এক
শীতের উজ্জ্বল জ্যোৎস্নারাত, তখনো কুয়াশা নাবে নাই। বাঁশঝাড়ে তাই অন্ধকারটা তেমন জমজমাট নয়। সেখানে আলো-অন্ধকারের মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি যুবতী নারীর অর্ধ-উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়। অবশ্য কথাটা বুঝতে তার একটু দেরি লেগেছে, কারণ তা ঝট্ করে বোঝা সহজ নয়। পায়ের ওপর এক ঝলক চাঁদের আলো। শুয়েও শুয়ে নাই। তারপর কোথায় তীব্রভাবে বাঁশি বাজতে শুরু করে। যুবতী নারীর হাত-পা নড়ে না। চোখটা খোলা মনে হয়, কিন্তু সত্যিই হাত-পা নড়ে না। তারপর বাঁশির আওয়াজ সুতীব্র হয়ে ওঠে। অবশ্য বাঁশির আওয়াজ সে শোনে নাই।
কিন্তু কখন সে মৃতদেহটি প্রথম দেখে? এক ঘণ্টা, দু-ঘণ্টা আগে? হয়তো ইতিমধ্যে এক প্রহর কেটে গেছে, কিন্তু যুবক শিক্ষক সে কথা বলতে পারবে না। মনে আছে সে বাঁশঝাড় থেকে বেরিয়ে এসেছিল। চতুর্দিকে ঝলমলে জ্যোৎস্নালোক, চোখ-ধাঁধানো উজ্জ্বল আলো। তখন সে দৌড়তে শুরু করে নাই। বাঁশঝাড়ের সামনেই পূর্ণ জ্যোৎস্নালোকে সে তাকে দেখতে পায়। ধীরপদে হেঁটেই যেন সে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, নিরাকার বর্ণহীন মানুষ। হয়তো তার দিকে কয়েক মুহূর্ত সে তাকিয়ে ছিলও। তারপর সে দৌড়তে শুরু করে।
তখন থেকে সে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটাছুটি করছে। হয়তো এক প্রহর হল ছুটাছুটি করছে। চরকির মতো, লেজে কেরোসিনের টিন বেঁধে দিলে কুকুর যেমন ঘোরে তেমনি। কেন তা সে বলতে পারবে না। কেবল একটা দুর্বোধ্য নির্দয় তাড়না বোধ করে বলে দিশেহারা হয়ে অবিশ্রান্তভাবে মাঠে-ঘাটে ছুটাছুটি করে, অফুরন্ত জ্যোৎস্নালোকে কোথাও গা-ঢাকা দেবার স্থান পায় না, আবার ছায়াচ্ছন্ন স্থানে নিরাপদও বোধ করে না। গভীর রাতে এমন দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে পশ্চাদ্ধাবিত অসহায় পশুর মতো সে জীবনে কখনো ছুটাছুটি করে নাই। অবশ্য গ্রামবাসী অনভিজ্ঞ যুবক শিক্ষক বাঁশঝাড়ের মধ্যে যুবতী নারীর মৃতদেহও কখনো দেখে নাই।
তারপর একটি অদ্ভুত কারণেই সে হঠাৎ থেমে একটা আইলের পাশে উবু হয়ে বসে নিঃশব্দ রাতে সশব্দে হাঁপাতে থাকে। ওপরে ঝলমলে জ্যোৎস্না, কিন্তু সামনে নদী থেকে কুয়াশা উঠে আসছে। কুয়াশা না আর কিছু, হয়তো সে ঠিক বোঝে না। হয়তো একদল সাদা বকরি দেখে, যার শিং-দাঁত-চোখ কিছুই নাই। হয়তো মনে হয় রাত্রি গা মোড়ামুড়ি দিয়ে উঠে বসেছে, চোখ-ধাঁধানো অন্তহীন জ্যোৎস্নালোকে জীবনের আভাস দেখা দিয়েছে। হঠাৎ আশ্রয় লাভের আশায় তার চোখ জ্বলজ্বল করতে শুরু করে।
অবশেষে মাঠ-ঘাট কুয়াশায় ঢেকে যায়, ওপরে চাঁদের গোলাকার অস্তিত্বের অবসান ঘটে। কুয়াশায় আবৃত হয়ে যুবক শিক্ষক গুটি মেরে বসে থাকে। হাঁপানি তখন কিছু কমেছে, সঙ্গে সঙ্গে দুরন্ত ভয়টাও যেন পড়েছে কিছু। যেখানে বসেছিল সেখানে বসেই কেবল লুঙ্গি তুলে সরলচিত্তে লাঙ্গল-দেয়া মাঠে সে প্রস্রাব করে। মনে হয় মাথাটা যেন সাফ হয়ে আসছে। বুক থেকে ভারি কিছু নাবতে শুরু করেছে দেখে সহসা মুক্তির ভাব এলে সে থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে, মনে হয় সে কাঁদবে। কিন্তু সে কাঁদে না। চারধারে গভীর নীরবতা। সে নিশ্চল হয়ে মাথা গুঁজে বসে যেন কারো অপেক্ষা করে।
শ্লথগতি হলেও কুয়াশা সদাচঞ্চল। নড়ে-চড়ে, ঘন হয়, হাল্কা হয়। সুতরাং এক সময়ে হঠাৎ চমকে উঠে উপরের দিকে তাকালে যুবক শিক্ষকের শীর্ণ মুখে এক ঝলক রূপালি আলো পড়ে। স্বচ্ছ-পরিষ্কার আকাশে কুয়াশামুক্ত চাঁদ আবার ঝলমল করে। স্নিগ্ধ প্রশান্ত চাঁদের মুখ দেখে অকারণে সভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে আবার ছুটতে শুরু করে। ওপরে চাঁদ হেলে-দোলে, হয়তো হাসেও। নির্দয় চাঁদের চোখ মস্ত। যুবক শিক্ষক প্রাণভয়ে ছোটে। যত ছোটে, ততই তার ভয় বাড়ে। সামনে কিছু নাই, তবু দেখে লোকটি দাঁড়িয়ে। দূরে কোথাও একটা কুকুর ডাকতে শুরু করে। তার মনে হয় একটি হিংস্র কুকুর তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বলে। তারপর সে দেখে, বাঁশঝাড়ের সে মৃতদেহটি তার পথ বন্ধ করে লাঙ্গল-দেয়া মাটিতে বাঁকা হয়ে শুয়ে আছে। অর্ধ-উলঙ্গ দেহে প্রাণ নাই তবু একেবারে নিশ্চল নয়। কোথায় যাবে যুবক শিক্ষক? তার হিমশীতল শরীর নিশ্চল, শীর্ণমুখে চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে।
আবার যখন সে দৌড়তে শুরু করে তখন কিছু দূরে গিয়ে মাটির দলায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মুখ থেকে একটা ক্ষুদ্র কিন্তু তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বের হয়। তারপর মাটিতে মুখ গুঁজে সে নিস্তেজভাবে পড়ে থাকে। শীঘ্র তার পিঠ শিরশির করে ওঠে। পিঠে সাপ চড়েছে যেন। বুকে হাতুড়ি পেটা শুরু হয়, অবাধে ঘাম ছোটে। সে বুঝতে পারে লোকটি দাঁড়িয়ে তারই পিঠের উপর। মুখ না তুলেই দেখতে পায় তাকে : বিশালকায় দেহ, তার ছায়াও বিশালাকার। যুবক শিক্ষক এবার নিতান্ত নিঃসহায় বোধ করতে শুরু করে। জীবনের শেষ মুহূর্তে দেহ গলে যায়, সর্বশক্তির অবসান ঘটে। আর কিছু করবার নাই বলে সে অপেক্ষা করে। সময় কাটে। আরো সময় কাটে, কিন্তু কিছুই ঘটে না। অবশেষে এক সময়ে পিঠ থেকে সাপ নাবে, বিশালাকার ছায়াও সরে যায় এবং যুবক শিক্ষকের নাকে মাটির গন্ধ লাগে। মাথা তুলে সে ধীরে-ধীরে এধার-ওধার তাকায়, বাঁ-দিকে, ডান দিকে। কুয়াশা নাই। জ্যোৎস্না-উদ্ভাসিত ধবধবে মাঠে কেউ নাই। দূরে একটা কুকুর বেদনার্তকণ্ঠে আর্তনাদ করে। তাছাড়া চারধার নিঃশব্দ। একচোখা চাঁদ সহস্র চোখে জনশূন্য পথপ্রান্তর পর্যবেক্ষণ করে। চাঁদ নয়, যেন সূর্য।
হাঁটুতে ভর করে যুবক শিক্ষক উঠে বসে, মুখ বিষাদাচ্ছন্ন। আলোয়ান দিয়ে মুখের ঘাম মোছে, চোখের উদ্ভ্রান্তি কাটে। কেবল থেকে-থেকে নিচের ঠোঁটটা থরথর করে কাঁপে। অনেকক্ষণ সে বসে থাকে নতমুখে। আবার যখন সে মুখ তোলে তখন কুয়াশার পুনরাগমন হয়েছে। সে-কুয়াশা ভেদ করে কেমন অহেতুক, উদ্দেশ্যহীনভাবে সে তাকাবার চেষ্টা করে। চোখে এখন নিস্তেজ ভাব, মনের ভয়টাও যেন দূর হয়েছে। তারপর আবার সে তাকে দেখতে পায়। একটু দূরে বটগাছ, আবছা-আবছা চোখে পড়ে। শিকড়ে-শিকড়ে দৃঢ়বদ্ধ গাছটি অস্পষ্ট আলোয় ভাসে, যেন পানিতে আমজ্জ হয়ে আছে গাছটি। যুবক শিক্ষক বারকয়েক মাথা নাড়ে বটগাছের পাশেই ছায়ার মতো সে দাঁড়িয়ে। জট নয় শাখা নয়, সে-ই দাঁড়িয়ে। এখন আবছা দেখালেও সে আর নিরাকার বর্ণহীন মানুষ নয়।
আবার কী ভেবে যুবক শিক্ষক মাথা নাড়ে। তার মনে গভীর অবসাদ, কিন্তু আর ভয় নেই যেন। যে-মানুষ নিদারুণ ভয়ে বিকৃতমস্তিষ্কের মতো দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে এতক্ষণ ছুটাছুটি করেছিল, সে-মানুষ এখন ভয়মুক্ত। বটগাছের পাশে ছায়াটিকে তার আর ভয় নাই।
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে সে ঘরাভিমুখে হাঁটতে শুরু করে। সবুজ আলোয়ানে আবৃত তার শীর্ণ শরীর দীর্ঘ মনে হয়, পদক্ষেপে অসীম দুর্বলতার আভাস দেখা গেলেও তাতে সঙ্কোচ-দ্বিধা নাই। তার অনভিজ্ঞ মনে নিদারুণ আঘাতের ফলে যে প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, সে বিক্ষুব্ধতা বিদূরিত হয়েছে।
কোনোদিকে না তাকিয়েই সে দ্রুতপদে হাঁটতে থাকে। সে আর ভাবে না। ভাবতে চেষ্টা করলেও তার ভাবনা ধরবার কিছু পায় না। বৃহৎ গহ্বরে ধরবার কিছু নাই।
ঘরে ফিরে পাথরের মতো প্রাণহীন শরীরের উপর কাঁথা টেনে সে নিঃসাড় হয়ে শুয়ে থাকে। গভীর রাতে কোথাও কোনো শব্দ নাই। শব্দ হলেও তা তার কানে পৌঁছায় না। অন্ধকারের মধ্যে তার দৃষ্টি খুলে থাকলেও নিশ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষীণতম শব্দও পাওয়া যায় না। তাছাড়া মনে হয়, সে যেন কারো অপেক্ষা করে।
.
কীভাবে রাত্রির অত্যাশ্চর্য ঘটনাটি শুরু হয়?
তখন বেশ রাত হয়েছে। শারীরিক প্রয়োজনে ঘুম ভাঙলে যুবক শিক্ষক আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। শীতের গভীর রাত, কেউ কোথাও নাই। ঘরের পেছনে জামগাছ। তারই তলে শারীরিক প্রয়োজন মিটিয়ে সে ঘরে ফিরবে কিন্তু আলোয়ানটা ভালো করে জড়িয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকল। তখন চোখের ঘুমটা কেটে গেছে। যেখানে সে দাঁড়িয়েছিল সেখানে ছায়া, কিন্তু চতুর্দিকে জ্যোৎস্নার অপরূপ লীলাখেলা।
তখনো কাদের বড়বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে নাই। অন্য এক কারণে যুবক শিক্ষক জামগাছের তলে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
সে-কারণটি হয়তো নেহাতই বালসুলভ। কিন্তু শিক্ষকতা করে বলে তার বাহ্যিক আচরণ-ব্যবহার বয়স্থব্যক্তির মতো হলেও তার মনের তরুণতা এখনো বিলুপ্ত হয় নাই। বরঞ্চ স্বল্পভাষী যুবক শিক্ষকের মনের অন্তরালে নানারকম স্বপ্ন-বিশ্বাস এখনো জীবিত। সুযোগ-সুবিধা পেলে তার পক্ষে স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ করা কষ্টসাধ্য নয়। তবে এ-সব সে গোপনই রাখে। তাছাড়া, মনের কথা ঠাট্টা করেও বলবে এমন কোনো লোক সে চেনে না।
জামগাছের তলে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জ্যোৎস্না-উদ্ভাসিত রাতের প্রতি তার অদমনীয় আকর্ষণ। শুধু তার রূপেই যে সে মোহিত হয়, তা নয়। তার ধারণা, চন্দ্রালোকে যে-অপরূপ সৌন্দর্য বিকাশ পায় তা উদ্দেশ্যহীন নয়, মূক মনে হলেও মূক নয়। হয়তো সে-সময়ে, যখন মানুষ-পশুপক্ষী নিদ্রাচ্ছন্ন, তখন বিশ্বভূমণ্ডল রহস্যময় ভাষায় কথালাপ করে। সে-কথালাপের মর্মার্থ উদ্ধার করা মানুষের পক্ষে হয়তো অসম্ভব, কিন্তু তা শ্রবণাতীত নয় : কান পেতে শুনলে তা শোনা যায়। বালকবয়সে পরপর তিন বছর লায়লাতুলকদরের রাতে যুবক শিক্ষক সমস্ত রাত জেগেছিল এই আশায় যে, গাছপালাকে ছেজদা দিতে দেখবে। গাছপালার এমন ভক্তিমূলক আচরণে আজ তার বিশ্বাস নাই, কিন্তু রাত্রি জাগরণের ফলে তার মনে যে-নতুন ধারণার সৃষ্টি হয় সে-ধারণা এখনো সে যেন কাটিয়ে উঠতে পারে নাই। এত সৌন্দর্য কি আদ্যোপান্ত অর্থহীন হতে পারে? এমন বিস্ময়কর রূপব্যঞ্জনার পশ্চাতে মহারহস্যের কিছুই কি ইঙ্গিত নাই? তাতে মানুষের মনে যে-ভাবের উদয় হয়, সে-ভাব কি সৃষ্টির মহানদীর তরঙ্গশীকরজাত নয়? মনঃপ্রাণ সম্পূর্ণভাবে নিঃশব্দ করে শুনলেই নিঃসন্দেহে অশ্রোতব্য শ্রোতব্য হবে।
চন্দ্রালোকের দিকে তাকিয়ে যুবক শিক্ষক হয়তো বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ নির্জন রাতে চলনশীল কিছু দেখতে পেলে প্রথমে সে চমকে ওঠে। তারপর সে তাকে দেখতে পায়। বড়বাড়ির কাদেরকে চিনতে পারলে তার বিস্ময়ের অবধি থাকে না। চন্দ্রালোক-উদ্ভাসিত এ-মায়াময় রাতে কাদেরের আকস্মিক আবির্ভাব তার কাছে হয়তো অজাগতিক এবং রহস্যময়ও মনে হয়। এত রাতে এমন দ্রুতগতিতে কোথায় যাচ্ছে সে?
তখন যুবক শিক্ষকের চোখ জ্যোৎস্নায় জলসে গেছে, তাতে ঘুমের নেশা পর্যন্ত নাই। দ্রুতগামী কাদেরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটি ঝোঁক চাপে তার মাথায়। সে ঠিক করে, তাকে অনুসরণ করবে।
মনে মনে ভাবে, দেখি কোথায় যায় কাদের। বড়বাড়ির দাদা সাহেব বলেন, কাদের দরবেশ। দেখি রাতবিরাতে কোথায় যায় দরবেশ।
তখন কাদের বেশ দূরে চলে গেছে। জামগাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে যুবক শিক্ষক তাকে অনুসরণ করতে শুরু করে।
ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় কাউকে অনুসরণ করা সহজ নয়। যুবক শিক্ষককে দূরে-দূরে গা-ঢাকা দিয়ে চলতে হয়। ধরা পড়বার ভয় ছাড়া একটা লজ্জাবোধও তার চলায় বাধা সৃষ্টি করে। ফলে শীঘ্র দ্রুতগামী কাদেরকে সে হারিয়ে ফেলে। খাদেম মিঞার ক্ষেত পার হয়ে গাঁয়ে আবার প্রবেশ করে দেখে, কোথাও কাদেরের কোনো চিহ্ন নাই। একটু পরে চৌমাথার মতো স্থানে এসে সে হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে পড়ে। কোন দিকে যাবে? চারপথের একটি যায় নদীর দিকে, আরেকটি গ্রামের ভেতরে। তৃতীয় পথ সদ্যতৈরি মসজিদের পাশ দিয়ে গিয়ে বাইরে সরকারি রাস্তার সঙ্গে মিলিত হয়। শেষটা যায় তারই ইস্কুল পর্যন্ত। যুবক শিক্ষক পথনির্দেশ পাবার আশায় কান খাড়া করে শোনবার চেষ্টা করে, কিন্তু কোনো পদধ্বনি শুনতে পায় না। কাদের যেন চন্দ্রালোকে এক মুঠো ধুঁয়ার মতো মিলিয়ে গেছে।
চৌমাথায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে স্থির করে, ঘরে ফিরে যাবে। ভাবে, লোকটা যে কাদেরই সে-কথা সঠিকভাবে সে বলতে পারে না, চোখের ভুল হয়ে থাকতে পারে। তাকে মুখামুখি দেখে নাই, কেবল তার পেছনটাই দেখেছে। ভুল হতে পারে বৈকি।
কিন্তু যুবক শিক্ষক ফিরে যায় না। কাদেরকে সে সামনাসামনি দেখে নাই বটে কিন্তু তার হাঁটার বিশেষ ভঙ্গি, ঘাড়ের কেমন উঁচু-নিচু ভাব, মাথার গঠন ইত্যাদি দেখেছে। ভুল অবশ্য হতে পারে, কিন্তু আরেকটু দেখে গেলে ক্ষতি কী? মানুষটি অদৃশ্য হয়ে গেলে তার সম্বন্ধে কৌতূহলটা আরো বাড়ে যেন। কিন্তু কোন দিকে যাবে? চারটা পথের কোনটা ধরবে? কাদেরের রাত্রিভ্রমণের উদ্দেশ্য যখন সে জানে না তখন কোনো একটি পথ ধরার বিশেষ কারণ নাই। তাই অনির্দিষ্টভাবে চারটি পথের একটি পছন্দ করে সে আবার হাঁটতে শুরু করে। কিছুক্ষণ সে কান খাড়া করে রাখে, ঘন-ঘন তাকায় এধার-ওধার। কিন্তু তার সন্ধানকার্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। শীঘ্র সে ভুলে যায় তার চলার উদ্দেশ্য। তার ঘরের পেছনে যে- অপরূপ চন্দ্রালোক তাকে বিমুগ্ধ করেছিল, সে-চন্দ্রালোক এখনো মাঠে-ঘাটে গাছপালা- ঝোপঝাড়ে মানুষের বাসগৃহে মোহ বিস্তার করে আছে। পরিচিত দুনিয়ায় অজানা জগতের মায়াময় স্পর্শ। চন্দ্রালোক-উদ্ভাসিত গভীর রাতে যুবক শিক্ষক একাকী ঘুরে বেড়ায় নাই অনেকদিন। কাদেরের কথা তার মনে থাকলেও তাকে অনুসরণ করার প্রয়োজন সে আর বোধ করে না।
তারপর একসময়ে একটি গৃহস্থবাড়ির কাছে দেখে, পোঁতা খুঁটির মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে কাদের। তার দেহে সহসা কেমন চঞ্চলতা আসে। মনে হয় সে হাসছে। তারই দিকে তাকিয়ে সে হাসছে এবং গা-ঢাকা দেবার কোনোই চেষ্টা নাই।
হঠাৎ ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জা হলে যুবক শিক্ষক সজোরে বলে ওঠে,
‘কী ব্যাপার?’
