এগার
কাদের তার জন্য অপেক্ষা করেছিল। যুবক শিক্ষক ঘরে প্রবেশ করলে সে এক পলকের জন্যে তার দিকে চোখ তুলে তাকায়, কিন্তু কিছু বলে না। জানালাটি বন্ধ বলে ঘরে আবছা অন্ধকার। সে-জন্যে তার চেহারা ভালো করে দেখা না গেলেও যুবক শিক্ষক তাতে কেমন স্তব্ধতা অনুভব করে।
একটু ইতস্তত করে যুবক শিক্ষক টেবিলের পাশের ছোট নড়বড়ে চেয়ারটি টেনে নিঃশব্দে সোজা হয়ে বসে। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে আপনা থেকেই খোশ মেজাজে ঘোষণা করে, ‘একটু বেড়িয়ে এলাম।’
কাদের এবারও কিছু বলে না। একটু পরে যুবক শিক্ষক সংগোপনে তার দিকে তাকায়। কাদেরের মুখটা সামান্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাতে নিঃসন্দেহে স্তব্ধভাব। তারপর সে তার অর্ধনিমীলিত চোখের দিকে তাকায়। সে-চোখের দিকে তাকিয়ে যুবক শিক্ষক হঠাৎ যেন তার অর্থ বুঝতে পারে। সে- চোখ এ-দুনিয়া সে-দুনিয়া, এপার-ওপার দু-দুনিয়া দু-পারই দেখে। জেগে থেকেও কাদের ঘুমিয়ে, ঘুমিয়েও সে জেগে। তার রাতে সূর্য অস্ত যায় না, আবার প্রখর সূর্যলোকে রাতের অবসান হয় না। তার দৃষ্টি অস্তিত্বের এমনই একটি ক্ষেত্রে নিবন্ধ যেখানে জীবনমৃত্যুর মধ্যে কোনো ব্যবধান নাই, যেখানে দুটিই যুগপৎ সত্য, দুটিই একত্রে বিরাজ করে। বিস্ময় কি যে কাদেরকে বুঝবার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেই অবাস্তব জগতে প্রবেশ করেছিল।
যুবক শিক্ষক কাদেরকে দেখে খুশিই হয়েছিল। তাকে তার শেষ প্রশ্নটি করা বাকি। কিন্তু এবার তার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়, আর প্রশ্নের কী দরকার? মনের অশান্তি কেটেছে। তার জীবনে যে-ফাটল ধরেছিল, সে-ফাটলে আবার জোড়া লেগেছে। কেন সে তাকে ব্যক্ত করবে?
আবার সে অনেকটা অকারণে বলে, নদীর ধারে একটু বেড়িয়ে এলাম।’
কাদের পূর্ববৎ নির্বাক থাকে। কিন্তু নদীর কথায় তার চোখে যেন ঈষৎ কম্পন দেখা যায়।
না, তবু তাকে প্রশ্নটি করতে হবে। তার শেষ প্রশ্ন। সে-প্রশ্নের পরেই কাদের খালাস পাবে। সন্তোষজনক উত্তর পাবে তাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু কথাটি মুখ থেকে না শোনা পর্যন্ত সে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হতে পারে না। সে কি একটা বিরাট দায়িত্বের বোঝা ঘাড়ে নেয় নাই? মায়ামমতার কারণেই সে তাকে নির্দোষ বলে গ্রহণ করবে—এ-সিদ্ধান্তের অর্থ কি এই নয় যে, সে নিজেকে নিজেই বিচারকের পদে নিযুক্ত করেছে? কে সে? একজন দরিদ্র শিক্ষক মাত্র, শিক্ষকতা করলেও যার জ্ঞানবুদ্ধি-অভিজ্ঞতা নেহাৎই সীমাবদ্ধ। তাছাড়া, অন্যদিক থেকে কথাটা ভেবে দেখলে এই মনে হয় না কি যে, দায়িত্বটি গ্রহণ করে খোদার চেয়ে বান্দাকেই সে বড় করে দেখছে? স্রষ্টার চোখে তাঁরই সৃষ্ট মানুষের প্রাণহরণ অতীব জঘন্য অপরাধ। সে- অপরাধের গুরুত্ব তিনিই সম্যকভাবে নির্ণয় করতে পারেন, তিনিই কেবল বলতে পারেন কোনো মানুষের অন্তরে কতখানি দয়ামায়া, কতখানি নির্দয়তা। যে-কথা যুবক শিক্ষক কাদেরের বিবৃতিতে এবং আচরণে সাব্যস্ত করবে, সে-কথা তার কাছে বিনা চেষ্টায় সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ পাবে। যুবক শিক্ষক কি বিশ্বাসী নয়?
শেষোক্ত প্রশ্নটি তাকে বিচলিত করে। ক্ষণকালের জন্যে তার মনে হয়, এ-প্রশ্নের জবাব সে দিতে পারবে না।
নিশ্চিত জয়ের সামনে দাঁড়াবার পর আকস্মিকভাবে এবং অপ্রত্যাশিত কোণ থেকে একটি দুর্লঙ্ঘনীয় বাধা এসে হাজির হলে মনে ক্ষোভদুঃখের সৃষ্টি হয়। সে-ক্ষোভদুঃখ সাময়িক বিহ্বলতা আনলেও পরে আবার যে-কোনো প্রকারে বাধাটি অতিক্রম করার জন্যে একটি অন্ধ জিদ চাপে, মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠে। যুবক শিক্ষকের মনে সন্ত্রাস সৃষ্টি হয় এই ভেবে যে, দুর্বহপ্রায় যে-দায়িত্বটি সে গ্রহণ করেছে এবং যে-দায়িত্ব সে কৃতকার্যতার সঙ্গে প্রতিপালন করতে পারবে বলে তার বিশ্বাস, সে-দায়িত্বটি যেন হাত থেকে শেষ মুহূর্তে খসে যাবে। কিন্তু এখন দায়িত্বটি ছাড়তে সে রাজি নয়।
না, সে অবিশ্বাসী নয়, কারণ বিশ্বাসী হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে সে এ-বিষয়ে সজ্ঞান যে, তার বিশ্বাসটি প্রশ্নহীন। যেখানে বিশ্বাসটি থামে তার ওধারে কী আছে সে জানে না। সে-কথা তার জানবার ক্ষমতা নাই, জানবার চেষ্টাও সে করে না। কেন করবে? অন্ধবিশ্বাস দাবি করে দৃষ্টিশক্তি আশা করা অনুচিত। কিন্তু যে-ক্ষুদ্র জগতে মানুষ বিচরণ করে সে- জগতের কোথায় ভালো কোথায় খারাপ সে-কথা বিচার করার ক্ষমতা মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া উচিত নয়। সে-ক্ষমতাটুকু হারালে মানুষ অতিশয় সীমাবদ্ধ প্রাণীতে পরিণত হবে। যুবক শিক্ষক কী চায়? সে চায় একটি কথা বিচার করতে : কাদের মানুষ কি অমানুষ, তার হৃদয়ে ভালবাসা- দয়ামায়ামমতা আছে, না তাতে কেবল নির্দয়তা। মানুষের কর্তব্য মানুষকে ভালবাসা, তার সঙ্গে স্নেহের নীড় বাঁধা, তাকে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করা। সে- বিষয়ে কে সফল হয়েছে কে হয় নাই, সে-কথা মানুষই বিচার করবে, কারণ মানুষের ভালোমন্দে মানুষেরই লাভ-লোকসান। যুবক শিক্ষক এ-কথা জিজ্ঞাসা করছে না সৃষ্টিকর্তা কেন কাউকে ভালো করেন কাউকে খারাপ করেন : তাঁর গূঢ় উদ্দেশ্য সে বোঝে না। শুধু মানুষের ভালোমন্দ বিচারের অধিকার চায়।
হঠাৎ সভয়ে যুবক শিক্ষক ভাবে, এমন সব কথা সে কখনো ভাবে নাই। সে কি পাগল হয়েছে? বাঁশঝাড়ের ঘটনাটি কি তার মস্তিষ্কবিভ্রান্তি ঘটিয়েছে?
কিন্তু অপরপক্ষকে শান্ত করবার জন্যেই যেন প্রশ্নটি তোলে। তার যুক্তির জন্যে সে মনে কোনো অনুশোচনা বোধ করে না।
আর ভাববার সময়ও পায় না। হঠাৎ কাদের সম্বন্ধে সচেতন হয়ে তার দিকে তাকায়। কাদেরের দৃষ্টি তার ওপর নিবদ্ধ। সে-দৃষ্টিতে কেমন যেন সন্দেহ। চোখাচোখি হতেই সে চাপা, খখনে গলায় প্রশ্ন করে, ‘কী অত চিন্তা করেন?’
উত্তর না দিয়ে যুবক শিক্ষক একটু হাসবার চেষ্টা করে, কিন্তু সামান্য মুখব্যাদান করে নিরস্ত হয়। তারপর তার দিকে না তাকিয়ে আস্তে বলে, ‘এসেছেন, ভালোই হয়েছে। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।’
সূর্যাস্তের দেরি নাই। উঠানে যে-অংশটি দৃষ্টিগত হয় সেখানে কয়েক মুহূর্তের জন্যে দুটি গরু, তারপর একটি রাখালমানুষকে দেখা যায়। হঠাৎ যুবক শিক্ষকের সন্দেহ হয়, প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করার জন্যে সময়টি কি উপযুক্ত? কিন্তু তার সময় নাই। দাদাসাহেবকে একটা উত্তর দিতে হবে। তাছাড়া, উত্তরটি জানবার জন্যে তার মনেও ঔৎসুক্য কম নয়। তবু মনে দ্বিধা হয়। উত্তরটি যে সুখবর হবে তা জেনেও প্রশ্নটি করতে তার ভয় হয়। কয়েক মুহূর্ত সে নিশ্বাস বন্ধ করে রাখে। তারপর সে ভাবে, তার বিশ্বাসটি যদি অসত্য প্রমাণিত হয়, তবে বাইরের পৃথিবীই ধূলিসাৎ হবে, তার কোনো ক্ষতি হবে না; সে-ধ্বংসলীলা তার চুল পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারবে না। তারপর তার চিকন নাসারন্ধ্র যেন সতর্কিতভাবে কেঁপে ওঠে। নিঃশব্দে সে নিশ্বাস নেয়, শূন্য বুক ভরে ওঠে।
‘একটা কথা জানা বড় প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’
কাদের নীরব হয়ে থাকে। তার নীরবতায় যুবক শিক্ষক কিছুটা দমিত হয়। কাদের যদি একবার জিজ্ঞাসা করত কী সে-কথা যা যুবক শিক্ষকের জানা বড় প্রয়োজন, তবে আপনা থেকেই প্রশ্নটি বেরিয়ে আসত। জিহ্বার ডগায় সে-প্রশ্ন, সামান্য পালকস্পর্শই যথেষ্ট।
কাদেরের দিকে চেয়ে সে প্রশ্ন করে, ‘আপনি কেন এসেছেন?’
কাদের অর্ধনিমীলিত চোখে প্রশ্নটা ভেবে দেখে। তারপর চোখ বন্ধ করে বলে, ‘আপনার কথাই বলেন।’
তার কণ্ঠের আওয়াজে কেমন প্রশ্রয়ের আভাস। কিন্তু মনে হয়, চোখ বন্ধ করেও সে যেন স্থির নির্নিমেষ দৃষ্টিতে যুবক শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে আছে, তার কথা শোনবার জন্যে কানও খাড়া করে রেখেছে। সে যেন আজ দু-জগতের বাসিন্দা আর নয়। মুহূর্তের জন্যে যুবক শিক্ষকের মনে ভয়ের আবির্ভাব হয়। সে ভাবে, তার মাথায় এ কী অদ্ভুত খেয়াল জন্মেছে? কেন সে কাদেরকে প্রশ্ন করতে চায়? অকস্মাৎ আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটিই যেন অর্থহীন মূল্যহীন মনে হয়, তার সত্যাসত্য বিচার করার কথাও নিতান্ত অহেতুক মনে হয়। তবু একটা হদিস পাবার আশায় সে কাদেরের দিকে তাকায়। তার চোখ পূর্ববৎ নিমীলিত, সারা শরীরে পাথরের মতো নিশ্চলতা। এবার যুবক শিক্ষকের মনে হয়, সে নিশ্চলতার সামনে বেশিক্ষণ সে স্থির হয়ে থাকতে পারবে না, হঠাৎ একটা দুর্বার স্রোত এসে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কাদের কিছু বলে না কেন? তার মনেও কি একটি নিদারুণ ভয় উপস্থিত হয়েছে? প্রশ্ন করতে যুবক শিক্ষকের মনে যেমন ভয়, প্রশ্ন শুনতেও তার মনে কি তেমনি ভয়? দু-জনের মনেই ভয়। তবে একই ভয় : দু-ভয়ে কোনো তারতম্য নাই। তাদের পক্ষে পরস্পরকে সাহায্য করা সম্ভব নয় কি?
একটা গভীর নিঃসঙ্গতাবোধে নিঃসাড় হয়ে থেকে কাদেরের মতো সেও চোখ নিমীলিত করে। এবার চারধারে ঘন-কালো অন্ধকার জাগে, নীরবতাও যেন নিবিড় হয়ে ওঠে। সে ভাবে, তারা আক্রমণ-উদ্যত শত্রু নয়, বন্ধু। তবে দু-জনেই নিঃসঙ্গ, কী একটা প্রশ্নের জন্যে ঘনতমসার মধ্যে হাতড়িয়ে ফিরছে। যা খুঁজছে তা না পেলেও তারা যদি পরস্পরের হাত ধরতে পারে, শুধু একটু সময়ের জন্যে, একটি মুহূর্তের জন্যে, তবে ক্ষীণতম হলেও তবু তারা একটা আলো দেখতে পেত।
যুবক শিক্ষকের ঠোঁটটা একটু কেঁপে ওঠে। কেন কথা বলছে সে-কথা বুঝতে না পারলেও ঘন অন্ধকারের মধ্যে সে এবার বলে, ‘আপনি সব কথাই বলেছেন কিন্তু একটা কথা বলেন নাই।’
কাদের উত্তর দেয় না। কিন্তু যুবক শিক্ষক কোনো উত্তর বা উক্তির জন্যে অপেক্ষা করে না। আবার বলে, ‘কথাটা কী করে বলি?’ মুখটা তার সামান্য লাল হয়ে ওঠে। তারপর সে বলেই ফেলে, ‘যুবতী নারীর প্রতি আপনার মায়ামমতার কথা বলেন নাই।’
কথাটা সে অবশেষে বলেছে। কেমন অসংলগ্ন শোনায়, কিন্তু ঘনতমসার মধ্যে কোন কথা অসংলগ্ন শোনায় না? যুবক শিক্ষক স্থির হয়ে থাকে। তারপর সে অপেক্ষা করে। অন্ধকারটা হাল্কা হয়ে উঠেছে, শীঘ্র সে যেন আলোতে ভেসে উঠবে, আবার চাঁদ-তারা আকাশ দেখতে পাবে। কোনো উত্তর না পেলে সে এবার চোখ খুলে তাকায়। অদূরে ছায়াটি এখনো নিশ্চল হয়ে আছে।
কাদেরের চোখ উন্মুক্ত। সে তারই দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। সে এমনভাবে তাকিয়ে আছে কেন? হয়তো তার দৃষ্টি এড়াবার জন্যেই সে এবার তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে, ‘দাঁড়ান, আলো জ্বালাই।’ তারপর লণ্ঠন জ্বালানোর কাজে মনোনিবেশ করে সে বলে, ‘বুঝলেন আমার কথাটা?’ কাদেরের দিকে তাকাতে তার আর সাহস হয় না, একটা গভীর লজ্জা এসে তাকে গ্রাস করে। লণ্ঠনটি জ্বালিয়ে সেটি দরজার এক পাশে ঠেলে দেয়, কাদেরের সঙ্গে চোখাচোখি হবার ভয়ে তা টেবিলে রাখতে পারে না। তারপর সে চেয়ারে ফিরে এসে কাদেরের দিকে পাশ দিয়ে বসে।
অবশেষে কাদেরের কণ্ঠ শোনা যায়। সে-কণ্ঠে গভীর বিস্ময় না সন্দেহ তা যুবক শিক্ষক ধরতে পারে না। সে আস্তে প্রশ্ন করে, ‘আপনার মতলব কী?’
এ-প্রশ্নটি কাদের সকালেও তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল এবং তখন প্রশ্নটি তাকে আঘাত দিয়েছিল। এখন সে তাতে আঘাত পায় না। বরঞ্চ সে ভাবে, সকালে কাদেরের সামনে যে- ভাবে সে আচরণ করেছিল, তারপর তার মনে এ-বিশ্বাসই হওয়া স্বাভাবিক যে তার প্রতি যুবক শিক্ষকের কোনো সহৃদয়তা নাই। যুবক শিক্ষকের মনে যে একটা পরিবর্তন এসেছে তা সে কী করে বুঝবে?
‘না, আমার কোনো কু-মতলব নাই।’ আবার সে একবার হাসবার ব্যর্থ চেষ্টা করে। ‘আমার কথাটি বুঝতে পারছেন না কেন?’
‘কথাটা কী?’
‘একটা দুর্ঘটনার কথাই আপনি শুধু বলেছেন। আর কিছু বলেন নাই।’
কাদের তার কথা এখনো বুঝতে পারে নাই। একটু থেমে আবার প্রশ্ন করে, ‘আর কী বলব?’
‘বললাম না?’
‘কী বললেন?’
