি ঝোলে। তার কোণটা একটু ছেঁড়া। গতকাল লুঙ্গিটি সে ধুয়েছে কিন্তু ছেঁড়া অংশটি সেলাই করবার সময় পায় নাই।

দ্বিতীয় রাতে বাঁশঝাড়ে অপেক্ষাকৃত নূতন লুঙ্গিটির সে-দশা ঘটে।

চাঁদের অমাবস্যা – সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চাঁদের অমাবস্যা – ৮

আট

এক সময়ে দরজায় করাঘাত শুরু হয়। প্রথমে আস্তে, সন্তর্পণে; তারপর হঠাৎ সে- করাঘাত কেমন দ্রুত এবং জোরালো হয়ে ওঠে। নিঃসন্দেহে বাইরে-দাঁড়ানো মানুষটি ধৈর্যহারা হয়ে পড়েছে।

যুবক শিক্ষকের ঘুমটা আলগোছে ভাঙে বলে তার মনে হয় সে জেগেই ছিল। করাঘাতে সে বিচলিত হয় না : সে-করাঘাত বিরক্তিকর কিন্তু তার দরজায় নয় যেন। অন্ধকারের মধ্যে চোখ খুলে পাশের দেয়ালের দিকে সে তাকিয়ে থাকে। সেখানে সূক্ষ্ম কারুকার্যের নক্শা কখন অদৃশ্য হয়ে গেছে।

তারপর কাদেরের কণ্ঠস্বর এবং করাঘাত যুগপৎ শোনা যায়। এবার যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে, কোনটা সত্য কোনটা অসত্য, কোনটা বাস্তব কোনটা অবাস্তব সে-বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন। কিন্তু সিদ্ধান্তে পৌঁছুবার আগেই তার দেহ একটি গভীর অবসাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, মনে একটা অস্পষ্ট আশঙ্কার উপস্থিতি সম্বন্ধেও সে সচেতন হয়।

দরজা খুললে বাইরে কাদেরের ছোটখাটো কিন্তু প্রশস্ত দেহটির ছায়া জেগে ওঠে। তাকে উপেক্ষা করেই যেন যুবক শিক্ষক একবার আকাশের দিকে তাকায়। রঙটা ঠিক ধরতে পারে না। না কালো না ধূসর; না আলো না অন্ধকার। সময় নির্ধারণ করা যেন সম্ভব নয়। তারপর শীতটা লাগে বলে দরজাটা ভেজিয়ে দেয়।

ঘরের অন্ধকারের মধ্যে কাদের অনুচ্চ কিন্তু কেমন হুকুমের কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘বাতি জ্বালান।’

যুবক শিক্ষক নীরবে বাতি জ্বালানোর কাজে মনোনিবেশ করে। প্রথমে দেশলাই খুঁজে পায় না; এখানে- সেখানে হাতড়ায়। অবশেষে দেশলাইটি যখন খুঁজে পায় তখন সে বুঝতে পারে, তার হাত একটু কাঁপতে শুরু করেছে। কিন্তু কেন? সে নিজেই বিস্মিত হয়। এতক্ষণে তার মনে আর কোনো সন্দেহ নাই যে, সে ডাকিয়ে পাঠিয়েছে বলেই কাদের এসেছে। সময়টা হয়তো একটু বেখাপ্পা, কিন্তু তার এ-আবির্ভাবের আর কোনো কারণ নাই।

লণ্ঠনের মৃদু আলোয় ঘরের অন্ধকারটা অবশেষে কাটে। মশারি সরিয়ে কাদের বিছানার কোণে বসে। একবার তাদের চোখাচোখি হয়। তারপর কাদের কতক্ষণ নিশ্চল হয়ে বসে থেকে অকস্মাৎ আঙ্গুল মট্‌কাতে শুরু করে। দশ আঙ্গুল থেকে দশাধিক আওয়াজ বের করে সে পকেট থেকে সিগারেটের বাক্স বের করে একটি সিগারেট ধরায়। মুহূর্তের মধ্যে তার গন্ধে ছোট ঘরটি ভরে ওঠে।

যুবক শিক্ষকের মুখে এখনো কথা সরে না। একবার সে ভাবে কাদেরকে জিজ্ঞাসা করে, কত রাত হয়েছে, কিন্তু কথাটি জানা নিষ্প্রয়োজনীয় মনে হয়। তবু তার কেমন সন্দেহ হয়, কাদের অন্য কোনো সময়ে এলেই ভালো হত। তাকে ডেকে পাঠাবার কারণটি সে যেন নিজেই এখন বুঝতে পারে না। তাই হয়তো মনে কেমন ভয়। তার হাত দুটিতে ঈষৎ কম্পন এখনো থামে নাই।

অসংযত মনকে সংযত করবার চেষ্টা করে সে ভাবে, ভয়ের কিছু নাই। কাদেরকে ডেকে পাঠিয়েছিল, সে এসেছে। সেটাই বড় কথা। যার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে এ ক’দিন সে এমন ব্যাকুল হয়ে ছিল, সে এখন দু-হাত দূরে বসে। ভয়ের কারণ কী?

যে-বিশ্বাসটি নিয়ে সে শুয়ে পড়েছিল, তার কথা একবারও মনে হয় না। সেটি যেন সব-ভুলানো রূপকথা, যার মধ্যে তার বিহ্বল মন একটু শান্তির জন্যে আশ্রয় নিয়েছিল। এখন যে-কঠিন সত্যের সামনে সে দাঁড়িয়ে, সেখানে তার স্থান নাই।

তবু সত্য কী? যাকে সে ডেকে পাঠিয়েছে সে তাকে ডেকে পাঠানোর কারণ জিজ্ঞাসা করলে কী উত্তর দেবে? ক-দিনব্যাপী মনের গভীর বিপর্যস্ততা সত্যে পরিণত করা কি সম্ভব?

কাদের কোনো কথা না বললে যুবক শিক্ষক অবশেষে স্বস্তিই বোধ করে। আড়চোখে তার দিকে একবার তাকায়। অভ্যাসমতো লণ্ঠনের দিকে তাকিয়ে সে’ নিশ্চল হয়ে বসে, ভুবনভুবর্লোকে তার যেন কিছুই বলবার নাই। হয়তো কিছুক্ষণ এমনি বসে থেকে এক সময়ে হঠাৎ উঠে চলে যাবে। যুবক শিক্ষক ভাবে, সেটাই ভালো হবে। ব্যাখ্যা-কৈফিয়তের, প্রশ্ন-উত্তরের প্রয়োজন উঠবে না। না, সে কিছুই জানতে চায় না। যে-অন্ধকারাচ্ছন্ন গোলকধাঁধাঁয় সে প্রবেশ করেছে, সে-গোলকধাঁধা হতে সে বের হতে চায় না। অন্ধকারই শ্রেয়, কারণ অন্ততপক্ষে অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পায় না।

নীরবতার মধ্যে হঠাৎ যেন একটা আওয়াজ হয়। চমকিত হয়ে যুবক শিক্ষক কাদেরের দিকে তাকায়। সে তারই দিকে তাকিয়ে। হাতে খোলা সিগারেটের বাক্স।

‘সিগারেট খাবেন?’

যুবক শিক্ষকের সিগারেটের অভ্যাস নাই। একটু পরে ক্ষুদ্রকণ্ঠে সে উত্তর দেয়, ‘না।’

কাদের আরেকটি সিগারেট ধরায়। হয়তো কল্পনা, কিন্তু যুবক শিক্ষকের মনে হয়, কাদের কেমন অস্থির অস্থির বোধ করে। কিন্তু তার অর্ধনিমীলিত চোখের দিকে তাকিয়ে অস্থিরতার কোনো আভাস দেখতে পায় না। বরঞ্চ সেখানে যেন গভীর বিষাদের ছায়া। তারপর যুবক শিক্ষক অকস্মাৎ স্বচ্ছন্দ বোধ করতে শুরু করে। না, ভয়ের কোনোই কারণ নাই। বাস্তবজগতে যদি ভীতির কারণ থাকে তা এখন অতি দূরে, দিগন্তরালে কোথাও হবে। তবু দূরগত সে-ভীতি যদি তার মনে বন্ধুত্ব – সান্ত্বনার জন্যে ক্ষুধা সৃষ্টি করে থাকে, তবে কাদেরই তা মেটাতে পারে। হয়তো কাদেরের মনেও বন্ধুত্ব-সান্ত্বনার জন্যে তেমনি ক্ষুধা। সেও কি এ-ক’দিন মানসিক কষ্ট-যন্ত্রণা ভোগ করে নাই? দু-জনেরই বন্ধুত্বের বিশেষ প্রয়োজন। তারা একটি গুপ্তকথার মালিক। সে-গুপ্তকথা একাকী বহন করা যদি কষ্টসাধ্য হয়, তবে বন্ধুত্বের সাহায্যেই তারা তা অনায়াসে বহন করবে, মনের বিহ্বলতাও জয় করতে পারবে।

লণ্ঠনের পতেটা বাঁকা বলে কাচের একপাশ ক্রমশ কালো হয়ে ওঠে, শীঘ্র তার অনুজ্জ্বল আলো আরো অনুজ্জ্বল হয়ে উঠবে। তারা কি অন্ধকারের জন্যে অপেক্ষা করছে?