কোনো উত্তর দেয় না।
তারপর কেমন সন্দেহ হলে এগিয়ে দেখে, ভিটেবাড়ির পাশে মূর্তিটি কলাপাতা মাত্র, চাঁদের আলোয় মানুষের রূপ ধারণ করেছে। চাঁদের আলো যাদুকরী, মোহিনী।
যুবক শিক্ষকের বুক সামান্য কাঁপতে শুরু করেছিল। এবার কিছুক্ষণ অনির্দিষ্টভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সে স্থির করে ঘরে ফিরে যাবে। মুখে তখনো লজ্জার ঝাঁঝ। সে ঘরাভিমুখে রওনা হয়। তবে সোজাপথ না ধরে একটু বাঁকাপথ ধরে। সোজাপথ ধরলে অসাধারণ দৃশ্যটি তাকে দেখতে হত না।
গ্রামের ভেতরের পথটা এড়িয়ে সে নদীর দিকে চলতে শুরু করে। কাদেরকে সে আর অনুসরণ করছে না, সে বিশ্বাসে তার কথা ভুলতে তার দেরি হয় না। তাকে কলাগাছে রূপান্তরিত করে সে আবার চন্দ্রালোকে উদ্ভাসিত বিস্ময়কর জগতের নেশায় আত্মভোলা হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে চলতে থাকে : পদক্ষেপে কোনো তাড়া নাই, তার শীর্ণমুখ আবেশাচ্ছন্ন।
গ্রামের প্রান্তে নদীর ধারে একটু বাদাড় ঝোপঝাড় পাঁচমেশালী গাছপালা, একটা প্রশস্ত বাঁশবন। তারপর ঢালা ক্ষেত। শস্যকাটা শেষ, স্থানে-স্থানে লাঙ্গল দেয়া হয়েছে।
সে-জঙ্গলের পাশে পৌঁছে খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে যুবক শিক্ষক একটু দাঁড়িয়েছে, এমন সময় একটা আওয়াজ তার কানে পৌঁছায়। আওয়াজটা যেন বাঁশবন থেকে আসে। সেখানে কে যেন চাপা ভারিকণ্ঠে কথা বলছে।
আশপাশে বাসাবাড়ি নাই। অকারণে যুবক শিক্ষক এধার-ওধার তাকায়, এক মুহূর্তের জন্যে তার মনে হয় নদীর বুক থেকে জেলেদের কণ্ঠস্বরই শুনতে পাচ্ছে সে। কিন্তু অবশেষে তার সন্দেহ থাকে না, বাঁশঝাড়ের মধ্যেই কেউ কথা বলছে। শ্রোতা থাকলেও তার গলার আওয়াজ শোনা যায় না : বক্তার শ্রোতা যেন বাঁশঝাড়ই। রাত্রির নিস্তব্ধতার মধ্যে সে-কণ্ঠ অশরীরী মনে হয় যুবক শিক্ষকের কাছে। তারপর কাদেরের কথা তার স্মরণ হয়।
এবার অদম্য কৌতূহল হলে যুবক শিক্ষক বাঁশঝাড়ের দিকে কয়েক পা এগিয়ে যায়। অল্পক্ষণের জন্যে কণ্ঠস্বর থামে বলে সে সামান্য নিরাশ বোধ করে। শীঘ্র কণ্ঠস্বরটি সে আবার শুনতে পায়। ঈষৎ হেসে এবার সে সজোরে বলে ওঠে, ‘কাদের মিঞা! বাঁশঝাড়ে কাদের মিঞা!’
কথাটা সজোরে বলেছে কি বলে নাই, অবশ্য সে-বিষয়ে এখন সে হলফ করে কিছু বলতে পারে না। নিঃশব্দ গভীর রাতে এ-সব ব্যাপারে কে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হতে পারে? তখন মনে–বলা কথাই সশব্দে বলা কথার মতো শোনায়। কিন্তু বাঁশবনের আকস্মিক নীরবতার কারণ শুধু তা নয়। কাদেরের কথা শোনবার জন্যে কৌতূহলী হয়ে যুবক শিক্ষক আবার যখন এগিয়ে যায়, তখন একরাশ শুকনো পাতায় তার পা পড়লে নীরবতার মধ্যে সহসা অকথ্য আওয়াজ হয়। সে-আওয়াজে চমকে উঠে সে নিজেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভয় কাটলে কান পেতে শোনে, কিন্তু বাঁশঝাড়ের নীরবতা এবার অখণ্ডিত থাকে।
সে-নীরবতার মধ্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর যুবক শিক্ষক ভাবে, হয়তো সবটাই মনের খেয়াল। একবার হেসে মনে মনে বলে, কলাপাতা যদি মানুষ হতে পারে, বাঁশঝাড়ের সঙ্গীত মানুষের কণ্ঠ হতে পারে না কেন?
তবে কথাটা নিজেরই কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না। হাওয়া ছাড়া বাঁশবনে সঙ্গীত কী করে জাগে?
কিছুটা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর হয়তো মনে ভয় এলে হঠাৎ সে অকারণে হাততালি দিয়ে রাখালের মতো গরু–ডাকা আওয়াজ করে ওঠে। পরক্ষণেই বাঁশবনে একটা আওয়াজ জাগে : সেখান থেকে তার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি আসে যেন। না, আওয়াজটা অন্য ধরনের। একটি মেয়েমানুষ যেন সভয়ে চিৎকার করে ওঠে।
আওয়াজটা কিন্তু জেগে উঠেই আবার নীরব হয়ে যায়। কেউ যেন তা পাথর-চাপা দেয়। সাপের মুখগহ্বরে ঢুকে ব্যাঙের আওয়াজ যেন হঠাৎ থামে, বা মস্তক দেহচ্যুত হলে মুখের আওয়াজ যেন অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়। দেহচ্যুত মাথা এখনো হয়তো আর্তনাদ করছে কিন্তু তাতে আর শব্দ নাই। চারধারে আবার অখণ্ড নীরবতা।
রুদ্ধনিশ্বাসে যুবক শিক্ষক দাঁড়িয়ে থাকে, দৃষ্টি নিশ্চল নিঃশব্দ বাঁশঝাড়ের উপর নিবদ্ধ। তারপর তার বুক কাঁপতে শুরু করে, ক্রমশ হাতে-পায়ে সারা শরীরেও কাঁপন ধরে। অবশেষে পায়ের তলে মাটি কাঁপতে শুরু করে, জ্যোৎস্না-উদ্ভাসিত আকাশও স্থির থাকে না। শুধু বাঁশঝাড় নিশ্চল, নিস্তব্ধ হয়ে থাকে।
অনেকক্ষণ পর পৃথিবীব্যাপী কম্পন থামলে ডুবতে ডুবতে বেঁচে যাওয়া মানুষের মতো ঝোড়ো বেগে নিশ্বাস নেয় যুবক শিক্ষক। তারপর হয়তো সাহসের জন্যে উপরের দিকে তাকায় কিন্তু চাঁদের মায়াময় হাস্যমুখ দেখতে পায় না। সে কিছুই বুঝতে পারে না বলে অবশ দেহে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।
অবশেষে যুবক শিক্ষকের মনে ভয় কাটে। এবার সে নির্ভয়ে চারধারে তাকিয়ে দেখে। না, জ্যোৎস্নারাতে কোনো তারতম্য ঘটে নাই। স্বচ্ছ আকাশে নীলাভা, চাঁদ তাতে রানীসম তার হাস্যোজ্জ্বল মুখ ঝকঝক করে। অপরিসীম তৃপ্তির সঙ্গে সে ভাবে, না, জ্যোৎস্নারাতের যাদুমন্ত্রের শেষ নাই। চাঁদ মোহিনীময়। আওয়াজটি কানেরই ভুল হবে। এমন ঝকঝকে চন্দ্রালোকিত রাতে কিছুই বিশ্বাস হয় না। যুবক শিক্ষক বাঁশঝাড়ের দিকে চেয়ে পরিষ্কার গলায় ডাকে, ‘কে?’ অবশ্য কোনো উত্তর আসে না। হাওয়ায় বাঁশঝাড়ে সঙ্গীতের ঝঙ্কার জাগে, কিন্তু মানুষের কণ্ঠ জাগে না। শীতের জমজমাট রাতে একটু স্পন্দনও নাই।
এক মুহূর্ত আগে যা সত্য মনে হয়েছিল, তা যে সত্যই সে-কথা কে বলতে পারে? সত্য চোখ-কানের ভুল হতে পারে, সত্য আবার চোখে কানে ধরা না-ও দিতে পারে। এবার নির্ভয়ে এবং কিছুটা কৌতূহলশূন্যভাবে যুবক শিক্ষক বাঁশঝাড়ের দিকে এগিয়ে যায়। হঠাৎ মনে হয় সেখানে আবার একটু আওয়াজ হয়, অস্পষ্ট পদধ্বনির মতো : কে যেন সেখান থেকে সরে যাচ্ছে। কিসের আওয়াজ? সঠিক করে বলা শক্ত। সামান্য হাওয়ায় বাঁশবনে শব্দ হয়। কিন্তু হাওয়া নাই। তাহলে জন্তু-জানোয়ারই হবে। শেয়াল কিংবা মাঠালী ইঁদুর। জঙ্গলে সর্বত্র শুষ্ক পাতা ছড়িয়ে আছে। একটুতেই শব্দ হয়। নির্ভয়ে যুবক শিক্ষক এগিয়ে যায়। অনভিজ্ঞ সরলচিত্ত যুবকের মনের আকাশে কোনো বিপদাশঙ্কার আভাস নাই, ভয়-দ্বিধা নাই। উপরে, স্বচ্ছ আকাশে সুন্দর উজ্জ্বল মায়াময়ী চাঁদ নির্ভয়ে একাকী বিরাজ করে। একটু ঝুঁকে সে একটা পড়ন্ত শাখা তুলে নেয়। তার তরুণ মুখে একটু কৃত্রিম আশঙ্কা, কৌতুকে মেশানো আশঙ্কা। ভাবে, সাপখোপও হতে পারে, এমন দুঃশীল সাপ যে দারুণ শীতেও গর্তে আশ্রয় নেয় নাই। হাতে গাছের শাখাটি শক্ত করে ধরে যুবক শিক্ষক বাঁশঝাড়ের দিকে এগিয়ে যায়, সাপ না হোক অন্ততপক্ষে দুষ্ট ছাত্রকে শাসন করতে যায় যেন।
জন্তু-জানোয়ার নয়, সাপখোপ বা মাঠালী ইঁদুর নয়, কোনো পলাতক দুষ্ট ছাত্রও নয়। বাঁশঝাড়ের মধ্যে আলো-আঁধার। সে আলো-আঁধারের মধ্যে একটি যুবতী নারীর মৃতদেহ। অর্ধ-উলঙ্গ দেহ, পায়ের কাছে এক ঝলক চাঁদের আলো।
গভীর রাতে বাঁশঝাড়ের মধ্যে আলুথালু বেশে মৃতের মতো পড়ে থাকলেই মানুষ মৃত হয় না। জীবন্ত মানুষের পক্ষে অন্যের জীবন সম্পর্কে নিরাশ হওয়াও সহজ নয়। যুবক শিক্ষক কয়েক মুহূর্ত মৃত নারীর দিকে চেয়ে থাকে। তারপর একটা বেগময় আওয়াজ বুকের অসহনীয় চাপে আরো বেগময় হয়ে অবশেষে নীরবতা বিদীর্ণ করে নিষ্ক্রান্ত হয়। হয়তো সে প্রশ্ন করে কিছু, হয়তো কেবল একটা দুর্বোধ্য আওয়াজই করে : তার স্মরণ নাই। তবে এ-বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ যে সে কোনো উত্তর পায় নাই। মৃত মানুষ উত্তর দেয় না।
যুবক শিক্ষক বাঁশঝাড় থেকে যখন বেরিয়ে আসে তখন তার দৃষ্টিতে ইতিমধ্যে বিভ্রান্তির ছাপ দেখা দিয়েছে, শরীরেও কাঁপন ধরেছে। নিজেকে সংযত করবার চেষ্টা করে সে দ্রুতপদে হাঁটতে থাকে। কিছুদূর গিয়ে সচকিত হয়ে দেখে, সামনে কাদের। সে যেন মাটি ফুঁড়ে উঠেছে। দেহ নিশ্চল, মুখে চাঁদের আলো। তাকে দেখে ক্ষণকালের জন্যে সে স্বস্তিই বোধ করে। কাছে গিয়ে সে কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থাকে, কিছু একটা বলবেও মনে হয়। কাদের পূর্ববৎ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। মুখে চাঁদের আলো তবু তার চোখ দেখা যায় না।
তারপর হঠাৎ যুবক শিক্ষকের মাথায় বিপুলবেগে একটা অন্ধ ঝড় ওঠে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে সে বুঝতে পারে না কী করবে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে সে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে শুরু করে। তার সমস্ত চিন্তাধারা যেন হঠাৎ বিচিত্র গোলকধাঁধায় ঢুকেছে এবং সে- গোলকধাঁধা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে সে দৌড়তে শুরু করে। কিন্তু কোথাও মুক্তিপথের নির্দেশ দেখতে পায় না। সে দৌড়তেই থাকে। যুবক শিক্ষক জ্যান্ত মুরগি-মুখে হাল্কা তামাটে রঙের শেয়াল দেখেছে, বুনো বেড়ালের রক্তাক্ত মুখ দেখেছে, মানুষের দুঃখ-কষ্ট মহামারী-হাহাকার দেখেছে, কিন্তু কখনো বিজন রাতে বাঁশঝাড়ের মধ্যে যুবতী নারীর মৃতদেহ দেখে নাই। হত্যাকারী দেখে নাই। সে ছুটতেই থাকে।
.
বাইরে চাঁদ ডুবে গেছে, পাখির রব শুরু হতে দেরি নাই। টিনের ছাদ থেকে প্রায় নিঃশব্দে শিশির পড়ে। বড়বাড়িতে কে একবার কেশে ওঠে। না-শুনেও যুবক শিক্ষক সে- আওয়াজ শোনে, তার পাথরের মতো শরীরের কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। তারপর আরেকটি আওয়াজ সে শুনতে পায়। এবার অন্ধকারের মধ্যেই ক্ষিপ্রভঙ্গিতে সে দরজার দিকে তাকায়। মনে হয় তার অপেক্ষার শেষ হয়েছে।
দরজায় আবার করাঘাত হয়। তারপর খিল-দেয়া দরজার ওপাশে কাদেরের গলাও শোনা যায়। যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে, তার শরীরে অবশিষ্ট শক্তিও নিঃশেষ হয়ে গেছে। কাদেরকে কোনো উত্তর দেবার বা দরজা খুলবারও কোনো প্রয়োজন সে বোধ করে না। তবু যন্ত্রচালিতের মতো উঠে সে দরজা খুলে একটু সরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে, কাদের ঘরে প্রবেশ করলে তার দিকে তাকায় না। শুধু গভীর নীরবতার মধ্যে সে শুনতে পায় কাদেরের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ।
অবশেষে কাদেরের কণ্ঠ শোনা যায়। তার স্বাভাবিক কণ্ঠ রুক্ষ। এখন সে নিম্নকণ্ঠে কথা বললেও সে-রুক্ষতা ঢাকা পড়ে না। কাদের প্রশ্ন করে, সে দৌড়ে পালিয়েছিল কেন।
তার গলা শুনতে পেয়ে যুবক শিক্ষক হয়তো একটু আশ্বস্ত বোধ করে, কিন্তু প্রশ্নটির কোনো অর্থ বোঝে না। সে কোনো উত্তর দেয় না।
কাদের উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করে। তারপর তার গলা ঝনঝন করে ওঠে। সে কেবল তার প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তিই করে। কিন্তু যুবক শিক্ষক এবারও কোনো উত্তর দেয় না। তার জিহ্বায় যেন কুলুপ পড়েছে। কাদেরের ডাকে দরজা না খোলার যেন উপায় থাকে নাই, কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর দিতে সে বাধ্য নয়। বা মুখে কোনো কথাই সরে না।
উত্তরের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা কাদেরের স্বভাব নয়। তা ছাড়া, কাদের বড়বাড়ির মানুষ। যুবক শিক্ষক সে-বাড়িরই পরাপেক্ষী, তাদেরই আশ্রিত।
‘কী হল?’
যুবক শিক্ষক উত্তর দেবার কোনো চেষ্টা করলেও অন্ধকারের মধ্যে তা দৃষ্টিগোচর হয় না।
অবশেষে কাদের কেমন এক কণ্ঠে আবার প্রশ্ন করে, ‘বাঁশবনে কী করছিলেন?’