যুবক শিক্ষকের মনে হয় আবার সে একটি ফাঁদে পড়েছে : এ-ফাঁদ অতীব বাস্তব, অতীব সত্য। তার মুখ ঝাঁ-ঝাঁ করতে শুরু করে।
‘বললাম তো! মেয়েলোকটির জন্যে আপনার মায়ামহব্বত ছিল সে-কথা একবারও বলেন নাই।’
এবার কথাটা বোধগম্য হয়েছে কিনা তাই দেখবার জন্যে ক্ষিপ্রদৃষ্টিতে সে একবার কাদেরের দিকে তাকায়। যা দেখে তাতে প্রথমে তার বিস্ময় হয়, তারপর ভয়। কাদেরের চোখ সম্পূর্ণভাবে খোলা : সে যেন কী একটা কথা বুঝবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তারপর সে চোখ ঘোলাটে হয়ে ওঠে, তাতে শেষে রক্তাভা দেখা দেয়।
শুষ্ককণ্ঠে যুবক শিক্ষক প্রশ্ন করে, ‘কী ব্যাপার?’
কাদের উত্তর দেয় না। সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় কিন্তু তার চোখে রক্তাভা ক্রমশ আরো গাঢ় হয়। তিল-তিল করে তাতে যেন রক্তবিন্দু জমছে। অবশেষে তার দৃষ্টি ঘরময় ঘুরতে থাকে। সে যেন কী সন্ধান করে, কী যেন বুঝতে চায়। এখানে-সেখানে সে-দৃষ্টি থামে, কিন্তু ক্ষণকালের জন্যে, তারপর এক সময় আলগোছে যুবক শিক্ষকের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। একবার, দু-বার। তাকে দেখেও দেখে না, তবু তার ওপর দিয়ে যখন বয়ে যায়, তখন তার দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যে কেমন তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। যুবক শিক্ষক বোধ করে, তার ভেতরটা হঠাৎ শীতল হয়ে উঠছে। অধীর হয়ে সে বলে, ‘সত্যি কিনা বলেন। হাঁ-না কিছু বলেন।’
কোনো উত্তরই আসে না। তারপর যুবক শিক্ষকের মনে হয়, ক্ষুদ্র ঘরটা যেন চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করেছে। সঙ্গে-সঙ্গে সেও ঘুরতে শুরু করে। তার মাথাটা শূন্য হয়ে ওঠে, তারপর দপদপ করে। একটা অকথ্য জ্বালায় সারা শরীরে যন্ত্রণাও জাগে। লোমশ বিষাক্ত বিচ্ছু গায়ে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে; হাতে, পায়ে। তারপর সমগ্র দেহে। কিন্তু সে কিছু পরওয়া করে না। তার দৃষ্টি কাদেরের ওপর নিবদ্ধ। চতুর্দিকে ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে কাদেরই যেন কেবল স্থির হয়ে আছে। না, তার রক্তাক্ত স্ফীতমস্ত চোখ দুটি ঘোরে, কেবল ঘোরে, চক্রাকারে এবং অন্তহীনভাবে।
তারপর যুবক শিক্ষকের মনে হয়, সে যেন দ্রুতভাবে কথা বলতে শুরু করেছে। গলা অনুচ্চ হলেও নিজেরই কানে তার স্বর অস্বাভাবিক ঠেকে, বিষয়বস্তুও ঠিক বোধগম্য হয় না। কেবল ক্ষিপ্রগতিতে অস্পষ্ট শব্দগুলি মুখ থেকে বেরিয়ে চতুর্দিকে ছিটকে পড়ে, একটার পর একটা, কোথাও জোড়া লাগে না, কোথাও বিদ্ধ হয় না। তাতে সে দমে না। শব্দগুলি সে ছুঁড়তেই থাকে, পাগল মানুষ যেমন ঢিল–পাথরের স্তূপ পেয়ে অশ্রান্তভাবে লক্ষ্যহীনভাবে তা ছুঁড়তে থাকে চতুর্দিকে। তারপর এক সময় হয়তো তার কথার উৎস শুকিয়ে আসে। কারণ তার মনে হয় সে একটি কথাই বারবার বলছে, একটি ঢিলই ছুঁড়ছে। কিন্তু ছুঁড়তেই আবার সেটা হাতে ফিরে আসে বা হাত থেকে বেরিয়েও হাতেই থেকে যায়।
‘বুঝলেন কথাটা কেন দরকারি? বুঝলেন, বুঝলেন?’
সে কোনোই উত্তর পায় না। তারপর ঘূর্ণমান ঘরটি ধীর স্থির হয়, একটা নিঃস্ব তবু প্রীতিকর নীরবতা ফিরে আসে।
অবশেষে কাদেরের কণ্ঠ শোনা যায়। সে কণ্ঠে ঘৃণা, বিস্ময়। শুধু তাই নয়। সে একটি অদ্ভুত কথা বলে। প্রথমে কথাটি বুঝতে পারে না যুবক শিক্ষক। কিন্তু কাদেরের কণ্ঠ যখন নীরব হয় তখন নীরবতার মধ্যেও তার কথাটি শুনতে পায় বার বার। অতি বিস্ময়ে সে নিজেকে প্রশ্ন করে, সে পাগল? কাদের যেন তাই বলল।
তারপর কাদের তাকে ভয়-প্রদর্শন করে। যুবক শিক্ষক সুস্থমস্তিষ্ক নয় কথাটি আবিষ্কার করেছে বলেই সে যেন ভয়-প্রদর্শন করার প্রয়োজন বোধ করে। কিন্তু কাদেরের উক্তিটি তাকে স্পর্শ করে না। তার মন অন্যত্র। কেবল সে একাধিকবার বলা কথাটি আবার বলবার জন্যে তীব্র ইচ্ছা বোধ করে বলে সেটি শেষবারের মতো শূন্যতায় নিক্ষেপ করে, নিরাশভাবে, পূর্ববৎ লক্ষ্যহীনভাবে।
‘আমার কথাটা এখনো বুঝলেন না?’
কাদের কোনো উত্তর দেয় না। যুবক শিক্ষকের প্রশ্নটি নিস্তব্ধ ঘরে কতক্ষণ বিসদৃশভাবে ঝুলে থাকে, তারপর প্রশ্নকারীকেই তা নির্মমভাবে লজ্জা দিতে শুরু করে। সেটি যেন তার প্রশ্ন নয়, তারই উলঙ্গ দেহ। সে-দেহ কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে।
একটি কথা তার কাছে অত্যাশ্চর্য মনে হয়। অনতিদূরে হত্যাকারী সম্পূর্ণভাবে বস্ত্রাচ্ছাদিত হয়ে সুস্থির হয়ে বসে, কোথাও একটু অসংলগ্নতা নাই।
যুবক শিক্ষক অবশেষে বোঝে, কাদেরের পক্ষে দরিদ্র মাঝির বউ-এর প্রতি কোনো ভাবাবেগ বোধ করা সম্ভব নয়।
তারপর যুবক শিক্ষকের চোখের সামনে একটি ধু-ধু প্রান্তর জেগে ওঠে। সে-প্রান্তর শুধু ধু-ধুই করে, তাতে কোনো মরীচিকা নাই। যে-মরীচিকার পেছনে সে এ-ক’দিন ছুটেছিল, সে-মরীচিকার কোনো আভাস নাই সেখানে।
একটু পরে আপন মনেই শান্তভাবে যুবক শিক্ষক বলে, ‘তবে আর কী? সব শেষ হল।’
মরীচিকা যদি অদৃশ্য হয়ে গিয়ে থাকে তবে কাকে দোষ দিতে পারে?
অবশেষে সে কাদেরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমার আর কোনো উপায় থাকল না।’
কাদেরের চোখটা দপ করে জ্বলে ওঠে, ঠোঁটের পাশটা বিকৃত হয়ে ওঠে। কিছু না বলে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধভঙ্গিতে সে চলে যায়। তার ঘাড়ের একটা দিক অতিশয় উঁচু মনে হয়।
বারো
অবশেষে যুবক শিক্ষকের পক্ষে বাঁশঝাড়ের নির্মম ঘটনাটি নিরপেক্ষ দর্শকের পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব হয়। চন্দ্রালোক দিবালোকে পরিণত হয়েছে। সে-দিবালোকে একটি নিহত যুবতী নারীর অর্ধ-উলঙ্গ দেহ স্পষ্টভাবে সে দেখতে পায়। শুধু তাই নয়। হত্যাকারীর পক্ষেও কোথাও গা-ঢাকা দেবার উপায় নাই।
না, ঘটনাটিতে আর কোনো জটিলতা নাই। একসময়ে ফৌজদারি আদালতে বাদীপক্ষ সেটি এ-ভাবেই পেশ করবে তাতে সন্দেহ নাই।
বড়বাড়ির প্রধান মুরুব্বি আলফাজউদ্দীন চৌধুরী সাহেবের কনিষ্ঠভ্রাতা কাদের চৌধুরী নিষ্কর্মা মানুষ। কয়েক মাস আগে বিবাহিত এবং ভদ্রবংশীয় সে নিষ্কর্মা মানুষটি তাদের গ্রামেরই একটি দরিদ্র মাঝির সন্তানহীনা যুবতী স্ত্রীর সঙ্গে কোনো প্রকারে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করে। কার্যোপলক্ষে স্বামীটিকে প্রায়ই গ্রামছাড়া হতে হয়। তখন ঘরে থাকে তিনজন মেয়েমানুষ : মাঝির স্ত্রী, বৃদ্ধা মা এবং কানা বোন। অবস্থা অনুকূল হলেই কাদের যুবতী নারীর সঙ্গে গোপনে দেখা-সাক্ষাৎ করে। মাঝির ঘরটা গ্রামের একপ্রান্তে। নিকটে একটু জঙ্গলের মতো। সেখানে একটা বৃহদাকার বাঁশঝাড়। সে বাঁশঝাড়ের মধ্যে ক্ষুদ্র খোলা স্থানে তাদের গোপনমিলন হয়। ধর্মনীতিবিরুদ্ধ অবৈধ এ- মিলনের কারণ কী? যুবতী নারী আজ মৃতা। তার মনে কী ছিল তা আজ জানা সম্ভব নয়। তবে তার সঙ্গে কাদেরের সম্পর্কের কারণ নিঃসন্দেহে বলা যায়। সে-কারণ ইন্দ্রিয়পরায়ণতা।
দিন-কয়েক পূর্বে বড়বাড়ির আশ্রিত যুবক শিক্ষক আরেফ আলী গভীর রাতে কাদেরকে বাড়ি ত্যাগ করে গ্রাম-অভিমুখে যেতে দেখে। তার জ্যেষ্ঠভ্রাতার মতে সে দরবেশ। কথাটা বিশ্বাস না-হলেও কাদের সম্বন্ধে যুবক শিক্ষক কৌতূহল বোধ করে। সে ভাবে, কাদেরকে অনুসরণ করে দেখে অত রাতে কী উদ্দেশ্যে সে ঘর থেকে বেরিয়েছে। অবশ্য খারাপ কিছু সে সন্দেহ করে না।
শীঘ্র সে কাদেরকে হারিয়ে ফেলে। তারপর উজ্জ্বল জ্যোৎস্নালোকে তার কথা ভুলে সে কিছুটা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে থাকে। হয়তো কাদেরকে আবার দেখতে পাবে সে-আশাটা এখনো সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করে নাই। তারপর একসময়ে নদীর কাছে বাঁশঝাড়ের নিকটবর্তী হতেই একটি মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলে তার বিস্ময়ের অবধি থাকে না। ঠিক চিনতে না পারলেও তার সন্দেহ থাকে না যে কণ্ঠস্বরটি কাদেরেরই। দ্বিতীয় কোনো কণ্ঠস্বর শুনতে না পেলে তার মনে হয়, কাদের হয়তো অদৃশ্য কোনো আত্মার সঙ্গে কথালাপ করছে। সে কি সত্যই দরবেশ? তার কথা ভালো করে শুনবার জন্যে সে বাঁশঝাড়ের দিকে এগিয়ে যায়। তখন শুকনা পাতায় তার পা পড়লে হঠাৎ আওয়াজ হয়, হয়তো ভয় পেয়ে সে নিজেও কিছু বলে ওঠে। এবার বাঁশঝাড়ে কণ্ঠস্বরটি থেমে যায়। কিছুক্ষণ পর যুবক শিক্ষক আবার রাখালের মতো ডেকে উঠলে যুবতী নারী ভয় পেয়ে সামান্য চিৎকার করে ওঠে।
বাঁশঝাড়ের বাইরে মানুষের আওয়াজ শুনতে পেলে কাদের ভেবেছিল হয়তো যুবতী নারীর স্বামীই তার স্ত্রীর সন্ধানে এসেছে। এবার যুবতী নারী চিৎকার করে উঠলে সে নিদারুণ ভয়ে দিশেহারা হয়ে যুবতী নারীকে চুপ করাবার জন্যে তার গলা টিপে ধরে। প্রাণের জন্যে যুবতী নারী যতই ধ্বস্তাধ্বস্তি করে ততই দিশেহারা কাদের তার হস্তবন্ধন শক্ত করে। শীঘ্র যুবতী নারীর জীবনাবসান ঘটে। কাদেরের মতে, সে-নিদারুণ ভীতির কারণ তার পরিবারের নামযশ। সে-পরিবারের মানুষ চরম ব্যভিচারে লিপ্ত তা প্রকাশ পেলে যে ভয়ানক পরিণাম হবে সে পরিণামের কথা স্মরণ হওয়াতে তার সমস্ত জ্ঞানবুদ্ধি হঠাৎ লোপ পায়। যখন সে বুঝতে পারে যুবতী নারীর দেহে প্রাণ নাই, তখন সে বাঁশঝাড়ের পেছন দিয়ে পালিয়ে যায়।
তারপর কাদের একটু ভুল করে। কিছুদূরে গিয়ে তার সন্দেহ হয়, হয়তো সবটা কানেরই ভুল। ভুলবশত সে কি এমন গুরুতর কাণ্ড করে বসেছে? তাছাড়া, বাঁশঝাড়ের সামনে কেউ যদি এসেও থাকে, সে যে হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে পেরেছে তার প্রমাণ কী? ভাবে, বাঁশঝাড়ের সামনের ভাগটা একবার দেখে এলে ক্ষতি কী! ফলে যুবক শিক্ষকের সঙ্গে তার দেখা হয়। সে-রাতে তার বিচিত্র আচরণ দেখে তার মনে সন্দেহ থাকে না যে, সে যে শুধু মৃত নারীর কথা জানে তা নয়, হত্যাকারী কে তাও সে জানে। যুবক শিক্ষক যে কিছু দেখে নাই, কাদের যে হত্যাকারী সেটা যে কেবল তার একটি খেয়াল, সে-কথা বোঝা তার পক্ষে সম্ভব হয় না।
পরদিন যুবক শিক্ষক ঘটনাটি প্রকাশ করবে সে-কথাই কাদেরের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। তবে সে বুঝতে পারে, সাক্ষীর অভাবে অভিযোগটা প্রমাণ করা তার পক্ষে সহজ হবে না। একটি মানুষের বিরুদ্ধে আরেকটি মানুষের কথা। অতএব যুবক শিক্ষকের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ আনার জন্যে সে তৈরি হয়ে থাকে। সে বোঝে, প্রথমে যে অভিযোগটি আনবে তারই অপেক্ষাকৃত বেশি লাভ থাকবে কিন্তু নিজে অপরাধী বলেই হয়তো তার পক্ষে আক্রমণটা শুরু করা সম্ভব হয় না। যুবক শিক্ষক কথাটি প্রকাশ করলে সে কী-পাল্টা জবাব দেবে তা সে ঠিক করে রাখে। সে বলবে, মৃতদেহটি সে স্বচক্ষে দেখেছে এবং যুবক শিক্ষককেও বাঁশঝাড়ের কাছাকাছি দেখেছে। অবশ্য যুবক শিক্ষকই যে হত্যাকারী সে কথা সে সরাসরি না বললেও তার ওপর সন্দেহ ফেলতে দেরি হবে না। তাছাড়া, তার দরবেশী সুনামের জন্যে সে রাতভ্রমণেরও একটা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারবে। উপরন্তু, তার পরিবারের নামযশ প্রতিপত্তিও তাকে সাহায্য করবে।
তাকে কিছুই করতে হয় নাই। পরদিন যুবক শিক্ষক নিয়মিতভাবে বড়বাড়িতে এবং ইস্কুলে শিক্ষকতা করে, রাত্রির ঘটনা কাউকে বলে না। তার ব্যবহারে কাদের বিস্মিতই হয়। তারপর তার নীরবতার একটি কারণই সে দেখতে পায়। যুবক শিক্ষকই তাদের আশ্রিত বলে চক্ষুলজ্জার জন্যেই হোক বা সাহসের অভাবেই হোক, সে নীরব থাকাই সমীচীন মনে করেছে।