না, সত্যিই সে কিছুই জানতে চায় না। কাদেরের উপস্থিতিতেই সে সন্তুষ্ট। মনে যদি কোনো ইচ্ছা বোধ করে সে-ইচ্ছা কাদেরকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে, তাকে তার বন্ধুত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত করবার জন্যে। জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস মানুষের সহানুভূতি, সহৃদয়তা, স্নেহমমতা। সে-বিষয়ে নিশ্চিত হলেই মানুষ বিভীষিকা-নিষ্ঠুরতার দিকে নির্ভয়ে তাকাতে পারে।

একটু হেসে দুঃসাহসীর কণ্ঠে যুবক শিক্ষক সজোরে বলে, ‘দিন্ একটা সিগারেট।’

সিগারেট হাতে নিয়ে কৌতুকভরে কিছুক্ষণ সেটি নেড়েচেড়ে দেখে, মুখে হাসি-মাখা দুষ্টু ছেলের কৃত্রিম ভাব।

‘একবার বিড়িতে দু-একটা টান দিয়েছিলাম।’

ধূমপানের ব্যাপারে সে যে একেবারে অজ্ঞমূর্খ মানুষ নয়, সে কথা প্রকাশ করে সে আনাড়ির মতো সিগারেটটি জ্বালায়। প্রথম টানেই তার শ্বাসরোধ হবার উপক্রম হয়, তবু সে পিছপা হয় না। মনে হয়, অন্তরটা যেন আরো স্বচ্ছন্দ হয়ে ওঠে। তাছাড়া এ-কথাও সে অনুভব করে যে, দুজনের মধ্যে যেন বন্ধুত্বের পুল পড়ছে।

‘মাথা ঘুরছে।’ সে-টি যে অতিশয় আনন্দেরই বিষয় তা কণ্ঠভঙ্গিতে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়ে এবং তাতে বিন্দুমাত্র না দমে, সে ঘন ঘন ফুঁকতে থাকে : দৃষ্টি সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ থেকে নড়ে না। কাদের নীরব হয়েই থাকে। সে-নীরবতা সম্বন্ধে সে সচেতন না হয়ে পারে না।

‘ইস, সত্যিই চরকির মতো মাথাটা ঘুরছে।’ আবার মহা-উল্লাসে তার মস্তিষ্কের অবস্থার কথা ঘোষণা করে সে এবার একগাল ধোঁয়া ছাড়ে। মনে-মনে ভাবে, কী করে কাদেরকে এ-কথা বলে যে সত্যিই সে কিছু জানতে চায় না? সত্য হলেও সব স্বপ্ন বলে মেনে নিতে সে রাজি। যা ঘটেছে তা ঘটেছে—তা বিস্মৃতির মধ্যে বিলীন হয়ে গেলে ক্ষতি কী? অন্ততপক্ষে আজ কোনো কথাই সে তুলতে চায় না।

‘কী করে রোজ এত সিগারেট খান?’ কৃত্রিম শ্রদ্ধা- বিস্ময়ে যুবক শিক্ষক মন্তব্য করে। কাদের জবাব দেয় না।

হঠাৎ যুবক শিক্ষক বোঝে, এ ভাঁড়ামিপনা অর্থহীন, তাতে কাদের বিন্দুমাত্র আমোদ বোধ করছে না। আড়চোখে সে আবার তাকায় তার দিকে। তার চোখ প্রায় নিমীলিত। তবে তার কারণ যে নিদ্রা নয়, তা বুঝতে তার দেরি হয় না। কাদেরের মুখে একটি অস্বাভাবিক কাঠিন্য।

কাদের কি তার উৎফুল্লতা এবং ভাঁড়ামিতে বিরক্ত হয়েছে? নিঃসন্দেহে সে একটু ভাঁড়ামি করেছে বটে কিন্তু সে ভাঁড়ামির কারণ আকস্মিক সুখবোধ। তার উৎফুল্লতায় কিছুটা কৃত্রিমতা যদি দেখা দিয়ে থাকে তার কারণ উৎফুল্লতা তার চরিত্রের স্বাভাবিক অঙ্গ নয় : সে জানে না তা কী করে প্রকাশ করতে হয়। অবশ্য সে কাদেরের বিরক্তির কারণ বোঝে। তার বিষাদাচ্ছন্ন মনে এ-মাত্রাহীন ভাঁড়ামি ও উৎফুল্লতা নিশ্চয়ই অত্যন্ত বিসদৃশ ঠেকেছে। উৎফুল্ল হবার কোনোই কারণ নাই। নদীর বুকে যুবতী নারীর দেহটি আবিষ্কার করে তারা কি তার সব পরিকল্পনা পণ্ড করে নাই?

সিগারেটের কথা ভুলে গিয়ে যুবক শিক্ষক কতক্ষণ নিশ্চল হয়ে বসে থাকে। ঘরে প্রগাঢ় নীরবতা। সে-নীরবতার মধ্যে এবার যুবক শিক্ষকের মনে হয়, বিভীষিকাময় যে-অবাস্তব জগৎ থেকে সে মুক্তি পেয়েছে বলে কল্পনা করেছিল, সে- অবাস্তব জগৎ‍ই তার চারধারে পূর্বের মতোই তাকে ঘিরে আছে। গভীর হতাশার সঙ্গে সে ভাবে, সত্যিই সে কিছুই জানতে চায় নাই। এখনো সে জানতে চায় না। কাদের যদি তাকে তার বন্ধুত্বের সামান্য প্রমাণ দিত তবে ভাঁড়ামির কোনো প্রয়োজন বোধ সে করত না। কাদের কি বুঝতে পারে না বন্ধুত্বের জন্যে তার মনের এ তীব্র আকাঙ্ক্ষা? পরিকল্পনাটি নিঃসন্দেহে কাদেরেরই, তবু তার সংসাধনকার্যে পরম-বিশ্বাসীর মতো দ্বিরুক্তি না করে তাকে কি সে সাহায্য করে নাই? কিন্তু শুধু বিশ্বাসেই দিন কাটানো যায় না। কিছু পরিষ্কারভাবে না জেনে একাকী সে-ভার কী করে সে বহন করে? সে-ভার ক্রমশ আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।

কেমন কঠিন গলায় কাদের হঠাৎ ডাকে, ‘মাস্টার!’

এ-নামে সে যুবক শিক্ষককে কখনো ডাকে নাই। বস্তুত আজ পর্যন্ত কোনো নামেই সে তাকে সম্বোধন করে নাই। চমকিত হয়ে সে কাদেরের দিকে তাকায়। তবে সেখানে বন্ধুত্বের ক্ষীণতম আভাস সে দেখতে পায় না।

তারপর এক মুহূর্তের জন্যে কাদেরের চোখ যেন ঝলকে ওঠে। পূর্ববৎকণ্ঠে সে আবার বলে, ‘আপনার মতলব কী?’

প্রশ্নটি যেন আকাশ থেকে পড়ে, বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো। তার মতলব? বিস্ময়ের ধমকটা কাটলে সে অনুচ্চস্বরে বলে, ‘আমার মতলব?’

কাদের তার প্রশ্নের কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন বোধ করে না বলে নীরব হয়ে থাকে। কিন্তু তার ভাব দেখে মনে হয়, সে যুবক শিক্ষকের কাছে এটি অর্থপূর্ণ উত্তর আশা করে।

যুবক শিক্ষক কোনো উত্তরই খুঁজে পায় না। কাদেরের অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটি তাকে যে ব্যথা দিয়েছে, কেবল সে ব্যথাই সে অনুভব করে। অনেক ভেবেও প্রশ্নটির যথার্থ কোনো কারণ দেখতে পায় না।

কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে কাদের একবার এক পলকের জন্যে চোখ খুলে যুবক শিক্ষকের দিকে তাকায়। তারপর আবার প্রশ্ন করে, ‘ডাকাডাকি করতে শুরু করছেন কেন?’

নুতন প্রশ্নটিও যুবক শিক্ষক নীরবে শোনে। অতি সহজবোধ্য প্রশ্ন, তবু তারও অর্থ সে বুঝতে পারে না। তবে পূর্বের প্রশ্নের মতো এ-প্রশ্নটিও তাকে আঘাত দেয়। না, তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের পুল তো পড়েই নাই, বরঞ্চ তারা প্রশস্ত নদীর দু-পাড়ে দাঁড়িয়ে। পাশে বসে থাকা কাদেরের চেহারাটা হঠাৎ অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। না, এ-লোকটিকে সে চেনে না।

একটু পরে দুর্বলকণ্ঠে সে উত্তর দেয়, ‘ডেকেছি এ কারণে যে আমি কিছুই বুঝতে পারি না।’

একটু ভেবে কাদের প্রশ্ন করে, ‘কী বুঝতে পারেন না?’

যুবক শিক্ষকের দুর্বলকণ্ঠের ওপর দিয়ে হঠাৎ দমকা হাওয়া বয়ে যায়। সজোরে মাথা নেড়ে সে উচ্চস্বরে বলে, ‘কিছুই বুঝতে পারি না।’

এই কথার পুনরাবৃত্তিতে কাদের সন্তুষ্ট হয় না। তার মুখে বিরক্তির ভাব দেখা দেয়। কণ্ঠেও সে বিরক্তি প্রকাশ পায়।

‘কী বুঝতে পারেন না?’

যুবক শিক্ষক এবার বিহ্বল হয়ে পড়ে। সে যেন শক্ত ফাঁদে পড়েছে, যে-ফাঁদ থেকে সে অক্ষতদেহে বের হতে পারবে না। কিছুক্ষণ আগে যার সঙ্গে সে একটা বন্ধুত্বের সম্ভাবনা কল্পনা করে কেবল তার উপস্থিতিতেই সুখবোধ অনুভব করতে শুরু করেছিল, সে-ই তাকে এ-ফাঁদে ফেলেছে। সে বন্ধু না হোক, শত্রু হবে কেন? না, তাকে কিছুই বলা যায় না। যা সে বুঝতে পারে না তা যেন অতি মূল্যবান। তা ব্যক্ত করা যায় না। একটু হাওয়া লাগলেই তা ভেঙে যাবে।

‘কথা বলছেন না কেন?’