যুবক শিক্ষক, পাথরের মতোই সে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বাইরে কোথাও পাখির কলতান শুরু হয়।
একটু পরে কাদের সহসা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
দুই
দাদাসাহেব বড়বাড়ির প্রধান মুরুব্বি। দীর্ঘ প্রশস্ত মানুষ, প্রৌঢ়-বয়সেও মুখভরা একরাশ কালো দাড়ি। তবে চুল-গোঁফ সুন্নত অনুযায়ী ছোট করে ছাঁটা।
বছর পাঁচেক হল দেশের বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করেছেন। তার পূর্বে তিনি সরকারি চাকুরিতে নিযুক্ত ছিলেন বলে কেবল ছুটি-ছাটাতেই দেশে আসতেন। সারা জীবন চাকুরি করেছেন বটে কিন্তু চাকুরিতে কখনো মন ছিল না! মাজহাব -শরিয়ত ব্যাপারে সর্বদা মশগুল থাকতেন বলে কর্মজীবনেও বিশেষ কৃতকার্য হন নাই। উপাধি-ইনাম তো দূরের কথা, পদোন্নতিও বিশেষ হয় নাই। অবশ্য সে-জন্য সেদিনও তাঁর কোনো আফসোস ছিল না, আজও নাই। বরঞ্চ চাকুরিজীবন শেষ হলে তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন : অবশেষে তিনি নিজের সময়ের ষোল আনা মালিক হলেন, তাতে কারো হিস্সা-দাবি থাকল না। তাছাড়া, এবাদতে এবং মাজহাবি কাজে সম্পূর্ণভাবে মনঃপ্রাণ দেবার পথে আর কোনো বাধা থাকল না।
অন্য একটি কারণেও চাকুরিজীবনে তিনি সুখী ছিলেন না। সে-জীবন পরাধীন যুগে কেটেছে। পরাধীনতার অবমাননা যতটা তাঁকে কষ্ট দেয় নাই ততটা দিয়েছে মনিবের বিধর্মীয়তা। বিধর্মীয় মনিব তাঁর প্রিয় ধর্মের প্রতি প্রকাশ্যে কোনো বিরোধিতা বা অবজ্ঞা প্রকাশ না করলেও তার সে-বিরোধিতা-অবজ্ঞা অহরহ অনুভব করেছেন। এমন মনিবের অধীনে গোলামি করা নিতান্তই পীড়াদায়ক। অবসরপ্রাপ্তিতে তাই তাঁর আনন্দের সীমা থাকে নাই।
দেশের বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করলে তিনি অবিলম্বে এ-কথা বুঝতে পারেন যে, অবসর গ্রহণ সময়োচিতই হয়েছে। বাড়িতে সংখ্যায় দশাধিক বালক-বালিকা। তাঁর গ্রামবাসী বড় ছেলের ছয়টি ছেলেমেয়ে। বিধবা মেয়েরও পাঁচটি সন্তানসন্ততি। তাদের শিক্ষাদীক্ষার একান্ত প্রয়োজন। সে-শিক্ষাদীক্ষা হেলা করা যায় না। তবে ভাগ্য ভালো, এখনো তাদের মন সার-দেয়া জমির মতো। তাতে যে-বীজ রোপণ করা যাবে সে-বীজই ফলবতী হবে।
প্রথম সপ্তাহে তিনি নির্দেশ দিলেন, বিমিল্লাহ না বলে কেউ যেন লোকমা না তোলে। শীঘ্র আরেক হুকুম হল, কারো একটি নামাজ যেন কাজা না হয়। (অবশ্য একেবারে নামাজ না পড়া কল্পনাতীত।) তারপর ঈমানের অর্থ, কোরান পাঠ ও হাদিস-সুন্নার প্রয়োজনীয়তা, তবি পড়ার উপকারিতা, নফল নামাজের কার্যকারিতা ইত্যাদি বিষয়ে যথাযথ ব্যাখ্যান দিতে লাগলেন। মাসখানেকের মধ্যে বাড়িময় এমন ঘোরতর পরিবর্তন ঘটল যে ঝানু মোল্লামৌলবীদেরও তাক লেগে গেল। মাথা নেড়ে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, দাদাসাহেব অসাধ্য সাধন করেছেন।
সকলের বিস্ময়ের পাত্র দাদাসাহেবের মেয়েপক্ষের নাতি, আমজাদ। ঘুমে অতি সহজে কাবু হয়ে পড়ে যে ছেলে সেও একটি নামাজ কামাই করে না। একবার নিদ্রার কবলে পড়লে যার শূন্য পেটে রসজবজবে মিঠাই-মণ্ডাও একটু আলোড়ন জাগাতে পারে না সে-ই গভীর নিদ্রা থেকে উঠে ওজু করে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়, একবার ডাকতে হয় না। স্বাভাবিক কথা, আমজাদ দাদাসাহেবের বড়ই প্রিয়পাত্র।
দাদাসাহেব ওয়াজ-নছিহত করেন, কিন্তু সহজে কাউকে ভর্ৎসনা করেন না। তাঁর নিষ্পলক দৃষ্টিই যথেষ্ট। তাঁর স্তব্ধতায় ছেলেমেয়েদের বুকে এক নিমেষে হিমশীতলতা আসে। যেমন সেদিন রাতের ঘটনা। সকলে খেতে বসেছে। দস্তরখানায় স্তূপাকার খাদ্য। ডালভাত, মাছতরকারি, দু-তিন রকমের ভাজি, একটু কাসুন্দি ও গরম পাতের ঘি, ঘন লাল সুরুয়ায় বড় বড় করে কাটা গোরুগোস্ত। ছোটপাতে মুখরোচক আচার-চাটনিও কয়েক পদের। সকলেই পাতে খাবার তুলে নিয়েছে। দাদাসাহেব শ্যেনদৃষ্টিতে চতুর্দিকে তাকান। তারপর হঠাৎ তিনি বলেন, বিসমিল্লাহ। সঙ্গে সঙ্গে চারধারে গুঞ্জন ওঠে, বিসমিল্লাহ। কেবল একজন সে-গুঞ্জনে যোগ দিতে ভুলে যায়। আমজাদের বড় ভাই, কুদ্দুস। হয়তো সেদিন তার পেটে ক্ষুধার দাউ-দাউ আগুন, অথবা কোনো কারণে অন্যমনস্ক।
থমথমে নিস্তব্ধতা নামে। দেখা যায় দাদাসাহেব গুরুগম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কুদ্দুসের দিকে। তার মুখে তখন ঠাসা ভাত। না গিলে সে ভয়ে পাথর হয়ে তাকিয়ে থাকে বাসনের দিকে, চোখ তুলতে সাহস হয় না। প্রথমে কানপাটা, তারপর গোটা কান, অবশেষে সমস্ত মুখ লাল হয়ে ওঠে। দাদাসাহেবের মুখে কিন্তু একটি কথা নাই।
পরে দাদাসাহেব শান্তকণ্ঠে বুঝিয়ে বলেন। খোদাকে কখনো ভুলতে নাই, বিশেষ করে যখন কেউ তাঁর অসীম দানদয়াশীলতায় শরিলাভ করে। নিঃস্বার্থতা, ত্যাগশীলতা এবং আত্মসংযম ধর্মের গোড়াঘাট। সে-সব গুণ ছাড়া দুনিয়ার কোনো সংগ্রামে তো জয়ী হওয়া যায়ই না, ক্ষমাশীল অসীম দয়াবান খোদারও প্রিয়পাত্র হওয়া মুশকিল। এ-উপদেশ দেন খেতে খেতেই। নীরব-ভোজনের পক্ষপাতী তিনি নন। সুন্নার নির্দেশ হল, সদালাপের সঙ্গেই ক্ষুধানিবৃত্তি করা উচিত। সদালাপের জন্যে ধর্মতত্ত্বের চেয়ে আর কোন বিষয় বেশি উপযুক্ত? ঠোঁটে মধুর হাসির আভাস, কণ্ঠ শান্ত স্নিগ্ধ, দাদাসাহেব একাকী কথা বলে যান। খাবার শেষে তখন হয়তো কুদ্দুসের সামান্য ভুলটার কথা কারো মনে নাই। কিন্তু খাদ্যই যে জীবনের সবচেয়ে প্রধান বস্তু নয় সে-কথা প্রমাণ করবার জন্যে সে পরদিন স্বইচ্ছায় নফল রোজা রাখে।
দাদাসাহেবের স্বাভাবিক স্থৈর্য-গাম্ভীর্যে সহজে তারতম্য ঘটে না। কিন্তু একটি ব্যাপারে তিনি কখনো-কখনো অসংযত হয়ে পড়েন। সে-ব্যাপার ধর্ম। যে-মানুষকে দূর থেকে লম্বা-লম্বা পা ফেলে আসতে দেখলে অনেক ছেলের মনে তাঁর দৃশ্যপথ থেকে অদৃশ্য হবার প্রবল বাসনা জাগে, যাঁকে বয়স্থব্যক্তিরা সমীহ-সম্মান না করে পারে না, ধর্মের ব্যাপারে তিনিই শিশুর মতো সরল বা প্রাণবন্ত বালকের মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারেন।
আরেকদিনের ঘটনা। ঘটনাটির উৎপত্তি জেলা শহরের খবর কাগজে প্রকাশিত একটি সংবাদে। অজস্র ছাপাভুলসমেত মেটে কাগজে প্রকাশিত খবর কাগজটি দেশের খবর ছাড়া বিদেশী খবরও সরবরাহ করে থাকে। অধর্মীয় পাঠ্যবস্তুর মধ্যে সে-সংবাদপত্রই সময় পেলে দাদাসাহেব একনজর চেয়ে দেখেন। সেদিন সকালে তাতে একটি খবর পড়ে তিনি বেসামাল ধরনে আনন্দোৎফুল্ল হয়ে পড়েন। তাঁর হাঁকডাক শুনে সবাই ছুটে আসে। অবশ্য এত হৈ- হুলুস্থুলের কারণ প্রথমে কেউ বুঝতে না পারলেও তাঁর উত্তেজিত উজ্জ্বল মুখ দেখে কারো সন্দেহ থাকে না যে, একটি গুরুতর কিন্তু অতিশয় প্রীতিকর এবং শুভময় ঘটনাই ঘটেছে।
ব্যাপারটা খোলাসা হলে জানা যায়, জেলা-শহরের সংবাদপত্রটিতে খবর বেরিয়েছে যে আমেরিকায় একজন বিশেষ গুণী এবং ধর্মসিক্ত ব্যক্তি তাঁর দেশবাসীদের ইসলামধর্মে দীক্ষিত করবার জন্যে বিষম তোড়জোড় শুরু করেছেন। হাজার হাজার নারী-পুরুষ শুনতে আসে তাঁর ওয়াজ। তাঁর যুক্তিপূর্ণ আবেদন-হুজ্জাতে এবং তাঁর উদ্দীপনা-ভরা বক্তৃতায় লোকেরা এত ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে যে রিভল্ভারধারী শতশত তাগড়া তাগড়া পুলিশও তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনতে পারে না।
নাকের ডগায় চশমা বসিয়ে দাদাসাহেব এবার সংযত তবু গর্বিতকণ্ঠে সংবাদটি আবার পড়ে শোনান। ততক্ষণে গোলযোগ শুনে তাঁর বিধবা মেয়ে আনোয়ারাও রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে এসে উপস্থিত হয়েছে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে সংবাদটি বুঝবার চেষ্টা করে। কোথায় আমেরিকা, কী তার বাসিন্দাদের ধর্ম সে-সব পরিষ্কারভাবে তার জানা নাই। কিন্তু এ-কথা সে বুঝতে পারে যে, সেখানে ইসলাম ধর্মের গর্বিত পতাকা উঠবার বেশি দেরি নাই। আনোয়ারার রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, চোখেও আকস্মিকভাবে বৃষ্টির ঝাপটার মতো পানি আসে।
আনন্দোচ্ছ্বসিত ব্যক্তি নিরস্ত্র। দাদাসাহেবের নিরস্ত্রভাবের সুযোগ নিয়ে তবারক হঠাৎ একটি উক্তি করে। ছেলেদের মধ্যে সে বয়োজ্যেষ্ঠ, ইস্কুলে সর্বোচ্চ শ্রেণীতে পড়ে।
‘লোকটা যে হাবসী।’
চশমার ওপর দিয়ে দাদাসাহেব পরমবিস্ময়ে তার দিকে তাকান।
‘দোষ কী তাতে? আমাদের মাহাবে জাতবিচার বর্ণবিচার নাই। সকলেই খোদার বান্দা। সবাই তাঁর চোখে সমান।’
ছেলের বেয়াদবিতে আশঙ্কিত হয়ে তার মা আনোয়ারা ভর্ৎসনা করে,
‘তুই চুপ কর, ফজুল কথা বলিস্ না।’
দাদাসাহেব তখনো অস্ত্রগ্রহণ করেন নাই। সুতরাং মায়ের কথা উপেক্ষা করে তবারক আবার বলে, ‘সে শুধু হাবসীদেরই মুসলমান করছে।’
এবার দাদাসাহেব কিছু দমিত হন, তাঁর উৎসাহে একটু ভাটা লাগে। হয়তো মনে একটু সন্দেহও জাগে। জানালার বাইরে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত ভাবিতভাবে নীরব থাকেন। তারপর আস্তে বলেন, ‘সবকিছুরই আরম্ভ আছে। আরম্ভ হয়েছে। বাকি খোদার মর্জি।’
তাঁর মুখভাব লক্ষ করে সমাকুল আনোয়ারা আবার তার ছেলেকে ভর্ৎসনা করে।
‘চুপ কর। কেন আবার ফজুল কথা বলছিস?’
‘না, কোনো ফজুল কথা বলছে না।’ দাদাসাহেব গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলেন। ছেলেদের ওপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস। ‘তবারকের আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ নাই। একটুতে সে খুশি হয় না।’
তবারক প্রতিবাদ করে না। এবার নিশ্চিন্ত হলে তার মায়ের মুখ সন্তানগৌরবে রক্তিমাভা লাভ করে। সংযত-আনন্দের সঙ্গে সে দাদাসাহেবকে প্রশ্ন করে, ‘বড় সুসংবাদ। ফকির- মিসকিন খাওয়ালে কেমন হয়?’
দাদাসাহেবের উৎসাহ নিচের খাদে নেবে সেখানেই আছে, মনের সন্দেহটাও কাটে নাই। কিন্তু এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা যায় না। সে রাতে এক অজানা মার্কিন নিগ্রোর বদৌলতে তিন গ্রামের ফকির-মিসকিন জেয়াফত পেল।
এশার নামাজের পর, ঘরে অনুজ্জ্বল লণ্ঠনের আলো, পায়ের ওপর ছক–কাটা লাল কম্বল, দাদাসাহেব কখনো কখনো ইতিহাসের গল্প বলেন। দেয়ালে দীর্ঘ ছায়া, আলো-অন্ধকারে দাদার মুখমণ্ডলে একটা অস্পষ্ট শ্রান্তির ভাব। দিনশেষে হয়তো বার্ধক্যের জন্য শ্রান্তি বোধ করেন, অথবা রাত্রির সন্নিধানে নিজের জীবনসন্ধ্যার বিষয়ে অজ্ঞাতে সচেতন হয়ে ওঠেন।
তিনি বলেন : ‘কোথায় না খোদাভক্ত খোদাভীত খোদাপ্রেমিক দীনদয়াময় বীর্যবান মুসলমান ধর্মের পতাকা উত্তোলন করে নাই, কোথায় না সভ্যতার উজ্জ্বল মশাল বহন করে নিয়ে যায় নাই? তাদের জয় বিজয় ও কৃতিত্বের কাহিনী ইতিহাসের অন্ধকার গহ্বরে মণিমুক্তার মতো ঝলমল করে। ইরান-তুরান – খোরাসান, সামারা-সিকিলিয়েহ- বালারাম; দূর দূর দেশে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারিত হয়েছে। তারা বাগদাদ-দামাস্কাস কুতুবা গ্রানাদার মতো মনোরম শহর সৃষ্টি করেছে, নির্মাণ করেছে বৃহৎ মহৎ সুদৃশ্য প্রাসাদ-দুর্গ-তোরণ-মিনার। কত নাম বলি? খুন্দ প্রাসাদ, বাবউজ্জাহাবের সোনালি তোরণ, বিশাল দুর্গ-প্রাসাদ, মেদিনাত্-উল-হামরা, নাইল নদীতীরে কাছর্-উল-খাবরি। তারপর শত শত মনোরম উদ্যান, শত শত শিক্ষাকেন্দ্র, বাণিজ্যবন্দর। ত
কিন্তু ইতিহাসের কথা দাদাসাহেব কখনো কখনোই বলেন। ইতিহাস মানুষের সৃষ্টি। তাঁর মতে, মানুষের সৃষ্টির কথা তুললে ভালো-খারাপের কথা ওঠে। দয়াবান নিষ্ঠাবান সচ্চরিত্র মহৎ খলিফা উমর বা রশীদ-মামুনের কথা তুললে ইয়াজিদ-হাজ্জাজ বিন ইউসুফ-মুতাওয়াক্কিলের নৃশংসতা হীনতা বিশ্বাসঘাতকতার কথা ঢেকে রাখা যায় না। কখনো কখনো দাদাসাহেব গভীর দুঃখের সঙ্গে ভাবেন, দ্বিতীয় দলই যেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। কী করে তাদের কথা ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায়? তাদের কথা ভাবলে কোনো-কোনো সময়ে তাঁর হৃৎকম্পনের মতো ভাব হয়। শুষ্ক হৃদয়ে ভাবেন, নির্দয় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নাকি নিজেই পনের হাজার মানুষের মস্তকচ্যুত করে। একটি দুটি নয়, পনের হাজার মানুষ! ওবাইদুল্লাহ্ বিন জিয়াদ কসাই নাম অর্জন করেছিল তার নিষ্ঠুরতা হিংস্রতার জন্যে। ইতিহাসের কথা তুললে তাদের নাম কি এড়ানো যায়?
দাদাসাহেব এ কথা বোঝেন যে পাপ-মন্দের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম চিরন্তন। খোদা সত্যপথ দেখিয়েছেন মানুষকে, কিন্তু ক-জন মানুষ সে পথে চলতে পারে? তবু একটা কথা থাকে। মানুষ কুপথে কেন যায়?
একটি বিষয়ে দাদাসাহেব নিঃসন্দেহ হতে পারেন না। মানুষের পঙ্কিলতা, তার চারিত্রিক দোষঘাট হিংস্রতা অমানুষিকতা কিশোর মনের জানার প্রয়োজন আছে কি? জীবনের শুরুতেই মানুষের ভুলভ্রান্তি অপচার-ব্যভিচারের কথা তাদের জানা উচিত কি? তরুণমনের আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন আর বিশ্বাস নবজাত বলেই সুন্দর ও পবিত্র। তা ধ্বংস করা কি ঠিক? দাদাসাহেব আপন মনে প্রশ্ন করেন কিন্তু সঠিক কোনো উত্তর পান না। এবং উত্তর পান না বলেই ইতিহাসের কথা কদাচিৎই বলেন।
অবশ্য প্রশ্নের উত্তর পান না বলে দাদাসাহেব বিচলিত হন না। তিনি পরমসত্যে বিশ্বাসী। তাঁর মতে সে সত্য কেবল আসল কিতাবেই পাওয়া যায় এবং সে-সত্য মানুষের বিগতদিনের বা বর্তমানকালের কার্যকলাপে ধ্বংস হয় না : চিরন্তন সত্যকে কখনো ধ্বংস করা যায় না। তাঁর গূঢ়বিশ্বাস, সে-কিতাবের আদেশ-নির্দেশ বাধা-নিষেধ অনুসরণ করে জীবনযাপন করলেই মানুষের মুক্তিলাভ হয়।
কখনো-সখনো তিনি ছেলেদের বংশের কথাও বলেন। বিনীতিশালীনতায় ঢাকা থাকে বলে সহজে তা পরিলক্ষিত হয় না, কিন্তু দাদাসাহেবের মনে বংশগৌরব কম নয়। আজ সে ধনসম্পদ বা মান-ইজ্জত নাই, কিন্তু এককালে চারধারে তাদের বড় নাম-ডাক ছিল। তখন তাঁরা বিশাল জমিদারির মালিক ছিলেন। তাঁদের ঘোড়াশালে তখন ঘোড়া ছিল, হাতিশালে হাতি। খিল্লাত পরিধান করে রেশমের খরিতায় পত্রাদি বাঁধতেন, খাশমহল আতর বাইমস্কের সুগন্ধিতে ফুরফুর করত এবং বিশেষ উৎসবের দিনে বাদশাহি কায়দায় পথে-ঘাটে মোহর ছড়াতেন। তখন আবদার- চোবদার রাখতেন গণ্ডায় গণ্ডায়, সাবর সেবন্দিও পুষতেন। আজ সেদিন আর নাই। তবে সে সমারোহ জাঁকজমক আজ নাই বলে দাদাসাহেবের মনে কোনো সময়ে দুঃখ এলেও বংশগৌরবের মতোই সে দুঃখ তিনি ঢেকে রাখেন, প্রকাশ করেন না। তাছাড়া তাঁর বিশ্বাস, জাঁকজমক হল বাইরের খোলস, অর্থ থাকলেই সে খোলস আসে। বংশের আসল দাম ধন-দৌলতের ওপর নির্ভর করে না। গরিব হলেও আসল খানদানিবংশের দাম পড়ে না। শুধু সোনারূপা, হাতিঘোড়া, পাইক-বরকন্দাজের শানশওকাত থাকলেই একটি বংশ খানদান হয় না। খানদানির মূলভিত্তি হল নেক-চরিত্র, ধর্মের প্রতি ভক্তিনিষ্ঠা, সাধুতা- দয়াশীলতা, বিনয়-নিরভিমান ব্যবহার ইত্যাদি গুণাগুণ। দাদাসাহেবের বিশ্বাস, এ সব গুণাগুণ বংশপরম্পরাক্রমে তাঁদের মধ্যে প্রবহমাণ আছে। একটি তুলনায় তিনি তাঁর যুক্তির পূর্ণ সমর্থন পান। মুসলমানদের শানশওকাত আজ নাই, কিন্তু তাই তাদের অন্তস্থিত মূল্য কি কিছু কমেছে? অবশ্য এ-যুক্তি তাঁরই।
.