হত্যাকাণ্ডটি প্রকাশ পায় নাই সে-বিষয়ে নিশ্চিন্ত হলে এবার কাদেরের মন বাঁশঝাড়ে পরিত্যক্ত মৃতদেহটির প্রতি যায়। রাত্রি হলে সে বুঝতে পারে, যুবক শিক্ষক তো কথাটি বলেই নাই, মৃত দেহটিও এ-পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত রয়েছে। সেটা তার কাছে অতি সৌভাগ্যের ব্যাপার বলেই মনে হয়। তবে সে এ-কথা উপলব্ধি করে যে, প্রথম দিন যে-কোনো কারণে তার প্রতি ভাগ্য অতি সুপ্রসন্ন থেকেছে, দ্বিতীয় দিনেও এমন সুপ্রসন্নতা আশা করা বাড়াবাড়ি হবে। নিখোঁজ নারীর সন্ধান চলছে, দেহটি আবিষ্কার করতে দেরি হবে না। স্থিরমস্তিষ্কে ব্যাপারটি বিবেচনা করে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, দেহটি অদৃশ্য হয়ে গেলেই সে সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ বোধ করতে পারবে। যুবতী নারীর দশা না জানলে তার হত্যার কথা কেউ সন্দেহ করবে না, হত্যাকারীকেও সন্ধান করবে না।
দেহটি গোর দেবার কথাটা ভেবে দেখে নদীতে ফেলাটাই সে সমীচীন মনে করে। তবে পন্থাটি মনঃপূত হলেও তা কম অপ্রীতিকর মনে হয় না। এ-সময়ে তার মাথায় খেয়াল আসে, সে-ব্যাপারে যুবক শিক্ষকের সাহায্য সে নেয় না কেন? খেয়াল হিসেবে যে-কথাটা তার মনে আসে, ভেবে দেখার পর তা তার ভালোই লাগে। দু-জন মানুষের পক্ষে কাজটি সম্পন্ন করতে দেরি হবে না, সাথী পেলে সেটি কাদেরের কাছে ততটা ন্যাক্কারজনকও মনে হবে না। তাছাড়া, কাদের এ-কথাও বুঝতে পারে যে, যে-লোকটি সব জেনেও কথাটি এ-পর্যন্ত প্ৰকাশ করে নাই, তাকে দেহ বহনের ব্যাপারে একবার জড়িত করতে পারলে চিরকালের জন্যে তার মুখ বন্ধ করা সহজ হবে। অবশ্য সে সাহায্য করতে রাজি হবে কিনা সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হতে পারে না, কিন্তু ভাবে, চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী! তাছাড়া, যুবক শিক্ষকের চোখে নিজেকে দোষমুক্ত করার একটা ক্ষীণ আশাও মনে মনে পোষণ করে। কে জানে একটি আজগুবি কথা বলে নিরীহ-সাদাসিধে লোকটির মনকে হয়তো অন্যপথে চালু করে দিতে সক্ষম হবে। সবদিক থেকে কথাটি তার পছন্দ হয়।
যুবক শিক্ষক বিনাতর্কে তাকে সাহায্য করতে রাজি হয়। প্রথমে সামান্য ভয় পায়, তার প্রস্তাবটিও হয়তো পরিষ্কারভাবে বোঝে না, কিন্তু দ্বিরুক্তি না করে তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। পরে কাজটির সামনাসামনি হলে সে ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কোনো প্রকারে দেহটি বহন করলেও নদীর পাড় দিয়ে নাবতে গিয়ে সে এভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যে আর ওঠে না। বাকি কাজটি কাদের একাকীই করে। পরে ধরাশায়ী যুবক শিক্ষকের দিকে তাকাতেই একটি ব্যাপারে সে নিঃসন্দেহ হয়। যুবক শিক্ষক মেরুদগুশূন্য ব্যক্তি। প্রয়োজন হলেও তাকে বেশি ভয় দেখাতে হবে না, একটুকুতেই তাকে কাবু করা যাবে। পাড় বেয়ে উঠে কাদের নিশ্চিন্তচিত্তে বাড়ি ফিরে যায়।
দুর্ভাগ্যবশত পরে রাতের বেলায় কোম্পানির জাহাজের সারেঙ্গ যুবতী নারীর দেহটি নদীতে ভাসতে দেখে। তার পরিকল্পনাটি কার্যকরী হল না দেখে কাদের অতিশয় নিরাশ হয় কিন্তু সে আর কী করতে পারে? অবশ্য যুবক শিক্ষকের দিক থেকে কোনো বিপদ সে আশঙ্কা করে না, তাই তাকে কোনো কথা বলার প্রয়োজনও বোধ করে না। যে-মানুষ সত্যকথা জেনেও এবং মৃতদেহটি বহনকার্যে তাকে সাহায্য করেও কাউকে কিছু বলে নাই, এখন দেহটি খুঁজে পাওয়া গেছে শুনে সে হত্যাকাণ্ডের কথাটি প্রকাশ করবে তা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না।
তারপর যুবক শিক্ষক তাকে ডেকে পাঠায়। প্রথমে সে ঠিক করে যাবে না। ঘটনাটির বিষয়ে তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার বা ষড়যন্ত্রের কোনো প্রয়োজন দেখে না। না গেলে যুবক শিক্ষক এ-কথাও বুঝতে পারবে যে, ব্যাপারটি ভুলে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। তবু পরে কেমন অস্বস্তি এবং কৌতূহল হলে সে যুবক শিক্ষকের ঘরে হাজির হয়। যুবক শিক্ষকের ব্যবহার কিন্তু তার বোধগম্য হয় না। পরিষ্কার করে সে কিছু বলে না, যেটুকু বলে তাও অসংলগ্ন মনে হয়। কাদেরের সন্দেহ হয়, যুবক শিক্ষকের মনে যেন একটা কুমতলব। এ-সময়ে একটি কথা জানতে পেরে তার অনুশোচনার শেষ থাকে না। কথাটি এই যে, কাদের যে হত্যাকারী তা যুবক শিক্ষক নিশ্চিতভাবে জানত না। যেটুকু অনিশ্চয়তা ছিল তা কাদের নিজেই দূর করেছে।
কথাটি জানতে পেরে যুবক শিক্ষকও কেমন বিচলিত হয়ে পড়ে, তার ব্যবহারও আরো বিচিত্র হয়ে ওঠে। সে যেন একটা বিভ্রমের ঘোরে ছিল, সে ঘোরটা কেটেছে। কিন্তু তবু তার ব্যবহার বোধগম্য না হয়ে আরো দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। কাদের একটি উপসংহারেই উপনীত হতে সক্ষম হয়। সত্যকথা জানতে পেরে যুবক শিক্ষক একটি বিকৃত আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় বার সে নিজেই যুবক শিক্ষকের কাছে হাজির হয়। মনে অশান্তি। তাছাড়া, সেদিন সকালে দাদাসাহেব যুবক শিক্ষককে ডেকে পাঠিয়েছিলেন সে কথা সে জানে।
যুবক শিক্ষককে এবার অপেক্ষাকৃত শান্ত মনে হয়। তাছাড়া মনে হয়, তার যেন কী একটা কথা বলার আছে। তার আচরণ-ব্যবহারে কোনোপ্রকার বিরুদ্ধতা প্রকাশ পায় না বলে কাদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। সে কোনো কথা বলতে আসে নাই, জানতেই এসেছে।
অবশেষে যুবক শিক্ষক তার মনের কথাটি কোনোপ্রকারে প্রকাশ করে। বলতে গিয়ে তার মুখ লাল হয়ে ওঠে, শব্দগুলিও ঠিকভাবে সরে না। যা বলে তা-ও অতিশয় বিচিত্র শোনায়। তার মর্মার্থ এই যে, যুবতী নারীর প্রতি প্রণয়ের কথাটা কাদের বলে নাই। সে-কথাটি বিশেষ জরুরি এই কারণে যে অপরাধটি ক্ষমার্হ কি ক্ষমার্হ নয় তা তার উত্তরের ওপরই নির্ভর করে। যুবক শিক্ষকের বক্তব্যটি এতই অপ্রত্যাশিত এবং অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় যে কাদের স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। এ কী ধরনের কথা? কাদের কি একটি বদ্ধপাগল মানুষের হাতে পড়েছে? বাঁশঝাড়ের ঘটনাটি ভয়ানক গুরুতর কিন্তু কী করে লোকটি প্রেমের কথা ভাবতে পারছে? তাছাড়া, নারী- পুরুষের সম্পর্কের কারণ কি শুধুমাত্র প্রেম? না, লোকটি নিঃসন্দেহে উন্মাদ। তা না হলে এমন অহেতুক কথার উত্থাপন করবে কেন? কাদের হঠাৎ রাগে অন্ধ হয়ে পড়ে। সে-ক্রোধ সামলানো তার পক্ষে সহজ হয় না। তারপর যুবক শিক্ষকও অকারণে বেসামাল হয়ে পড়ে। তার মধ্যে যেন একটা বিষম মানসিক সঙ্কট উপস্থিত হয়। অবশেষে সে পরিষ্কারভাবেই ঘোষণা করে যে, তার পক্ষে কাদেরকে ক্ষমা করা আর সম্ভব নয়।
লোকটি যে উন্মাদ সে-বিষয়ে কাদেরের এবার আর কোনো সন্দেহ থাকে না। অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পেরে সে এবার সত্যিই ভয় পায়। ফলে, যুবক শিক্ষককে ভয় দেখানো অত্যন্ত প্রয়োজন মনে করে। যুবক শিক্ষক একটু সুস্থির হলে সে তাকে পরিষ্কারভাবে বলে যে, কথাটা প্রকাশ করলে তার সর্বনাশই হবে। কিন্তু ভয়-প্রদর্শন বৃথা মনে হয়। কাদেরের কথা যুবক শিক্ষকের কানে পৌঁছায় না। কাদের যে প্রেমিক নয়, সে-দুঃখেই সে যেন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। লোকটির প্রতি ক্রোধে-ঘৃণায় কাদেরের শ্বাসরোধ হবার উপক্রম হয়।
সচকিত হয়ে যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে, কাদেরের সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাৎটি সে কাদেরের দৃষ্টিতেই দেখতে শুরু করেছে। কিন্তু তাতে ক্ষতি নাই। অবশেষে সব দুর্বলতা-স্বপ্ন-কল্পনা থেকে সে মুক্তি পেয়েছে, কাদেরের কুকীর্তিটি স্বচ্ছদৃষ্টিতে দেখবার পথে আর বাধা নাই। কাদের যখন তাকে কোনোপ্রকারে আর প্রভাবিত করতে পারবে না তখন তার দৃষ্টিতে ব্যাপারটি দেখতে কোনো ভয় নাই। এখন সে তার যুক্তি-অজুহাত সম্পূর্ণভাবে বুঝতে চায়।
কাদেরের যুক্তির উপসংহার কী? শুধু এই যে, যুবক শিক্ষক একটি মতিচ্ছন্ন মানুষ। সেখানেই তার যুক্তির শেষ। অপরের বিষয়ে এ সিদ্ধান্তের পর নিজের সম্পর্কে কী তার বলার আছে? কিছু না। সেখানে তার যুক্তি শূন্যতায় খাঁ-খাঁ করে।
না, কাদের যে প্রেমিক নয় সে-কথাই তার দুঃখের কারণ নয়। আসল কারণ এই যে, একটি যুবতী নারী নিতান্ত অর্থহীনভাবেই প্রাণ হারিয়েছে। তার মৃত্যুতে কাদেরের মনে একটু দুঃখ-বেদনা জাগে নাই। শূন্য হৃদয়ে দুঃখ-বেদনা জাগে না। কাদেরের হৃদয়ের শূন্যতার জন্যেই যুবতী নারীর মৃত্যুটা একটি নির্মম হত্যা ছাড়া কিছু নয়।
হয়তো যুবক শিক্ষক মতিচ্ছন্ন মানুষ। সে-বিষয়ে নিজে সে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারে না। কিন্তু তার কর্তব্য সে পরিষ্কারভাবে দেখতে পায়। কাদেরের বিচারের যে-ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল সে-ভার সে আর বহন করতে পারবে না। তাকে এবার কথাটা প্রকাশ করতে হবে। প্রথমে দাদাসাহেবকে, তারপর কর্তৃপক্ষকে।
কর্তব্যটি পালন করা যে কষ্টসাধ্য হবে তা সে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করে। সর্বপ্রথম দাদাসাহেবের কথাই তার মনে আসে। কথাটা তাঁকে বলা সহজ হবে না। তিনি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন আঘাত পাবেন, যে-আঘাত বৃদ্ধবয়সে তাঁর পক্ষে সামলে ওঠা হয়তো দুষ্কর হবে। হয়তো হঠাৎ তিনি দেখতে পাবেন, যে আশা-ভরসা আশ্বাস- বিশ্বাসের জোরে এতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন, তা সারশূন্য হয়ে উঠেছে : সমস্ত জীবনটাই এক পলকের মধ্যে নিষ্ফল হয়ে পড়েছে। তাছাড়া, যুবক শিক্ষক জানে তিনি অতিশয় দয়াবান মানুষ। তাঁর দয়াবান চরিত্রের ভিত্তি হল মানুষের প্রতি অটল বিশ্বাস! এমন মানুষের হৃদয়ে নিষ্ঠুর আঘাত দেওয়া কি সহজ? কর্তৃপক্ষকে বলাও সহজ হবে না। যে-হত্যাকাণ্ড সে নিজের চোখে দেখে নাই সে হত্যাকাণ্ডের সমর্থনে কী সাক্ষী-প্রমাণ পেশ করবে সে? বলতে বিলম্বেরও কী কারণ দেবে? তার মনের নানাপ্রকার বিচিত্র বিশ্বাস-চিন্তাধারার কথা তাদেরকে বলতে হবে। কিন্তু তখন তাদের কাছে তার অভিযোগটি বিভ্রান্তমস্তিষ্কের প্রলাপ বলে মনে হবে না কি? তাছাড়া, নদীতে যুবতী নারীর দেহটি ফেলার ব্যাপারে তার সহায়তারও কী ব্যাখ্যা দেবে?
কথাটি প্রকাশ করলে তার সমূহ ক্ষতিরও সম্ভাবনা আছে। কাদের ইতিমধ্যে তার পরিণামের কথা বলে তাকে ভয়-প্রদর্শন করেছে। যুবক শিক্ষক শুধু যে তার অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হবে না তা নয়, কাদের তার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ আনলে নিজেকে রক্ষা করার কোনো উপায় তার থাকবে না। এখন সে ভাবছে দাদাসাহেব কথাটি জেনে অত্যন্ত আঘাত পাবেন। হয়তো তিনি তা বিশ্বাস করতেই চাইবেন না। অকারণে তার কনিষ্ঠভ্রাতার গুরুতর ক্ষতি সে করতে চাইছে এই ধারণায় বদ্ধমূল হয়ে কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করে কাদেরকে রক্ষা তো করবেনই, তার বিরুদ্ধে কাদেরের পাল্টা জবাবটি যাতে টেকে তার যথাযথ ব্যবস্থা করবেন। সত্য কথা জেনেই যে তিনি এমন অন্যায় কাজ করবেন তা নয় : কাদেরকে অপরাধী বলে গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। আরেকটি কথা। ভাইকে রক্ষা করার প্রয়োজন ছাড়া আরেকটি প্রয়োজনও তিনি বোধ করবেন : তাঁর পরিবারের সুনাম রক্ষা করা
যুবক শিক্ষকের বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ না আনলেও কথাটি প্রকাশ করার পর তাকে বড়বাড়ির আশ্রয় এবং ইস্কুলের শিক্ষকতার চাকুরিটি ছাড়াতে হবে, তারপর এখানে থাকতে তার বিবেকে বাধবে। তখন সে কোথায় যাবে? কোথায়ই-বা এমন লাভজনক চাকুরি বা দাদাসাহেবের মতো এমন স্নেহ-দয়াশীল অভিভাবক পাবে?