আবার কাদেরের কঠিন গলা তার কর্ণগোচর হয়। এবার তার গলায় সে বিচলিত হয় না। কাদেরের প্রশ্নের উত্তর দেবার কোনোই প্রয়োজন সে বোধ করে না। কাদের তার সঙ্গে যেন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তার অন্তরটা অভিমান- ক্রোধে জমে যায়।

নাকে বিরক্তি-ক্রোধের আওয়াজ করে কাদের এবার চুপ হয়ে যায়। তাকে ডেকে পাঠিয়ে যুবক শিক্ষকের এ অদ্ভুত ব্যবহার তার কাছে অর্থহীন মনে হয়।

কিছুক্ষণ নীরবতার পর কাদেরের মনোভাবে হয়তো কিছু পরিবর্তন হয়। যুবক শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে সে আস্তে বলে, ‘শোনেন।’

যুবক শিক্ষক যে শোনবার জন্যে তৈরি তার কোনো প্রমাণ না পেলেও একটু থেমে আবার বলে, ‘মানুষের জীবনটা অতি ভঙ্গুর। একটুতেও মটকে যায়।’

এ-গভীর দার্শনিকোচিত উক্তিটি যুবক শিক্ষকের কানে গেল কি গেল না, তা বোঝা যায় না। সে তেমনি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। একটু থেমে কাদের আবার বলে, ‘একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, কী আর করা যায়? ডাকাডাকি করে আর লাভ কী?’

এবারও যুবক শিক্ষক নির্বাক হয়ে বসে থাকে। কিন্তু ক্রমশ তার বসে থাকার ভঙ্গিতে পূর্বের অভিমান-ক্রোধের কঠিনতা যেন মিলিয়ে যায়। মনে হয়, সে যেন গভীরভাবে ভাবছে। এমন একটা নিগূঢ় কথা যার রহস্য ভেদ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়, তারই রহস্য ভেদ করবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। না, ঠিক তা নয়। একটি কথা তার মাথায় ঢোকবার চেষ্টা করছে, তাকে ঠেকিয়ে রাখবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু সে-কথাটি তার চেয়েও বেশি শক্তিবান। তাকে ঠেকাবার চেষ্টায় সে কেবল গলদঘর্ম হয়ে ওঠে।

সে-কথাকে ঠেকানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। যে-টুকু শক্তি ছিল সে-শক্তিও নির্বিবাদে অন্তর্ধান করেছে। কী দিয়ে সে তার সঙ্গে লড়াই করবে? লড়াইর ছলনা পরিত্যাগ করতেই গভীর অবসাদে তার দেহমন ভরে ওঠে।

বাইরে উঠানে মৃদু আলোর আভাস দেখা দিয়েছে। ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে সেদিকে একবার অকারণে তাকিয়ে কাদের কেমন হৃদ্যতার সঙ্গে বলে, ‘বুঝলেন?’

যুবক শিক্ষক সবই বোঝে। প্রথম থেকেই সে সব কথা বুঝেছিল, কিন্তু মন স্বীকার করতে চায় নাই। ঘটনার নৈকট্যে তা না বুঝে উপায় ছিল না, কিন্তু কিছু সময় পেরিয়ে গেলে কথাটা মন আর মানতে চায় নাই। তারপর থেকে সে সত্যকে এড়াবার জন্যে বাঁদরের মতো কল্পনার গাছের এক শাখা থেকে অন্য শাখায় ঝুলে ঝুলে বেড়াচ্ছে। সত্যটি গ্রহণ করা কি এত সহজ? একবার গ্রহণ করলে চিরকালের জন্যে জীবনে একটা ফাটল ধরবে না? তারপর কি পৃথিবী সে-ই পৃথিবী থাকবে?

‘বুঝেছি।’ অকস্মাৎ ঘন-ঘন মাথা নেড়ে যুবক শিক্ষক বলে।

বোঝা কি অতই শক্ত ব্যাপার? বোঝা-না-বোঝার মধ্যে ব্যবধান অতি সামান্য। চুলের মতো সরু সীমারেখার ওপারেই সত্য। এধারে আশা-ভরসা, ওধারে হতাশা-নিরাশা। পা বাড়ালেই ওধারে চলে যাওয়া যায়, তবু সে সীমারেখা সে অতিক্রম করতে চায় নাই। সীমারেখাটি যাতে অতিক্রম করতে না হয় তার জন্যে সে কাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করেছে, তাকে অশেষ গুণাগুণেও আবৃত করেছে যাতে সে-প্রয়াসে সে সফল হয়।

আবার ঘন-ঘন মাথা নেড়ে যুবক শিক্ষক আপন মনে বলে, ‘কেন বুঝব না? আপনি আমার আত্মীয়-কুটুম্ব বা দোস্ত মানুষও নন, বুঝতে বাধা কী?’ শুধু তা-ই নয়, তার সঙ্গে যুবক শিক্ষকের পরিচয়ও ছিল না। মুখ দেখাদেখি হয়েছে বটে, কিন্তু কখনো কথার আদান-প্রদান হয় নাই। তবু কথাটা সে বিশ্বাস করতে চায় নাই। আত্মীয়স্বজন বা বন্ধ মানুষ না হোক, পরিচয়ও না থাক, একটি মানুষের সম্বন্ধে এমন কথা বিশ্বাস করা কি সোজা?

যুবক শিক্ষকের আচরণে কাদেরের স্থৈর্য একটু টলে ওঠে যেন। ইতস্তত করে সে বলে, ‘কী বুঝেছেন!’

‘বুঝেছি, বুঝেছি।’ আবার যুবক শিক্ষক দ্রুতভাবে মাথা নেড়ে বলে, কণ্ঠে এবার কোনো দুর্বলতার চিহ্ন নাই। সে এ-কথা বুঝে তৃপ্তি পায় যে, বঞ্চনার আঘাতের ফলে মনে যে একটি অসহনীয় তিক্ততার ভাব এসেছিল, সে ভাব এখন ক্রোধে চাপা পড়েছে। এখন ক্রোধ দাউ-দাউ করে জ্বলছে, এবং সে-ক্রোধে সে গভীর তৃপ্তিই পায়। বারবার একটি কথা মনে পড়ে, বারবার সে-ক্রোধ ফুঁসে ওঠে। কী দুঃসাহস! যাকে কাদের হত্যা করেছে, তার দেহ নদীতে ফেলবার জন্যে তারই সাহায্য নিতে তার একটু দ্বিধা হয় নাই? বুকে কত সাহস! শীর্ণদেহ যুবক শিক্ষক আগুনের লেলিহান শিখায় যেন দীর্ঘকায় হয়ে ওঠে, তার রক্তহীন শুষ্ক মুখ যেন অত্যুজ্জ্বল রূপ ধারণ করে। না, শুধু দুঃসাহস নয়। অন্য মানুষের প্রতি কী অবজ্ঞা! যুবক শিক্ষক যেন তুচ্ছ কীটপতঙ্গ। এত ক্রোধ সত্ত্বেও যুবক শিক্ষক নিষ্কম্পকণ্ঠে বলে, ‘আপনার সাহসের সীমা নাই।’

কাদের কথাটি বুঝবার চেষ্টা করে। তারপর কী বুঝে উত্তর দেয়, ‘ভয় পেলে মানুষ কী না করে? মানুষের গলার আওয়াজ পেলে জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। বললাম না দুর্ঘটনা? দুর্বল সুতায় জীবন বাঁধা। জীবন কী?’

যুবক শিক্ষক উত্তর দেয় না। মনে হয় কাদেরের কোনো কথা তার শ্রবণেন্দ্রিয় গ্রহণ করতে রাজি নয়। তার কথার কি আর কোনো মূল্য আছে?

তার মানসিক অবস্থা দেখে কাদেরের মনে এবার হয়তো কিছু ভয়ের সঞ্চার হয়। তার এ বিচিত্র আচরণের কোনো অর্থই খুঁজে পায় না। কিন্তু যুবক শিক্ষককে আর কী বলবে? সে নীরব হয়ে থাকে।

ক্রোধ অবশেষে উপশমিত হলে যুবক শিক্ষক কতক্ষণ নিঃস্ব বোধ করে। তারপর অস্ফুটকণ্ঠে বলে, ‘যান, বাড়ি যান।’ কাদেরের উপস্থিতিতে সে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছে।

কাদের যাবার কোনো লক্ষণ দেখায় না। তাকে একটু অন্যমনস্ক মনে হয়। তারপর হঠাৎ সে অপ্রত্যাশিতভাবে কথা বলতে শুরু করে। অনেকটা আপন মনেই। তাছাড়া, কেমন ইশারা-ইঙ্গিতেই বলে যেন। মনের কথা খুলে বলার তীব্র ইচ্ছা বোধ করলেও সব খুলে বলতে যেন বাধে। হয়তো যা বলে তার অর্থ সে নিজেই বোঝে না। প্রথমে সে আশ্বিন মাসের কথা বলে। কেন সে মাসের কথা বলে তা প্রথমে পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় না। কিন্তু একটু নীরব থেকে কথাটি বোধগম্য করে। আশ্বিন মাসেই যুবতী নারীর সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়।

যুবক শিক্ষক তার কথা শুনেও শোনে না। শুনে লাভ কী? যে-কথাটি সে জানতে পেরেছে তারপর আর কোনো কথা জানার প্রয়োজন সে বোধ করে না। যে-কলুষতা সে সমগ অন্তরে সমগ্র দেহে বোধ করে সে-কলুষতা কোনো কথায় কি কাটবে? তাছাড়া, কাদেরের কণ্ঠস্বর তাকে পীড়া দেয়।