আজ সন্ধ্যায় ছক-কাটা লাল কম্বল গায়ে জড়িয়ে দাদাসাহেব প্রথমে চোখ নিমীলিত করে তবি পড়তে শুরু করেন। পায়ের কাছে কুদ্দুস, তবারক এবং আমজাদ বসে। তারা কতক্ষণ তাঁর নিমীলিত চোখের পানে তাকিয়ে থাকে, তারপর লক্ষ করে, তাঁর মুখ ভাবনাচ্ছন্ন। কিচ্ছা কাহিনীর আশা কিছুটা ছেড়ে দিয়ে তারা শোনে বাইরে ঝোড়ো হাওয়ার গোঙানি। থেকে থেকে পশলা বৃষ্টি নাবে কিন্তু দুরন্ত হাওয়ায় সে-বৃষ্টি শীঘ্র বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। থেকে থেকে সে-হাওয়া ভীতিবিহ্বল অন্ধ পশুর মতো জানালা-দরজায় ঝাপটা দিয়ে যায়। শীতের সন্ধ্যায় এ-অসময়ী ঝড় ছেলেদের মনে বিষাদের ছায়া ঘনিয়ে তোলে।
দাদাসাহেব তাঁর নিয়মিত বৈঠক শুরু না করে আপন ভাবনায় কেমন নিঝুম হয়ে থাকেন। মাথা নত করে তবি টেপেন, অস্পষ্টভাবে তাঁর ঠোঁট নড়ে, দেহ নিস্পন্দ। আমজাদ একবার ঝুঁকে তাঁর চোখ দেখবার চেষ্টা করে কিন্তু তা ছায়াচ্ছন্ন বলে দেখতে পায় না। তারপর একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে সে জানালার দিকে তাকায়। ঝড়ের লেজের বাড়ি খেয়ে জানালাটি তখন থরথর করে কাঁপছে।
একটু পরে কিছু সচকিত হয়ে ছেলেরা শোনে দাদাসাহেব অনুচ্চস্বরে কোরানের একটি সুরা আবৃত্তি করতে শুরু করেছেন। চোখ পূর্ববৎ নিমীলিত কিন্তু তাঁর কণ্ঠে মিষ্টি-মধুর শব্দলহরি জেগেছে। এবার কিছুটা আশান্বিত হয়ে তারা নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে, ঝড়ে আর কান দেয় না।
আবৃত্তি শেষ করে দাদাসাহেব আবার নীরব হন। তারপর যেন অপেক্ষমাণ ছেলেদের কথা স্মরণ করে আচম্বিতে ঘোষণা করেন, ‘কম লোকেই বোঝে, কিন্তু তোমাদের কাদের দাদা দরবেশ মানুষ।’
ছেলেরা এবার অনুমান করে যে, দাদাসাহেব তাঁর ভাই কাদেরের কথা ভাবছেন। কেন জানতে ইচ্ছা করলেও তাঁর ভাবনাগ্রস্ত মুখ দেখে কোনো প্রশ্ন করতে সাহস পায় না। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্যে একটু অপেক্ষা করে। দাদাসাহেব আবার চোখ বুজে নীরবাচ্ছন্ন হলে তারা নিরাশ হয়ে ঝড়ের বিচিত্র আর্তনাদে কান ফেরায়।
কাদের দাদাসাহেবের কনিষ্ঠতম ভাই হলেও দু-জনের মধ্যে প্রায় ত্রিশ বছরের ব্যবধান। দুনিয়ায় কাদেরের যখন আবির্ভাব হয় তখন দাদাসাহেবের ওয়ালেদ বয়োবৃদ্ধ। তখন তাঁর চোখে ছানি পড়েছে, হয়তো চরিত্রে ভীমরতির আভাসও দেখা দিয়েছে। জন্মের প্রথম দিন থেকেই অপ্রত্যাশিত শিশুসন্তান তার বাপের চোখের মণি হল। তাতে দোষ নাই। সবাই মেনে নিল তাঁর শেষ-সন্তানের প্রতি অপরিমিত স্নেহ : বৃদ্ধ বয়সে নোতুন প্রাণের সংস্পর্শে জীবনের প্রতি পুনরুদ্ভূত তীব্র অভীপ্সা কৌতূহলজনক হলেও নিন্দনীয় নয়। কিন্তু চেতনাবোধের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের যে চরিত্র প্রকাশ পেল তাতে সবাই শীঘ্র সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল তাদের আদর্শের সঙ্গে সে চরিত্র যেন ঠিক খাপ খায় না। তার অদম্য খামখেয়ালি ভাব, উগ্র মেজাজ এবং সৃষ্টিছাড়া দুরন্তপনা তাদের কাছে নেহাতই বেখাপ্পা ঠেকে। কেবল বৃদ্ধ বাপ অবিচলিত থাকেন। তার বিসদৃশ চরিত্র হয়তো তাঁর নজরে পড়ে না। পড়লেও এবং সংগোপনে তার চারিত্রিক রুক্ষতা স্নেহের মলমে মোলায়েম করবার চেষ্টা করে থাকলেও সে চেষ্টায় তিনি কৃতকার্য হন না।
কাদেরের উগ্র-দুর্দান্ত স্বভাব বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা না হয়ে আরো তেজী হতে থাকে। কিছুদিন সে ইস্কুল করে, কিন্তু ইস্কুলের চার দেয়ালের শক্তি কি তাকে দু-মিনিটের জন্যেও কয়েদ করে রাখে! সে যে বিদ্রোহী ছেলে তাতে সন্দেহ রইল না। কেবল কিসের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ সে-কথা কেউ বুঝল না।
চোখ না খুলেই হঠাৎ দাদাসাহেব অনুচ্চকণ্ঠে আপন মনে বলেন, ‘দরবেশের বিদ্রোহ সাধারণ লোকে কী করে বোঝে?’
হঠাৎ একদিন সে-দুরন্ত ছেলের মধ্যে ঘোরতর পরিবর্তন এল। যেন অকস্মাৎ ঝড় থামল। বয়স তখন আঠার-উনিশ। মুখে আর কথা নাই, চলনে তেজ নাই, চোখে চোখে কারো দিকে তাকায় না। একা একা থাকে, কারো সঙ্গ পছন্দ হয় না। এই সময়ে দাদাসাহেব তাকে তাঁর কার্যস্থলে নিয়ে যান। ধর্মের ব্যাপারে কিছু শিক্ষাদীক্ষা দেবার চেষ্টা করেন, নানারকম উপদেশ-নছিহত দেন যাতে এতদিন যা বাদ পড়েছে তার কিছুটা পূরণ হয়, তার জ্ঞানবোধ আর চারিত্রিক অভাব কিছুটা কাটে। এই সময়ে কাদেরের প্রতি তাঁর পিতার অন্ধস্নেহের কিছুটা যেন তার মনেও দেখা দেয়। ইস্কুলের লেখাপড়া তার বিশেষ হল না, কারণ গোড়া থেকে শুরু করার বয়স তখন পেরিয়ে গেছে। তবে পার্থিব জ্ঞানার্জন না হলেও তার আধ্যাত্মিক উন্নতির বিষয়ে দাদাসাহেবের মনে কোনো সন্দেহ রইল না। তারপর একদিন সে হঠাৎ দেশের বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করে।
‘আমিই তাকে শিখিয়েছি। আমার হাতেই সব শিখেছে, তোমাদের কাদের দাদা’, দাদাসাহেব আবার বলেন। কথাটায় আত্মদত্ত লক্ষ করে একটু লজ্জিত হয়ে যোগ দেন, ‘অবশ্য দরবেশকে কে কী শেখাতে পারে?’
দাদাসাহেবের বাপ-মা দুজনেরই ততদিনে ইন্তেকাল হয়েছে। কাদেরের স্বভাব পরিবর্তনের পরে আশা হল, সেই জমিজমা ঘরসংসার দেখবে। ভরসা হল চারিত্রিক বিশৃঙ্খলা কেটেছে, এবার একটু কেমন বিহ্বলতা যে দেখা দিয়েছে তাও কাটবে এবং ঘরসংসারের জটিলতা বুঝতে তার দেরি হবে না। সে আশা পূর্ণ হয় নাই।
‘সংসারে দরবেশের মন কখনো পড়ে না।’ দাদাসাহেব আবার আপন মনে উক্তি করেন। তারপর ছেলেদের উপস্থিতি সম্বন্ধে সজ্ঞান হয়ে তাদের দিকে একবার তাকান। সংক্ষিপ্তভাবে বলেন, ‘তোমাদের কাদের দাদার কথা বলছি।’
অবশেষে সংসারের ভার নিল দাদাসাহেবের জ্যেষ্ঠপুত্র হামিদ। সিধেসাধা গোবেচারা মানুষ, সদাসর্বদা আদেশাধীন, নম্র-বাধ্য। অশেষ শ্রমসহিষ্ণুতার সঙ্গে এবং বারংবার চেষ্টার ফলে কলেজের শেষ পরীক্ষা কোনো প্রকারে পাস করলেও সকলের আশা হয় সে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করবে। যোগদান করেওছিল, কিন্তু ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো তার প্রাণ শীঘ্রই আইঢাই করতে শুরু করে। চাকুরি অসহ্য হয়ে উঠলে তাতে ইস্তফা দিয়ে দেশের বাড়িতে ফিরে আসে। নামে শুধু কাদের সংসারের দায়িত্ব নিয়েছিল। হামিদের প্রত্যাবর্তনের পর সে-দায়িত্বও থাকল না।
আজ কাদের সম্পূর্ণভাবে নিষ্কর্মা। অত্যন্ত স্বল্পভাষী এবং অসামাজিক বলে তার মনের পরিচয় পাওয়া দুষ্কর, কিন্তু তার বাইরের চেহারা স্বভাবত নিদ্রালস। নিদ্রালস ভাব কাটলে চরম উদাসীনতা নাবে তার মুখে। দাদাসাহেব বলেন, তা তার মুখাচ্ছাদন মাত্র। বিছানায় যখন লম্বা হয়ে পড়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তখন খাটের খুরোতে আর তাতে তফাৎ থাকে না! মাছ ধরার বাতিক জাগলে ছিপ-বড়শি নিয়ে পুকুরধারে গিয়ে যখন বসে তখন প্রাতঃকাল মধ্যদিনের উত্তাপ পেরিয়ে নিষ্প্রভ অপরাহ্ণে গড়িয়ে যায়, সে নড়েচড়ে না, নিস্পৃহমুখ দেখে মনে হয় তার যেন কোনো আশা-আকাঙ্ক্ষাই নাই। বার দুয়েক তাকে তর্ক করতে দেখা গেছে। পরিবারের কারো সঙ্গে নয়, মসজিদের এক চোখ-কানা ইমামের সঙ্গে। যুক্তিতর্কের সূত্র বেশিক্ষণ ধরে রাখা তার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। মতবিরোধ ঘটলে হঠাৎ তার মেজাজ রুক্ষ হয়ে ওঠে, কিশোর বয়সে যেমন হত। তবে শীঘ্র নিজেকে সংযত করে অপ্রস্তুত ইমামকে রেহাই দেয়। দ্বিতীয়বারও তার বক্তব্যের মূলকথা উত্তপ্ত ভাষায় বাষ্পীভূত হতে দেরি লাগে নাই। তার সাধারণ মানুষসুলভ কর্মের মধ্যে আকস্মিক বিয়েই হয়তো একমাত্র উল্লেখযোগ্য। তিন বছর আগে চির বিবাহ-বিরোধী কাদের মত বদলিয়ে হঠাৎ বিয়ে করে। কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে আজ তার সম্বন্ধ অতি ক্ষীণ। অনেক সময় দীর্ঘকাল তাদের মধ্যে কথালাপ হয় না।
দরবেশ বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল, সেটাই মস্ত কথা। আর দশজন জামাইর মতো ব্যবহার কীভাবে করে? একবার দাদাসাহেব তার স্ত্রী-উদাসীনতা সমর্থন করে বলেছিলেন, ‘কেবল কথা বলে না। মারপিট করে কি? না, তা করে না। তবে নালিশের কারণ কী?
কাদেরের দরবেশীলাভের ইতিহাস একদিন কিছুটা সংগোপনে দাদাসাহেব ছেলেদের বলেছিলেন। তখন সে অবিবাহিত। একদিন মধ্যরাতে সে জেগেই শুয়েছিল, হঠাৎ বাড়ির দেউড়ির কাছে থেকে কে যেন তাকে ডাকল। অপরিচিত কণ্ঠস্বর, তবু কোন বন্ধু যেন ডাকল তাকে। ধড়মড়িয়ে উঠে দরজার খিল খুলে সে বেরিয়ে গেল। কাউকে দেখতে পেল না, কিন্তু তাতে নিরুৎসাহ হল না, বিস্মিত হল না, ভীতও হল না। তারপর সে হাঁটতে থাকল। অনির্দিষ্টভাবে নয়, কারণ কণ্ঠস্বরটি তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। সে-রাতে বুজুর্গের সঙ্গে তার প্রথমবার সাক্ষাৎ হয়। পরদিন সকালে যখন সে ঘরে ফেরে, তার মুখ ফ্যাকাসে, রক্তহীন, কিন্তু চোখে অত্যুজ্জ্বল দীপ্তি, অলৌকিক তৃপ্তি-সন্তোষ ভাব। সেই থেকে বুজুর্গের সঙ্গে তার প্রায় সাক্ষাৎ হয়।
দাদাসাহেব বলেন, ‘অবশ্য মুখ খুলে এসব কথা সে কখনো বলে নাই। এসব কথা কেউ মুখ খুলে বলে না।’ কী করে কথাটা তিনি জানতে পেরেছেন তা তিনি পরিষ্কার করে বলেন না।
আজ ঝোড়ো সন্ধ্যায় দাদাসাহেব ধর্মোপদেশ না দিয়ে, নীতিমূলক কিচ্ছা-কাহিনী না বলে কাদেরের কথাই কেন ভাবছেন, তার কারণ আছে। সকালবেলায় তার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকালে তিনি লক্ষ্য করে দেখেন, তার মুখ ফ্যাকাসে ও রক্তহীন। তাঁর বুঝতে দেরি হয় না কেন। তবে তার চোখ দেখে তিনি অতিশয় বিস্মিত হন। তাতে কেমন তীক্ষ্ণ খরধার। শুধু তাই নয়। এক পলকের জন্যে সে এক বিশেষ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকায়, যার অর্থ তিনি বোঝেন না। ইশারায় সে যেন তাঁকে কিছু জানাতে চায়।
সে-দৃষ্টি সারাদিন দাদাসাহেবকে নিপীড়িত করেছে, তার সঙ্গে নির্জনে একটু আলাপের জন্যে, তাকে দু-একটা প্রশ্ন করবার জন্যে একটি প্রবল বাসনা থেকে থেকে তিনি বোধ করেছেন।
বিষাদাচ্ছন্নকণ্ঠে দাদাসাহেব উচ্চস্বরে বলেন, ‘বলবার হলে সে-ই বলবে। আমার পক্ষে জিজ্ঞাসা করাটা সমীচীন হবে না।’
বাইরে ঝড় থেমেছে। রুদ্ধ জানালার দিকে একবার তাকিয়ে দাদাসাহেব পিঠ সোজা করে বসেন। বড়ঘরে দেয়ালঘড়িতে সাড়ে দশটার ঘণ্টা বাজে। ছেলেদের দিকে তাকাবার আগে আরেকবার ভাবেন কাদেরের কথা। ভাবেন, অবশ্য এ কথা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না, কিন্তু বুজুর্গ মানুষ সহজে দেখা দেন না। দরবেশ না হলে কাদের কি বুজুর্গের দেখা পেত? না, কাদের যে দরবেশ তাতে সন্দেহ নাই।
তারপর চোখ খুলে তিনি ছেলেদের দিকে তাকান। একটু কেশে গম্ভীরভাবে ঘোষণা করেন, ‘আজ তোমাদের প্রিয় পয়গম্বরের ইন্তেকালের কথা বলব। ত
তিন
শীতের মিষ্টিরোদ ইস্কুলের নেড়ে প্রাঙ্গণেও স্নিগ্ধ সোনালি আলো ফেলেছে। এক কোণে পাতাবাহারের গাছে সে আলো ঝলমল করে।
চুনবালিতে লেপা বাঁশের দেয়াল, কাঠের ঠাট, ওপরে তরঙ্গায়িত টিনের ছাদ। ছাত্রদের সামনের বার্নিশশূন্য বেঞ্চিতে কালির দাগ, অনেক গ্রীষ্মের ঘামের ছাপ, এখানে-সেখানে ছুরির নির্দয় আঁচড়। অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার টেবিলের পেছনে বসে যুবক শিক্ষক আরেফ আলী। গায়ে নিত্যকার মতো সামান্য ছাতাপড়া, জীর্ণ সবুজ আলোয়ান, পরনে আধা-ময়লা সাদা পায়জামা, পায়ে ধুলায় আবৃত অপেক্ষাকৃত নোতুন পাম্প-সু। অভ্যাসমতো টেবিলের তলে সে অবিরাম ডান পা নাড়ে। পা-টি যেন কলযন্ত্রে চালিত হয়।
আরেফ আলীর বয়স বাইশ-তেইশ। কিন্তু তার শীর্ণ মুখে, অনুজ্জ্বল চোয়ালে বয়োতীতভাব : যৌবনভার সে যেন বেশিদিন সহ্য করতে পারে নি। সে-মুখে হয়তো যৌবনকণ্টক জন্মেছিল, কখনো যৌবনসুলভ পুষ্পোদগম হয় নাই। কয়েক বছর আগে মাদ্রাসা- হাদিসের প্রভাবে দাড়ি রেখেছিল, আজ সে-দাড়ি নাই। কিন্তু এখনো মনে হয় থুতনির নিচে কেমন উলঙ্গতার ভাব। খাড়া নাক চিকন, কপাল ঈষৎ সমুন্নত, চোখে একটু কাঠিন্যভাব। তবে রসশূন্যস্বাস্থ্যের জন্যেই তার চোখ কঠিন মনে হয়। লক্ষ্য করে দেখলে সে-চোখের সরলতা, সময়ে সময়ে অসহায়তাও নজরে পড়ে। কখনো-কখনো তার মধ্যে উদ্ধতভাব ও দম্ভ দেখা যায়, কিন্তু সেটা শিক্ষকতা করে বলে চড়ানো ব্যাপার। তবু একটু অহঙ্কার নাই যে তা নয়। দম্ভ-ঔদ্ধত্য না হোক, শিক্ষক হলে অহঙ্কার না হয়ে পারে না। তবে সেটা কৃত্রিম নয় বলে সযত্নে ঢেকে রাখে, শুধু ক্বচিৎ-কখনোই তার আভাস পাওয়া যায়।
আরেফ আলী অনেকক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। এক সময়ে হঠাৎ সচেতন হয়ে সে লক্ষ্য করে, ছাত্রদের কোলাহল ঝড়ের বেগ ধারণ করেছে। শিক্ষকের অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করে তারা সংযমের লাগাম ছেড়ে শোরগোল শুরু করেছে এবং সে- শোরগোল এমন এক উচ্চ খাদে উঠেছে যে সেখানে ব্যক্তিগত কন্ঠের কোনো চিহ্ন নাই। সে জন্যেই মনে হয় ঝড় বইছে।
অন্যদিন তীক্ষ্ণগলায় তবু হৃদ্যতার সঙ্গে শিক্ষক আরেফ আলী আঙ্গুল নেড়ে শাসন করত। আজ কেমন শ্রান্তগলায় বলে, ‘না না, গোলমাল করো না।’
ছাত্রদের কোলাহল দু-এক খাদ নিচে নেমে একটু অপেক্ষা করে, তারপর আবার সে উচ্চপদে আরোহণ করে। কিছুক্ষণ সময় কাটে। অবশেষে আরেফ আলী এধার-ওধার তাকায়। আওয়াজটা কোত্থেকে যে আসছে তা যেন বুঝতে পারে না। পূর্ববৎ শ্রান্তগলায় বলে, ‘কী? বললাম না গোলমাল করো না?’