তবু কথাটা প্রকাশ না করে তার উপায় নাই। উপায় থাকলে সে বলত না। বাঁশঝাড়ে একটি নারী অর্থহীনভাবে জীবন দিয়েছে। তার বিশ্বাস, মানুষের জীবন এত মূল্যহীন নয়। না, সত্যিই তার উপায় নাই।
যুবক শিক্ষকের শীর্ণ মুখ শুষ্ক কাঠের মতো নীরস-কঠিন মনে হয়। সে-মুখ কখনো যেন হাসবে না কাঁদবে না।
তেরো
দীর্ঘ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে নানারকম মৃদু সঙ্কুচিত আওয়াজ শুরু হয়েছে : দিনাগমনের বেশি দেরি নাই।
শীতটা কনকনে মনে হয়। তার হাড়ে-মজ্জাতে সে-শীত হানা দিলেও যুবক শিক্ষক নিশ্চল হয়ে শুয়ে অপেক্ষা করে। চৌকির নিকটে টিনের বাক্সটি তৈরি, টেবিলের ওপরটা শূন্য, ঘরের কোণ থেকে দড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেছে।
তারপর আকাশের ধূসর আলো কিছু পরিস্ফুট হয়ে উঠলে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। এবার যুবক শিক্ষক উঠে পড়ে দরজার নিচে দুইধাপ সিঁড়ির ওপর বসে ওজু করে। একবার সে দাদাসাহেবের জানালার দিকে তাকায়। তাঁর ঘরে আলো। মুহূর্তের মধ্যে যুবক শিক্ষকের ভেতরটা ব্যথায় মুচড়িয়ে ওঠে। দাদাসাহেব আজ নির্মম কথাটি জানতে পারবেন।
ঘরের কোণে এখনো অন্ধকার। সে-অন্ধকারে নক্শা-কাটা শীতলপাটির জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়াতেই সে ভেজানো দরজার কাছে একটি আওয়াজ শোনে। মাথাটা ঈষৎ সরিয়ে দেখে, সেখানে কাদের দাঁড়িয়ে। কিন্তু তাকে দেখেও সে যেন দেখে না। কোনো কথা না বলে তার দিকে পিঠ দিয়ে সে নামাজ পড়তে শুরু করে। কাদেরের অস্তিত্বের আর কোনো মূল্য নাই যেন। যুবক শিক্ষক তার মনে যে অত্যন্ত গুরুতর একটি কর্তব্যবোধের ভার বোধ করে, তার তলে কাদের নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
বড়বাড়িতে আসার পূর্বে নিয়মিতভাবে নামাজ পড়ার অভ্যাস যুবক শিক্ষকের ছিল না। আজকাল অন্ততপক্ষে সকাল-সন্ধ্যায় নামাজটা পড়ে। তবু ঠিক মনঃপ্রাণ দিয়ে পড়ে যে তা নয়। তার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার না করলেও তা সে সম্পূর্ণভাবে বোঝে না। কিন্তু আজ সে হঠাৎ অত্যন্ত নিঃসঙ্গ এবং অসহায় বোধ করে বলে নামাজ পড়তে দাঁড়ালেই তার মন একটি তীব্র ভাবোচ্ছ্বাসে ভরে ওঠে। সে যেন আর তোতার মতো মুখস্থ-করা বুলি আবৃত্তি করে সারশূন্য কর্তব্যপালন করছে না : যাঁর সামনে সে দাঁড়িয়েছে তাঁর উপস্থিতি সে অন্তর দিয়ে অনুভব করছে, তার বক্তব্য তাঁর কর্ণগোচর হচ্ছে তাতেও তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না।
মনে যে-অপরিচিত ভাবোচ্ছ্বাসের উদয় হয়, তাতে কিছু আশান্বিত হয়ে সে নিঃশব্দে সূরা আল্-খালাক পড়ে। অসংখ্যবার পড়েও যে-সূরাটি তার মনে কখনো আলোড়ন সৃষ্টি করে নাই, আজ সে-সূরার প্রতিটি শব্দ সহস্র অর্থে ঐশ্বর্যশালী হয়ে ওঠে। তাতে আশ্রয়-রক্ষার জন্যে নিঃসহায়ের যে-আকুল আবেদন, সে- আবেদনের মর্মার্থও সহসা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তার সাহায্যের দরকার। সঙ্কটের সময় কেবল দাদাসাহেবের কাছেই সে যেতে পারত। আজ সে- দরজা বন্ধ।
কিন্তু যুবক শিক্ষক শীঘ্র এ কথা উপলব্ধি করে যে, ভাবাপ্লুত হয়ে সজ্ঞানে প্রার্থনা করেও সে মনে কোনো শান্তি পাচ্ছে না। শীঘ্র তার মনে হয়, হয়তো কাদেরের উপস্থিতিই তার অশান্তির কারণ। কেন সে আবার এসেছে? কী তার বলার বাকি? যুবক শিক্ষকের সামনে কঠিন কর্তব্য। সে-কর্তব্যপালনের জন্যে তার শান্তি ও সাহসের প্রয়োজন। কাদের কেন তাকে বিরক্ত করতে এসেছে? যুবক শিক্ষকের মতো সে-ও যদি আজ নিঃসহায় নিঃসঙ্গ বোধ করে, তার জন্যে তার নির্দয় অন্তরই দায়ী। সে অন্তর মরুপ্রান্তরের মতোই ধু-ধু করে। সেখানে কোনো উদ্ভিদের জন্ম হলেও সে-উদ্ভিদ শীঘ্র কণ্টকাকীর্ণ হয়। সেখানে যদি ক্ষীণ আর্তনাদ জাগে, সে-আর্তনাদ চতুর্দিকের বালুরাশি অতিক্রম করতে পারে না। না, কাদেরের কোনো আবেদন থাকলেও তার কানে তা পৌঁছুবে না।
অশান্তি কাটে না দেখে যুবক শিক্ষক আরেকটি সূরা পছন্দ করে। কেন সেটি পছন্দ করে তা বোঝে না, কিন্তু তৃষ্ণার্তের মতো অধীরভাবে নিঃশব্দে তা আওড়াতে থাকে। দ্রুতভাবে তার ঠোঁট নড়ে, মনের গহ্বর থেকে সূরাটির শব্দগুলি অনর্গল ধারায় কিন্তু অশ্রোতব্যভাবে ঝরতে থাকে, তার চোখে চঞ্চলতা আসে। আবু লাহাবের শক্তি ধ্বংস হবে, সে ধ্বংস হবে : তার ধনসম্পত্তি তাকে রক্ষা করতে পারবে না। লেলিহান আগুনে সে নিক্ষিপ্ত হবে, তার স্ত্রী—কাষ্ঠবাহক স্ত্রী—তার গলায় তালতন্তু তৈরি ফাঁস-দড়ি পড়বে। সূরাটি পড়তে পড়তে তার বুকের স্পন্দন দ্রুত হয়ে ওঠে, কিন্তু আবৃত্তিতে একটু স্খলন হয় না, মনে কোনো ভয়ও জাগে না। কেন সে সূরাটি পড়ছে? তার চোখে কাদের কি আবু লাহাব -দম্পতিতে রূপান্তরিত হয়েছে? তাদের পাপ কি তার পাপের সমতুল্য? তাদের যে-শাস্তিবিধান কেতাবে লিখিত, সে-শান্তিবিধানই কি যুবক শিক্ষক তার জন্যে কামনা করে? অথবা পাপীর শাস্তি যে অনিবার্য সে-বিষয়ে তার মনকে সে কি নিশ্চিত করতে চায় যাতে তার সম্মুখে যে-কঠোর কর্তব্য সে-কর্তব্যপালনে তার মধ্যে কোনো দুর্বলতা দেখা না দেয়?
যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে না। মনে সে শান্তিও পায় না। নিমীলিত চোখে ভক্তিমান শান্তচিত্ত ব্যক্তির মতো সে নামাজ পড়ে, কিন্তু সেটি বাহ্যিক রূপ। ভেতরে অশান্তির জ্বালা।
অবশেষে নামাজ শেষ করে মাটিতে বসেই কাদেরের দিকে মুখটা সামান্য ফেরায়, কিছু বলে না। কাদের এবার তার খনখনে গলায় প্রশ্ন করে, ‘কী ব্যাপার?’
যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে, কাদের তার প্রস্থানোদ্যোগ লক্ষ করে। তার কারণ জানতে চায়।
সামনের দেয়ালটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। সেদিকে তাকিয়ে যুবক শিক্ষক নীরব হয়ে থকে। তার উত্তরের কোনো প্রয়োজন নাই। কাদের কিছু না বলে কতক্ষণ চুপ করে থাকে। মনে হয় সে আর কিছু বলবে না, কিছু ঘটবেও না। তারপর অকস্মাৎ বিষম ক্রোধে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে অস্ফুটকণ্ঠে বিড়বিড় করতে শুরু করে। যুবক শিক্ষক তার কথা বুঝতে পারে না, বুঝবার চেষ্টাও করে না। কেবল তার ক্রোধটা দমকা হাওয়ার মতো তার গায়ে ঝাপটা দিলে সে অকারণে দুর্বল বোধ করতে শুরু করে।
তারপর কাদের নীরব হয়ে কেমন দম খিচে থাকে যেন। অবশেষে কৃত্রিম সংযত গলায় প্রশ্ন করে, ‘কজন চাই? সাক্ষী। কজন চাই?’
সামনের দেয়ালের রক্তিমাভা দেখা দিয়েছে। সে রক্তিমাভার অর্থ যুবক শিক্ষক যেমন বোঝে না, তেমনি কাদেরের কথারও অর্থ সে বোঝে না। নিস্পন্দভাবে সে বসে থাকে : সে যেন স্তূপাকার হাড়মাত্র।
কাদেরের সংযম স্থায়ী হয় না। সে এবার গর্জে ওঠে, ‘ক-জন সাক্ষী চাই? তারা বলবে কোথায় আপনাকে দেখেছে।’
এবার যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে, কাদের তাকে ভয়-প্রদর্শন করছে। কিন্তু এবারও কিছু না বলে সে পূর্ববৎ নিশ্চল হয়ে বসে থাকে। তবে আরেকটি কথা বুঝতে পেরে সে স্বস্তিই বোধ করে। সে মুখ খুলে কথাটি যদিও বলে নাই, কাদের তার সঙ্কল্পটি অনুমান করতে পেরেছে। তাকে মুখ খুলে কথাটি বলতে হবে না।
যুবক শিক্ষকের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর না পেলে কাদের হয়তো হতাশ হয়েই এবার নীরব হয়ে পড়ে। মনে হয়, দমকা হাওয়া নিঃশেষ হয়ে গেছে। ঘরময় নীরবতাটি অবিচ্ছিন্ন থাকলে এক সময়ে যুবক শিক্ষকের মনে হয়, হয়তো কাদের কখন নিঃশব্দে উঠে চলে গেছে। তাকিয়ে দেখবে কি দেখবে না সে-কথা ভাবছে, এমন সময় নিতান্ত অপরিচিত গলায় আস্তে প্রশ্ন করে, ‘মেয়েলোকটাকে চিনতেন?’
কাদেরের কণ্ঠস্বর তাকে এতই বিস্মিত করে যে তার মুখ হতে আপনা থেকেই একটা উত্তর বেরিয়ে আসে। সে বলে, ‘না।’
‘সে বেঁচে নাই বা কীভাবে মরেছে, তাতে আপনার কী?
প্রশ্নটির জন্যেই হোক বা তার কণ্ঠস্বরের জন্যেই হোক যুবক শিক্ষকের মনে এবার একটা সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কাদের তার জন্যে কোনো প্রকারের ফাঁক তৈরি করছে যেন। থেমে কাদের আবার বলে, ‘কিন্তু দুর্ঘটনাটির কথা কাউকে বললে আমার কী হবে জানেন?’ সে যেন অবোধ শিশুর সঙ্গে কথা বলছে। যুবক শিক্ষক আরো সতর্ক হয়, কিন্তু উত্তরটা শুনবার জন্যে তার শ্রবণেন্দ্রিয়ও সজাগ হয়ে ওঠে। পূর্ববৎ কণ্ঠে কাদের বলে, ‘ফাঁসি।’ থেমে আবার বলে, ‘তাতে আপনার লাভ কী হবে?’
প্রথমে কোনো প্রতিক্রিয়াই যুবক শিক্ষক অনুভব করে না। তারপর সে বুঝতে পারে, হঠাৎ তার সমস্ত শরীর অতিশয় দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমন ক্ষিপ্রগতিতে সে-দুর্বলতা সমস্ত শরীরে বিস্তারলাভ করে যে সে তা প্রতিরোধ করার কোনোই চেষ্টা করে না। কিন্তু কাদের যে- শব্দটি উচ্চারণ করেছে সে-শব্দটিতে সে এমন তীব্রভাবে আঘাত পাবে কেন? কথাটা কি সে একবারও ভাবে নাই? না, কথাটা সে ভাবে নাই। অন্ততপক্ষে, স্পষ্টভাবে ভাবে নাই। সে তার কর্তব্যের কথা ভেবেছে, কিন্তু পরিণামের কথা স্পষ্টভাবে ভাবে নাই। সে কি মনে করেছিল কথাটি তার এলাকার বাইরে? না, কথাটি ভাবতে তার সাহস হয় নাই?
যুবক শিক্ষক তার মুখের পার্শ্বদেশে কাদেরের দৃষ্টি অনুভব করে। একটা উত্তরের আশায় কাদের তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একটা উত্তর দেয়ার প্রয়োজনও সে নিজেই বোধ করে কিন্তু কী করে উত্তর দেবে? তার মনে হয়, কাদেরের দৃষ্টির তলে সে যেন গলে যাচ্ছে। একটি কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষ ক্রমশ একটি দায়িত্বহীন মানুষে, একটি বুদ্ধিমান মানুষ নির্বোধ মানুষে পরিণত হচ্ছে। যা সে শক্ত করে ধরেছিল তা যেন হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে। না, তার প্রতি ভাগ্যের নির্মমতা সত্যিই মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাঁশঝাড়ে একটি মৃতদেহ দেখেই তার নিস্তার নাই, একটি মানুষের জীবনমৃত্যুর দায়িত্বও তাকে নিতে হবে।
যুবক শিক্ষকের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেলেও হয়তো তার মুখে বিহ্বলতার ভাব লক্ষ করে কাদের আশ্বস্ত বোধ করে। এবার বড়বাড়ির ছোকরাটি সকালের নাস্তা-পানি নিয়ে এলে কোনো কথা বলে, যেন আলাপ-আলোচনার মধ্যখানে বক্তব্য অসমাপ্ত রেখে কাদের হঠাৎ উঠে চলে যায়। যুবক শিক্ষক যখন সে-কথা বুঝতে পারে তখন সে অতি বিস্মিত হয়ে দরজার দিকে তাকায়। দরজাটি অর্থহীনভাবে শূন্য মনে হয়।
কথা শেষ না করে এমনভাবে কাদের চলে গেল কেন? সে কি তাহলে বুঝতে পারে নাই যে আজই সকালে তার নিষ্ঠুর কীর্তির কথা প্রকাশ করবে বলে সে মনস্থির করেছে? কথাটা অবশ্য বিশ্বাস হয় না। তবে যুবক শিক্ষককে নীরব থাকবার জন্যে স্পষ্টভাবে অনুরোধ করে সে তার বক্তব্যটি সম্পূর্ণ করে নাই কেন?
অবশেষে একটি কথা যুবক শিক্ষকের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে এবং তা তার কাছে বিশেষ অর্থপূর্ণ মনে হয়। কাদের তাকে ভয় দেখিয়েছে, পরিণামের কথা বলেছে, কিন্তু বাঁশঝাড়ের কথাটি প্রকাশ না করার জন্যে একবারও অনুরোধ করে নাই। কেন? কারণ এ-কথা সে জানে যে, যুবক শিক্ষক একবার তার কাজের পরিণাম বুঝতে পারলে কথাটি প্রকাশ করা উচিত হবে কি হবে না তা সে নিজেই বুঝতে পারবে, নিষেধের প্রয়োজন হবে না। কাদের কি তার বুদ্ধিবিবেচনায় গভীর আস্থা প্রকাশ করে নাই?
জায়নামাজে বসেই যুবক শিক্ষক স্থির হয়ে থাকে। সময় কাটে। টেবিলের ওপর চা কিছুক্ষণ ধোঁয়া ছেড়ে থেমে গেছে, বাইরে উঠানে রোদ পড়েছে।
যুবক শিক্ষকের সন্দেহ থাকে না, কোথায় কী যেন গোলতাল পাকিয়ে উঠেছে, সে যেন নিজের উদ্দেশ্যই ভালোভাবে বুঝতে পারছে না। সে কী চায়? কেনই-বা তার মধ্যে একটুতেই এমন বিহ্বলতা দেখা দেয়? অথচ মাঝে মাঝে রাগান্বিত হলেও কাদেরকে এমন সুস্থির এবং আত্মনির্ভরশীল মনে হয় কেন? সে যেন সব জানে, সব বোঝে তাছাড়া, একটি নারীর মৃত্যুর অর্থই-বা কী?
অবশেষে যুবক শিক্ষক উঠে দাঁড়ায়। দেহের অসীম দুর্বলতা তার মনেও গভীর অবসাদ সৃষ্টি করেছে। সে যন্ত্রচালিতের মতো বড়বাড়ির অভিমুখে রওনা হয়। সে জানে, অন্যান্য দিনের মতো সে ছেলেমেয়েদের পড়াতেই যাচ্ছে।
না, তার সঙ্কল্পে কোনো পরিবর্তন হয় নাই। তবে আজ সকালে সে দাদাসাহেবকে কথাটা না বলে সন্ধ্যাবেলায়ই বলবে। ইতিমধ্যে এত দেরি হয়েছে, আরেকটু দেরি হলে তেমন ক্ষতি কী? বিষয়টি আবার ভেবে দেখা প্রয়োজন। তার বিবেচনায় যদি কোনো ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে তবে একবার বলে ফেললে পরে শোধরানো সহজ হবে না। অবশ্য ভুলভ্রান্তির কোনো সুযোগ সে দেখতে পায় না। তবু বিষয়টি অতি গুরুতর। তার সিদ্ধান্তের যথার্থতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়া ভালো।
একটি কথায় সে নিজেই কিছু বিস্মিত না হয়ে পারে না। বাঁশঝাড়ের ঘটনাটি প্রকাশ করায় কিছু বিলম্বের সুযোগ পেয়ে সে এমন স্বস্তিবোধ করছে কেন?