আশ্বিন মাসের কথাটার উল্লেখ করেই চার মাস ডিঙিয়ে কাদের সেদিনের বাঁশঝাড়ের ঘটনায় এসে পৌঁছায়। হয়তো সে চার মাসে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটে নাই, ঘটলেও তার আর কোনো মূল্য নাই। বাঁশঝাড়ের কথা বলতে-বলতে তার বলার ভঙ্গিটা কিছু সাবলীল হয়ে ওঠে।

শীঘ্র তাকে বাধা দিয়ে যুবক শিক্ষক আবার বলে, ‘যান, বাড়ি যান।’

এবার নীরব হয়ে কাদের কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে। তারপর কালো মুখে কিন্তু সহিষ্ণুকণ্ঠে বলে, ‘ঘটনাটা বুঝিয়ে বলছি।’

এ-উক্তিটা যুবক শিক্ষকের অসহ্য মনে হয়। কী তাকে সে বোঝাবার চেষ্টা করছে? যে-কথাটি জানতে চায় নাই বা বিশ্বাস করতে চায় নাই, সে কথা সে জানতে পেরেছে। তারপর বাকি সব কি অর্থহীন নয়? কাদের যে-কথা এখনো পরিষ্কারভাবে বোঝে নাই, সে- কথাই সে এবার তাকে বলে।

মুহূর্তের মধ্যে কাদেরের মুখে গভীর বিস্ময়ের সঞ্চার হয়। ক্ষিপ্রগতিতে ঘুরে সে কতক্ষণ যুবক শিক্ষকের দিকে বিচিত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অবশেষে সে প্রশ্ন করে, ‘আপনি জানতেন না?’

যুবক শিক্ষক উত্তর না দিলেও শীঘ্র কাদেরের মুখ ক্রোধে বিকৃত হয়ে ওঠে, তার স্বাভাবিক গভীর স্থৈর্য ভীষণভাবে টলে ওঠে। সে যে হত্যাকারী সে-কথা যুবক শিক্ষক জানত না? এবং সে-কথা সে নিজেই তাকে বলেছে?

যুবক শিক্ষক এবার চিৎকার করে ওঠে, ‘যান যান।’ তার মনে হয়, কাদেরের দেহ থেকে কলুষতা সমাপ্তিহীন ধারায় তার মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে, আর তার উপস্থিতি সহ্য করা অসম্ভব।

কাদের আপন ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে আরো কিছুক্ষণ বসে থাকে। এক সময়ে আর দ্বিরুক্তি না করে সে উঠে চলে যায়। সে কোনোদিকে তাকায় না।

বাইরে উঠানে তখন সূর্যের প্রথম সোনালি রশ্মি পড়েছে, দূরে মাঠে কুয়াশাও জমতে শুরু করেছে। যুবক শিক্ষক বোধ করে তার গলা-মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। অত্যধিক তৃষ্ণায় তার ভেতরটা যেন জ্যৈষ্ঠের রোদপোড়া মাঠের মতো চড়চড় করে।

ঘরের কোণে সুরাহিতে শীতল পানি। কিন্তু সে নড়ে না।

আপন মনে সে প্রশ্ন করে, অবশেষে সে কি অবাস্তব জগৎ থেকে প্রত্যাবর্তন করেছে?

বাস্তব জগতে সে যদি প্রত্যাবর্তন করে থাকে, তবে সেখানেও অতৃপ্তির জ্বালার শেষ নাই যেন।

চাঁদের অমাবস্যা – সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চাঁদের অমাবস্যা – ৯

নয়

রবিবার সকাল। বেলা ন’টার দিকে যুবক শিক্ষককে আসতে বলে দাদাসাহেব নিচের তলার বারান্দায় খোলা জানালার পাশে রোদে পিঠ দিয়ে বসেন। হাতে তসবি, মুখভাব গম্ভীর। একটু পরে পায়ের মৃদু শব্দ শুনতে পেলে সেদিকে না তাকিয়ে বলেন, ‘বসেন।’

অদূরে হাতল ছাড়া কাঠের চেয়ারে সঙ্কুচিত হয়ে যুবক শিক্ষক বসে, মনে অস্বচ্ছন্দতা। কেন তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন? গত ক’দিনে শিক্ষকতার ব্যাপারে তার কোনো গাফিলতি হয়েছে কি? বা তার বিসদৃশ আচরণ-ব্যবহারের খবর তাঁর কাছে পৌঁছেছে কি? এসব ব্যাপারে তিনি যদি প্রশ্ন করেন তবে সে কী বলবে? সকালবেলা কাদেরের মুখে সত্য কথাটি জানবার পর একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে তার দেরি হয় নাই। কিন্তু পরে আরেকটি কথা সে বুঝতে পারে। সে-কথাটি ভেবে দেখা দরকার। না, গত ক’দিনের কথা দাদাসাহেবকে বলবার জন্যে এখনো সে তৈরি নয়।

অবশেষে দাদাসাহেব গলা সাফ করেন। তারপর অস্পষ্টকণ্ঠে যুবক শিক্ষককে তার বাড়ির খবর জিজ্ঞাসা করেন। শ্রদ্ধাভরে সেও একটি উপযুক্ত উত্তর দেয়।

সামান্য নীরবতার পর দাদাসাহেব পুনর্বার গলা সাফ করেন। তারপর তসবিতে তাঁর আঙ্গুল সঞ্চালন থেমে যায়।

‘আমার ছোটভাই কাদের মিঞার সঙ্গে আপনার নাকি দেখাসাক্ষাৎ হয়। শুনে বড়ই খুশি হলাম।’

তিনি বলেন না যে আজ সকালে ওপরের জানালা দিয়ে কাদেরকে যুবক শিক্ষকের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে স্বচক্ষে দেখেছেন। কাদেরকে কেমন রাগান্বিত মনে হয়েছিল। দু-জনের মধ্যে অকস্মাৎ এই মেলামেশার কারণ কী, যুবক শিক্ষকের ঘর থেকে এমন রাগান্বিতভাবে সে বেরিয়ে আসবেই-বা কেন? ক’দিন আগে কাদেরের বিচিত্র দৃষ্টির কথা এখনো তিনি ভোলেন নাই।

গভীর বিশ্বাস-ভরা কণ্ঠে—যে কণ্ঠ সম্পূর্ণ খাঁটি মনে হয় না, তিনি আবার বলেন, ‘তার ভাবসাব সাধারণ মানুষের মতো নয়।’ সামান্য ইতস্তত করে কথাটা বলেই ফেলেন। ‘একটু দরবেশী ভাব আছে তার মধ্যে।’

যুবক শিক্ষক নত মাথায় তাঁর কথা শোনে, কিন্তু কিছু বলে না। কাদেরের বিষয়েই তিনি যে তাকে ডেকে পাঠাবেন, সে-কথা সে ভাবে নাই। হয়তো এখন সে তার সম্বন্ধে কিছু বলতে প্রস্তুত নয় বলেই সে-কথাটি ভাবতে পারে নাই। না, এই মুহূর্তে কিছু বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বাঁশঝাড়ের সত্যটি সে জানতে পেরেছে বটে কিন্তু সে সত্যটি যেন অতিশয় নগ্ন। বস্তুত, তা এত নগ্ন যে তাতে না আছে সম্পূর্ণ সত্য, না আছে তার প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর। সব কথা জানার আগে তার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব নয়।

দাদাসাহেবকে একটু অপ্রস্তুত মনে হয়। তাঁর পক্ষেও কাদেরের কথা তোলা সহজ হয় নাই। তিনি বড়বাড়ির মুরুব্বি। বয়স বা আত্মীয়তার ধরন যাই হোক, সে-বাড়ির প্রত্যেক বাসিন্দার প্রতি তিনি যে শুধু একটি গভীর দায়িত্ব বোধ করেন তা নয়, তাদের সঙ্গে একটা আন্তরিক যোগাযোগও বোধ করেন। কোথায় কার দোষত্রুটি, কোথায় কার গুণ বা গুণের সম্ভাবনা, সে-সব তাঁর অজ্ঞাত নয়। এমনকি প্রত্যেকের হৃদয়ের কথাও তিনি জানেন বলে তাঁর বিশ্বাস। এ-বিষয়ে কেবল কাদেরের ক্ষেত্রেই একটা ব্যতিক্রম বোধ করেন। সে জন্যে এবং তার সম্বন্ধে তাঁর চিন্তার শেষ নাই বলে অনাত্মীয়ের সামনে তার কথা তোলা তাঁর পক্ষে সহজ নয়।

যুবক শিক্ষক নীরব হয়ে থাকলে তিনি এবার অনিশ্চিতকণ্ঠে প্রশ্ন করেন, ‘আপনাদের মধ্যে কী আলাপ হয়?’

যুবক শিক্ষক ক্ষিপ্রদৃষ্টিতে দাদাসাহেবের দিকে একবার তাকায়। বর্তমান মানসিক অবস্থার জন্যে প্রশ্নটি সরলভাবে গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। কাদের যে দরবেশ সে-বিশ্বাসটি তাঁর মনে কি এতই দৃঢ় হয়ে উঠেছে যে তিনি তার প্রমাণের জন্যে এমন উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন, না তার সম্বন্ধে তাঁর মনে কোনো প্রকার সন্দেহ উপস্থিত হয়েছে?