শিক্ষকের দৃষ্টি ছাত্রদের উপর নিবদ্ধ থাকে বলে এবং তার মন অন্যত্র ফিরে যায় না দেখে কোলাহল হঠাৎ থামে। যেন ঝড় থামে। একটু দম নিয়ে যুবক শিক্ষক আবার এধার-ওধার তাকায়। কেন তাকায়, নিজেই তা বোঝে না। তারপর অভ্যাসবশত অন্যদিনের মতো আমজাদকেই প্রশ্ন করে, ‘বলো, তিনটি পর্বতমালার নাম বলো।’
শান্তচিত্ত হয়ে যেন যুবক শিক্ষক শিক্ষকতার কাজ শুরু করে, ছাত্ররাও হঠাৎ পাঠানুরাগী হয়ে ওঠে। আমজাদ দ্বিধা না করে বলে,
‘হিমালয়।’
‘তারপর?’
‘আরাবল্লী।’
‘তারপর?’
‘বিন্ধ্যাচল।’
‘বেশ। মনে রেখো, হিমালয় দুনিয়ার সবচেয়ে বড় পর্বতমালা। দৈর্ঘ্যে, উচ্চতায়, ঘনত্বে তার সেরা নাই।’
সামনের বেঞ্চি থেকে একটি ছেলে ডাকে ‘স্যার?’
‘বলো।’
‘হিমালয় দেখেছেন?’
দরিদ্র যুবক শিক্ষক, কোপন নদীর ধারে ক্ষুদ্র চাঁদপারা গ্রামে তার জন্ম। কষ্টেসৃষ্টে নিকটে জেলা শহরে গিয়ে আই.এ. পাস করেছে, সুপরিচিত নদী-খাল-বিল ডোবা-মাঠ-ঘাট সুদূরপ্রসারী ধান ফসলের ক্ষেতের বাইরে কখনো যায় নাই। সমতল বাংলাদেশের অধিবাসী, পর্বতমালা কখনো দেখে নাই। বই-পুস্তকে, সাময়িক পত্রিকা- সংবাদপত্রে কোনো কোনো পর্বতের ছবি দেখেছে, কিন্তু অনেক পর্বতের শুধু নামই শুনেছে। এণ্ডিজ, উরাল, ককেসিয়ান আলতাই পর্বতমালা। কত নাম। সব স্বপ্নের মতো শোনায়।
‘না। হিমালয় দেখি নাই। হিমালয় দেখার সৌভাগ্য হয় নাই।’ কিছুটা ক্ষুণ্ণ কিন্তু পরিষ্কারকণ্ঠে যুবক শিক্ষক জবাব দেয়।
যুবক শিক্ষকের মনে ইস্কুল ঘরের পারিপার্শ্বিকতা এবং শিক্ষকতার কাজ সাধারণ রূপ ধারণ করেছিল। হয়তো দেখা না-দেখার কথাতেই হঠাৎ নিমেষের মধ্যে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো একটি ভয়াবহ দৃশ্য আবার তার চোখের সামনে এসে উপস্থিত হয়। তারপর কেউ যেন তার শরীরের রক্তপানি শুষে নেয়, শূন্য শরীর অপরিসীম শ্রান্তিতে অবশ হয়ে আসে। দমটা কাটলে সে আপন মনে বলে, হিমালয় সে দেখে নাই। বস্তুত, সে কিছুই দেখে নাই। দরিদ্র শিক্ষক, কিছুই তার দেখার সৌভাগ্য হয় নাই।
সজোরে নিশ্বাস নিয়ে যুবক শিক্ষক তারপর জানালা দিয়ে স্বর্ণোজ্জ্বল সূর্যালোকের দিকে তাকায় কিন্তু সে-আলো সে দেখতে পায় না। একটি দৃশ্যই কেবল তার চোখে ভাসে। সে-দৃশ্য থেকে তার নিস্তার নাই, তার মনে-প্রাণে ও দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার বিভীষিকাময় ছায়া।
কিছুক্ষণ পর যুবক শিক্ষক অস্পষ্টভাবে শুনতে পায়, ক্লাসঘরে আবার কলরব জেগেছে। কিন্তু তাদের শাসন না করে সে সর্বাঙ্গে নিশ্চল হয়ে বসে থাকে। সে যে কেবল দৃশ্যটিই দেখে তা নয়, একটি মানুষের মুখও বার বার দেখতে পায়। আসলে সে-মুখই যেন ভয়াবহ দৃশ্যটিকে ঢেকে দেয়, এবং সে-মুখ ভয়াবহ মনে না হলেও প্রতিবার তার জন্যেই তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, শরীরেও কাঁপুনি ধরে। তবু বারেবারে মনশ্চক্ষুতে মুখটিকে সে চেয়ে চেয়ে দেখে।
তারপর হয়তো ছাত্রদের কোলাহল অসহনীয় হয়ে ওঠে। অথবা অতি বিচিত্র মানসিক অবস্থার মধ্যেও কর্তব্যের কথা তার স্মরণ হয়। আবার সজোরে নিশ্বাস নিয়ে সে ছাত্রদের দিকে তাকায়। তাদের মুখ কেমন অস্পষ্ট মনে হয়। দুর্বলকণ্ঠে সে প্রশ্ন করে, ‘কে বলবে এবার?’
সে শাসন না করলেও গোলযোগ সহসা শান্ত হয়। যুবক শিক্ষক অবশেষে মতিনকে দেখতে পায়। ঘোর-কালো ছেলে, কিন্তু বড় বড় চোখ টলটল করে।
‘তুমি বলো। তিনটে উপদ্বীপের নাম বলো।’
যুবক শিক্ষক মতিনের দিকে তাকিয়ে থাকে বটে কিন্তু তার উত্তর তার কানে পৌঁছায় না। কেবল শোনবার ভঙ্গি করে ঘন ঘন মাথা নাড়ে। তার ডান পাও আবার অভ্যাসমতো নড়তে শুরু করেছে।
মতিনের গলার স্বর থামলে অজান্তেই সাধুতার পরিচয় দিয়ে যুবক শিক্ষক প্রশ্ন করে, ‘বলেছ তিনটি উপদ্বীপের নাম?’
‘বললাম তো।’
‘বেশ বেশ।’ যুবক শিক্ষক আবার সজোরে নিশ্বাস নেয়। ছেলেদের মুখ যেন পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। এবার তাদের কচি মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অকারণে কেমন বেদনা বোধ করে। ‘বেশ। তাহলে এবার তিনটে দীর্ঘতম নদীর নাম বলো।’ এধার-ওধার চেয়ে আবার আমজাদের ওপরই আঙ্গুল নিবদ্ধ করে।
‘তুমিই বলো।’
.
দু-বছর আগে আরেফ আলী শিক্ষক হয়ে এ গ্রামে আসে। থাকার আশ্রয় পায় বড়বাড়িতে। খাওয়াদাওয়াও সেখানেই হয়। তার বদলে বড়বাড়ির ছেলেদের দুই বেলা ঘরে পড়ায়। তার বিশ্বাস এই যে, যত নেয় তত সে দেয় না, কিন্তু সেটা দয়াশীল দাদাসাহেবেরই ব্যবস্থা। দাদাসাহেবের প্রতি তাই তার ভক্তিশ্রদ্ধার অন্ত নাই।
দক্ষিণে তিন মাইল দূরে তার নিজের গ্রাম। দরিদ্র সংসার, হাতের তালুর মতো এক টুকরো জমিতে জীবনধারণ চলে না। টেনে-হিঁচড়ে আই.এ. পাস করে সে দেশে ফিরে আসে। পড়তে পারলে আরো পাস করত, কিন্তু কলেজের ফি, বইখাতা কেনার পয়সা আর যোগাড় হয় না। তাছাড়া, জেলাশহরে ঘুসি-আস্তানায় থাকলেও খরচ হয়। এক রত্তি শাকসবজির জমিটাও বিক্রি করে উচ্চশিক্ষার পশ্চাতে ছোটার অর্থ হয় না।
বর্তমান চাকুরিতে আরেফ আলীর অসন্তোষের কারণ নাই। বরঞ্চ তার বিশ্বাস, ভাগ্য দয়াবান না হলে এমন চাকুরি সহজে মিলত না। ইস্কুলটি এখনো উচ্চ ইস্কুলে পরিণত হয় নাই বটে তবু নবম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ-অধ্যয়নের দরজা খোলা হয়েছে। আশা এই যে, দু-এক বছরের মধ্যে সর্বশেষ শ্রেণীও খোলা সম্ভব হবে। সরকারি অর্থ সাহায্যের জন্যে যথাযথ আর্জি পেশ করা হয়েছে। শীঘ্র সে সাহায্যও পাওয়া যাবে সকলের ভরসা। বড়বাড়ির উদ্যম ও আর্থিক সাহায্যে এ ইস্কুলের পত্তন পড়ে। কিন্তু এখন সেদিনের ক্ষুদ্র ইস্কুলটি আর নাই; এ-কে পোষা বড়বাড়ির সামর্থ্যের বাইরে। সরকারি সাহায্য ছাড়া ইস্কুলটির উন্নতি সম্ভব নয়। অবশ্য নিরাশাবাদীদের মতে সরকারি অর্থ সাহায্য পাওয়ার পথে অনেক বাধাবিঘ্ন আছে। নিকটবর্তী জেলাশহরের দুটি উচ্চ ইস্কুলের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবলই বাগাড়ম্বর নয়। এ-ইস্কুল ক্রমশ তাদের আয়ে হস্তক্ষেপ করছে সেটা সহনীয় ব্যাপার নয়। সুতরাং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থামাবার জন্যে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করবে। আরেফ আলী কিন্তু নিরাশ বোধ করে না। ইস্কুলের এবং সাথে সাথে নিজেরও আর্থিক এবং পদোন্নতির বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ। তাছাড়া, বর্তমান অবস্থাই-বা তেমন বিশেষ খারাপ কী? দাদাসাহেবের অভিভাবকত্ব শুধু যে লাভজনক তা নয়, পিতৃহীন যুবকের জন্যে একটা নিরাপদ স্নেহশীল ছাতার মতো।
হাতে যে সামান্য টাকা আসে মায়না বাবদ, তা প্রায় না ছুঁয়ে বৃদ্ধা মায়ের হাতে দিয়ে আসে। মাকে টাকা দেবার সময় প্রতিবার তার অন্তরে কী একটা ভাব উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, চোখে প্রায় পানি আসে। কিন্তু সে-আবেগ অপ্রীতিকর ঠেকে না। অন্তর শান্ত হলে একটা সুখবোধ আসে। তখন তার মনে হয়, জীবনে যেন এই সর্বপ্রথম সে সুখবোধ অনুভব করছে। তবে নবজাত এই সুখবোধকে সরাসরি আলিঙ্গন করতে সাহস হয় না, লাজুক মানুষের মতো অজ্ঞাত আগন্তুকটিকে এড়িয়ে-এড়িয়ে চলে। তবু তার সহবাস ভালোই লাগে। একটি হাসিখুশি প্রফুল্লচিত্ত সঙ্গী জুটেছে যেন।
.
হঠাৎ সচেতন হয়ে যুবক শিক্ষক লক্ষ করে, ক্লাসঘরে অখণ্ড নীরবতা। কপালে হাত রগড়ে ভ্রূ উঠিয়ে সে নির্বাক ছাত্রদের পানে তাকায়। দেখে, সবাই নিষ্পলকদৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। অপ্রস্তুত হয়ে সে ছাত্রদের শাসন করতে গিয়ে থেমে যায়। ছাত্ররা গোলমাল করছে না, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বাঁদরনাচও দেখছে না। এধার-ওধার তাকিয়ে অবশেষে আমজাদকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কী? বলেছ উপদ্বীপের নাম?’ আমজাদ প্রতিবাদ করার আগেই সজোরে মাথা নেড়ে বলে, ‘কী বলছি! উপদ্বীপ নয়, নদীর নাম।’
আমজাদ নিরুত্তর হয়ে থাকলে পেন্সিল দিয়ে টেবিলে আওয়াজ করে কৃত্রিম বিস্ময়ের সঙ্গে আরেফ আলী বলে, ‘কী? ভুলে গেছ সব?’
কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর আমজাদ শিক্ষকের দিকে সোজা তাকিয়ে গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করে, ‘স্যার, আপনার আজ শরীর ভালো নয়?’
হঠাৎ এমন প্রশ্নের জবাবটা ঝট্ করে আসে না। যুবক শিক্ষক কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। নিদ্রাহীন রাত্রি বিচরণের ছাপ নিশ্চয় তার চোখে-মুখে স্পষ্টভাবে লেখা। তার আচরণ ও কি ছাত্রদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকে?
অবশেষে নিরাশমুখে পেটে হাত বুলিয়ে সে বলে, ‘বোধহয় একটু বদহজম হয়েছে।’ পরমুহূর্তেই সে-কথা উড়িয়ে দিয়ে উচ্চকণ্ঠে আদেশ দেয়, ‘উপদ্বীপের নাম বলেছ, এবার তিনটি দীর্ঘতম নদীর নাম বলো, আমজাদ।’
আমজাদ বলে না যে ইতিপূর্বে সে তিনটি নদীর নাম একবার বলেছে। নত মাথায় শুষ্ককণ্ঠে সে পুনর্বার বলে। অন্য ছাত্ররা একটি কথা বলে না।
দাহজ্বরাগ্রস্ত মানুষ যেমন স্নেহস্পর্শ অনুভব করে কিন্তু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে না, তেমনি যুবক ছাত্রদের স্নেহজাত উদ্বেগ সে নীরবেই গ্রহণ করে। সে বোঝে তার মানসিক কষ্ট-যন্ত্রণা বিভাজ্য নয়, কারো সাথে তার ভাগাভাগি সম্ভব নয়। কারণ তার জন্মকথা প্ৰকাশ করা যায় না।
অপরিসীম দুঃখের সঙ্গে সে ভাবে, এ কী হল তার? কিন্তু কী যে তার হয়েছে তা সে পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারে না। সে একটি গোলকধাঁধায় ঢুকেছে, যার আকৃতি-পরিধি কিছুই জানে না, যার অর্থ সে বোঝে না। সে-গোলকধাঁধায় পরিচিত জগতের কোনো চিহ্নও নাই।
ঘণ্টা বাজার একটু আগে হঠাৎ যেন তার জ্বর ছাড়ে। চিন্তাধারা সংযত হলে সে এবার সামান্য লজ্জাও বোধ করতে শুরু করে, কারণ তার মানসিক অবস্থার কোনো যুক্তিসঙ্গত হেতু সে খুঁজে পায় না। গোলকধাঁধায় যেন সূর্যরশ্মি প্রবেশ করেছে। সে বুঝতে পারে, বাঁশঝাড়ের দৃশ্যটির সঙ্গে তার কোনো ব্যক্তিগত যোগাযোগ নাই। দৃশ্যটি অতি বীভৎস তাতে সন্দেহ নাই কিন্তু সে শুধু তার ক্ষণকালের দর্শকমাত্র। একবার দেখেছে, আর দেখবে না। দেখে মনে যে আঘাত পেয়েছে, সে আঘাতও স্থায়ী হবে না। তাছাড়া, সে-দৃশ্যটির সঙ্গে কোনো পাপ-নৃশংসতা জড়িত, সে-পাপ-নৃশংসতা তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
মনে সামান্য শক্তির সঞ্চার হলে যুবক শিক্ষক ছাত্রদের বলে, ‘বলো, কে আমাজন আবিষ্কার করেছিল?’ তারপর হঠাৎ একটি কথা স্মরণ হলে বলে, ‘না, তোমাদের বইতে তার নাম নাই। পনের শ শতাব্দীতে ভিনসেন্ট পিনজোন সর্বপ্রথম আমাজন নদীটি আবিষ্কার করে। তবু বহুদিন সে-নদী রহস্যময় ছিল। কিন্তু আজ সে-নদী সম্বন্ধে কিছুই মানুষের অজানা নাই।’ একটু থেমে যুবক শিক্ষক আবার বলে, ‘সে-রহস্যও নাই, নদীটির সম্বন্ধে সে-রূপকথাও নাই। অজ্ঞানতায় রহস্য-রূপকথার জন্ম হয়।’
হঠাৎ শিক্ষকের কানে ঝাঁঝ ধরে। মনে হয় কান দুটি জ্বলে যাচ্ছে। সজোরে সে প্রশ্ন করে, ‘আমাজন নদীর আবিষ্কারকের নামটি বল।’
ছাত্ররা চুপ করে থাকে। নতুন বিদেশী নামটি তারা ধরতে পারে নাই। কোনো উত্তর না পেলে যুবক শিক্ষক কিন্তু আবিষ্কারকের নামটি দ্বিতীয় বার বলে না। তার মনে হয়, কানের ঝাঁঝটা আরো বেড়েছে যেন। সে ভাবে : তাই, কেন সে পালিয়ে গিয়েছিল? কেমন করে সে এ-কথা ভাবতে পেরেছিল যে বীভৎস দৃশ্যটির সঙ্গে কাদের জড়িত থাকতে পারে?
অবশেষে ক্লাস বদলের ঘণ্টা বেজে ওঠে। ভূগোলের বই বন্ধ করে যুবক শিক্ষক উঠে দাঁড়ায়। পায়ে অসীম দুর্বলতা, তবে মাথাটা পরিষ্কার মনে হয়। লজ্জাভাবের রেশটা এখনো কাটে নাই, কিন্তু সে একটা গভীর স্বস্তি বোধ করে।
চার
দু’বছর ধরে বড়বাড়ির বাইরের ঘরে বসবাস, তবু কাদেরের সঙ্গে মুখামুখি হবার সুযোগ কমই হয়েছে। মুখামুখি হলেও কথালাপ হয় নাই। তবু তার সম্বন্ধে যুবক শিক্ষক কখনো কখনো গভীর কৌতূহল বোধ করেছে। হয়তো তার সম্বন্ধে দাদাসাহেবের খেয়ালটির কোনো ভিত্তি নাই, তবু দরবেশী ব্যাপারে কে নিশ্চিত হতে পারে?