চৌদ্দ
দুপুরবেলায় ইস্কুলের বিশ্রামঘরে আত্মপ্রবঞ্চনার কথাটি যুবক শিক্ষক সর্বপ্রথম আপন-মনে স্বীকার করে। বস্তুত, স্বীকার করতে সে বাধ্য হয়। সর্বপ্রকার চেষ্টার শেষ হয়েছে, কি করে তার ক’দিনব্যাপী মানসিক বিহ্বলতার সত্য কারণ নিজের কাছে আর ঢেকে রাখে? সঙ্গে সঙ্গে যে- ন্যায়বানের শ্বেতসৌধ সে সৃষ্টি করেছিল তা নিমেষে ধূলিসাৎ হয়। নিজের কাছেই সে নিজে ধরা পড়েছে অবশেষে : কোথাও আর একটি প্রাচীর দাঁড়িয়ে নাই যার পশ্চাতে সে আত্মগোপন করতে পারে।
সত্যি, সন্দেহের আর অবকাশ নাই। জটিল এবং পরিশ্রমসিদ্ধ আত্মপ্রবঞ্চনাটি শুরু হয় তখন যখন আত্মরক্ষার প্রবল বাসনার জন্য তার বিবেকের নির্দেশ শুনতে সে অক্ষম হয়। তারপর তার লজ্জাকর ভীতি-দুর্বলতা সে নিজের কাছেই লুকাবার চেষ্টা করে।
কাদের একটি গুরুতর অপরাধ করেছে তা জানতে পারলে একটি কঠিন সমস্যাও সে অনতিবিলম্বে দেখতে পায়। লোকটি সম্ভ্রান্তশালী অভিভাবক আশ্রয়দাতার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। অন্যদিকে, যুবতী নারী শুধু যে তার সম্পূর্ণ অপরিচিতা তা নয়, সে আর জীবিতদের মধ্যে কখনো প্রত্যাবর্তন করবে না। আজ সকালে কাদেরের উক্তির পরেই সে তা বুঝতে পারে। কাদের তাকে প্রশ্ন করেছিল, সে যুবতী নারীকে চিনত কিনা। হত্যাকাণ্ডটি প্রকাশ করলে তার কী শাস্তি হবে তা-ও সে স্পষ্টভাবে বলেছিল। বস্তুত, আত্মপ্রবঞ্চনার কথাটি বুঝবার ব্যাপারে কাদেরই তাকে সাহায্য করেছে।
যুবক শিক্ষক লজ্জাই বোধ করে, তার কানে কেমন ঝাঁঝ ধরে। কিন্তু স্বীকার না করে উপায় নাই, সে ভাবেই মানসিক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। বিবেক বলে, কথাটি প্রকাশ করা তার কর্তব্য, কিন্তু কাজটি তার কাছে দুষ্কর মনে হয়। সে দুর্বল মানুষ। মানসিক দ্বন্দ্বটি অসহ্য হয়ে উঠলে সে একটি পলায়নপথ আবিষ্কার করে : স্বপ্নরাজ্যে সে আশ্রয় গ্রহণ করে। তার দুর্বলতার সমর্থনে যদি কোনো যুক্তি থাকে তবে তা হয়তো এই যে, যুবতী নারী তার অপরিচিতা বলেই তার প্রতি নির্মম অবিচারটি সে সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারে নাই, কাদেরের অপরাধটিও হৃদয় দিয়ে অনুভব করে নাই। কিন্তু সে-যুক্তিতে জোর আছে কি নাই তার বিবেচনা এখন তার কাছে অহেতুক মনে হয়।
কর্তব্যটি যাতে পালন না করতে হয় সে জন্যে স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ করে সেখানেই সে এ ক’দিন বাস করছে। যুবতী নারীর মৃতদেহটি বহনের ব্যাপারে কাদের যখন তার সাহায্যপ্রার্থী হয় তখন সে ইতিমধ্যে স্বপ্নরাজ্যে পৌঁচেছে। বাস্তবজগৎ তখন মূল্যহীন বলে কাদেরকে সে-ব্যাপারে সাহায্য করতে তার বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় নাই। তবে স্বপ্নরাজ্যে সে নিরাপদ বোধ করে নাই : সব প্রবঞ্চনার মধ্যে আত্মপ্রবঞ্চনাই অধিকতম শক্ত। তাই সেখানে সে অলস হয়ে বসে থাকে নাই। তার বাহ্যিক আচরণ বিহ্বল মানুষের মতো হলেও সে অতি দক্ষতা এবং ব্যগ্রতার সঙ্গে কাদেরকে দোষমুক্ত করবার জন্যে একটির পর একটি বিচিত্র অবিশ্বাস্য যুক্তি-অজুহাত আবিষ্কার করেছে। কেন? কারণ কাদের নির্দোষ প্রমাণিত হলেই তার রক্ষা। তাহলে বিবেকের নির্দেশটি তাকে আর শুনতে হবে না, বিপজ্জনক কর্তব্যটিও পালন করতে হবে না। আত্মরক্ষার জন্যে সে কী সব যুক্তি-অজুহাতই না আবিষ্কার করেছে এবং তাতে নিজেই বিশ্বাস করেছে? যেমন, কাদের কেন মৃতদেহটি নদীতে ফেলবে ঠিক করে। হঠাৎ যুবক শিক্ষকের কাছে কাদের একটি দয়াশীল মহৎ মানুষ হিসেবে উদয় হয় এবং সে যুবতী নারীকে একটি নিদারুণ অপমান থেকে উদ্ধার করতে চায়।
তবে গোড়াতে আত্মপ্রবঞ্চনা শক্ত বলেই নয়, অন্য একটি কারণেও সে-সব যুক্তির পশ্চাতে আশ্রয় গ্রহণ করা তার পক্ষে তত সহজ হয় নাই : তখন বাঁশঝাড়ের সত্য কথাটি সে নিশ্চিতভাবে জানত না। দুঃখের বিষয়, কাদের নিজের মুখেই কথাটি স্বীকার করে বসে। তারপর যুবক শিক্ষকের পক্ষে স্বপ্নরাজ্যে বাস করা যেন অসম্ভব হয়ে পড়ে, পালাবারও কোনো পথ থাকে না। কিন্তু হাল ছাড়তে সে রাজি হয় না। তার ভীত-নিপীড়িত মস্তিষ্ক শীঘ্র একটি নূতন যুক্তি দেখতে পায়। যুক্তিটি এই যে, যুবতী নারীর প্রতি প্রেম ছিল বলেই কাদের তার অন্তিম ব্যবস্থা না করে পারে নাই। এবং, যেহেতু নারীর প্রতি কাদেরের প্রেম ছিল সেহেতু হত্যাকাণ্ডটি শুধুমাত্র একটি শোচনীয় দুর্ঘটনা নয় কি? আর সে যুক্তি অনুসারে তার অপরাধও কি ক্ষমাই নয়?
কাদেরের হাতেই যুবক শিক্ষকের স্বপ্নরাজ্যের দুর্বল প্রাচীর দ্বিতীয় বার ভাঙে। প্রেমের কথাটি সে স্বীকার করে না। বরঞ্চ সেটি যে অচিন্তনীয় সে-কথা সে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয়। এবার যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে, তার পালাবার সত্যিই কোনো পথ নাই : তার কর্তব্যটি যতই ভীতিজনক হোক না কেন, সেটি এড়াবার আর কোনো উপায় নাই।
সম্পূর্ণভাবে নিরাশ হয়ে সে যখন ঘটনাটি প্রকাশ করবার জন্যে সাহস যোগাড় করার চেষ্টা করছে তখন কাদের তাকে প্রথম বার একটু সাহায্য করে স্বপ্নরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করার একটি পথ দেখায় তাকে। সে বলে, ঘটনাটি প্রকাশ করলে তার চূড়ান্ত শাস্তি হবে এবং তার জন্যে যুবক শিক্ষক একাই দায়ী হবে। কাদের যে-বীভৎস শব্দটির উচ্চারণ করে সে–শব্দটিই ঘোর তমসার মধ্যে একটু আলোর সৃষ্টি করে। নতুন উদ্যমে যুবক শিক্ষক তার যুক্তির তলোয়ারে শান দেয় এবং তার এই বিশ্বাস হয় যে, সে অস্ত্রটির সাহায্যে সে যে শুধু বিবেকের সামনাসামনি হতে পারবে তা নয়, বিবেককে কাবু পর্যন্ত করতে পারবে। এবার তার নিজের সর্বনাশের প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হচ্ছে অন্য একটি মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে। সে নিজের প্রাণের জন্যে ভীত নয়, অন্য মানুষের প্রাণের জন্যে ভীত। সে-মানুষের জীবন-মৃত্যু সম্বন্ধে একটি ভীষণ দায়িত্ব গ্রহণ করার যথার্থ সব কারণ কি তার জানা আছে?
যুক্তিটি অব্যর্থ মনে হয় কেবল অল্প সময়ের জন্যেই। শীঘ্র সে বুঝতে পারে, সেটি অতিশয় দুর্বল। আত্মপ্রবঞ্চনার জন্যে যথেষ্ট তো নয়ই, তা দিয়ে বিবেককেও মানানো যায় না। আর কোনো উপায় যখন নাই তখন সত্য কথাটি স্বীকার করতে অসীম লজ্জা হলেও তা স্বীকার করাই কি বাঞ্ছনীয় নয়? তাছাড়া, আপন-মনে বিবেকের মূল্য কী?
সত্য কথা হল এই, বাঁশঝাড়ের হত্যাকাণ্ডটি প্রকাশ করার সাহস তার নাই। প্রথম দিন ছিল না, আজও নাই। সে ভীত, দুর্বলচিত্ত অসহায় মানুষ। কাদেরের ভয়-প্রদর্শন কার্যকরী হয়েছে। নিজেকে ফাঁকি দেওয়া আর যখন সম্ভব নয় তখন ফাঁকি দেবার চেষ্টা ছেড়ে কেন সে ভীত সে-কথা খোলাখুলিভাবে বুঝবার চেষ্টা করাটাই কি সাধু কাজ হবে না? তাছাড়া, বিবেকের মুখ বন্ধ করবার জন্যে ছলনার চেয়ে এ পন্থাটাই অধিকতর কার্যকরী। বস্তুত তার মনে হয়, ভীতির নগ্ন চেহারা দেখে বিবেকের কণ্ঠস্বর ইতিমধ্যে সম্পূর্ণভাবে স্তব্ধ হয়েছে।
ঘটনাটি প্রকাশ না করার পক্ষে যে-সব যুক্তি সে পরিষ্কারভাবে ভাবতে সাহস পায় নাই, এবার সে-সব যুক্তি বিশ্লেষণ করে দেখতে তার আর বাধে না। চারপাশে খোলা মাঠ, আর বাধা কোথায়? প্রথমত, সে নিজের কথাই ভাবে। কে সে? একজন দরিদ্র শিক্ষক মাত্র। বর্তমানে জনৈক সম্ভ্রান্ত ধনী কিন্তু দয়াশীল মানুষের অভিভাবকত্বে জীবনে সর্বপ্রথম বেদনাদায়ক অভাব-অভিযোগটা যেন ভুলেছে, সুখের একটু আস্বাদ পেতে শুরু করেছে। তার ব্যক্তিগত দারিদ্র্যই যে শুধু ঘুচেছে তা নয়। সে তার বিধবা মা এবং তার মুখাপেক্ষী দুটি ভাই-বোনকেও খাওয়াতে পরাতে পারছে। তার যদি কোনো ক্ষতি হয় তবে কে তাদের দেখাশোনা করবে? কাদের যে তাকে মিছামিছি ভয় দেখিয়েছে সে-কথা ভাবা অন্যায়।
তাছাড়া, কার জন্যেই-বা সে নিজের সর্বনাশ করবে? যুবতী নারী তার আত্মীয়-বন্ধু নয়, তার মৃত্যুতে সে ব্যক্তিগতভাবে কোনোপ্রকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই। এ হতভাগা দেশে কত যুবতী নারীর জীবন অর্থহীনভাবে এবং অকারণে শেষ হয়, কে প্রতিবাদ করে, কে একবার ফিরে তাকায়? যেখানে জীবন মূল্যহীন সেখানে আরেকটি জীবন শেষ হয়েছে। কীভাবে হয়েছে, তাতে কোনো অন্যায়-অবিচার হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে মাথা ঘামিয়ে সে নিজের ওপর বিপদ ডেকে আনবে কেন?
তারপর, কাদেরের কথা। হোক তার অপরাধ অতি গুরুতর বা যুবতী নারীর সঙ্গে তার সম্পর্কের কারণ পশুবৎ বাসনা, হোক সে নির্মম-নির্দয় মানুষ, তবু সে যুবক শিক্ষকের কোনো ক্ষতি করে নাই। তাছাড়া, কাদের তার বন্ধু না হোক, সে তার শত্রুও নয় : তার প্রতি সে হিংসাদ্বেষ বা প্রতিহিংসার ভাব বোধ করে না। কাদেরের সঙ্গে লড়াই করে তার কী লাভ হবে, কারই-বা সে মঙ্গল করবে?
যুবক শিক্ষকের মনে কোনো সন্দেহ থাকে না যে, যুবতী নারীর মৃত্যুর সুবিচার হোক, তার চেষ্টা করলে কেউ তাকে সমর্থন করবে না, কেউ তাকে সাধু-সত্যবান বলে তার গলায় মালা দেবে না। সত্যবাদিতার মূল্য অবশ্য কেউ খোলাখুলিভাবে অস্বীকার করে না। এ-কথাও কেউ অস্বীকার করে না যে, সাক্ষ্য দেবার সমন পড়লে মিথ্যা বলা অন্যায়—বিশেষ করে মিথ্যাবিবৃতি যখন ধরা পড়ে। কিন্তু যুবক শিক্ষককে কেউ সমন পাঠায় নাই। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সত্যকথা বললে, এবং তার জন্যে শাস্তি লাভ করলে, তাকে তারা নির্বোধই বলবে।
যুবক শিক্ষক সহসা তার সহযোগীদের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।
‘মানুষটি আরামে ছিল। খাসা চাকুরি, বড়বাড়িতে জামাই-আদর। বোকা না হলে খামাখা নিজের ওপর এমন সর্বনাশ ডেকে আনবে কেন?’
‘তাই। কত অন্যায়-দুর্নীতির কথা মানুষ জানতে পায়। কিন্তু নিজের ভাত মারা না পড়লে নিজের ক্ষতি করে কেউ সে-সব কথা প্রকাশ করে নাকি?’
আদর্শ চরিত্র শুধু রূপকথায় বিরাজ করে, বাস্তবজগতে তার অস্তিত্ব নাই।
যুবক শিক্ষকের কোনো ক্ষতি না হলেও, এবং কাদেরের যথাযথ শাস্তি হলেও তারা যুবক শিক্ষককে উচ্চাসনে বসাবে না। তার কার্যে তারা গূঢ় অভিসন্ধি খুঁজে বের করবে।
‘নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো কথা আছে।’ (উক্তিটি যুবক শিক্ষক বারবার শোনে নাই কি?) ‘তার নিরীহ গোবেচারা চেহারায় ভুলবেন না।’
‘কী কথা?
‘বলে দিলাম, মেয়েলোকটির সঙ্গে আমাদের মাস্টারটিরও যোগাযোগ ছিল।’
ন্যায়বানের প্রতি ক্রূরহিংসায় তাদের হৃদয়ে অশান্তির সৃষ্টি হবে। অন্য কেউ আরেকটি সম্ভাবনার কথা বলবে।
‘কোনো কারণে বড়বাড়িতে জামাইর আদর শেষ হয়ে আসছিল। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যাদের নিমক খেয়েছে তাদেরই ক্ষতি করবার জন্যে কথাটা সে প্রকাশ করেছে।’
অকারণে কেউ ন্যায়বানের মুখাচ্ছাদন পরে না।
যুবক শিক্ষকের বিরুদ্ধে কাদেরের পাল্টা অভিযোগটা প্রমাণিত হলে কারো মনে কি একবার কাদেরের দেরি করে কথাটা প্রকাশ করার বিষয়ে একটু প্রশ্ন জাগবে না? হয়তো জাগবে। কিন্তু যুবক শিক্ষক তারও একটা উত্তর শুনতে পায়।
‘আহা, দরবেশ মানুষ। অতশত কী বোঝে?’
যুবক শিক্ষক তার সমর্থনে একটি কণ্ঠস্বরও শুনতে পায় না। কিন্তু জয় বা পরাজয়ের পরে তারা কী বলবে, সে-ভয়েই যে সে ভীত তা নয় : তাদের সম্ভাব্য মতামতের জন্যেও সে আত্মপ্রবঞ্চনার প্রয়োজন বোধ করে নাই। তবু সে-সব কি ঘটনাটি প্রকাশ না করার পক্ষে গণ্য করা যায় না?
যুবক শিক্ষক কিছুক্ষণ আপন মনে স্তব্ধ হয়ে থাকে। তার অনুসন্ধান যেন শেষ হয়েছে। পূর্বের সিদ্ধান্তটি ত্যাগ করে নূতন সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে আর কোনো বাধা নাই। ভেতরটা কেমন হাল্কা হাল্কাই মনে হয়, কষ্টকর আত্মপ্রবঞ্চনার প্রয়োজন থেকে মুক্ত হয়ে সে হয়তো স্বস্তিই বোধ করে।
তবু সে নিজের মনেই শেষবারের মতো দুটি প্রশ্ন না করে পারে না। যুবতী নারীর সঙ্গে কাদেরের সম্পর্কটি যখন নিন্দনীয় এবং হত্যাকাণ্ডটি যখন অতিশয় গুরুতর অপরাধ, তখন তা প্রকাশ না করে কেউ চুপচাপ বসে থাকতে পারে কি?
যুবক শিক্ষক আবার তার সহযোগীদের চেহারা দেখতে পায়। তারা যেন কেমন গোপনভাবে হাসছে। তারপর তাদের উত্তরটা সে শুনতে পায়।
‘পুরুষের ওসব দুর্বলতা একটু থাকেই। দোষটা আসলে মেয়েলোকটির। দুশ্চরিত্রা হলে এমন অপঘাত মৃত্যু অবধারিত।’
বিশ্রামঘরটা শীতল হলেও কেমন ভ্যাপসা গরম বোধ করে যুবক শিক্ষক। চারপাশটা কেমন সঙ্কুচিত হয়ে উঠেছে যেন। হয়তো ভালো করে শ্বাস নেবার জন্যেই সে সোজা হয়ে উঠে বসলে আরবির মৌলবীর ওপর তার দৃষ্টি পড়ে। আজ সে বিপরীত দিকে বসে চোখ বুজে হয়তো ঝিমুচ্ছে। যুবক শিক্ষক অকারণে তার চিন্তাশূন্য শান্ত মুখমণ্ডলের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর সে বুঝতে পারে, নিজের মনে যে-সব সহযোগীদের চেহারা সে দেখেছিল তার মধ্যে মৌলবীর শাশ্রুমণ্ডিত চেহারাটি নাই। তাকে কি একবার জিজ্ঞাসা করে দেখবে? হয়তো সে তাকে সমর্থন করবে। মনের ভীতির জন্যে যে-ব্যাপারটি তার কাছে অতীব গুরুতর সমস্যায় পরিণত হয়েছে, হয়তো সেটি তার কাছে কোনো সমস্যাই মনে হবে না। সমস্যা কোথায়? একটি খুনের কথা সে জানতে পেরেছে। সে-কথা সে প্রকাশ করবে। তাতে কোনো জটিলতা বা ভীতির প্রশ্ন নাই।
মৌলবী চোখ বুজে থাকলেও চোখের অন্তরালে তার দৃষ্টি অবিশ্রান্তভাবে এধার-ওধার নড়ে : যেন চোখ বুজেই সে সব কিছু দেখতে পায়। তারপর তার চোখের পাতা নিমীলিত থেকেই প্রজাপতির পাখার মতো ফড়ফড় করতে শুরু করে, মনে হয় চোখ খুলবে। কিন্তু এবার মৌলবীর জিহ্বাগ্র ধীরে-সুস্থে এবং নিপুণতার সঙ্গে দাঁতপাটির গুহাগহ্বরে খাদ্যকণার সন্ধানে নিযুক্ত হয়। অনতিবিলম্বেই সে তার সন্ধানকার্যে সাফল্যমণ্ডিত হয়। তারপর কয়েক মুহূর্তের জন্যে তার চোখমুখ নিশ্চল হয়ে পড়ে। সে কি তুচ্ছ খাদ্যকণাটির জন্যে মহান অন্নদাতার কাছে শোকর আদায় করছে?