কারণ যা-ই হোক, তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেয়া তার পক্ষে এখন সত্যিই সম্ভব নয়। তার মনে সন্দেহ নাই, শীঘ্র তাঁকে বাঁশঝাড়ের ঘটনাটি বলতে হবে, কিন্তু যে-নগ্ন সত্যটি আজ সকালে সে জানতে পেরেছে, তাতে সে তৃপ্ত নয়। যে-ঘটনাটি তার মনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল, নিঃসন্দেহে সে ঘটনাটির রহস্য ঘুচেছে : নানাপ্রকার কল্পনা-অনুমানের জটিল জাল থেকে মুক্তি পেয়ে তা একটি স্পষ্টরূপ ধারণ করেছে। তবু কাদেরের মুখে যা জানতে পেরেছে, তা একটু ভেবে দেখতেই তার মনে এ ধারণা জন্মে যে, এখনো সব কথা জানা হয় নাই। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে জানার পূর্বে দাদাসাহেবকে এমন একটি নিদারুণ কথা কী করে বলে?

আজ সকালে কাদের স্বীকার করেছে, সে-ই যুবতী নারীর হত্যাকারী। তবে সেটি ঠিক হত্যা নয়, একটি দুর্ঘটনা। বাঁশঝাড়ের বাইরে যুবক শিক্ষকের পদধ্বনি এবং পরে তার গলার শব্দ শুনতে পেলে হঠাৎ ভয়ে দিশেহারা হয়ে সে যুবতী নারীর গলা টিপে ধরেছিল। হত্যার উদ্দেশ্যে নয়, তার মুখের আওয়াজ বন্ধ করার জন্যে। মুখ না ঢেকে গলা টিপে ধরেছিল কেন সে তা বলতে পারে না : তখন তার জ্ঞান-বুদ্ধি ছিল না। আসল অপরাধী সে সংজ্ঞাবুদ্ধিগ্রাসী মারাত্মক ভয়। সে-নিদারুণ ভয়ের কারণ কী? তার পরিবারের সুনাম। এককালে যে-পরিবারের এত নামডাক ছিল, সে পরিবারের আজ আগের মতো ধন-দৌলত না থাকলেও ধার্মিকতা দান-দয়া-নিষ্ঠার জন্যে এখনো অনেক সুনাম। কাদের সে পরিবারেরই মানুষ। যে-পরিবার নিষ্কলঙ্কভাবে দীর্ঘদিন সুনামের সৌরভ ছড়িয়েছে, তার সে-সুনামে কলঙ্কের ছাপ বসাতে কার বুকে সাহস হয়? কথাটা অবিশ্বাস্য ঠেকে না।

কাদের যখন বুঝতে পারে একটি ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, তখন সে বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু অল্পদূর যাবার পর তার মনে একটা সন্দেহ জাগে : সত্যই কি কোনো মানুষের শব্দ সে শুনেছিল? শীতের এমন গভীর রাতে কে আসবে বাঁশঝাড়ে? যুবতী নারীর স্বামীর কথাই কেবল তার মনে আসে কিন্তু সে যে গ্রামে নাই সে-বিষয়ে সে নিশ্চিত। সে কি ভুলবশত এমন মর্মান্তিক কাণ্ড করে বসেছে?

কথাটা পরখ করে দেখবার জন্যে নির্বোধের মতো সে বাঁশঝাড়ের সামনে এবার ফিরে আসে। পরিস্ফুট চন্দ্রালোকে এধার-ওধার চেয়ে দেখে, কেউ কোথাও নাই। এমন সময় সে যুবক শিক্ষককে বাঁশঝাড় থেকে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে আসতে দেখে। সে যেন তারই দিকে তাকিয়ে। শুধু তাই নয়। সে তারই দিকে আসছে। পালাবার কোনো সময় নাই, মুক্তস্থানে গা-ঢাকা দেবারও কোনো উপায় নাই। কাঠের পুতুলের মতো হতভম্ব হয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে। সেখানে তার উপস্থিতির একটা কৈফিয়ৎ বের করার চেষ্টাও করে কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য কোনো কৈফিয়ৎ খুঁজে পায় না। তারপর যুবক শিক্ষক তার সামনে এসে দাঁড়ায় কিন্তু সে কোনো প্রশ্নই করে না। কয়েক মুহূর্ত তার দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ সে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে পালিয়ে যায়। সে যেন ভূত দেখেছে।

এবার কাদের দুটি কথা বুঝতে পারে। প্রথমত, যুবতী নারী যে এখনো বেঁচে থাকতে পারে সে-কথা আশা করা বৃথা। দ্বিতীয়ত, সে-ই যে হত্যাকারী সে কথা যুবক শিক্ষক জানে। বস্তুত, তাকে উদ্ভ্রান্তের মতো মাঠে-ঘাটে ছুটাছুটি করতে দেখলে সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না। তবু কথাটা সামনাসামনি একবার যাচাই করে দেখবার জন্যে পরে সে তারই ঘরে এসে উপস্থিত হয়। সেখানে সে একটি অতি ভীত-বিহ্বল, বাকশূন্য মানুষ দেখতে পায়। সন্দেহের কোনোই অবকাশ থাকে না।

এ-বিবৃতিতে অবিশ্বাস্য কিছুই নাই : নিঃসন্দেহে তার প্রতিটি শব্দ সত্য। প্রথম রাতের বিবরণটি এতই নিখুঁত যে তাতে কোনো ছিদ্র নাই, প্রশ্ন-জেরার স্থান নাই। অস্পষ্টতা দেখা দেয় দ্বিতীয় রাতের বিবরণে।

যুবতী নারীর দেহটি নদীতে ফেলার ব্যাপারে কাদের যুবক শিক্ষকের সাহায্যপ্রার্থী হয়েছিল কেন? কথাটির কোনো ব্যাখ্যা কাদের দেয় নাই। তখন প্রশ্ন করার কোনো প্ৰয়োজন বোধ করে নাই বলে যুবক শিক্ষকও তাকে সে-বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করে নাই। এখন বিষয়টির ব্যাখ্যা শিক্ষকের কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মনে হয়। চারটি সম্ভাব্য উত্তর তার দৃষ্টিগোচর হয়। এক—বাঁশঝাড়ের ঘটনার পর কাদেরের মনে নিশ্চয়ই গভীর বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। হয়তো একটি ঘোরতর পাপ বোধে সে জর্জরিত হয়ে পড়ে। তখন একটি বিচিত্র যুক্তির সাহায্যে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, যুবক শিক্ষক মৃতদেহটির বহনকার্যে অংশগ্রহণ করলে সে-পাপের খানিকটা তার মধ্যে স্থানান্তরিত হবে। দুই—তার এই বিশ্বাস হয় যে, যুবতী নারীর মৃত্যুর সঙ্গে যুবক শিক্ষক জড়িত, কারণ বাঁশঝাড়ে সে উপস্থিত না হলে দুর্ঘটনাটি ঘটত না। অতএব দেহ বহনকার্যে সাহায্য করা তার কর্তব্য। তিন— যুবতী নারীর মৃত্যুর কথা যুবক শিক্ষক ছাড়া অন্য কেউ জানে না। পরদিন সে কথাটা প্রকাশ করে নাই সত্য কিন্তু ভবিষ্যতে করবে না সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। দেহটির বহনকার্যে তার কাছ থেকে একবার সাহায্য আদায় করতে পারলে তার মুখ বন্ধ করা সহজ হবে। দুর্বলচিত্ত লোকটি সাহায্য করতে রাজি না হতে পারে, সে-সম্ভাবনা নিশ্চয়ই কাদেরের মনে জেগেছে। হয়তো সে-ব্যাপারে তাকে বাধ্য করার ফিকির-ফন্দিও সে ভেবে নিয়েছিল। হয়তো তাকে ভয় দেখাত বা কোনো প্রকারে তার হৃদয় গলাবার ব্যবস্থা করত। কিন্তু কাদেরকে কিছুই করতে হয় নাই। দু-একবার ডাকতেই সে বিনাবাক্যে তার অনুসরণ করে। চার—ভয়াবহ কাজটি একা করতে সাহস পায় নাই। কাজটি একাকী সম্পন্ন করার লাভ নিশ্চয়ই তার চোখে পড়েছে। যুবক শিক্ষকের অগোচরে দেহটি একবার অদৃশ্য হয়ে গেলে সে কোনো অভিযোগ আনলেও সাক্ষীর অভাবে তা প্রমাণ করতে পারবে না। কিন্তু নির্জন রাতে বাঁশঝাড়ে একটি যুবতী নারীর সঙ্গে মিলিত হওয়া এক কথা, গভীর রাতে তার মৃতদেহটি বহন করা অন্য কথা। সে স্বভাবজাত খুনী-ডাকাত নয়।

ভীতি, স্বার্থপরতা, দুরভিসন্ধি ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্দেশ্য-অনুপ্রাণিত এর কোনটি সত্য?