আজ রাতে যুবক শিক্ষক শান্তচিত্তে তাকে ভালো করে চেয়ে দেখে। খাটো মানুষ, কিন্তু বংশজাত চওড়া হাড়। কালো রং, চেহারার গঠন ধারালো। তবে তার চেহারায় দুটি জিনিস শীঘ্র চোখে পড়ে। প্রথমত, তার অর্ধ-নিমীলিত চোখ। সে যেন নিদ্রা-জাগরণের মধ্যে কোথাও সর্বদা বিরাজ করে। নিদ্রাবিষ্ট চোখের প্রভাব তার সারা মুখেও বিস্তারিত। দ্বিতীয়ত, তার মাথায় চুলের বাহার। তেল-চকচকে মাথায় সযত্নে সিঁথি কাটা, একটি চুলও অস্থানে নাই। তার অর্ধঘুমন্ত মুখে সে চুলের বাহার কেমন বেমানান মনে হয়।
কাদের মশারি সরিয়ে যুবক শিক্ষকের বিছানার একপ্রান্তে বসে। তার অর্ধ-নিমীলিত ছোট টেবিলে স্থাপিত লণ্ঠনের ওপর নিবদ্ধ। কেমন মনে হয়, যুবক শিক্ষকের এ-সূক্ষ্ম পরীক্ষা সম্বন্ধে সে সচেতন এবং এ-পরীক্ষায় তার আপত্তি নাই। বরঞ্চ স্ব-ইচ্ছায়ই যেন সে তার পরীক্ষাধীন হয়েছে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে যুবক শিক্ষকের ভয় হয়, কানে আবার ঝাঁঝ ধরবে বুঝি। ভাগ্যবশত, কাদের এমন সময় একটু নড়ে ওঠে। হয়তো সে বুঝতে পারে, পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আলগোছে সে এধার-ওধার তাকায়। টেবিলের ওপর দু-একটা বইয়ের ওপর তার নজর পড়ে। কিন্তু ক্ষণকালের জন্য। অবশেষে লণ্ঠনের ওপরই তার দৃষ্টি ফিরে আসে।
শীঘ্র যুবক শিক্ষক অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করে। একই বাড়িতে দু-বছর বসবাস করে যার সঙ্গে কখনো কথালাপ হয় নাই এবং যার সঙ্গে গত রাতে অতি বিচিত্র অবস্থার মধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছিল, গভীর রাতে তার এ আগমন এবং আগমনের পরেও তার গভীর নির্বাকতা বেশিক্ষণ স্বচ্ছন্দচিত্তে গ্রহণ করা মুশকিল। কী জন্যে সে এসেছে? তার সম্বন্ধে যুবক শিক্ষকের মনে যে একটি অদ্ভুত সন্দেহ জেগেছিল, সে সন্দেহটি দূর করতে এসেছে কি? তার সন্দেহটি কাদেরকে হয়তো সারাদিন পীড়া দিয়েছে।
একটা অস্পষ্ট সহানুভূতিতে যুবক শিক্ষকের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু নীরব লোকটিকে কী বলবে বুঝে পায় না। মনে সন্দেহটা কেটেছে বলে কথাটা ভাবতেই মনে লজ্জা আসে। তার পক্ষে সে কথা তোলা সহজ নয়।
অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে কাদের কিছু বলে ওঠে। যুবক শিক্ষক তার কথাটা ঠিক ধরতে পারে না। কেবল কাদের কথা বলেছে বলে একটা স্বস্তির ভাব বোধ করে। নম্রকণ্ঠে সে প্রশ্ন করে, ‘কী বললেন?’
কাদেরের দৃষ্টি পূর্ববৎ লণ্ঠনের ওপর নিবদ্ধ। একটু চুপ থেকে সে কেমন খনখনে গলায় বলে, ‘তোতারী কিংখাবের কথা বলছিলাম।’
আরেকটি বিসদৃশ জিনিস : খনখনে গলা। মুখের সঙ্গে মানায় না!
‘তোতারী কিংখাব?’
‘শোনেন নাই?’
গলা আরো নম্র করে যুবক শিক্ষক উত্তর দেয়, ‘না।’
‘পুরোনো আমলের জিনিস। সিন্দুকে তালাবন্ধ থাকে।’
যুবক শিক্ষক বোঝে, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কোনো মূল্যবান বস্তুর কথা কাদের বলছে, কিন্তু সে কথার আকস্মিক উত্থাপনের অর্থ সে বোঝে না। হঠাৎ তার সন্দেহ হয়, গত রাতের ঘটনা বা তার প্রতি যুবক শিক্ষকের যে সন্দেহ জেগেছিল, সে ঘটনা বা সে-সন্দেহ তার আগমনের কারণ নয়। তাদের বংশের তোতারী কিংখাবের কথাও যে তাকে বলতে এসেছে, তা নয়। কাদের নিঃসঙ্গ মানুষ। গত রাতে বিচিত্র অবস্থার মধ্যে তাদের সাক্ষাৎ হলে হঠাৎ সে কি তার প্রতি একটা বন্ধুত্ব-ভাব বোধ করতে শুরু করেছে?
‘দামি জিনিস হবে।’ অবশেষে যুবক শিক্ষক উত্তর দেয়। সে যে তোস্তারী কিংখাবের মূল্য বুঝতে পেরেছে সে-কথা কাদের উপলব্ধি করেছে কিনা তাই দেখবার জন্যে তার দিকে একবার তাকায়। কাদের তার দৃষ্টি লক্ষ করে না। কয়েক মুহূর্ত নির্বাক থাকার পর যুবক শিক্ষক ভাবে তাকে প্রশ্ন করবে তোস্তারী কিংখাব আসলে কী জিনিস, এমন সময় কাদের হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। একটু ইতস্তত করে অবশেষে খনখনে গলায় বলে, ‘চলেন যাই।’
যুবক শিক্ষক সহসা কোনো উত্তর দিতে সক্ষম হয় না। শেষে শুষ্ককণ্ঠে প্রশ্ন করে, ‘কোথায়?’
‘এখনো বাঁশঝাড়ে পড়ে আছে। কেউ খবর পায় নাই।’
কথাটি এমন সাধারণ শোনায় যেন তা যুবক শিক্ষকের মনে তৎক্ষণাৎ কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে না। তারপর হঠাৎ কাদেরের কথার মর্মোদ্ধার করার আগেই যেন একটা দুর্বোধ্য স্রোত প্রবলবেগে এসে তাকে স্থানচ্যুত করে। দুপুরবেলা থেকে তার মনে দুনিয়াটা স্বাভাবিক রূপ ধারণ করেছিল। মধ্যরাতে তার ঘরে কাদেরের উপস্থিতিও সে যে শুধু স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছিল তা নয়, তাদের কেমন বন্ধুত্বের আভাস পেয়ে তার মন উষ্ণ হয়ে উঠেছিল। কাদেরের প্রস্তাবে এবার সব ধূলিসাৎ হয়ে যায়। না, সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
যুবক শিক্ষকের উত্তর দিতে দেরি হচ্ছে দেখে কাদের আবার বলে, ‘বাঁশঝাড়ে জন্তু-জানোয়ার আসে।’
যুবক শিক্ষক তখন লণ্ঠনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে। এবারও সে কোনো উত্তর দিতে সক্ষম হয় না। সে কী উত্তর দেবে? মনটা তার কেমন ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। কী একটা কথা ধরবার চেষ্টা করে বলে সারা মনে প্রচণ্ড আলোড়ন হয় কিন্তু কথাটি শুধু কাদায় নয়, লতাপাতা-আগাছায়ও জড়িয়ে আছে।
‘চলেন।’ আরেকটু অপেক্ষা করে কাদের আবার বলে। চলার ভঙ্গি করে বলে তার জুতায় একটু শব্দ হয়।
যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে, তার পক্ষে চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব নয়। কাদেরের প্রস্তাবটি বুঝতে না পারলেও সেটিকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা তার নাই। সত্যাসত্য, সাধারণ-অসাধারণ, উচিত-অনুচিত বিচার করাও যেন আর সম্ভব নয়। মনের কথাটি উদ্ধার করবার চেষ্টায় শুধু শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, শরীরে কোথাও কাঁপনও ধরেছে।
তবু সাহসের জন্যেই যেন বিহ্বল দৃষ্টিতে কাদেরের দিকে তাকায়। তার মুখের পাশটা কেবল দেখতে পায়। কপালটা খাড়া, কিন্তু অর্ধ-নিমীলিত চোখে বেদনার আভাস। তার মুখে ভীতিজনক কোনো ছায়া তো নাই-ই বরঞ্চ তাতে অতি নিরীহ, এমনকি একটু অসহায় ভাবও। বিস্মিত হয়ে সে কতক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
অকস্মাৎ যুবক শিক্ষক যন্ত্রচালিতের মতো উঠে দাঁড়ায়। ঘরের কোণে খড়ম ছেড়ে পাম্প-সু পরে, টেবিলের ওপর লণ্ঠনটা নিভিয়ে দেয়। কাদের তখন খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। বাইরে উজ্জ্বল চন্দ্রালোকের জন্যে চৌকাঠের মধ্যে তার শরীরের ছায়া জেগে উঠেছে। মুহূর্তের মধ্যে সে যেন অন্য মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে। যুবক শিক্ষক কিন্তু তার দিকে আর স্পষ্টভাবে তাকায় না।
সন্ধ্যার পর ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু এখন চাঁদ আর ছিটেফোঁটা কয়েকটা তারা ছাড়া সম্পূর্ণ আকাশ শূন্য। স্থানে স্থানে মাটি ভেজা, গাছের সিক্ত পাতায় আলোর ঝলকানি। যুবক শিক্ষক কোনো দিকে তাকাবার প্রয়োজনও বোধ করে না। চতুর্দিকে অন্ধকার দেয়াল, যে-দেয়ালের জন্যে বাস্তব জগতের সঙ্গে হঠাৎ তার সমস্ত সংযোগ ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অন্যান্য দিনের মতো সে আজও সুপরিচিত পথে চলেছে কিন্তু যে-অবাস্তব জগতে সে প্রবেশ করেছে সে-জগতের সঙ্গে সত্যিকার পারিপার্শ্বিকতার কোনো সম্বন্ধ নাই। তার পরিচিত জগৎ সে যে আর দেখতে পায় না তাতে তার দুঃখ হয় না, বরঞ্চ তাতে সে স্বস্তিই পায়। তবে এমন স্বচ্ছন্দতার সঙ্গে সে-জগৎ পরিত্যাগ করতে পেরেছে বলে মনে একটু বিস্ময় হয়। যে-দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীরবেষ্টিত জগতের মধ্যে মানুষ আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, তার আলিঙ্গন থেকে এত সহজেই যে মুক্তিলাভ করা সম্ভব সে-কথা সে জানত না। চোখের পলকেই সে তার সীমানা অতিক্রম করেছে। এ-নূতন জ্ঞান শীঘ্র তার মনে একটা বিচিত্র নেশার সৃষ্টি করে। ক্ষণকালের জন্যে তার হৃদয়ে কম্পন উপস্থিত হয়। ভয়ে নয়, কেমন একটা উত্তেজনায়। বাঁশঝাড়ে মৃতদেহের কাছে নয়, সে যেন অভিসারে চলেছে।
খানিকটা পথ গিয়ে তারা লাঙ্গল-দেয়া ক্ষেতের পাশে আইল পথ ধরে। পাশে ছোট সেচনী-নালা। একটু দূরে রাতে পরিত্যক্ত সেঁউতি নজরে পড়ে। মনে হয়, একটি মানুষ হাত বাড়িয়ে উবু হয়ে বসে আছে। সেদিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে কাদের আস্তে বলে, ‘সেকালে তোতারী কিংখাব বড় মশহুর ছিল।’
পাশে ক্ষুদ্র নালায় স্বচ্ছ আকাশের প্রতিবিম্ব। নিঃশব্দ রাতে তাদের দু-জনের পায়ের শব্দ। তারা দ্রুতপায়ে চলে। একটু পরে কাদেরের উক্তিটা যুবক শিক্ষকের কানে পৌঁছায়। উক্তিটি অর্থহীন মনে হয়, তবু তাতে সে বিস্ময় বোধ না করে বরঞ্চ স্বস্তিই বোধ করে। অবাস্তব জগতে প্রবেশ করেও বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্বন্ধ যে একেবারে ছিন্ন হয় নাই, কোথাও যে দুটির মধ্যে একটি অদৃশ্য বন্ধন আছে, উক্তিটি সে-কথাটাই যেন ঘোষণা করে। তাই মনে স্বস্তি আসে। অবাস্তব জগৎও নেহাত স্বাভাবিক। তাতে কিছু অসাধারণত্ব নাই। দুটি যেন একই মুদ্রার এপাশ-ওপাশ।
সে-বিষয়ে আশ্বস্ত হলে একটু আগে যে-নেশা এসেছিল সে নেশা কাটে। পরক্ষণেই তার মনে একটি প্রশ্ন আসে, কোথায় যাচ্ছে সে? উত্তরের জন্যে সে কাদেরের দিকে চোরা- দৃষ্টিতে একবার তাকায়। অভ্যাসবশত বাঁ-হাত স্থির রেখে ডান-হাত সজোরে দুলিয়ে তার সঙ্গী পূর্ববৎ দ্রুতপায়ে হাঁটে, দৃষ্টি সামনের পথে নিবদ্ধ। সে জানে কোথায় সে যাচ্ছে।
শীঘ্র যুবক শিক্ষক নিঃসঙ্গ বোধ করতে শুরু করে। একটা নিদারুণ বেদনায় বার-বার ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। অকারণেই যেন কতগুলি অর্থহীন ঘরোয়া চিত্র তার মনের পর্দার ওপর দিয়ে ভেসে যায়। তার গ্রামের মুদির দোকানের ফেনি বাতাসা, ঘরের পেছনে শেওলা পড়া ছায়াচ্ছন্ন পুকুর, পড়শীর নূতন বেড়া। তার বর্তমান যাত্রার পরিণাম তার কাছে প্রত্যক্ষগোচর হয় না বলে হয়তো তার ভীত মন পশ্চাতের পরিচিত স্থানে খুঁটি গাড়তে চায়। অথবা যা সে পেছনে ফেলে যাচ্ছে তার মূল্য নিরূপণ করবার চেষ্টা করে। হয়তো এখনো ফিরবার সময় আছে। যা সে ফেলে যাচ্ছে তার সে মূল্য জানে না কিন্তু সেখানেই তার প্রত্যাবর্তন করা উচিত। জীবনের মূল্য কি কেউ কখনো সঠিকভাবে বুঝতে পারে? মানুষ সর্বদা, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে, জীবনের মূল্য নিরূপণ করার চেষ্টা করে কিন্তু সক্ষম হয় কি? কী দিয়ে ওজন করে তুলনা করে? স্বর্ণকারের নিক্তিতেও তার মূল্য যাচাই করা যায় না। তার মূল্য নিরূপণের কোনো মানদণ্ড নাই।
যুবক শিক্ষক কাদেরের দ্রুতগতিতে তাল দিয়ে চলে কিন্তু তার সঙ্গীর সাবলীলতা নাই তার পদক্ষেপে। কাদের জানে যাত্রার কারণ, সে জানে না। অর্ধ-নিমীলিত চোখেও কাদের সবকিছু দেখে, যা সে সম্পূর্ণ খোলা দৃষ্টিতেও দেখতে পায় না। কিন্তু দেখার কী আছে? না দেখাতেই নিরাপত্তা। শীঘ্র কল্পনায় সে শত-শত চোখ দেখে : হাটে-বাজারে, পথে-ঘাটে, ক্ষেত-খামারে। তার বিশ্বাস হয়, সবারই চোখ আছে কিন্তু কেউ কিছু দেখে না। সবাই তাই অতল গহ্বরের প্রান্তে দাঁড়িয়েও নিরাপদ বোধ করে।
একটু পরে যুবক শিক্ষকের মনটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। চারধারে চাঁদের আলো ঝকঝক করে। না, সে দেখতে না পেলেও সামনে অতল গহ্বর নাই। পাশে কাদেরের নিঃশঙ্কচিত্ত ও সে যেন স্পর্শ করতে পারে।
তবু শীতের রাতেও তার কপালে ঘামের আভাস দেখা দেয়।
.
বাঁশঝাড়ে প্রবেশ করার আগে কাদের একবার থমকে দাঁড়ায়। শান্তভাবে এদিক-ওদিক তাকায়, পাশে যুবক শিক্ষক সম্বন্ধে সজ্ঞান বলে মনে হয় না। তারপর সে দৃঢ়পদে বাঁশঝাড়ের মধ্যে প্রবেশ করে। অপ্রশস্ত পথ, পাশাপাশি দুজন মানুষের পক্ষে চলা সম্ভব নয়। একটি মানুষের গায়েও আঁচড়-খোঁচা লাগে। যুবক শিক্ষকও কাদেরের মতো এধার-ওধার তাকায়, কিন্তু কেন তাকায় তা সে নিজেই জানে না। তারপর পায়ে কেমন জড়তা বোধ করলে সে দাঁড়িয়েই থাকে। অনতিদূরে নদী দেখা যায়। নদীর বুকে কুয়াশা। বাঁশঝাড়ে কাদেরের আওয়াজ শোনা যায় কিন্তু সেদিকে কান দেয় না। সে যে নদীর বুকে কুয়াশা দেখতে পায় তাতেই সে সন্তুষ্ট। উদ্দেশ্যহীনভাবে সে উরুর কাছে চুলকাতে শুরু করে এবং মনে হয় একবার হাই তুলবে।
বাঁশঝাড় থেকে কাদেরের অনুচ্চকণ্ঠ শোনা যায়।
‘কোথায় আপনি?’
যুবক শিক্ষক উত্তর দেয় না। উত্তর দেবার চেষ্টা করে বটে কিন্তু ভেতর থেকে উঠে এসেও উত্তরটা মাঝপথে কোথাও হারিয়ে যায়। তারপর কাদের আবার তাকে ডাকে। যুবক শিক্ষক কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকে? এবারও সে উত্তর দেয় না বটে কিন্তু ঝট্ করে বাঁশঝাড়ে ঢুকে পড়ে। সঙ্গে-সঙ্গে শরীরটা অবশ হয়ে ওঠে, চোখের সামনে নিবিড় অন্ধকারটিও আবার নাবে। আজও বাঁশঝাড়ে হাল্কা অন্ধকার, দেখতে চাইলে সব দেখা যায়, কিন্তু সে আর কিছুই দেখতে পায় না। একটি দুর্বোধ্য কিন্তু দুর্লঙ্ঘ্য আদেশে অন্ধের মতো সে এগিয়ে যায়।
তারপর বাঁশঝাড়ে সে কাদেরকে সাহায্য করে, কিন্তু কিছু না দেখে কিছু না অনুভব করে। সময় দীর্ঘ ঢেউয়ের মতো ধীরে-ধীরে বয়ে যায়, চোখের অন্ধকার আরো নিবিড় কালো হয়, তার সমস্ত জ্ঞানেন্দ্রিয় শিল-পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে থাকে। সাবধানতা সত্ত্বেও বাঁশঝাড়ে নানাবিধ শব্দ হয়, প্রভূত বাধাবিপত্তির সৃষ্টি হয়। যুবক শিক্ষক সে-সব শব্দের বা বাধাবিপত্তির কারণ বোঝে না, বোঝার তাগিদও বোধ করে না।
একবার কাদেরের কণ্ঠস্বর তার কর্ণগোচর হয়। অনুচ্চ কণ্ঠ, তবু সন্দেহ থাকে না যে যুবক শিক্ষককে সে তিরস্কার করে।
‘শক্ত করে ধরেন না কেন?’ সে বলে।
কী সে শক্ত করে ধরবে? তার হাতে দুই খণ্ড হিমশীতল কাঠ। কিন্তু নিজের হাত দুটিও কাঠের মতো প্রাণহীন মনে হয় তার কাছে। তবু যতটা পারে ততটা শক্ত করে ধরে।
আবার কাদেরের গলা কোত্থেকে ভেসে ওঠে। তখন কালোস্রোতে যুবক শিক্ষক ভাসছে। কাদেরের কণ্ঠ অনেক দূরে অজানা কোনো পানির জন্তুর মতো লাফিয়ে ওঠে। যুবক শিক্ষক হিমশীতল কাঠ দুটি প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে।
‘কোথায় যাচ্ছেন?’ আবার কাদেরের গলা। কাছাকাছি কোথাও সে-গলা ঝনঝন করে ওঠে।
উত্তরে যুবক শিক্ষক ব্যথার অস্ফুট আওয়াজ করে, কারণ তার পশ্চাদ্ভাগে সূক্ষ্মাগ্র কিছু বিদ্ধ হয় যেন। ত্রস্তগতিতে অন্যদিকে মোড় নিলে বাঁশঝাড় তাকে সহস্র হস্ত দিয়ে আলিঙ্গন করে। ফলে বিদ্যুদ্বেগে একটি নিদারুণ ভয় তাকে এবার আঁকড়ে ধরে। তারপর সে-ভীতির জন্যেই হয়তো সে ক্ষণকালের জন্যে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। বাঁশে আলোয়ান আটকে গেছে। একহাতে মৃত নারীর পা-দুটি ধরে সে বিষম বেগে আলোয়ানটা ছাড়িয়ে নেয়। হিংস্র জন্তুর মুখগ্রাস থেকে সে যেন হাত ছিনিয়ে নেয়। সারা বাঁশঝাড় কেঁপে ওঠে।
কয়েক মুহূর্ত পরে অত্যাশ্চর্য একটি ঘটনা ঘটে। হঠাৎ উজ্জ্বল জ্যোৎস্নালোকে যুবক শিক্ষকের মুখ ভেসে যায়। সে অবশেষে দীর্ঘ গুহা অতিক্রম করে আলোতে পৌঁছেছে। কিছুটা বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে কাদের তৎক্ষণাৎ ভর্ৎসনা করে ওঠে। কাতরকণ্ঠে যুবক শিক্ষক উত্তর দেয়, ‘কোন্ দিকে যাব?’