হয়তো সেটি তার খেয়াল, তবু যুবক শিক্ষক ক্ষিপ্রগতিতে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়, সঙ্গে সঙ্গে একটা গভীর নিরাশায় সে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। না, মৌলবীর মতো অসহায় ব্যক্তির কাছ থেকে কোনো উপদেশ আশা করা বৃথা।
কিন্তু উপদেশের আর প্রয়োজনই-বা কী? ইতিমধ্যে তার সমস্যার সমাধান কি হয় নাই? ঘটনাটি প্রকাশ করার বিরুদ্ধে নানাবিধ যুক্তিতর্কে সে কি সন্তুষ্ট নয়?
না, সে সন্তুষ্ট। সমস্যার সমাধান হয়েছে, আর ভাবনার কারণ নাই। কাউকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন আর নাই।
বিশ্রামঘরে আজ প্রগাঢ় নীরবতা, তর্কবিতর্ক এখনো শুরু হয় নাই। সে নীরবতার মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি অস্পষ্ট শ্রান্তিতে চোখ বোজে। তার কি ঘুম পাচ্ছে? জোয়ারের সময় চর যেমন আস্তে, অলক্ষিতে ডুবে যায়, তেমনি তার সমগ্র অস্তিত্ব শ্রান্তির কালো জোয়ারে নিমজ্জিত হয়। না, তার আর কোনো প্রশ্ন নাই, বলবারও কিছু নাই। নিঃশব্দে সময় কাটে। কখনো কখনো কেউ কথা বললে মনে হয় তার কণ্ঠ যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসে। বাইরে মাঠে খেলারত ছেলেদের চিৎকারধ্বনি অর্থহীন কোলাহলে পরিণত হয়।
তারপর একসময় যুবক শিক্ষক আস্তে চোখ খুলে তাকায়। তার দৃষ্টি ছায়াচ্ছন্ন; কী যেন তার স্মরণ হয়েছে। একটু পর সে কারো সন্ধান করে, ধীরে ধীরে এধার-ওধার তাকায়। অবশেষে তারই বাম পাশে উপবিষ্ট সেদিনের বিজয়ী বক্তার ওপর তার দৃষ্টি থামে। সে আজ নির্বাক। নত মাথায় আঙুল দিয়ে নাক খুঁটতে খুঁটতে গভীর মনোযোগসহকারে সে একটি সংবাদপত্র পড়ে।
শীঘ্র সে পাতা উল্টাতে খস্থস আওয়াজে ঘরের নীরবতা ভঙ্গ হয়। যুবক শিক্ষক আর দ্বিধা করে না। বক্তাকে প্রশ্ন করে, ‘মেয়েলোকটার সম্বন্ধে কিছু জানা গেছে কি?’
তার আকস্মিক প্রশ্নে বিশ্রামঘরে অতি ক্ষীণ একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয়, যেন শান্ত পানির বুকের ওপর দিয়ে একটা পাখি উড়ে গেল। তারপর কয়েক জোড়া দৃষ্টি তার ওপর নিবদ্ধ হয়।
সেদিনের খবরবিশারদ প্রথমে যুবক শিক্ষকের প্রশ্নটির অর্থোদ্ধার করতে যেন সক্ষম হয় না। সে কি এর মধ্যে এমন মুখরোচক কথাটি ভুলে গেছে?
না, তার স্মরণ হয়। বিপরীত দেয়ালের দিকে চোখ মিট্মিট্ করে তাকিয়ে নাকে একবার উচ্চ আওয়াজ করে, ডান ঊরুটা চুলকে নেয় বার কয়েক। তারপর সে পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘কী জানা যাবে?’
যুবক শিক্ষকের গলায় ঈষৎ কাঁপন ধরবার উপক্রম করে। সরাসরি প্রশ্নটা করতে তার দ্বিধা হয়। অবশেষে অস্ফুটভাবে কেশে সে বলে, ‘কে তাকে খুন করেছে?’
‘ও।’ এবার বক্তার চোখ ক্ষিপ্রগতিতেই মিট্মিট্ করতে শুরু করে। তারপর তাতে সামান্য হাসির আভাস জাগে। যুবতী নারীর মৃত্যু সম্বন্ধে সে একটি বিচিত্র খবর দেয়।
যুবতী নারীর বৃদ্ধা মায়ের বিশ্বাস যে, হতভাগিনীর ওপর জিন-পরীর আছর পড়েছিল। একদিন দুপুরবেলায় উঠানে বসে সে শালীর চুলে উকুন দেখছিল, এমন সময় দীর্ঘকায় সাদা কিছু তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মেঘহীন আকাশে সাদা মেঘের মতো, স্তব্ধদিনে দমকা হাওয়ার মতো। কানা শালী কিছু দেখতে না পেলেও তার গায়ে হাওয়া লাগে। তবে কেমন ধরনের হাওয়া যেন। বৃদ্ধা নারী ঘরে ছিল। অকারণে তার বুকটাও কেঁপে ওঠে।
সেদিন থেকে যুবতী নারীর দশা উপস্থিত হয়। যার একবার দশা হয় সে কি আর বাঁচতে পারে?
শীঘ্র হাসির ভাবটা মিলিয়ে যায় বক্তার চোখ থেকে।
‘কেন?’
কয়েক জোড়া দৃষ্টি যুবক শিক্ষকের উপর পূর্ববৎ নিবদ্ধ হয়ে থাকে।
প্রশ্নটি সে শুনতে পায় না। এবার তার মনে পরম স্বস্তির ভাব এলে সে ভাবে, শেষ বাধাটিও অবশেষে দূর হয়েছে। চাষাভূষা মানুষেরাও কথাটা গোপন রাখার প্রয়োজন বোধ করে। এ-বিষয়ে হন্তা-নিহতের মধ্যে কোনো প্রভেদ নাই।
সন্দিগ্ধ চোখে বক্তা সহযোগীদের সঙ্গে একবার দৃষ্টি বিনিময় করে আবার বলে, কেন?’
‘এমনি।’ যুবক শিক্ষক কোনোপ্রকারে উত্তর দেয়। তারপর সে মাথা নত করে। মুখে ভারি কিছু নেবেছে যেন, ঠোঁটের পাশটাও কেমন বিকৃত হয়ে উঠেছে। স্বস্তির ভাবটা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেছে।
তারপর হঠাৎ ঝড়ের মতো তর্কবিতর্ক শুরু হয়। হাসিভরা চোখে বক্তা যে-কথাটি বলেছিল, সে-বিষয়ে অনেকের মৌলিক কিছু বলবার আছে।
তারপর যুবক শিক্ষক তার হাত দুটি টেবিলের তলায় লুকায়। তার ভয় হয়, হয়তো তার হাত কাঁপতে শুরু করবে।
পনেরো
দাদাসাহেব ফজরের নামাজ শেষ করে কারুকার্যময় রেহালে কোরান শরীফ রাখবেন এমন সময় একটি চাকর দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। এ-সময়ে তাঁর ধর্মীয় কাজে ব্যাঘাত ঘটলে তিনি বিরক্ত বোধ করেন বলে চশমার ওপর দিয়ে অসন্তুষ্টদৃষ্টিতে তার দিকে তাকান।
‘মাস্টার দেখা করতে চায়।’
দাদাসাহেবের মুখ থেকে অসন্তুষ্ট ভাবটি মিলিয়ে যায়। একটু ভেবে তিনি বলেন, ‘যাও, আসছি।’
চাকরটি অদৃশ্য হয়ে গেলে জরির কাজ-করা গাঢ় লালরঙের মখমলের সুদৃশ্য আবরণে কোরান শরীফ ভরে সেটি বুকের কাছে ধরে কতক্ষণ তিনি নিশ্চল হয়ে বসে থাকেন, মুখে একটু দুশ্চিন্তার ছায়া দেখা দেয়। তাঁর সন্দেহ থাকে না যে, যুবক শিক্ষক কাদের সম্বন্ধে কোনো কথা বলতে এসেছে। কিন্তু কী কথা?
কাদের এবং যুবক শিক্ষকের মধ্যে হঠাৎ দেখাশুনা হলে তিনি কৌতূহলী হয়ে সেদিন যুবক শিক্ষককে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, তাদের দেখাশোনার কারণ যুবক শিক্ষকের নিকট হতেই জানা সহজ হবে। কিন্তু সে কিছু বলতে রাজি হয় নাই। তার আচরণ এবং না-বলতে চাওয়ার অর্থ তিনি বুঝতে পারেন নাই। কী এমন কথা হতে পারে যা বলতে তার এত দ্বিধা? অকারণে কাদেরের সেদিনের বিচিত্র দৃষ্টিও তাঁর স্মরণ হয়। সে-দৃষ্টির অর্থও তিনি এখনো বুঝতে পারেন নাই।
কাদের দরবেশ সে-কথা তিনি নানা সময়ে বলে থাকেন বটে কিন্তু তাতে যে তিনি সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করেন, তা নয়। তিনি নিজেই জানেন, তা তাঁর একটি খেয়াল মাত্র। তবে এমন একটি খেয়াল যা কাদেরের মতো মানুষের পক্ষে সত্য হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তার আচরণ-ব্যবহার দশজনের মতো নয়। সাধারণ জীবনের নকশার সঙ্গে তার জীবনের মিজুক নাই। তার সম্বন্ধে তার বড় ভাইয়ের ভাবনাচিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। তাই একদিন তিনি আশা করতে শুরু করেন, হয়তো কাদেরের মন দরবেশীতেই। আশাটি সত্য হলে তার আচরণের একটি যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা হবে, ভাবনাচিন্তারও কারণ থাকবে না। ক্রমশ আশাটি একদিন খেয়ালে পরিণত হয়। প্রথমে প্রথমে সে রসিকতা – অবিশ্বাসের অংশটা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুবক শিক্ষক তাঁর সে আশা-খেয়াল ভাঙতে এসেছে কি?
অবশেষে সজোরে কেশে গলা সাফ করে তিনি উঠে দাঁড়ান। না, এমন আশঙ্কা অহেতুক।
রেহালটি প্রশস্ত বিছানায় স্থাপিত জায়নামাজের ওপর পড়ে থাকে। তবে কোরান শরীফটা তিনি খাটের মাথার কাছে তাকের ওপর সযত্নে তুলে রাখেন। তারপর গলার মাফলারটি ভালো করে পেঁচিয়ে আলোয়ানটাও আরেকবার জড়িয়ে নেন। এ-সময়ে মুহূর্তের জন্যে হঠাৎ কেমন একটি কথা তাঁর মনে আসে। তিনি ভাবেন, না, তাঁকে কাদের সম্বন্ধে কোনো কু-কথা বলার সাহস যুবক শিক্ষকের হবে না। অবশ্য তৎক্ষণাৎ সেটিকে মন থেকে দূর করে তিনি ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হন।
শূন্য বারান্দায় নিশ্চল হয়ে বসে যুবক শিক্ষক দাদাসাহেবের জন্যে অপেক্ষা করে। একটু দুর্বল দেখালেও মুখ শান্ত। নিদ্রাহীনতার জন্যে চোখে শুষ্কতা কিন্তু তাতেও অস্থিরতা- বিহ্বলতার স্পর্শ নাই। মেঝের সাদা-কালো ছকের দিকে তাকিয়ে ধীর-স্থির ভাবেই সে ভাবে, অবশেষে দাদাসাহেবকে দুঃসংবাদটি দিতে এসেছে। দুঃসংবাদটি এই যে, কাদের একটি যুবতী নারী খুন করেছে। কিন্তু কেবল দুঃসংবাদটি দিতেই কি সে এসেছে? বাঁশঝাড়ের ঘটনাটি আসলে বড় অস্পষ্ট মনে হয়। শুধু তা-ই নয়। যা সে বলতে এসেছে এবং যা দাদাসাহেবকে নিঃসন্দেহে ক্রুরভাবে আঘাত দেবে, তা যেন ঘটনাটির সঙ্গে অতি ক্ষীণভাবে জড়িত। যা সে বলতে এসেছে আর যা ঘটেছে, সে দুটি পৃথক বিষয় যেন। হত্যাকাণ্ড নয়, কাদের যেভাবে তার সামনে স্তরে স্তরে ধাপে ধাপে নিজেকে ধ্বংস করেছে সেটাই বড়। কাদের যখন নিম্নতম সোপানে এসে নাবে তখন তার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে নাই : কেবল থেকেছে সামান্য বিষাক্ত কালো ধুঁয়া, হয়তো একটা দূষিত ছায়া।
না, তার ধ্বংস হওয়াটাও আর বড় কথা নয়। বাঁশঝাড়ের ঘটনার মতো সেটিও যেন আবছা হয়ে উঠেছে। যুবক শিক্ষক এখন কেবল একটি কথাই বোঝে। কাদের অবশেষে যে বিষাক্ত ধুঁয়ায় এবং দূষিত ছায়ায় পরিণত হয়েছিল, সে-ধুঁয়া এবং ছায়া যুবক শিক্ষককেও যেন গ্রাস করার উপক্রম করেছিল।
মনের কথা বোঝা মুশকিল। বাঁশঝাড়ের ঘটনাটি কেন তার মনে এমন বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছিল তা সে এখনো সঠিকভাবে জানে না। হয়তো হত্যাকাণ্ডের কথাটি তার পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব হয় নাই। এমন নির্মম কথা বিশ্বাস না হওয়াই স্বাভাবিক। অথবা বিশ্বাস না করাই সম্ভব হয় নাই। তাই কথাটা প্রকাশ করলে তার সমূহ ক্ষতি হতে পারে সে-কথা কাদেরের নিকট হতে শোনার আগেই নিজেকে বুঝতে পেরে স্বপ্নরাজ্যে সে আশ্রয় নিয়েছিল। দুটির ফল কিন্তু একই : ঘটনাটির বিষয়ে তার নীরবতা এবং দুটিই যে-কোনো একটির সাহায্যে তার পক্ষে সর্বপ্রকার আত্মরক্ষা করাও সম্ভব হত : মনটা নিষ্কলঙ্ক থাকত, কোনোপ্রকার ক্ষতিও হত না। কিন্তু কোনোটাই ধরে রাখা তার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। কথাটা বিশ্বাস না করে উপায় থাকে নাই, স্বপ্নরাজ্যে বাস করাও সম্ভব হয় নাই।
কেন? কারণ নিজের কাছে তার মনের ভয় লুকানো আর সম্ভব হয় নাই। আয়নায় একটি নগ্নভীতি দেখতে পায়; তার সন্দেহ থাকে না যে সেটি তারই প্রতিবিম্ব। তার কার্যের পরিণাম সম্বন্ধে এখনো সে ভীত, কিন্তু কাজটি না করে এখন তার উপায় নাই। ভয়টা যে তারই মনের ভয়, সে-কথা সে এখন জানে।
পরিণামভীতি না কাটা সত্ত্বেও সে যখন কথাটি প্রকাশ করতে উদ্যত হয়েছে তখন কোনো একটি যুক্তির সাহায্যে সে নিশ্চয়ই তার ভীত মনকে মানিয়েছে। হ্যাঁ, যুক্তি একটা আছে বটে, কিন্তু হয়তো সেটি একটু বিচিত্র। দাদাসাহেবকে তা সে বোঝাবার চেষ্টা করবে। তাহলে তিনি একথাও বুঝতে পারবেন যে, সে তাঁকে কাদের সম্বন্ধে একটা নিষ্ঠুর খবরই দিতে আসে নাই। তারপর তাঁর পক্ষে যুবক শিক্ষককে খানিকটা ক্ষমা করাও হয়তো সম্ভব হবে।
গতকাল স্বচ্ছদৃষ্টিতে পরিণামের সম্ভাবনাগুলি ভেবে সে ভয়ই পেয়েছিল। তারপর সে একটি কথা জানতে পারে। কথাটি এই যে, যুবতী নারীর আত্মীয়-স্বজন হত্যার অপরাধটি জিন-পরীর ঘাড়ে চাপানোই শ্রেয় মনে করেছে। হত্যাকারী কে তা না জানলেও হত্যার কথা সন্দেহ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নাই, তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় নাই; মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে সরকারি ডাক্তারের রায়ের মধ্যে জিন-পরীর নামগন্ধ পর্যন্ত নাই। তবে কেন তারা জিন-পরীর নাম তুলেছে? কারণটি হয়তো এই যে, মৃত যুবতী নারীকে আর যখন তারা ফিরে পাবে না তখন তার মৃত্যুর অপ্রীতিকর ব্যাপারটি ঘাঁটিয়ে লাভ নাই। আত্মীয়-স্বজনের এমন বাসনা স্বাভাবিক।
এমন সময় যুবক শিক্ষক একটি বিচিত্র কথা লক্ষ করে। কথাটা সত্যিই বিচিত্র। (প্রথমে ঘটনাটি প্রকাশ না করার জন্যে সে যেমন অদ্ভুত যুক্তি-অজুহাতের সাহায্য নিয়েছিল, এবার তা প্রকাশ করবার জন্যেও কি তেমনি অদ্ভুত যুক্তি-অজুহাতের সাহায্য নিচ্ছে?) সে দেখতে পায় যে, সব যুক্তি কাদেরের, তার নিজের, এমন কি যুবতী নারীর মৃত্যুতে একমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ তার আত্মীয়-স্বজনের—সব যুক্তিই সত্য ঘটনাটি গোপন রাখার পক্ষে। সহসা তার মনে হয়, এই ঐকতানের মধ্যে একটি নিগূঢ় অর্থ আছে যেন।
না-বলার পক্ষে অতি আগ্রহের সঙ্গে কারা সে-সব যুক্তি জুগিয়ে দিয়েছে? জীবিত মানুষরা। জীবিত মানুষরা তাদেরই কথা বলছে, মৃত মানুষের কথা বলছে না। তারপর আরেকটি কথা সে বুঝতে পারে। জীবিত মানুষের পক্ষে জীবিত থাকার জন্যে আকুল আকাঙ্ক্ষা, বা জীবন থেকে যতটুকু পারা যায় লাভ-সুবিধা আদায় করার তীব্র বাসনা আপত্তিজনক নয়, কিন্তু যারা যুক্তিগুলি পেশ করেছে তারা যেন নামেই শুধু জীবিত। আসলে তারা মৃত, তাদের জীবনও ধার-করা জীবন। তা না-হলে তারা মৃত নারীর প্রতি কোনো সমবেদনা বোধ করবে না কেন, যে-মানুষ তার মৃত্যু ঘটিয়েছে তার প্রতি তীব্র ঘৃণা বোধ করবে না কেন? জীবনের ব্যাপারে তারা প্রতারক বলেই তাদের মনে এত ভীতি, সত্য ঘটনাটি লুকাবার জন্যে এত অধীরতা, এত শঠতা।
যুবক শিক্ষক শীঘ্র সে দল থেকে কাদেরকে এবং যুবতী নারীর আত্মীয়-স্বজনকে বাদ দেয় : ঘটনাটি গোপন রাখার ইচ্ছাটি তার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু অন্যান্য যুক্তিগুলি সে কোথায় শুনেছে? কাদের ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সে যখন আলাপ করে নাই, তখন সে-সব সে কি নিজের মনে শোনে নাই?