আরেকটি কথাও কুজ্‌ঝটিকাবৃত মনে হয়। কী কারণে কাদের দেহটি নদীতে ফেলবে ঠিক করে? আজ সকালে সে-বিষয়টি সে স্পর্শই করে নাই।

হত্যাকাণ্ডের জের টানা বিপজ্জনক। দেহটি নিশ্চিহ্ন করার প্রয়োজনটা কি তার কাছে এতই জরুরি মনে হয়েছে যে সে দ্বিতীয় রাতে বিপজ্জনক কাজটি করতে দ্বিধা করে নাই? হয়তো পাপের ফল সম্পূর্ণভাবে অদৃশ্য না হয়ে-যাওয়া পর্যন্ত পাপী মনে শান্তি পায় না। এ- কথা যদি সত্যি হয় তবে কাদেরের চোখে যে-ব্যাপার একটি দুর্ঘটনা হিসেবে শুরু হয়েছিল, সেটি আর দুর্ঘটনা থাকে নাই, শীঘ্রই তা পাপে পরিণত হয়।

আজ সকালে ঘটনাটির নির্মম সত্য জানার পর যুবক শিক্ষকের মনে হয়েছিল : আর কোনো কথা জানার প্রয়োজন নাই। কিন্তু দেখতে-না-দেখতে নূতন অনেক প্রশ্ন তার মনে এসে উপস্থিত হয়েছে। কাদেরের গুরুতর অপরাধের কথা প্রকাশ করা তার কর্তব্য। কিন্তু কর্তব্যটির সঙ্গে একটি গভীর দায়িত্ব জড়িত মনে হয়। অপরাধটি প্রকাশ করা অতি সহজ কিন্তু সব কথা না জেনে কী করে সে তা প্রকাশ করে? তার মনে হয়, অপরাধের গুরুত্ব অপরাধের ফলের উপরই নির্ভর করে না। একটি যুবতী নারীর খুন অতি গুরুতর ব্যাপার। তারই ওজনে অপরাধ মেপে দেখা স্বাভাবিক। কিন্তু দুটির ওজন সমান না-ও হতে পারে। সব কিছু না বুঝে কথাটা প্রকাশ করলে কর্তব্যপালন হবে কিন্তু তাতে দায়িত্বহীনতাও প্রকাশ পেতে পারে।

তাছাড়া, সর্বপ্রথম তাকে ঘটনাটি পুরাপুরিভাবে বুঝতে হবে। সামাজিক কর্তব্যপালনের চেয়ে সেটাই তার কাছে বড় মনে হয়। অপরাধী কে সে কথা সে জানতে পেরেছে, কিন্তু অপরাধের অর্থ এখনো সে বোঝে নাই।

যুবক শিক্ষককে চুপ করে থাকতে দেখে দাদাসাহেব কিছু বিস্মিত হন। তাঁর মনে হয়, দরবেশীর কথাটা তুলে তিনি ভুল করছেন। যুবক শিক্ষক হয়তো সে-কথা বিশ্বাস করে না বলে কী উত্তর দেবে তা ভেবে উঠতে পারছে না। সে-বিষয়ে তাকে নিশ্চিত করার জন্যে এবার তিনি বলেন, ‘কাদের একা একা থাকে। আপনার সঙ্গে মেলামেশা করতে শুরু করেছে দেখে মনটা খুশি হয়েছে।’ তাদের মধ্যে কী আলাপ-আলোচনা হয় সে বিষয়ে তাঁর ঔৎসুক্যের কথা তিনি এবার উল্লেখ করেন না। একবার বলেছেন, দু-বার বলতে পারেন না। তারপর তাঁর মুখে একটি কৌতূহলশূন্যতার ভাব জাগে। সেটা কৃত্রিম মনে হয়।

হঠাৎ যুবক শিক্ষক মাথা তুলে বেদনার্ত দৃষ্টিতে দাদাসাহেবের দিকে তাকায়। তার সঙ্গে চোখাচোখি হলে সে ইতস্তত করে দৃষ্টি নাবিয়ে অস্ফুট গলায় বলে, ‘বেআদবি মাফ করবেন কিন্তু আজ কিছু বলতে পারব না।’

দাদাসাহেব এবার তাঁর বিস্ময় ঢাকবার চেষ্টা করেন না। তার উক্তিটা বুঝবার চেষ্টা করে গম্ভীরকণ্ঠে প্রশ্ন করেন, ‘কী কথা বলতে পারেন না?’

যুবক শিক্ষক চোখ না তুলে কয়েকবার কেবল ঘন-ঘনভাবে মাথা নাড়ে। দাদাসাহেবের দিকে তাকাতে বা তাঁকে আর কিছু বলতে তার সাহস হয় না। নিজের দৃষ্টিতে এবং কণ্ঠে সে- বিশ্বাস যেন হারিয়েছে। তার মনে হয়, আজ কিছু বলতে পারবে না এ-কথা বলেই সে ইতিমধ্যে অনেক কথা বলে ফেলেছে।

দাদাসাহেব আর কিছু বলেন না। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বারান্দা অতিক্রম করতে শুরু করেন। তাঁর খড়মের আওয়াজ আজ কেমন বেসুরো মনে হয়।

শঙ্কিত হয়ে যুবক শিক্ষক বোঝে, তার হাতে সময় আর বেশি নাই।

চাঁদের অমাবস্যা – সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চাঁদের অমাবস্যা – ১০

দশ

অপরাহ্ণে সামনের উঠানে ছেলেমেয়েরা শোরগোল করে খেলা করে। দাদাসাহেব বাড়িতে নেই। সম্ভবত তাঁর পীরের সঙ্গে দেখা করতে শহরে গেছেন।

চৌকিতে লম্বা হয়ে শুয়ে থেকে যুবক শিক্ষক এক সময়ে হঠাৎ উঠে বসে। শোরগোলটা যেন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে উঠেছে। পাম্প-সু পায়ে দিয়ে সবুজ আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সে দ্রুতপদে নদীর দিকে হাঁটতে শুরু করে। মেঘহীন আকাশে নিরুত্তপ্ত সূর্যের মধুবর্ষী সোনালি আলো। হাওয়া নেই বলে নিশ্চলতা, তবু চতুর্দিকে আলো আর রঙের নিঃশব্দ ঘূর্ণিঝড়। সেদিকে যুবক শিক্ষকের দৃষ্টি নাই। তারপর নদীর তীরে পৌঁছে সে অনিশ্চিতভাবে থামে। নদীর নিস্তেজ মসৃণ ধারায় এবং ওপারে কাশবনের শুভ্র বিন্যাসেও সোনালি আভা। এ- সবও সে দেখে না। তার নিদ্রা-তৃষ্ণার্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি একটি তীব্র আশায় জ্বলজ্বল করে। কোথায় সে যেন আলো দেখতে পায় : তার প্রশ্নের একটি উত্তর যেন আলিঝালি চোখে পড়ে। তার সম্পূর্ণ রূপ দেখবার জন্যে সে অধীর হয়ে ওঠে। অনিশ্চিতভাবে থেমে পড়ে সে দাঁড়িয়েই থাকে।

সারা দুপুর একটি কথাই তার মনে বারেবারে ঘোরে : কী কারণে কাদের দেহটি নদীতে ফেলবে ঠিক করে? সে এ-কথার কোনো সন্তোষজনক উত্তর এখনো পায় নাই। আসল সত্য জেনেও যা সে জানতে পারে নাই, তা সে-উত্তরের মধ্যেই পাবে তাতে তার সন্দেহ নাই। সে-উত্তরটা হাতের নাগালে এসেছে। কেন কাদের বিপজ্জনক কাজটি করতে তৈরি হয়? হাতুড়ি দিয়ে প্রশ্নটিকে সে যেন বার বার পেটায়। তাতে যে স্ফুলিঙ্গ জাগে, সে-স্ফুলিঙ্গ তার চোখেও প্রতিফলিত হয়।

যুবক শিক্ষক অনেক কথাই নির্বিবাদে মেনে নিয়েছে। অকস্মাৎ অন্ধ ভয় হলে বুদ্ধি-বিবেচনাশক্তি হারিয়ে একটি মানুষ অন্য একটি মানুষের জীবন নিতে পারে। যত বীভৎস হোক, তবু সেটা দুর্ঘটনা বলে মেনে নেয়া যেতে পারে। সে-কথা যুবক শিক্ষক সম্পূর্ণভাবে মেনে নিয়েছে। এ-কথাও সে স্বীকার করে, জীবন অতি ভঙ্গুর! জীবন দুর্বল সুতায় বাঁধা। সামান্য অসাবধানতায় জীবনাবসান হতে পারে। কিন্তু কাদের কী কারণে দ্বিতীয় রাতে বাঁশঝাড়ে আবার ফিরে গিয়েছিল?

যুক্তিতে কোথাও একটা অসম্পূর্ণতা সে দেখতে পায়। জীবন ভঙ্গুর সে-কথা সে মানে, কিন্তু জীবনের মূল্য নাই সে-কথা সে মানে না। অন্ততপক্ষে যারা জীবনের মূল্য বোঝে, তারা যখন সে-কথা বলে তখন সে মানতে রাজি নয়। তার মনে হয়, সে-কথা মানলে জীবনের ভিত্তিই ধূলিসাৎ হবে, বেঁচে থাকার পশ্চাতে কোনো যুক্তিসঙ্গত অর্থ থাকবে না। না, জীবন মূল্যহীন নয়। অতএব কাদেরের উক্তিটি সম্পূর্ণভাবে সত্য নয়; তার স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপটি ধোঁকা মাত্র।

ভয়জাত আকস্মিক দুর্বলতার কথাও গ্রহণযোগ্য। নিদারুণ ভয়ে কাদের একটি জঘন্য কাজ করেছে। কিন্তু সে-দুর্বলতা সাময়িক মানসিক অবস্থা মাত্র : বিশেষ একটি মুহূর্তে মনের একটি বিশেষ অবস্থা। কিন্তু সে সাময়িক মানসিক অবস্থা সময়– কালনিরপেক্ষ চরম সত্য বলে মেনে নিলে একটি অতীব শোচনীয় সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে হয় : মানুষ পশুর চেয়েও অধম। কিন্তু তা সম্ভব নয়। সে-নিদারুণ অন্ধভীতির মুহূর্তটিই একমাত্র সত্য এবং তার পশ্চাতে বা সম্মুখে কিছু নাই, সে-কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। পূর্বের উক্তির মতো এ-উক্তিটিও সম্পূর্ণ সত্য নয়। অতএব, জীবনের ভঙ্গুরতা এবং সাময়িক মানসিক দুর্বলতা —যার অকস্মাৎ গোলযোগের ফলে একটি যুবতী নারীর জীবনাবসান ঘটে—সে দুটির একটিও নিরালম্ব সম্পূর্ণ সত্য বলে গ্রহণ করা যায় না।

যুবক শিক্ষকের চোখ ছুরির মতো ধারালো হয়ে ওঠে। তার শীর্ণ মুখেও প্রত্যাশার তীক্ষ্ণতা।