তারা নদীর দিকে চলতে শুরু করে। কাদের নির্বাক। দূরে গ্রামে একটা কুকুর ঘেউ-ঘেউ করে, কোথাও একটা রাত জাগা পাখি নিঃসঙ্গ কণ্ঠে ডেকে ওঠে। যুবক শিক্ষকের মুখ দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরে। অতি নিকটে পরিচিত আওয়াজ শুনতে পেলে প্রথমে কিছুটা বিস্মিত হয়, তারপর বোঝে সে-আওয়াজ তাদের উচ্চ শ্বাস-প্রশ্বাসের। তার মনে হয়, তারা যেন বিক্রয়সামগ্রী নিয়ে হাট-বাজার অভিমুখে ধাবমান দুটি মানুষ, দিগন্তে সকালের তির্যক সূর্যালোক। তারা হাঁপাচ্ছে। পথে অশেষ ধুলা।
নদীর খাড়া পাড় দিয়ে নাবতে শুরু করে যুবক শিক্ষক ভয়ে নিথর হয়ে পড়ে। তার মনে হয়, সে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। নিচে আবার অতল গহ্বর।
‘কী হল?’ কাদের অনুচ্চকণ্ঠে হুমকি দিয়ে ওঠে।
যুবক শিক্ষক চোখ খুলবার আপ্রাণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে কান্নাকাতর স্বরে বলে, ‘কিছু দেখতে পাচ্ছি না।’
কিন্তু অতল গহ্বরের প্রান্তে চোখ আপনা থেকেই খোলে। অবশেষে অসীম শক্তি প্রয়োগ করে যুবক শিক্ষক তার দৃষ্টিকে কেন্দ্রীভূত করে। খাড়া পাড় অত খাড়া নয়। অদূরে একটু সমতল স্থানের পর পানি অস্ফুট শব্দে ছলছল করে। তারপর সে মুখটি দেখে। কাদের তার মুখ ঢেকে দিয়েছিল কিন্তু এক সময়ে আঁচলটি সরে গেছে! তার উন্মুক্ত মুখে চাঁদের পূর্ণ আলো।
নিচে নেবে যুবক শিক্ষক এবার হুমড়ি খেয়ে পড়ে। চাপাস্বরে কাদের আবার ভর্ৎসনা করলে সে উঠবার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। দেহে একবিন্দু শক্তি আর নাই। হাড়-মাংস গলে নিঃশেষ হয়ে গেছে! যুবক শিক্ষক আর ওঠে না। কাদেরের ভর্ৎসনায় কানও দেয় না।
কিছুক্ষণ পরে একাকী কাজ শেষ করে কাদের যখন নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়ায়, তখন তার কিছু সম্বিত ফিরেছে। সে নিঃসাড় হয়ে পড়ে থেকে তার কণ্ঠস্বরের জন্যে অপেক্ষা করে। কাদের কিছু না বললে সে ধীরে-ধীরে উঠে বসে। তারপর একবার এক পলকের জন্যে মুখ তুলে তাকায় তার দিকে। কোমর পর্যন্ত তার কাপড় ভিজে জবজব করছে। সে তার দিকে তাকিয়ে আছে বলে তার মুখটা অন্ধকারে ঢাকা। তারপর অস্পষ্টভাবে তার চোখ সে দেখতে পায়। সে-চোখে যেন পরম ঘৃণার ভাব। কাদেরের পায়ের তলে সে যেন ঘৃণ্য বস্তু, শিরদাঁড়াহীন নপুংশক কীটপতঙ্গ কিছু।
যুবক শিক্ষক মন্থরগতিতে প্রবাহিত শীতের শীর্ণ নদীর দিকে তাকায়। জ্যোৎস্না তার বুকে রূপালি আলোয় ঝলমল করে। এখন তাতে কুয়াশার কোনো চিহ্ন নাই। সত্যিই সে কি কুয়াশা দেখেছিল? নদীর বুকে কিছুই নাই। একবার দূরে একটা শিশুক মাছ ভেসে উঠে পরক্ষণেই আবার ডুবে যায়। ওপারে শুভ্র কাশবন স্বপ্নের মতো বিস্তারিত হয়ে ধবধব করে। পানির অস্ফুট কলতান ছাড়া চারধারে প্রগাঢ় নীরবতা।
একটু পরে কাদের নিঃশব্দে সরে গিয়ে পাড় বেয়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে যায়। যুবক শিক্ষক মুখ ফিরিয়ে দেখে, কাদের নাই। কোনো কথা না বলে সে চলে গেছে। কোনো কথা, কোনো ব্যাখ্যার যেন প্রয়োজন ছিল না। শূন্য পাড়ের দিকে তাকিয়ে যুবক শিক্ষক কতক্ষণ হতবাক হয়ে বসে থাকে। তারপর কোথেকে একটা ক্রোধ এসে তার সারা মন ভরে দেয়। সে-ক্রোধের কারণ না বুঝলেও তার সন্দেহ থাকে না যে, ক্রোধটা ন্যায্য। তারপর এক সময় সে-ক্রোধ নিঃশেষ হয়ে গেলে সে অতিশয় নিঃসঙ্গ বোধ করে।
পাড় বেয়ে ওঠার আগে যুবক শিক্ষক শেষবারের মতো নদীর বুকে দেহটাকে খুঁজে দেখে : কিন্তু কোথাও তার চিহ্ন নাই। তারপর একটি অপ্রীতিকর কথা স্মরণ হলে সে পানির ধারে গিয়ে কাদা মেখে প্রবলভাবে হাত সাফ করে। সে কাজ সম্পন্ন হলে সে আলোয়ানটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে তীরে উঠে বাড়ি অভিমুখে রওনা হয়।
নদীর শূন্য বুকের মতো তার বুকও শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে।
পাঁচ
একচোখ-কানা মুয়াজ্জিনের তীক্ষ্ণ-কর্কশ কণ্ঠে অভ্যস্ত হওয়া কঠিন, প্রতিবার একটু চমকে উঠতেই হয়। দাদাসাহেব অবশ্য তাতে অনেক ফায়দা দেখেন। কেউ একবার নালিশ করলে তার লম্বা ফর্দ দিয়েছিলেন। লোকটির জাঁদরেল কণ্ঠ আজানের আসল উদ্দেশ্য তো জোরদারভাবে হাসিল করেই, তাছাড়া শয়তান বিতাড়িত করে, অলস মনকে ধর্মতত্ত্বে সক্রিয় করে। কণ্ঠে মাধুর্যের অভাব আছে বৈকি কিন্তু কর্তব্যের আহ্বানে মাধুর্যের কোনো প্রয়োজনীয়তা নাই। হৃৎপিণ্ডদুর্বল মানুষের ক্ষতি হতে পারে? অতিশয় গম্ভীর হয়ে দাদাসাহেব উত্তর দেন, অন্তিম মুহূর্তে খোদার নাম কানে পাওয়া পরম সৌভাগ্যের কথা। অবশ্য মুয়াজ্জিনটি যে তাঁর বিশেষ স্নেহের পাত্র সে-কথা তিনি বলেন না। সে-কথা মুখে বলা যায় না। কারো নিঃস্ব দারিদ্র্য স্নেহের কারণ সে-কথা বলতে মুখে বাধে। তবে তাঁর একটা বিশ্বাস একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়। এ-দরিদ্র দেশেও দারিদ্র্যের ব্যাপারে তার সমকক্ষ কেউ নাকি নাই। কথাটা মনে পড়তেই যুবক শিক্ষকের একটু হাসি পায়। তারপর খোলা দরজা দিয়ে সূর্যাস্তের কত বাকি তা একবার লক্ষ্য করে দেখে সে স্থির হয়ে বসে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বরের জন্যে অপেক্ষা করে। আজানের জন্যে মনে অধীরতা বোধ করলেও সবকিছু তার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। পৃথিবী আবার স্বরূপ ধারণ করেছে।
সমস্ত দিন যুবক শিক্ষকের গতানুগতিক জীবনযাত্রার কোনো ব্যতিক্রম ঘটে নাই, সকালে বড়বাড়িতে বা ইস্কুলে শিক্ষকতার কাজেও কোথাও ত্রুটি হয় নাই। কিন্তু অভ্যাসবশতই সে যে নিত্যকার কর্তব্যপালন করেছে তা নয়। বরঞ্চ তার গতানুগতিক জীবনযাত্রা সে রক্ষাবরণ হিসাবেই ব্যবহার করেছে। বিপদ আশঙ্কা করলে শামুক যেমন খোসার মধ্যে নিরাপদ বোধ করে তেমনি সে তার জীবনযাত্রার মধ্যেই নিরাপদ বোধ করেছে। কর্তব্যপালন কষ্টসাধ্য মনে হয়েছে কিন্তু তাতে কোথাও যাতে স্খলন না হয় তার জন্যে তার সাবধানতার শেষ থাকে নাই। প্রথম রাতে অতিশয় ভয়-বিহ্বল হয়ে পড়লেও সে চিন্তাশক্তি হারায় নাই। কিন্তু গতরাতে নদী থেকে ফিরবার সময় তার মনে হয়, তার চিন্তাশক্তি সত্যিই যেন লোপ পেয়েছে। কেবল সে বোঝে, তার কিছুই করার নাই, শুধু অপেক্ষাই করতে পারে। হয়তো কোথাও কিছু ঘটবে, কোথাও একটা আলো দেখতে পাবে, তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার মর্মার্থ বুঝতে পারবে। কিন্তু কিছুই ঘটে নাই।
তারপর এক সময়ে ক্ষুধার্ত শামুকের মতো পরিণামভয়শূন্য হয়ে খোসা ছেড়ে সে ধীরে-ধীরে বেরিয়ে আসে। তখন অপরাহ্ণ। ইস্কুল থেকে ফিরে সে বড়বাড়ির ছাতাপড়া বিবর্ণ সম্মুখভাগের দিকে তাকিয়ে দেখে, কোথাও কোনো পরিবর্তন ঘটে নাই। দাদাসাহেবকে দেখতে না পেলেও সে যেন তাঁর শান্ত-সৌম্য চেহারা দেখতে পায়। তাঁর চেহারা মনে পড়তে সে কেমন সাহস পায়। বড়বাড়ির সামনে সুপরিচিত উঠানটি শীতের শুষ্কতায় খটখট করে। সে-উঠানও তাকে আশ্বস্ত করে।
হঠাৎ সে বুঝতে পারে, তার ভয়ের কারণ নাই। যে-বিচিত্র অভিজ্ঞতার অর্থ সে জানে না, সে অভিজ্ঞতার সঙ্গে সে জড়িত বোধ হলেও আসলে সে জড়িত নয়। শুধু সে নয়, কাদেরও তার সঙ্গে জড়িত নয়। তারপর অকস্মাৎ তার মনে নানাপ্রকার প্রশ্ন জাগতে শুরু করে। খই ফোটার মতো, একটির পর একটি। সারাদিন যেমন স্তব্ধ হয়েছিল, সে মনে প্রশ্নের এ-বিস্ফোরণে সে কেমন বিহ্বল হয়ে পড়ে। তবে নৈর্ব্যক্তিক দর্শকের যে-পরম স্বস্তিভাব সে বোধ করে, সে-স্বস্তিভাব আরো গাঢ় হতে থাকে।
মনে আর ভয় নাই কিন্তু অন্ধকার আছে। সে-অন্ধকার কাটাবার জন্যে যুবক শিক্ষক তীব্র ব্যাকুলতা বোধ করে। সে বুঝতে পারে, কাদেরই সে-অন্ধকার দূর করতে পারবে।
মনে ভয় নাই কিন্তু অশান্তি এবং বিশৃঙ্খলতা। সে-অশান্তি এবং বিশৃঙ্খলতাও কাদের দূর করতে পারে। কাদেরের সঙ্গে শীঘ্র দেখা করা তার অতি প্রয়োজন।
বড়বাড়ির লম্বা বারান্দায় প্রতিদিন পারিবারিক জমায়েতে মগরেবের নামাজ হয়। তাতে যুবক শিক্ষক নিত্য যোগদান করে। মতিগতি ভালো হলে কাদেরও আসে। যুবক শিক্ষকের মনে আশা হয়, আজ হয়তো কাদের সান্ধ্যনামাজে আসবে। সূর্যাস্তের সন্নিধানে তার সঙ্গে দেখা করার বাসনাটি কেমন সহ্যাতীতভাবে তীব্র হয়ে ওঠে।
কী সে তাকে জিজ্ঞাসা করবে? মনে প্রশ্নের যেন শেষ নাই। তার কোনটা সে জিজ্ঞাসা করবে, কোনটার উত্তর পেলে সে শান্তি পাবে? অস্থিরভাবে সে প্রশ্নগুলি ছাঁটাই-বাছাই করে, যে-গুলো অতি প্রয়োজনীয় মনে হয় সে-গুলো পরিপাটিভাবে সাজাবার চেষ্টা করে।
যুবক শিক্ষকের মনে সন্দেহ থাকে না যে, প্রথম রাতে কাদের কেন মাঠে-ঘাটে একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সে-কথাই তাকে প্রথম জিজ্ঞাসা করতে হবে। প্রত্যুত্তরে কাদেরও তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারে, সে-ই বা কেন শীতের গভীর রাতে বাইরে ঘোরাঘুরি করছিল। কিন্ত প্রশ্নটির উত্তর দিতে সে প্রস্তুত। সে দ্বিধা না করে স্বীকার করবে, কাদেরকেই সে অনুসরণ করছিল। তাকে হারিয়ে ফেলার পর সে ঘরে ফিরে যায় নাই কেন সে-কথা কাদের জিজ্ঞাসা করলে সে বলবে সত্য কথা, কাদের বিশ্বাস না করলেও বলবে কী কারণে সে ঘরে ফিরে যায় নাই। জ্যোৎস্না-উদ্ভাসিত রাতের প্রতি তার গোপন নেশার কথা বলতে হয়তো কিছু লজ্জা হবে, কিন্তু সে-কথা ঢেকে রাখা সম্ভব হবে না। সে যদি নিজেই সত্য কথা না বলে তবে কাদেরকে কোনো প্রশ্ন করার বা তার কাছ থেকে সত্য উত্তর দাবি করার অধিকার তার থাকবে না। তাছাড়া, সত্যই সত্যকে আকর্ষণ করে।
একটা কথায় যুবক শিক্ষকের মনে শীঘ্র খটকা লাগে। কেন সে কাদেরকে তার ভ্রমণের কথাটি প্রথম জিজ্ঞাসা করতে চায়? একটি বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ : যুবতী নারীর মৃত্যুর সঙ্গে কাদেরের কোনো সম্বন্ধ নাই। সে-বিষয়ে নিঃসন্দেহ না হলে তার সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো প্রয়োজনীয়তা সে বোধ করত না, তার মনে হঠাৎ মেঘ কেটে আলোও প্রকাশ পেত না। বস্তুত, তাকে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনও সে দেখত না। তবে কেন সে প্রশ্নটি তার প্রশ্নতালিকার শীর্ষে বসিয়েছে? অবিশ্বাস সত্ত্বেও সে কি বিশ্বাস করে কাদের দরবেশ? সে-কথাই কি সে প্রথম যাচাই করে নিতে চায়?
খট্কাটা যায় না। সে যে কাদেরকে তার বাল-সুলভ বাতিকটির কথা বলতে প্রস্তুত তাতেও সে নিজেই নিজের মনে একটা গূঢ় অভিসন্ধি দেখতে পায়। হয়তো তার গোপন বাসনা এই যে, হোক তাদের রাতভ্রমণের উদ্দেশ্য ভিন্ন, তবু সে তার মনের গোপন বাতিকটির কথা প্রকাশ করলে পরস্পরের মধ্যে একটি মানসিক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সে যেন তার অভিজ্ঞতার অর্থ বোঝার চেয়ে কাদেরের সঙ্গে একটা সম্পর্ক স্থাপন করার জন্যেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। অনেক ভেবেও যুবক শিক্ষকের মনের খটকা যায় না। কেবল এ-কথা সে বোঝে, প্রশ্নটি বিশেষ প্রয়োজনীয়। যেন তার উত্তরের ওপরেই অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করবে। যেন সে প্রশ্নের উত্তরের পরেই সে বুঝতে পারবে কাদের তার মনের অশান্তি বিশৃঙ্খলতা এবং তার মনের অন্ধকার দূর করতে পারবে কি পারবে না। শুধু অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর নয়, সে- প্রশ্নের উত্তর কাদেরের মনের পরিচয়ও দেবে। কাদেরকে না বুঝতে পারলে বিচিত্র অভিজ্ঞতাটির রহস্য মোচন হবে না।
দ্বিতীয় প্রশ্ন : কাদের কি যুবক শিক্ষককে হত্যাকারী বলে সন্দেহ করেছিল?
ঘটনাটি সে কাদেরের দৃষ্টিতে ভেবে দেখে। প্রথম রাতে কাদের তাকে বাঁশঝাড় থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে। দু-জনে মুখামুখি হলে যুবক শিক্ষক হঠাৎ উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালিয়ে যায়। তখন কৌতূহলী হয়ে কাদের বাঁশঝাড়ে প্রবেশ করলে মৃতদেহটি দেখতে পায়। তারপর যুবক শিক্ষককে হত্যাকারী বলে সন্দেহ করাই তার জন্যে স্বাভাবিক নয় কি?