তার মানে এই নয় কি যে যুবক শিক্ষক নিজে জীবিত হয়েও মৃত, জীবনের ব্যাপারে সে-ই প্রতারক?
আয়নায় সে যেন নিজের আরেকটি চেহারা দেখতে পায়। তাহলে বাকি কথাও সত্য। কর্তব্য এড়াবার জন্যেই সে স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ করেছিল এবং নিজেরই সৃষ্ট অবিশ্বাস্য যুক্তি– অজুহাতে সে বিশ্বাস করেছিল। কাদের যে হত্যাকারী বা সে যে প্রেমিক নয় সে-কথা জানার পর তার মধ্যে যে-ভীষণ ক্রোধ দেখা দিয়েছিল তার কারণ অপরাধীর প্রতি ঘৃণা নয়, কাদের তাকে স্বপ্নরাজ্যে বাস করতে দেয় নাই বলেই সে এমন ক্রোধে আত্মহারা হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া, এ-কথাও সত্য যে যুবতী নারীর মৃত্যুর বীভৎসতা সে কিছুক্ষণের জন্যে বোধ করলেও তার প্রতি কোনো দুঃখ হয় নাই বা তার প্রতি গভীর অন্যায়টির সুবিচার হোক তার প্রয়োজন বোধ করে নাই। সে শুধু ভয়ই বোধ করেছে, নিজের জীবনের জন্য ভয়। সে-ভয়েই প্রথম রাতে মাঠে-মাঠে এমন উন্মাদের মতো ছুটাছুটি করেছিল এবং এ- ক’দিন এমন দিশেহারা হয়েছিল।
নিজের সত্যরূপ সে কী করে সঠিকভাবে জানবে?
কথাটি জানবার একটি পথই আছে। তার সত্যাসত্য বিচার ঘটনাটি প্রকাশ না করলে সম্ভব নয়। আবার, সে-বিষয়ে একটি পরিষ্কার উত্তর চাইলে মূল্যস্বরূপ দুটি পরিণামের জন্যে তাকে তৈরি হয়ে থাকতে হবে : হয় কাদের শাস্তি পাবে, না হয় সে-ই শাস্তি পাবে।
তারা যেন দু-জনেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যে আর প্রভেদ নাই।
না, দাদাসাহেবের কাছে সে কাদেরের কথাটিই কেবল বলতে আসে নাই।
হয়তো এখনো সে অন্যপ্রকারে স্বপ্নরাজ্যেই বাস করছে, নিজেকে ফাঁকি দেবার নূতন একটি পন্থা আবিষ্কার করেছে। তার একথা মনে হয় যে, সে যেন নিজেকেই কোনোপ্রকারে ভুলিয়ে ক্ষুধার্ত সিংহের গুহায় নিয়ে এসেছে। কিন্তু তবু তার মনে হয়, সে যেন ঘন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে উন্মুক্ত স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, কোথাও আশ্রয় নেবার স্থান নাই বলেই মনে বিচিত্র শান্তিও। বস্তুত, মন যেন শান্ত নদীর মতোই ঢেউশূন্য, মসৃণ। নদী তবু প্রবাহিত হয়। সে যেন নদীর মতোই একটি গন্তব্যস্থলের দিকে ভেসে যাচ্ছে। সে গন্তব্যস্থল সে দেখতে পায় না, সেখানে তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর আছে কিনা তা-ও সে জানে না। তবে নদীর ধারা যেমন থামানো যায় না বা তার দিপরিবর্তন করা যায় না, তেমনি তার পক্ষে থামা বা দিক্- পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
ভেতরের সিঁড়িতে দাদাসাহেবের খড়মের আওয়াজ শোনা যায়। সে আওয়াজ ক্রূরভাবে সারা বাড়িতে প্রতিধ্বনিত হয়। আচমকা সে আওয়াজ শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্যে যুবক শিক্ষক বেসামাল হয়ে পড়ে, তার শান্তমনে আলোড়নের সৃষ্টি হয়। দাদাসাহেবকে কথাটি বলতে এসে সে ভুল করে নাই তো? আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে নিস্তার পাওয়ার প্রয়াসে সে কি আত্মহত্যা করতে বসেছে?
মনকে সংযত করার চেষ্টা করে সে আপন মনে বলে, না। ভীতির কোনোই কারণ নাই। দাদাসাহেব তার অসহায়তা বুঝতে পারবেন। যে-স্রোতের বিরুদ্ধে সে দাঁড়াতে চেয়েছিল কিন্তু দাঁড়াতে পারে নাই এবং যে-স্রোতে সে এখন ভেসে যাচ্ছে দুটির কোনোটার অর্থই সে বোঝে না। এমন নিঃসহায় মানুষের জন্যে তাঁর নিশ্চয় দয়া হবে।
দাদাসাহেবের খড়মের উচ্চ আওয়াজে উদ্বেগের আভাস নাই। হয়তো তাতেই সে অবশেষে আশ্বস্ত হয়, তার মনের আলোড়ন শান্ত হয়। তারপর দাদাসাহেব বারান্দায় উপস্থিত হলে সে সসম্মানে উঠে দাঁড়ায়, তিনি সশব্দে আসন-গ্রহণ করলে সে-ও আবার বসে। তারপর সে খোলা দরজা দিয়ে উঠানের দিকে তাকায়। সেখানে অস্পষ্ট ঈষৎ কুয়াশাচ্ছন্ন রোদ দেখা দিয়েছে। একধারে একটি ব্যস্তসমস্ত সাদারঙের মুরগি চঞ্চলভাবে খাদ্য অন্বেষণ করে। দাদাসাহেব কাশেন।
কোথায় সে শুরু করবে? নদীর উৎস কোথায়, কোথায়ই-বা জীবন-মৃত্যুর উৎপত্তি? তাছাড়া, জীবন কি সত্যিই মৃত্যুর চেয়ে অধিকতর মূল্যবান?
দাদাসাহেব আবার কাশেন। তিনি অপেক্ষা করছেন সে-কথা যুবক শিক্ষককে জানান। যুবক শিক্ষক বোধ করে, তার ভেতর ঝরঝর করে কী যেন ঝরতে শুরু করেছে। তার অন্তর কি কাঁদতে শুরু করেছে একটি নিঃসহায় অজ্ঞানতার জন্যে?
তারপর সে অস্পষ্ট গলায় বলে, ‘কাদের মিঞা একটি মেয়েলোককে খুন করেছে।’
কথাটি বলার পরও তার ভেতরে সে-অজানা ধারাটি ঝরতে থাকে। ধারাটি ঝরতেই থাকে, ঝরঝর করে ঝরতেই থাকে। অবশেষে সব কিছু ক্রমশ শেষ হয়ে যায়। নিঃস্ব শূন্যতায় কোনো শব্দ হয় না।
বহুক্ষণ পর যেন নীরবতা ভঙ্গ করে দাদাসাহেব আস্তে বলেন, ‘বুঝলাম না।’
যুবক শিক্ষক তখন দৃষ্টিহীনভাবে ছককাটা মেঝের দিকে তাকিয়ে নিঃস্পন্দভাবে বসে। পূর্ববৎ কণ্ঠে সে কথাটি আবার বলে। তারপর কতক্ষণের জন্যে নীরবতা অবিচ্ছিন্ন থাকে।
‘পরিষ্কার করে বলেন।’
দাদাসাহেবের কথা ভালোভাবে বুঝবার ক্ষমতা না থাকলেও সে বোঝে, তিনি হয়তো ঘটনাটির বৃত্তান্ত জানতে চাইছেন। অনুচ্চ প্রাণহীন কণ্ঠে সে বাঁশঝাড়ের ঘটনাটির বৃত্তান্ত দিতে শুরু করে। কিন্তু শীঘ্র তার মনে হয়, তার শ্রোতা যেন নাই। তার কথা এলোমেলো হয়ে ওঠে। একবাক্যে যা বলেছে তার ব্যাখ্যা-সম্প্রসার হয়তো তার কাছে নিতান্ত নিষ্প্রয়োজনীয় বোধ হয়। বস্তুত, দাদাসাহেবকে আর কোনো কথা বলার প্রয়োজনই সে বোধ করে না। হঠাৎ লম্বা-চওড়া সম্ভ্রান্ত মানুষটি যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন। তাছাড়া, কোনো কথা জানার কৌতূহলও যেন শেষ হয়ে গেছে।
একটু পরে বিসদৃশভাবে উঠে দাঁড়িয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে যুবক শিক্ষক বলে, ‘আপনার কাছে বিদায় নিতে এসেছি।’
গাঢ় নিঃশব্দতার মধ্যে তার কথাটা কেমন বেখাপ্পা শোনায়। হয়তো তা সে নিজেই অনুভব করে। তবু কয়েক মুহূর্ত সে অপেক্ষা করে। দাদাসাহেব নীরব হয়ে থাকলে সে এবার হাল্কা পায়ে বারান্দা অতিক্রম করে বেরিয়ে যায়। প্রস্থানটিও কেমন বেখাপ্পা মনে হয় যেন, কিন্তু সে-কথা বুঝলেও সে থামে না। উঠানে মুরগিটি সচকিত হয়ে ডানা তুলে পলায়নোদ্যত হয়, উচ্চ কর্কশ রব তোলে, কিন্তু নড়ে না।
ঘরে সব তৈরি। ফুলতোলা টিনের সুটকেসটি কেবল হাতে তুলে নিলেই হয়। তবে মাথাটা কেমন শূন্য শূন্য মনে হয় বলে কতক্ষণ ঘরের মধ্যখানে স্থির হয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে। যে-ঘরে সে দু-বছর বসবাস করেছে, সে ঘরের চারধারে একবার তাকিয়ে দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে, কিছু দেখতে পায় না। মনে কোনো বেদনার ভাবও বোধ করে না।
তারপর সে সুটকেসটি তুলে নেয়। কর্তব্য কাজ এখনো সম্পূর্ণ হয় নাই। দু-ক্রোশ দূরে আদালতের সামনে ঘাসশূন্য বৃক্ষছায়াচ্ছন্ন প্রাঙ্গণের এককোণে যে থানা, সে-থানায় তাকে যেতে হবে। কথাটা কর্তৃপক্ষকে বলার দায়িত্ব তারই। কাদেরের বড় ভাইয়ের ওপর সে-দায়িত্বের ভার দেওয়ার মানে কর্তব্য শুধু অসম্পূর্ণ রাখাই নয়, তাঁকে অমানুষিক একটি কাজ করতে বলা।
উঠানে নেবে বড়বাড়ির দিকে না তাকিয়ে সে হাঁটতে শুরু করে। তারপর যে-বাড়ি মূর্ছিত হয়ে আছে মনে হয়েছিল সে-বাড়ি থেকে এবার গুরুগম্ভীর একটা ডাক আসে। সে-ডাকটির জন্যে তারই অজ্ঞাতে সে কতক্ষণ অপেক্ষা করেছিল। অবশেষে সেটি যখন তার কানে পৌঁছায়, তখন সে হয়তো আর তার জন্যে তৈরি নয়, বা তাতে তার মনে একটা নতুন ভয়ের সৃষ্টি হয়।
সে ছুটতে শুরু করে। হাঁটার ভঙ্গিতে চললেও আসলে সে দৌড়তেই থাকে। টিনের সুটকেসটি সশব্দে হাঁটুতে বাড়ি খায়।
ষোল
আদালতের সামনে ঘাসশূন্য বৃক্ষছায়াচ্ছন্ন প্রাঙ্গণটি অতিক্রম করে দু-দিন আগে স্ব-ইচ্ছায় যে-ঘরে সে এসেছিল, আজ সে ঘরেই তারা তাকে নিয়ে এসেছে। টেবিলের ওপাশে সেদিনের মতো উপরিতন পুলিশ -কর্মচারীটিও যথাস্থানে বসে। ছোটখাটো মানুষ দেখতে নিরীহ। সামনের দাঁত অসমান, নিচের ঠোটটা ভারি। তাই হয়তো মুখ খুলে রাখার অভ্যাস। তবে একটা স্থায়ী ভ্রূকুটির জন্যে তার মুখের শিথিলতা কিছু রক্ষা পায়।
তাদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে পুলিশ কর্মচারী চোখ তুলে তাকায়। দেখতে-না-দেখতে তার চোখে-মুখে বিপুল পরিবর্তন উপস্থিত হয়। তার ভ্রূকুটি গাঢ় হয়ে ওঠে, দৃষ্টিতে ক্ষীণ ধার দেখা দেয়। সন্দেহের অবশ্য কোনো অবকাশ ছিল না, তবু যুবক শিক্ষকের মন থেকে এবার সব সন্দেহ দূর হয়। কিন্তু তার মুখে ভাবান্তর ঘটে না। সেদিনের ঘরটি এবং টেবিলের ওপাশে পুলিশ-কর্মচারীকে সে যেন বহুদূর থেকেই দেখে। তার দৃষ্টি স্বচ্ছ, তবু কিছুই নিকটে মনে হয় না। পুলিশ-কর্মচারীটি সাব-ইন্সপেক্টরের দিকে তাকায়। সাব-ইন্সপেক্টরের পেছনে দণ্ডায়মান কনস্টেবলটির বুটে আওয়াজ হয়।
‘বসেন।’ পুলিশ-কর্মচারী সাব-ইন্সপেক্টরকে বসতে বলে। সাব-ইন্সপেক্টর বসলে তার মধ্যে সর্বপ্রথম স্বচ্ছন্দতা আসে। তার বয়স বেশি নয়।
‘ঘরেই ছিল। পালাবার চেষ্টা করে নাই।’ অল্পবয়স্ক সাব-ইন্সপেক্টরটি বলে।
যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে, সে-ই উক্তিটির বিষয়বস্তু। তবু তার মনে হয়, সাব-ইন্সপেক্টর অন্য কোনো মানুষের কথা বলছে যেন। অপরিচিত কোনো মানুষ ঘরেই ছিল, পালাবার চেষ্টা করে নাই।
ততক্ষণে পুলিশ-কর্মচারির দৃষ্টি তার ওপর আবার নিবদ্ধ হয়েছে। সে-দৃষ্টিতে প্রবঞ্চিত মানুষের ক্রোধভাব যেন। যুবক শিক্ষক এবারও বোঝে যে, সে-ই তার ক্রোধের কারণ। কিন্তু তাতে বিচলিত না হয়ে নিস্পৃহ-নিষ্পলক দৃষ্টিতে সে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রয়োজনীয় সরকারি ক্ষমতাপত্র সমেত অল্পবয়স্ক সাব-ইন্সপেক্টর এবং দু’জন বন্দুকধারী কনস্টেবল সকালবেলায় তার বাড়িতে উপস্থিত হলেও সে বিচলিত হয় নাই। বরঞ্চ তাদের আগমন, তারপর সুটকেস হাতে তাদের সঙ্গে থানা অভিমুখে যাত্রা সবই তার কাছে বারবার মহড়া-দেয়া অভিনয়ের মতো সুপরিচিত মনে হয়েছে। পুলিশ কর্মচারীর চোখে এখন সে যে-ক্রোধ দেখতে পায়, সে- ক্রোধও অপ্রত্যাশিত মনে হয় না। তাছাড়া, সে- ক্রোধ সত্য নয় যেন। আসলে তা বর্তমান অভিনয়ের একটি অংশমাত্র।
শীঘ্র যুবক শিক্ষক কেমন অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করে। তখনো সে ফুলতোলা সুটকেসটি হাতে করে দাঁড়িয়ে। সে সুটকেসটি সমস্যায় পরিণত হয়েছে যেন। সে বুঝতে পারে না সেটি কোথায় রাখবে। কনস্টেবলটি তার সমস্যার কথা বুঝে তার হাত থেকে সুটকেসটি তুলে নিয়ে দেয়ালের পাশে রাখে। ঘরের নিঃশব্দতায় শক্ত বুটের অজস্র আওয়াজ হয়।
পুলিশ-কর্মচারীর রাগ পড়ে, ভ্রূকুটিটাও ক্ষণকালের জন্যে অন্তর্ধান করে। সে যুবক শিক্ষককে বলে, ‘বসেন।’
বসার অনুরোধটি মহড়ায় যেন বাদ পড়েছিল। তাই যুবক শিক্ষকের বসতে কিছু দ্বিধা হয়। তারপর আস্তে বসে পড়ে সে টেবিলের তলে আলগোছে হাত কচলাতে শুরু করে। তারপর সে অপেক্ষা করে।
পুলিশ-কর্মচারীর মুখমণ্ডলে ক্রোধভাব কঠিনতা এবং ভ্রূকুটি ফিরতে দেরি হয় না। সঙ্গে সঙ্গে ধমকে বলে ওঠে, ‘চালাকি করতে চেয়েছিলেন? না, চালাকিতে কাজ হয় না।’
যুবক শিক্ষক তার ভর্ৎসনা শোনে, কিন্তু কিছু বলে না। হয়তো অভিনয়ে তার বলার সময় এখনো আসে নাই বলেই সে নির্বাক হয়ে থাকে। বাইরে আদালতের সামনে মামলাবাজদের কলরব তার কানে লাগে।
পুলিশ-কর্মচারী চোখ ছোট করে তীক্ষ্ণভাবে যুবক শিক্ষককে কয়েক মুহূর্ত পরীক্ষা করে দেখে। নিচের ঠোঁটটা অভ্যাসমত ঝুলেই থাকে। তারপর হঠাৎ টেবিলে হাত পিটিয়ে বাঘা-গলায় আবার সে আগের কথাই একটু ঘুরিয়ে বলে, ‘ভেবেছিলেন চালাকি করে পার হয়ে যাবেন?’