সে দৃঢ়ভাবে আপন মনে বলে, একটি মুহূর্তের কথা বলে কাদের তার চোখে ধুলা দিয়েছে। তাই সে-মুহূর্তের পেছনে সে তাকাতে পারে নাই; সে-নিদারুণ মুহূর্তে চোখ এমন ঝলসে যায় যে আর কিছু দেখা তার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। পেছনে সে তাকাতে পারে নাই বলেই কাদেরের দ্বিতীয় রাতের ব্যবহারের কারণও সে বুঝতে পারে নাই।

তারপর এক সময়ে যুবক শিক্ষকের শিরা-শিরায় আঁট হয়ে থাকা মুখে হয়তো বহুদিন পরে একটা ক্ষীণ হাসির আভাস দেখা দেয়। সে বুঝতে পারে, তার সন্ধান সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে, সে তার উত্তর পেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কাদেরের যে-চেহারা আজ প্রত্যুষে ঘৃণ্য মানুষের চেহারায় রূপান্তরিত হয়েছিল, সে চেহারাটি একটি নূতন রূপে তার মনশ্চক্ষুতে উদয় হয়। চেহারাটি একটি স্বল্পভাষী, গোপন স্বভাবের প্রেমিক মানুষের। সে জন্যেই যুবক শিক্ষকের মুখে ঈষৎ হাসির আভাস দেখা দেয়।

কাদের তার দুষ্কীর্তির চিহ্ন ধ্বংস করবার জন্যে যুবতী নারীর দেহটি নদীতে ফেলে নাই। একটি কারণেই মানুষ মানুষের অন্তিম ব্যবস্থা না করে পারে না। সে কারণ, প্রেম-ভালবাসা। যুবতী নারীর দেহটি পরিত্যক্ত জঞ্জালের মতো বাঁশঝাড়ে পড়ে থাকবে সে-কথা তার অসহ্য বোধ হয়েছে। না, প্রথম রাতের সে-নিদারুণ মুহূর্তের পেছনের ইতিহাস না জানলে দ্বিতীয় রাতের ঘটনা বোঝার উপায় নাই। যে-ব্যাপারটি দুর্বোধ্য মনে হয়েছিল, সে ব্যাপারটি এবার ছকে-ছকে মিলে যাচ্ছে : চিত্রটিতে আর ফাঁক নাই। এবার যুবক শিক্ষক শুধু যে দেহটি নদীতে ফেলার সিদ্ধান্তের কারণ বোঝে তা নয়, কাদের কেন তার সাহায্যপ্রার্থী হয়েছিল সে-কথাও সে পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে। একজন মানুষের সাহায্যের তার বিশেষ প্রয়োজন হয়েছিল বইকি। যুবতী নারী মৃত হলেও তার দেহটি অতি প্রিয়। একাকী তা বহন করার চেষ্টা করলে তার অযত্ন-অসম্মান হত, দেহটি টানা—হ্যাঁচড়া করতে হত, প্রতি মুহূর্তে এ-কথাও স্মরণ হত যে সে আর জীবিত নাই। কাদেরকে সাহায্য করার সময় যুবক শিক্ষক যেন দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু এখন ঘোর অন্ধকার থেকে কাদেরের উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। বারে বারে সে কি তাকে সাবধান হতে বলে নাই? এত সাবধানতার অর্থ কি এই নয় যে, যুবতী নারীর মৃতদেহেও একটু আঁচড় লাগবে তা তার সহ্য হয় নাই? তারপর, নদীর পাড় বেয়ে নাবতে গিয়ে যুবক শিক্ষক হুমড়ি খেয়ে পড়লে, এবং শেষ মুহূর্তে কাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম না হলে, কাদেরের মনে তার প্রতি যে তীব্র ঘৃণা জেগেছিল সে ঘৃণাও কি যুক্তিটিকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করে না? না, দেহটি তার কাছে অতি প্রিয় মনে না হলে পরের সাহায্য দরকার সে বোধ করত না। শুধু দুষ্কীর্তির প্রমাণ ধ্বংস করতে চাইলে কোনোপ্রকারে নিজেই অপ্রীতিকর কাজটি সম্পন্ন করত।

একটি গভীর স্বস্তিবোধে আপ্লুত হয়ে যুবক শিক্ষক ভাবে, বাঁশঝাড়ের দুর্ঘটনাটি নিঃসন্দেহে অতিশয় মর্মান্তিক কিন্তু তাতে এ-কথা প্রমাণিত হয় না যে, জীবন মায়ামমতাশূন্য নিঃসাড় প্রান্তর। দুর্ঘটনাটি অতিশয় শোচনীয়, কিন্তু সেটি মনুষ্যত্ববিবর্জিত নয়। তার বিশ্বাস প্রমাণিত হয়েছে; সে যে একটি অর্থহীন গোয়ার্তুমির জন্যেই কাদেরকে নিষ্ঠুর দুর্বৃত্ত বলে গ্রহণ করতে চায় নাই তা নয়। অবশ্য আজ সকালে ক্ষণকালের জন্যে কাদের সম্বন্ধে সে-অসত্য চিত্রটি সে গ্রহণ করেছিল বটে কিন্তু তার কারণ আকস্মিক আঘাত। আঘাতটি কাটলে কথাটি প্রত্যাখ্যান করতে তার দেরি হয় নাই।

একটি কথা ভেবে যুবক শিক্ষক কিছুটা ক্ষুণ্নই হয়। হত্যার মতো ভীষণ কথাটি কাদের দ্বিধা না করে স্বীকার করেছে, কিন্তু যুবতী নারীর প্রতি তার ভাবাবেগের কথা ইশারা-ইঙ্গিতেও ব্যক্ত করে নাই। কেন? যে-ভাবাবেগের জন্যে যুবক শিক্ষক তাকে এখন ক্ষমা করতে প্রস্তুত, সে-ভাবাবেগ কি এতই লজ্জাকর যে তার ক্ষীণতম উল্লেখও তার পক্ষে সম্ভব হয় নাই?

একটু ভেবে সে-বিষয়ে কাদেরের নীরবতার কারণ সে বুঝতে পারে। খাঁটি মানুষ অসঙ্কোচে দোষঘাট স্বীকার করে, কিন্তু হৃদয়ের সৌন্দর্য সহজে উন্মুক্ত করে না। তাছাড়া, সে- কথা যুবক শিক্ষককে বলবে কেন সে? ধরতে গেলে তাকে সে চেনেই না।

অপরাহ্ণ গড়িয়ে গেছে বলে সূর্যের সোনালি আভা অনুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তবু এবার সেদিকে উন্মুক্তদৃষ্টিতে তাকালে যুবক শিক্ষক বিস্মিত হয়। যেন সে ভেবেছিল মেঘাচ্ছাদিত কালো আকাশ দেখবে, কিন্তু দেখে নির্মল আলোর বিচ্ছুরণ। তার মনের তমসা সত্যিই কেটেছে!

সে-আলোর দিকে তাকিয়ে শীঘ্র যুবক শিক্ষক একটি মিষ্টি-মধুর চিত্র দেখে।

কাদের বলেছিল, আশ্বিন মাস। হয়তো আশ্বিনের প্রথমাংশ, ভাপসা গরমটা তখনো কাটে নাই। নদীতে ভরা যৌবন, খাল-বিল-পুকুরও কানায় কানায় ভরা। ছায়াশীতল পুকুরটির একটি পাড় কেমন উঁচু, যেন উদ্ধতভাবে ঘাড় তুলে দাঁড়িয়ে। সেখানে বসে কাদের। সামনে তেল-চকচকে মসৃণ ছিপ, অদূরে শান্ত পানিতে ফাত্রাটি স্থির হয়ে আছে। হয়তো পুকুরের অন্যধারে পানিতে ঝুলে থাকা বৃক্ষশাখায় একটি মাছরাঙাও নিশ্চল হয়ে বসে। রৌদ্রতপ্ত আকাশে চিল ওড়ে।

ফানার মতো আর মাছরাঙার মতো কাদেরও নিশ্চল হয়ে বসে। তার চোখ অর্ধনিমীলিত। কিন্তু তাতে কোনো নিদ্রালস ভাব নাই। থেকে থেকে কেমন একদৃষ্টিতে পুকুরের অন্যদিকে সে তাকায়। সেখানে একটি যুবতী নারী দেহ-নিমজ্জিত করে অলসভাবে পানির শীতলতা উপভোগ করে। তার সিক্ত কালো চুলে প্রখর সূর্যের প্রতিফলন, পাশে একটা লাল রঙের আঁচল ভাসে। কাদেরের দিকে সে পেছন দিয়ে থাকে বলে তার মুখটা দেখা যায় না। কিন্তু কখনো কখনো সে ক্ষিপ্রদৃষ্টিতে কাদেরের দিকে তাকায়। চকিতে-দেখা তার মুখের পাশটা আর তার নীরব কটাক্ষ কাদেরকে প্রতিবার গভীরভাবে বিচলিত করে। যুবতী নারীর যৌবনদীপ্ত মুখে এখনো কৈশোরের সজীবতা, আকর্ষণময় চেহারায় নির্মল সরলতা।

তারপর যুবতী নারী অনেকক্ষণ মুখ ফেরায় না। পানির তলে ধীরে ধীরে সে চক্রাকারে হাত নাড়ে, তাতে অতি সামান্য ঢেউ ওঠে। তাছাড়া সে স্থির হয়ে থাকে, ফাত্রার মতো, শাখায় মাছরাঙার মতো, কাদেরের মতো। তারপর যুবতী নারীর মুখটি দেখবার জন্যে কাদেরের মনে একটি বাসনা জাগে। সে-বাসনা ক্রমশ এত প্রবল হয়ে ওঠে যে মনে হয় উত্তপ্ত আকাশে রঙ-পরিবর্তন হয়, দিগন্তরেখায় স্বপ্নের কুয়াশা জাগে। কাদেরের অর্ধনিমীলিত চোখে ভাবাবেশ। এক সময়ে ভীষণভাবে ফাত্না নড়ে, কিন্তু সেদিকে তার দৃষ্টি যায় না। যুবতী নারী আর তাকায় না কেন? মাছরাঙাও নিঝুম হয়ে বসে অপেক্ষা করে।