এখানে যুবক শিক্ষক একটু ইতস্তত করে। সে বুঝতে পারে না, ভূমিকা না দিয়েই প্রশ্নটি করা সমীচীন হবে কিনা। একটি সন্দেহের কথা বলে অন্য একটি সন্দেহের কথা চাপা দিয়ে রাখলে হয়তো প্রশ্নটি কাদেরের কাছে অসম্পূর্ণ মনে হবে। হয়তো তখন তার মনে এই সন্দেহের সৃষ্টি হবে যে, যুবক শিক্ষকের মনে কোনো দুরভিসন্ধি আছে বলেই সব কথা সে খুলে বলছে না। তখন কাদেরও মন খুলে সব কথা বলবে না বা তাকে সাহায্য করতে চাইবে না।
একটু ভেবে যুবক শিক্ষক স্থির করে, ভূমিকাটি না বলে প্রশ্নটি সে করতে পারবে না। এক হাতে সত্য দিয়ে অন্য হাতে সত্য নেবে।
কাদের সম্বন্ধে তার সন্দেহই সে-ভূমিকার বিষয়বস্তু। বাঁশঝাড়ে বীভৎস দৃশ্যটি দেখে বেরিয়ে আসার পর কাদেরের সঙ্গে মুখামুখি হলে হঠাৎ তার মস্তিষ্কবিভ্রান্তি ঘটে : তার চোখে কাদেরই নিষ্ঠুর-নির্মম হত্যাকারীর রূপে আবির্ভূত হয়। তাই সে হঠাৎ একটি নিদারুণ ভয়ে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল। কাদেরই যে হত্যাকারী, সে-ধারণা পরদিন দুপুরবেলা পর্যন্ত তার মনে বদ্ধমূল হয়ে থাকে।
এখানে যে-একটা প্রশ্ন উঠতে পারে সে-কথা যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে। তেমন ধারণাই যদি থাকে তবে পুলিশকে সে খবর দেয় নাই কেন, কাউকে কিছু বলে নাই কেন? প্রশ্নটি মনে জাগতেই যুবক শিক্ষক অবিলম্বে তার যথার্থতা স্বীকার করে। সে-প্রশ্ন কাদের না করলে অন্য কেউ করবে।
একটা উত্তর ঝট্ করে মাথায় আসে। কী করে সে পুলিশকে খবর দেয়? সে বড়বাড়ির আশ্রিত মানুষ, এবং কাদের বড়বাড়িরই লোক। তার পক্ষে কথাটা প্রকাশ করা কি সহজ? উত্তরটা কিন্তু তার পছন্দ হয় না। তাতে কেমন দুর্বলচিত্ত স্বার্থপরতার ছাপ। না, বড়বাড়ির আশ্রয়টি অত্যন্ত লৈাভজনক বটে কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। আসল কারণ বড়বাড়ির প্রধান মুরুব্বি দাদাসাহেবের প্রতি তার গভীর ভক্তিশ্রদ্ধা। কাদের যে তাঁর বিশেষ প্রিয়পাত্র সে-কথা সে জানে। দাদাসাহেবের প্রতি তার যখন এত ভক্তিশ্রদ্ধা তখন কী করে তাঁরই প্রিয়পাত্রের ক্ষতি করতে সে ছুটে যায়?
এ-উত্তরেও যুবক শিক্ষক সন্তুষ্ট হয় না। তারপর হঠাৎ একটি কথা উপলব্ধি করে সে সামান্য বিহ্বল হয়েই পড়ে। প্রশ্নকার যেন উত্তরদাতায় পরিণত হয়েছে। আকস্মিক স্থান পরিবর্তনের ফলে মনে গোলযোগ দেখা দিয়েছে এবং তার ফলে সে ঘটনার অনুক্রম মিশিয়ে ফেলছে, যে-কথা ভাবে নাই সে-কথা ভেবেছে বলে কল্পনা করছে, সম্ভাব্য কিন্তু ঘটে নাই এমন সব কথা তুলছে। আসল সত্য কী? আসল সত্য এই যে, মস্তিষ্কবিভ্রান্তির জন্যে কথাটা কাউকে বলার খেয়াল তার মাথায় আসে নাই।
সেটাই কি সত্য, সম্পূর্ণ সত্য?
না, আরেকটি কথা আছে যা হয়তো সে কাদেরকে কেন, কাউকে বলতে পারবে না। তার মনে হয়েছিল, বাঁশঝাড়ের কথাটি প্রকাশ করা যায় না। সে-টি কাদের আর তার মনের গোপন কথা। শরীরের গোপন স্থানে গুপ্তক্ষতের মতো। এমন কথা কাউকে বলা যায় না।
ক্ষণকালের জন্যে একটি অজানা অন্তর্বেগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যুবক শিক্ষক। সে-ভাবাবেগ কাটলে সে গভীর নিঃসহায়তার সঙ্গে ভাবে, সে অল্পবয়সী দরিদ্র শিক্ষক, বাঁশঝাড়ে নিহত মানুষের মৃতদেহ কখনো দেখে নাই। তার যে মস্তিষ্কবিভ্রান্তি ঘটবে তাতে বিস্ময় কী? সে কিছুই বোঝে না, কিছুই জানে না। চতুর্দিকে যে-অন্তহীন রহস্য সে অনুভব করে তার কতটা সে বোঝে? সূর্যোদয় সূর্যাস্ত, উদ্ভিদ-তরুলতা, নদীপ্রবাহ, মানুষের হাসিকান্না-দুঃখকষ্ট, তার জন্মমৃত্যু : এ-সবের অর্থ কি সে বোঝে? সে জন্যেই সে একটি মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন এমন তীব্রভাবে বোধ করছে।
কাদের যে হত্যাকারী সে-ধারণা কী করে যায়? যে-ধারণা পরদিন দুপুরবেলা পর্যন্ত তাকে ভীত-নিপীড়িত করেছে, সে-ধারণা থেকে কোন যুক্তি সাক্ষ্য-প্রমাণের সাহায্যে সে মুক্তিলাভ করে?
এ-প্রশ্নেও যুবক শিক্ষক ঠক্কর খায়। কিন্তু এ-প্রশ্নের কি কোনো বোধগম্য উত্তর আছে? সবই বিশ্বাস। দোষী, সেটাও বিশ্বাস; নির্দোষ, সেটাও বিশ্বাস। বিশ্বাসের ওপরই কি সমগ্র মানবজীবন নির্ভর করে নাই? বিশ্বাস যে, কাল সূর্যোদয় হবে, পাখিরা আবার গান করবে। বিশ্বাস যে আজকার পাড়-অবরুদ্ধ নদী কাল প্লাবিত হবে না। বিশ্বাস যে এবার ফসল হল না, বৃক্ষে ফল ধরল না, আগামী বছর ফসল হবে ফল ধরবে। বিশ্বাস যে অলব্ধ সুখও কোথাও সীমাহীন এবং নিশ্চিত, অনলবর্ষী দুঃখ-যন্ত্রণার সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে একদিন, এ-জীবনে না হলেও পরবর্তী জীবনে। বিশ্বাস যে, মনের গভীর অস্থিরতার উত্তর না পেলেও ভাবনা কী, কারণ কেউ কোথাও সে-মনের রক্ষক-অভিভাবক। সবই বিশ্বাস, জীবনের একমাত্র সম্বল। কাদেরের ক্ষেত্রে তার মনে কেবল এক বিশ্বাস ভাঙে, অন্য বিশ্বাস গড়ে
এ-উত্তরই কি যথেষ্ট? সব বিশ্বাসেরই কোনো-না-কোনো হেতু থাকে। জীবনের একমাত্র অবলম্বন হোক, তবু তার মধ্যে একটা যুক্তির কাঠামো থাকে।
না, তার এ-বিশ্বাসের কোনোই যুক্তি নাই। সে কেবল জানে, এমন কথা কিছুতেই সত্য হতে পারে না। পরদিন দুপুরে অন্ধ ভয় কাটলে সে পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে, তা অসম্ভব। দুনিয়াতে নিষ্ঠুরতা পাপ-কলুষতা আছে সে জানে এবং তার প্রমাণ বাঁশঝাড়ের মৃতদেহটি। কিন্তু তা সর্বত্র ছড়িয়ে নাই, আগাছার মতো সর্বত্র জন্মায়ও না তা। তা যদি হত তবে মানুষে-মানুষে বিশ্বাস সম্ভব হত না, জীবন দুর্বিষহ হত। বস্তুতপক্ষে, তাহলে জীবনের কোনোই অর্থ থাকত না।
তারপর তৃতীয় প্রশ্ন : সে-রাতে কাদের তার ঘরে কেন এসেছিল? যুবক শিক্ষকই হত্যাকারী কিনা সে কথা নিশ্চয় করে দেখার উদ্দেশ্যে কি? বা গভীর রাতে একটি অসহায় মৃতদেহ দেখে মনে পরম নিঃসঙ্গতা বোধ করলে সঙ্গলিপ্সা সান্ত্বনা-আশ্বাসের জন্যে?
যুবক শিক্ষকের বিশ্বাস, সে হত্যাকারী কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্যে কাদের আসে নাই। যুবক শিক্ষকের মতোই তারও মনে মানুষের উপর আস্থা না থাকার কারণ নাই। তাছাড়া সে যে যুবক শিক্ষককে সন্দেহ করে নাই তার প্রমাণ সে-ও পুলিশকে বা কাউকে কিছু বলে নাই।
দ্বিতীয় রাতের ঘটনার বিষয়ে একটি প্রশ্ন যুবক শিক্ষকের কাছে জরুরি মনে হয়। যুবতী নারীর মৃতদেহটিকে গুম করে দেবার অত্যাশ্চর্য সিদ্ধান্তের কারণ কী?
উত্তরটি যুবক শিক্ষক ভাসা-ভাসা দেখতে পায়।
বাঁশঝাড়ে মৃতদেহটি আবিষ্কার করার পরদিন নির্বাক-নিদ্রালস কাদেরও সমস্তক্ষণ কান খাড়া করে রাখে। রাত হলে সে বোঝে, বাঁশঝাড়ের গুপ্তকথা কেউ জানতে পারে নাই। হয়তো তার অন্তর্ধানে তার আত্মীয়-স্বজনের বিস্ময়ের অবধি থাকে নাই। হয়তো নানাবিধ কারণ তাদের মাথায় আসে। কিন্তু সে যে গ্রামের প্রান্তেই বাঁশঝাড়ের মধ্যে চিরনিদ্রায় শায়িত সে-কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারে না।
কাদের সাব্যস্ত করে, যুবতী নারীর মৃতদেহটি গুম করে দেবে। কেন? হয়তো সে ভাবে, হতভাগা নারীর পক্ষে বাঁশঝাড়ে অর্ধনগ্ন অবস্থায় আবিষ্কৃত হবার চেয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াই শ্রেয় হবে। হয়তো তার জীবনে সুখশান্তি অর্থ-সম্পদ স্নেহ-ভালোবাসার মান-মর্যাদার সৌভাগ্য হয় নাই। তার মৃত্যুও কি এমন কুৎসিতভাবে ঘটবে? সে যদি তাকে এই গভীর অপমান থেকে বাঁচাতে পারে তবে অন্ততপক্ষে প্রাণান্তের পর তার একটু সাহায্য হবে। তাতে তার আত্মীয়-স্বজনের কোনো ক্ষতি হবে না। যাকে তারা হারিয়েছে তাকে আর ফিরে পাবে না। বরঞ্চ তার অন্তর্ধানে তাদের মনে রহস্যের সৃষ্টি হবে। সে-রহস্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা হয়তো তার মৃত্যু সম্বন্ধে সুন্দর রূপকথা সৃষ্টি করতেও সক্ষম হবে। হতভাগা যুবতী নারী অবশেষে স্বপ্নাকাশের অম্লানকুসুমে পরিণত হবে।
এখানে একটি কথা যুবক শিক্ষক ভালো করে বোঝে না। যুবতী নারীর যে প্রাণ নিয়েছে তার শাস্তির কথা কি কাদের ভাবে নাই? দেহ গুম করে দিয়ে সে খুনীর অপরাধও নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। তার শাস্তির চেয়ে যুবতী নারীর মান-মর্যাদাই কি তার কাছে বড় ঠেকেছে? অথবা তার মত এই কি যে, মানুষের অপরাধ মানুষের পক্ষে বিচার করা সম্ভব নয়, তাই তার অপরাধের প্রমাণ—–যা কেবল অর্থহীন আবর্জনা মাত্র—তা অদৃশ্য হয়ে গেলে ক্ষতি কী? যুবক শিক্ষক ঠিক করে, এ-বিষয়েও কাদেরকে প্রশ্ন করতে হবে।
একা মানুষের পক্ষে একটি মৃতদেহ নদীতে বহন করে নিয়ে যাওয়া শুধু যে বিপজ্জনক তা নয়, অতি কষ্টসাধ্যও। কাদের সাহায্যের প্রয়োজন বোধ করে। কার সাহায্য চাইবে সে?
অতএব পঞ্চম প্রশ্ন : সাহায্যের জন্যে কাদের তারই কাছে কেন আসে? প্রথম রাতে সে কি তার দুর্বল নির্বোধ চরিত্রের যথেষ্ট প্রমাণ স্বচক্ষে দেখে নাই? তারপর মানুষের ওপর নির্ভর করার কথা কী করে সে ভাবতে পারে?
হয়তো ওসব কিছু নয়। কাদেরের মনে কোনো সন্দেহ থাকে না যে যুবক শিক্ষকই হত্যাকারী। অতএব সে স্থির করে যে, যে মানুষ যুবতী নারীকে হত্যা করেছে তাকে বাধ্য করবে যুবতী নারীকে শেষ অপমান থেকে রক্ষা করার জন্যে।
অথবা বিচিত্র অবস্থার মধ্যে দু-জনের মধ্যে সাক্ষাৎ হলে কাদেরের মনে যুবক শিক্ষকের প্রতি কেমন একটা বন্ধুত্বের ভাব জাগে। তাই দ্বিতীয় রাতে স্বাভাবিকভাবে সে তারই দরজায় এসে হাজির হয়।
শ্রান্তভাবে যুবক শিক্ষক আপন মনে স্বীকার করে, তার চারধারে ঘোর অন্ধকার, যে-অন্ধকারের মধ্যে অন্ধের মতোই সে প্রশ্নগুলি তৈরি করেছে। তবে তার সন্দেহ থাকে না যে, একবার কাদেরের সঙ্গে মন খুলে কথা বলবার সুযোগ পেলে সব অন্ধকার দূর হবে। এমন অন্ধকার জীবনে কখনো সে দেখে নাই, অন্ধকার থেকে মুক্তিলাভের জন্যে এমন তীব্র ব্যাকুলতাও কখনো বোধ করে নাই।
অবশেষে মুয়াজ্জিনের তীক্ষ্ণ-কর্কশ কণ্ঠ সন্ধ্যাকাশ খণ্ডবিখণ্ড করে ফেটে পড়ে। একটু পরে যুবক শিক্ষক ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়। নিত্যকার মতো তার শীর্ণমুখ গম্ভীর। তবে আজ তার পদক্ষেপে লঘু চঞ্চলতা।
নামাজের সময় কাদের দেখা দেয় নাই। বারান্দার কোণে ছেলেমেয়েদের পড়াতে বসে যুবক শিক্ষক কতক্ষণ শ্বসনক্রিয়ারহিত অবস্থায় থেকে হঠাৎ সজোরে নিশ্বাস নেয়। তারপর এক সময়ে তার মনে হয় অতি ক্ষুদ্র কণ্ঠে আনিশা কিছু বলছে।
‘কী?’
কিন্তু সে ভাবে, কাদেরের বিবেকে দোষ জ্ঞান নাই। হয়তো ইতিমধ্যে দুই রাতের বিচিত্র নাটকের কথা সে ভুলে গেছে। যুবক শিক্ষকের বিবেকও পরিচ্ছন্ন। সে ভোলে না কেন?
বইতে এক জায়গায় আনিশা আঙ্গুল দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট উল্টায়। যুবক শিক্ষক আবার বলে, ‘কী?’
তারপর নীরব বারান্দায় মত্ত দেয়ালঘড়ির টক্টক্ আওয়াজ শোনা যায়। ওপর থেকে দাদাসাহেবের খড়মের আওয়াজ আসে। অবশেষে যুবক শিক্ষক বলে, ‘শক্ত কেন হবে? পশ্চাদাভিমুখে।’
আনিশা ঠোঁট উল্টায় আবার। অকারণে যুবক শিক্ষক এধারে-ওধারে তাকায়। বড়বাড়িতে এখন গভীর নীরবতা। বাইরে শীতের রাত ঝিম্ ধরে আছে। কেশে যুবক শিক্ষক আবার বলে, ‘পশ্চাদাভিমুখে।’
হয়তো কাদেরের মতে কর্তব্য শেষ হয়েছে। নদীর বুকে যে আশ্রয় নিয়েছে সে আর দেখা দেবে না। তার আর কিছুই করবার নাই।
কাদেরের সঙ্গে তার যদি আর দেখা না-ই হয়? দু-বছর একই বাড়িতে বাস করেও যার সঙ্গে কথার আদান-প্রদান হয় নাই, তার সঙ্গে আবার কথা বলার সুযোগ না হওয়াই স্বাভাবিক।
শীঘ্র আনিশা বসে-বসে ঝিমুতে শুরু করে। পাশে আমজাদ লাইনকাটা খাতায় সযত্নে কতগুলি অঙ্কের সংখ্যা সাজায়। যুবক শিক্ষক তাদের আর দেখে না। একনাগাড়ে একই ভঙ্গিতে বসে থাকার ফলে তার পায়ের গাঁটে কেমন কাঠ-কাঠ ভাব জাগে বলে সে নড়ে বসে। তারপর কুদ্দুসের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ প্রশ্ন করে, ‘তোমাদের কাদের দাদা কোথায়?’
তিনটি ছেলে মুখ তুলে তাকায়। তাদের চোখে ঘুম-ঘুম ভাব। অকারণে তারা এধার-ওধার দৃষ্টি দেয়। অবশেষে ভারি গলায় কুদ্দুস উত্তর দেয়, ‘কী জানি।’
‘ঘরে হবে।’ আরেকজন বলে।
এই সুযোগে তৃতীয় ছেলেটি অদূরে আধা খোলা জানলার দিকে তাকায়। এখনো চাঁদ ওঠে নাই বলে বাইরে অন্ধকার। অন্ধকারকে তার ভয়।
আবার নীরবতা নাবলে যুবক শিক্ষকের কাছে এবার হঠাৎ সবকিছু এমন অসত্য এবং অবাস্তব মনে হতে শুরু করে। সে ভাবটি কাটাবার জন্যেই হয়তো সে সজোরে নিশ্বাস নেয়, তার নাসারন্ধ্র কেঁপে ওঠে। তারপর তার ভয় হয়, দিনের মানসিক অবস্থাটি ফিরে আসছে যেন। সে আবার এমন একটি গুহায় প্রবেশ করছে যেখানে জন-মানব পশু-পক্ষীর আওয়াজ পৌঁছায় না। তখন বাইরে যেন জীবনের অবসান ঘটে, সারা পৃথিবী নির্জনতায় খাঁখাঁ করে।
অবশেষে সেদিন শেষবারের মতো একচোখ-কানা মুয়াজ্জিনের উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা যায়। চমকিত হয়ে যুবক শিক্ষক সামনের বইখাতা বন্ধ করে, কর্কশ কণ্ঠস্বরে কেমন আশ্বস্ত বোধ করে। মানুষের কর্কশ কণ্ঠও সান্ত্বনাদায়ক। তাছাড়া, যা সে শোনে তা যেন মানুষের আদিম সতর্কবাণী। অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদসঙ্কুল পৃথিবীতে প্রহরী জেগে আছে জানলে ভীতির উপশম হয়।
উঠবার আগে যুবক শিক্ষক কুদ্দুসের দিকে একবার তাকায়। কাদেরকে ডেকে পাঠাবে কি?
কিন্তু কিচ্ছু না বলে সে নীরবে বারান্দা ত্যাগ করে।