এবারও যুবক শিক্ষক উত্তর দেয় না। সব কথা জেনে পুলিশ কর্মচারী অর্থহীন কথা বলছে। সেটাও অভিনয়ের অংশ। এখানে যুবক শিক্ষকও একজন অভিনেতা। তবে যথানিৰ্দিষ্ট সময়েই সে কথা বলবে।
তার নীরবতা পুলিশ-কর্মচারীর পছন্দ হয় না। টেবিলে দু-হাত চেপে সামনে ঝুঁকে থুত ছিটিয়ে আবার সে বলে, ‘কী, অপরাধ স্বীকার করতে রাজি আছেন?’
এবার একটা উত্তর না দিয়ে উপায় নাই। তবে প্রশ্নটির মতো উত্তরটিও তার মুখস্থ বলে কোনো দ্বিধা না করে সে ক্ষুদ্র গলায় তার বক্তব্য বলে। কিন্তু তার বক্তব্যটি শুনে পুলিশ -কর্মচারীটি অকস্মাৎ ক্রোধে আত্মহারা হয়ে পড়ে। সেটাও অভিনয় সন্দেহ নাই, কিন্তু তবু তার ক্রোধের ঝাপটা গায়ে লাগে বলে যুবক শিক্ষক ঈষৎ চমকে ওঠে।
‘সত্য কথা!’ পুলিশ -কর্মচারী আবার হুঙ্কার দিয়ে ওঠে।
যুবক শিক্ষক তার বক্তব্যটি আবার বলে, ক্ষুদ্র নিস্তেজ কণ্ঠে। সেদিন সে সত্য কথাই বলেছিল।
পুলিশ-কর্মচারী কয়েক মুহূর্তের জন্যে বাকশূন্য হয়ে পড়ে যেন। বাক্শক্তি ফিরে এলে সে এবার গভীর বিরক্তির সঙ্গে বলে, ‘তদারক হবে। কিন্তু আপনার তাতে লোকসান বই লাভ নাই।’
যুবক শিক্ষক এবার নীরব হয়ে থাকলে পুলিশ-কর্মচারী সহসা হয়তো বুঝতে পারে না, সে কী বলবে। ভাগ্যবশত এমন সময় একটি ছেলে দু-পেয়ালা চা নিয়ে ঘরে ঢোকে। এক পেয়ালা পুলিশ কর্মচারীর জন্যে দ্বিতীয় পেয়ালা সাব-ইন্সপেক্টরের জন্যে। এক চুমুক দিয়ে উপরিতন কর্মচারীটি পকেট থেকে একটা আধা-ভরা সিগারেট-প্যাকেট বের করে একটি সিগারেট ধরায়। মুহূর্তের মধ্যে তার গন্ধে ঘরটা ভরে ওঠে।
গন্ধটা নাকে লাগতেই যুবক শিক্ষক সন্তর্পণে তা বার-দুয়েক ঘ্রাণ করে দেখে, তারপর তার মনের অন্তরালে কোথাও ঈষৎ বেদনার ভাব দেখা দেয়। কাদেরের কথা তার মনে পড়ে। সে-রাতে কাদের তাকে একটি সিগারেট দিয়েছিল। সে-কথাটাই স্মরণ হয়। না, কাদেরের কথা যে স্মরণ হয়, তা নয়। কাদের যেন তার মন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তবে সিগারেটের গন্ধটি একটি দৃঢ়জীবনের স্মৃতিই যেন জাগায় তার মনে। সে-রাত আর আজকার মধ্যে এতই কি ব্যবধান?
চা-এ আরো কয়েকবার চুমুক দিয়ে পুলিশ -কর্মচারী কণ্ঠস্বর নিচতম খাদে নাবিয়ে অন্তরঙ্গভাবে বলে, ‘আপনি মাস্টার। কথাটা বুঝতে দেরি হবে না আপনার।’
পরম হিতৈষীর মতো সে একটি নাতিদীর্ঘ কিন্তু সহৃদয় বক্তৃতা শুরু করে। প্রথমে তার দিকে নিষ্পলকদৃষ্টিতে তাকিয়ে যুবক শিক্ষক কান দিয়েই তার কথা শোনে। তারপর বিস্ময়ে তার মন ভরে ওঠে। সে বুঝতে পারে যে, পুলিশ কর্মচারী তাকে সুবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির মতো ব্যবহার করতে বলে যে-সব যুক্তিতর্কের অবতারণা করছে, সে-সব যুক্তিতর্ক সে যে শুধু জানে তা নয়, সে-সব নিজেই সে ভেবে দেখেছে। পুলিশ-কর্মচারী নূতন কিছুই বলছে না; যা সে বলছে যুবক শিক্ষক তার মহড়া দিয়েছে অনেকবার। তার কার্যের কী পরিণাম হবে, কেন হবে, কী কী ভাবে হবে—সে-সব কথা উপলব্ধি করে তার ভীতির শেষ থাকে নাই। সে-ভীতি এখনো যায় নাই। তবে তা এমনই এক ধরনের ভীতি যা শরীরে কোথাও গভীর ক্ষতের মতো লেগে আছে, তা উপড়ানোও যায় না অস্বীকার করাও যায় না। এমন ভয়কে মেনে নিয়ে ভুলে যাওয়াই ভালো।
পুলিশ-কর্মচারীর কথা শুনে অকস্মাৎ সে একটা অপরিসীম তৃপ্তিও বোধ করতে শুরু করে। সে কি তার মনের যুক্তিতর্কের কথা অপরের মুখে শুনছে না? এ কি তার বিচক্ষণতা এবং পরিণামদর্শিতার প্রমাণ নয়?
ভ্রূকুটি করে পুলিশ-কর্মচারী প্রশ্ন করে, ‘শুনছেন আমার কথা?’
সচকিত হয়ে যুবক শিক্ষক উত্তর দেয়, কিন্তু পুলিশ-কর্মচারী তাকে ভুল বোঝে। তার চোখে প্রথমে সন্দেহ, শেষে কেমন যেন অহেতুক প্রতিহিংসার ভাব দেখা দেয়। বিকৃতকণ্ঠে সে বলে, ‘হবে, তদারক হবে। আপনার ভালো হতে পারে, মন্দও হতে পারে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন। যার ক্ষতি করতে চান, তার ক্ষতি করা সহজ হবে না।’
সে যে কারো ক্ষতি করতে চায় না, সে-কথা বলার বিশেষ প্রয়োজন বোধ করলেও শেষপর্যন্ত সে কিছুই বলতে পারে না। এক কথায় উক্তিটির উত্তর দেয়া যায় না। তাছাড়া, কী একটা কথা সে বুঝতে চেষ্টা করে বলে কোনো উত্তর তৈরি করাও তার পক্ষে হয় না।
নিজেকে কিছুটা সংযত করে পুলিশ-কর্মচারী আবার বলে, ‘হয় অপরাধ স্বীকার করেন, না হয় আজগুবি কথাটা ছাড়েন।’
সাব-ইন্সপেক্টরও এবার তার উপরিতন কর্মচারীকে সমর্থন করে বলে, ‘নিজের মন্দ না চাইলে আজগুবি কথাটা ছাড়াই ভালো হবে।’
তাদের কথা যুবক শিক্ষকের কানে আর পৌঁছায় না। তার মন অন্যত্র। তার মনের তৃপ্তির কারণ সে বুঝতে পেরেছে। বিচক্ষণতা-পরিণামদর্শিতার প্রমাণ পেলে তৃপ্ত হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু সে-জন্যে সে তৃপ্ত নয়। তার তৃপ্তির কারণ এই যে, মনে-মনে যে-সব সম্ভাবনা সে দেখেছিল, তা সত্যে পরিণত হয়ে তার সিদ্ধান্তকে অর্থপূর্ণ করেছে। কথাটা অত্যন্ত বড় মনে হয় তার কাছে। তার মনে যে তুমুল দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল, সে-দ্বন্দ্বের ভিত্তি কাল্পনিক ভয় নয়। তাছাড়া, যে-সংগ্রাম পরের বিরুদ্ধে মনে হলেও আসলে নিজেরই বিরুদ্ধে ছিল, সে-সংগ্রামে সে জয়লাভ করেছে।
তার তৃপ্তির ভাবটি স্থায়ী হয় না। এক প্রকার প্রাকৃতিক আলোড়নে নদী যেমন হঠাৎ শুকিয়ে যায়, তেমনি তার মন থেকে সব ভাববোধ নিঃশেষ হয়ে যায়। সে তার উত্তর পেয়েছে। কিন্তু সে উত্তরটি চতুর্দিকে মরুভূমির সৃষ্টি করে যেন।
দূর থেকে পুলিশ-কর্মচারীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
‘বুঝতে পারছেন? হোক আপনার কথা সত্য, কিন্তু সাক্ষী কই? আপনি নিজের চোখে কিছু দেখেন নাই, কিন্তু অপর পক্ষ দেখেছে।’ সে যেন একটু দ্বিধা করে। তারপর বলে, ‘আপনাকে স্বচক্ষে দেখেছে।’
হয়তো কথাটি পুলিশ কর্মচারীর নিজেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, কিন্তু সে কী করতে পারে? ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মূল্য কী?
ক্ষীণভাবে পুলিশ-কর্মচারীর কণ্ঠস্বর যুবক শিক্ষকের কানে পৌঁছালে সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার বক্তব্যটির পুনরাবৃত্তি করে। যেন সে কথাটি প্রথম বার বলছে। কিন্তু তার দ্বিতীয় বক্তব্য নাই। একই কথা বারবার বলছে সে-কথা বুঝলেও সে অপ্রস্তুত বোধ করে না।
‘সত্য কথা!’ ব্যঙ্গের সুরে পুলিশ কর্মচারী চিৎকার করে ওঠে। ব্যঙ্গটি যুবক শিক্ষককে স্পর্শ করে না। সে আপন-মনে একটি দৃশ্য দেখবার চেষ্টা করে। যে-দৃশ্যটি মন থেকে এ-ক’দিন ঠেকিয়ে রেখেছে, সে দৃশ্যটিই সে দেখবার চেষ্টা করে। অল্প চেষ্টাতে দৃশ্যটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাঁশঝাড়ে যুবতী নারীর দৃশ্য। একটু পরে সে বোঝে, কিছুই সে স্পষ্টভাবে দেখতে পারছে না। কী করে দেখতে পারবে? দু-রাতের এক রাতেও সে-প্রাণহীন দেহটির দিকে ভালো করে তাকাবার সাহস তার হয় নাই। শুধু কয়েক মুহূর্তের জন্যেই সে তার দিকে তাকাতে সক্ষম হয়েছিল। তার দেহে যে প্রাণ নাই, সে-কথা বোঝার আগে। এখন যেটুকু সে দেখতে পায়, তা সে সংক্ষিপ্ত স্মৃতির জন্যেই। শাড়িটা অসংলগ্ন, পায়ের কাছে এক ঝলক চাঁদের আলো। একটি হাতই দেখা যায়। অন্য হাতটি কি দেহের তলে চাপা পড়েছে? মুখে ছায়া, শুধু ছায়া। আসলে মুখটা ঠিক মনে পড়ে না।
যুবক শিক্ষকের মনে ভয় বা ঘৃণা বা দুঃখ – কোনো ভাবই জাগে না। তবে কেন সে দৃশ্যটি স্মরণ করার চেষ্টা করছে? আজ যে স্থানে সে এসে পৌঁচেছে, তারই অর্থ কি সে-পরিত্যক্ত প্রাণহীন দেহটির মধ্যে সন্ধান করছে? কাদের তার জন্যে যে-ভাবাবেগ বোধ করে নাই, সে ভাবাবেগই কি সে নিজের মনে সৃষ্টি করতে চাইছে? সে জানে না কেন সে দৃশ্যটি স্মরণ করবার চেষ্টা করে।
হয়তো সে-দেহটি প্রাণ নেই বলে অর্থহীন নয়। বাঁশঝাড়ে যুবতী নারীর জীবন শেষ হলেও সে দৃশ্য স্মরণ করে যুবক শিক্ষকের মনে কোনো ভাবের আভাসও না দেখা গেলেও, সেখানেই যুবতী নারীর কথা শেষ হয় নাই। কারণ, তার জন্যে এখনো কি কারো শাস্তি পাওয়া বাকি নাই?
কিন্তু কে শাস্তি পাবে? পুলিশ-কর্মচারীর সামনে বসে যুবক শিক্ষকের হয়তো এই ধারণা হয় যে, কে শাস্তি পাবে সেটি আর প্রধান কথা নয়। শাস্তিটার অর্থ যখন মৃত যুবতী নারীর কাছে আর পৌঁছবে না, তখন কে শাস্তি পাবে তাতে তার আর কী এসে যাবে? শাস্তিটা তার জন্যে নয়। যুবক শিক্ষক যদি ভুল করে শাস্তিটা নিজের ওপরই টেনে আনে, যুবতী নারীর মৃত্যুর জন্যে সে-ই যদি অবশেষে শাস্তি পায়, তবে শাস্তিটা আসলে যার উদ্দেশ্যে সেখানে তা পৌঁছবে। সে-কথায় সে কি একবার সান্ত্বনা পেতে পারে না?
কিন্তু যুবক শিক্ষক জানে না। যে-দৃশ্যে কোনোই মনোভাব জাগে না, সে-দৃশ্যই সে অর্থহীনভাবে দেখবার চেষ্টা করে।
তার ব্যঙ্গ যুবক শিক্ষকের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে না দেখে পুলিশ-কর্মচারী এবার তার দিকে তাকায়, তারপর তার ঝানু চোখে ঈষৎ কৌতূহলের ভাব দেখা দেয়। যুবক শিক্ষক তারই দিকে নিষ্পলকদৃষ্টিতে চেয়ে পূর্ববৎ স্থির হয়ে বসে আছে, চোখে-মুখে কোনো উদ্ধত ভাব নাই। বরঞ্চ সমীহ বিনয়ের ভাবই যেন তাতে। গায়ের জীর্ণ আলোয়ানটি ঘরের উজ্জ্বল আলোয় অতিশয় জীর্ণ মনে হয়। আর মনে হয় কোনো কথায় তার কান নাই। কোনো, কথার প্রয়োজন সে বোধ করে না।
পুলিশ-কর্মচারীর চোখ একবার ক্রোধে সঙ্কুচিত হয়ে ওঠে। কিন্তু যুবক শিক্ষকের দৃষ্টির সামনে সে–ক্রোধ হয়তো অর্থহীন মনে হয় বলে সে নিজেকে সংযত করে। তারপর তার সরকারি ভ্রূকুটিও প্রত্যাবর্তন করে। সোজা হয়ে বসে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে যুবক শিক্ষককে প্রশ্ন করে, ‘আপনার আর কিছু বলবার নাই?’
যুবক শিক্ষক উত্তর দেয় না।
‘শুনছেন?’ সাব-ইন্সপেক্টর বলে। কনস্টেবলের বুটের আওয়াজ হয়।
সচকিতভাবে সজ্ঞান হয়ে যুবক শিক্ষক আবার তার বক্তব্যটি বলে। শুনে পুলিশ–কর্মচারীর মুখে তীব্র বিরক্তির ভাব জাগে। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের জন্যে কেবল। তারপর সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ওঠে। বাজে কথার সময় শেষ হয়েছে।