যুবক শিক্ষক থামে। চিত্রটি তার মনঃপূত হয় না। যুবতী নারীর বাড়ির পেছনে পুকুরটা সে দেখে নাই। কিন্তু সেখানে কাদের মাছ ধরতে বসতে পারে তা সম্ভব মনে হয় না। সে- চিত্রে খুঁত।

কিন্তু তাদের প্রথম সাক্ষাতের চিত্র কল্পনা করার চেষ্টা করছে কেন সে? তাতে তার লাভ কী? আশ্বিন মাসে একদিন কোনোপ্রকারে তাদের মধ্যে দেখা হয়, তারপর তাদের মধ্যে ভাবাবেগ অনুরাগের সৃষ্টি হয় : তার পক্ষে তা-ই যথেষ্ট। নিজেকে সংযত করে প্লুতগতি কল্পনার রাশ ধরে।

কিন্তু বেশিক্ষণের জন্যে নয়। নিজেরই অজান্তে আশ্বিনের একটি রৌদ্র-দগ্ধ অপরাহ্ণের চিত্র আবার তার মনে ভেসে ওঠে। না, কাদের পুকুরপাড়ে বসে নাই। ছিপ হাতে সে তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ পুকুরের বিপরীত অংশে স্নানরতা একটি যুবতী নারীকে দেখতে পায়। তার কালো চুলে রোদ ঝিকমিক করে, মুখটা বাষ্পাবৃত বলে তাতে বিচিত্র আকর্ষণ। থমকে দাঁড়িয়ে সে তার দিকে তাকায়। যুবতী নারীও তার দিকে তাকায়; সরল দৃষ্টিতে হয়তো একটু বিস্ময় কিন্তু কোনো নির্লজ্জতার আভাস নাই। তারপর হঠাৎ সে চঞ্চল হয়ে ওঠে, মুখে তার রঙ ধরে। কী বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্যে দু-একবার কাদেরের দিকে তাকায়, তারপর তাড়াতাড়ি পুকর থেকে উঠে সে ঘরে ফিরে যায়। চিকন শরীর, পিঠভরা কালো চুল, পরনে লাল শাড়ি। পদক্ষেপ দ্রুত হলেও জড়ানো। অদৃশ্য হবার আগে সে আরেকবার কাদেরের দিকে তাকায়। এবার দৃষ্টিতে কেমন সলজ্জিত আকাঙ্ক্ষার আভাস।

কিন্তু যুবক শিক্ষক নিজেই কি এমন একটি দৃশ্য কোথাও দেখে নাই? মনের অতল গহ্বর থেকে হঠাৎ একটি চেহারা ভেসে ওঠে। তেমনি চুল, তেমনি বাষ্পাবৃত মুখ, চোখে একটা অস্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা। তেমনি শরীর, পরনে তেমনি লালপেড়ে শাড়িও। মনে পড়ে, সেদিন যুবক শিক্ষকের অন্তরে যে-বিচিত্র ভাবাবেগের সৃষ্টি হয় তাতে সে প্রথমে অভিভূত হয়ে পড়ে। তারপর একটি অজানা ভয় এসে তাকে গ্রাস করে। মেঘশূন্য আকাশে যেন অদৃশ্য ঝড় উঠেছে : ভয়েরই কথা। কিন্তু যে ঝড়ের নাম জানা নাই, যে ঝড়কে দেখা যায় না, সে-ঝড়কে চেপে রাখতে হয়। সে ঝড় তার মনে আর প্রত্যাবর্তন করে নাই।

কাদের হয়তো সে-ঝড়ে ভীত হয় নাই, তাকে থামাবার চেষ্টাও করে নাই। হয়তো যুবক শিক্ষকের মতোই তার অর্থ সে বোঝে নাই, কিন্তু তার মতো সে ঝড় দমাবার চেষ্টা না করে বরঞ্চ তার মর্মার্থ বুঝতে চেষ্টা করে। যুবতী নারীকে কী একটা কথা বলার তীব্র ব্যাকুলতা বোধ করে যার অর্থ সে নিজেই বোঝে না। সে-কথা যেন ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না।

ব্যক্ত করতে পারলেও কথাটি বলা নিষেধ। যে-কথা আকাশের সূর্যচন্দ্রতারা, ধরণীর ফুললতাপাতা–দূর্বাদল বা স্রোতস্বিনী নদী নির্বিঘ্নে বলতে পারে সে-কথা বলা নিষেধ। যে- কথা হয়তো জীবন সম্বন্ধে একটি সরল কৌতূহল মাত্র, যার উৎস অজানার প্রতি মানুষের ভীতির মধ্যে, সে-কথা বলা নিষেধ। বললে ভীষণ পরিণাম নিশ্চিত : নদী নির্ধারিত ধারা পরিত্যাগ করে হয়তো মহাপ্লাবন সৃষ্টি করবে, নক্ষত্রপুঞ্জ কক্ষচ্যুত হয়ে প্রলয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলতা বিস্তার করবে, সূর্য আর উদয় হবে না। সে-ভয়াবহ সম্ভাবনায় কে না ভীত হয়? তবু ভীত না হয়ে কাদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করতে চেয়েছিল।

কিন্তু তার দুঃসাহসের ফল তাকে ভোগ করতে হয়েছে। সে নিষেধাজ্ঞা খণ্ডনীয় নয়; একবার খণ্ডন করলে ক্ষমা নাই। পরিণামের কথা যখন বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো তার স্মরণ হয় তখন দিশেহারা হয়ে যাকে সে একটি দুর্বোধ্য কথা বলবার জন্যে এত ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল, তাকেই আপন হাতে সে হত্যা করে। তার কঠোর শাস্তি : আমৃত্যু শোকাকুল অনুতাপ সে–অনুতাপের অসহনীয় জ্বালা কখনো প্রশমিত হবে না।

যুবতী নারীর প্রতি তার ভাবাবেগ ন্যায়সঙ্গত নয় সে-কথা যুবক শিক্ষক উপলব্ধি করে। কিন্তু তার জন্যে সে চূড়ান্ত শাস্তি লাভ করে নাই কি? এরপর আর কোনো শাস্তির কথা উঠতে পারে না। অন্যায়ের তুলনায় শাস্তিটি অতি কঠোর বলে তার প্রতি মানুষের সমবেদনা হওয়াই স্বাভাবিক।

একটি বিষয়ে যুবক শিক্ষকের মনে কোনো সন্দেহ নাই। সে যে-উত্তর পেয়েছে সে-উত্তরে সে সন্তুষ্ট। অন্যায় হোক, তবু যুবতী নারীর প্রতি কাদেরের মনে মায়ামমতা ভাবাবেগ ছিল। বাঁশঝাড়ের দুর্ঘটনাটি তাই নির্দয় নির্মম হত্যাকাণ্ড নয়।

বাড়ি ফেরবার পথে যুবক শিক্ষকের তৃপ্ত মনে হঠাৎ অপ্রীতিকর একটি সন্দেহের ছায়া উপস্থিত হয়। যুবতী নারীর হত্যাকারী কে, সে নিজেই নয়? সে যদি কাদেরকে অনুসরণ না করত, অপ্রত্যাশিতভাবে এবং অকারণে বাঁশঝাড়ের সামনে উপস্থিত না হত, তবে দুর্ঘটনাটি ঘটত না।

একটু ভেবে সে নিজেকে দোষমুক্ত করে। এ-কথা সত্য যে বাঁশঝাড়ে সে উপস্থিত না হলে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটত না, কিন্তু অন্যদিন অন্যখানে অন্য কোনোপ্রকারে হয়তো এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হত। আসল হত্যাকারী সে নয়, কাদেরের মনের গভীর ভীতি! সে-ভীতির মূলে সিন্দুকে লুকানো তোস্তারী কিংখাব হতে শুরু করে নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা। সে-সব নিষেধাজ্ঞার যথার্থতা বিচার করার ক্ষমতা তার নাই, তা বিচার করে দেখতেও সে চায় না। তার প্রশ্ন কাদেরের হৃদয় সম্বন্ধে। কাদের তার চোখে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।

বাড়ি পৌঁছবার আগে যুবক শিক্ষক একটি বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। তার চোখে কাদের যখন দোষমুক্ত হয়েছে তখন বাঁশঝাড়ের কথাটি আর প্রকাশ করার কথা ওঠে না। তার মুখ থেকে কথাটি কেউ জানতে পারবে না। অবশ্য দাদাসাহেবকে একটি কথা বলবে বলে সে ওয়াদা দিয়েছে। তাঁকে কী বলবে? সে কিছু ভাবিত হয়। সে বুঝতে পারে, তাঁকে আজেবাজে কোনো কথা বলে সে নিস্তার পাবে না। কী বলবে তাঁকে?

তার বর্তমান স্বস্তিভরা মনের পক্ষে বেশি চিন্তা করা সম্ভব হয় না। তাই হয়তো সহসা সে ভাবে, তাঁকে বলবে কাদের দরবেশ। তিনি খুশি হবেন, কারো কোনো ক্ষতিও হবে না।

তাছাড়া, কে দরবেশ কে দরবেশ নয়, সে-কথা কি কেউ কখনো সঠিকভাবে বলতে পারে?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *