রেবু আজ শাড়ি পরে আসে নি। সালোয়ার-কামিজ পরেছে। পোশাকের জন্যই হয়তো তাকে কিশোরীদের মতো লাগছে। শাড়ি না পরার কারণে তার মধ্যে এখন তরুণী ভাব একেবারেই নেই। শাড়ি অদ্ভুত একটা পোশাক। ছেলেদের এমন কোনো পোশাক নেই। যা পরলে একটা কিশোরকে যুবক মনে হবে। মিসির আলির মনে হলো শাড়ি নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। বারো-তেরো হাত লম্বা একটা কাপড় কেন একজন কিশোরীকে তরুণী বানিয়ে দেবে?
রেবু বলল, আপনি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? কীভাবে তাকিয়ে আছি? মনে হচ্ছে আপনি আমার কথা শুনে খুবই অবাক হচ্ছেন।তোমার ভালো নাম রাবেয়া এটা শুনে অবাক হচ্ছি।কেন? মানুষের ভালো নাম রাবেয়া থাকতে পারে না? অবশ্যই পারে। তোমার নাম তো শুধু রাবেয়া না, তোমার নাম ঘুম রাবেয়া।আমি খুব মজা করে গল্প করতে পারি, তাই না?
হুঁ।যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে সে আমার গল্প শুনে খুব মজা পাবে। আগে আরো মজা করে গল্প করতে পারতাম। অসুখের পর আগের মতো মজা করে গল্প করতে পারি না। আপনার তো খুব বুদ্ধি, বলুন তো কেন আগের মতো মজা করে গল্প করতে পারি না? বলতে পারছি না। তুমিই বলো? যখনই কারো সঙ্গে গল্প করি তখনই মনে হয়। সে বুঝে ফেলছে আমার মাথা পুরোপুরি ঠিক নেই। তখন সাবধান হয়ে যাই। সাবধান হয়ে কথা বললে কি আর গল্পের মধ্যে মজা থাকে?
মিসির আলি বললেন, থাকে না।রেবু গলার স্বর নামিয়ে বলল, আপনি কি জানেন, আপনার এখানে আসা আমার জন্য পুরোপুরি নিষেধ হয়ে গেছে? না, জানি না।আমার ওপর সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। মামা বলে দিয়েছে। আর কোনোদিনও যেন আপনার এখানে না আসি।নিষেধ অমান্য করে এসেছ, তোমার মামা তো রাগ করবেন।মামা জানতে পারলে তবেই না রাগ করবে। আজ বৃহস্পতিবার না? বৃহস্পতিবার কী?
হরতন ইশকাপন পর্ব – ৮
বৃহস্পতিবারে মামার পীর ভাই আসে। মামা সন্ধ্যার পর থেকে ছাদের ঘরে চলে যায়। জিকির করে। সারারাত ছাদের ঘরে থাকে। নামে না।বলতে বলতে রেবু খিলখিল করে হেসে ফেলল। মিসির আলি বললেন, হাসছ কেন? রাবেয়া হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, কারণটা আপনাকে বলব না। আচ্ছা শুনুন, আপনার কি জ্বর?
না।আমার মনে হয় আপনার জ্বর। জ্বর হলে আপনার খুব কষ্ট হয়, তাই না? সেবা করার কেউ নেই। অসুখ-বিসুখ হলে সেবা পেতে খুব ভালো লাগে। ঠিক বলেছি না? মিসির আলি জবাব দিলেন না। মেয়েটির সঙ্গে এখন আর কথা বলতে ভালো লাগছে না। তাকে হাসপাতালে যেতে হবে। হঠাৎ করেই তার মনে হচ্ছে আঁখিতারার শরীর ভালো না। তার কোনো একটা সমস্যা হচ্ছে। মিসির আলি বললেন, রেবু আমি এখন একটু বের হব।
আচ্ছা, আমি চলে যাচ্ছি। আপনি কিন্তু আর কখনো দরজা খোলা রেখে ঘর অন্ধকার করে বসে থাকবেন না।রেবু চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মিসির আলি বাতি নিভিয়ে দিলেন। ছোট্ট হিসাবটা এখনো মেলে নি। বাতি নেভানোর পর যদি মেলে। একটা উত্তর তার কাছে আছে। উত্তরটা গ্রহণযোগ্য না। গ্রহণযোগ্য না এমন উত্তরও অনেক সময় সঠিক হয়। রেবুকে জিজ্ঞেস করে উত্তরটা যাচাই করে নেওয়া যেত। কিন্তু রেবুর কথাবার্তায় তাঁর সংশয় আছে। সে মানসিকভাবে সুস্থ না। তার কোনো কথাই গ্রহণযোগ্য না।
মিসির আলি খাট থেকে নামলেন। তার শরীর খারাপ লাগছিল। শরীর খারাপের কারণ ধরতে পারছিলেন না। খাট থেকে নামার পর শরীর খারাপের কারণ ধরতে পারলেন। আজ সারা দিন তার খাওয়া হয় নি।রিকশায় উঠে মিসির আলির ক্ষুধাবোধ চলে গেল। তাঁর মনেই রইল না। রিকশায় ওঠার আগ পর্যন্ত তিনি ভেবে রেখেছিলেন আলি মিয়ার রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খেয়ে নেবেন। তাঁর যখন রান্না করতে ইচ্ছা করে না। তখন এই রেস্টুরেন্টে খেতে যান।
হরতন ইশকাপন পর্ব – ৮
বিচিত্র কারণে রেস্টুরেন্টের মালিক চান মিয়া তাঁকে অসম্ভব পছন্দ করে। তাঁকে দেখলেই হাসিমুখে বলেন, বাবুরে খানা দে। ঠিকমতো দিবি। আগে টেবিল সাফা কর। টেবিলে যেন আর কেউ না বসে।চান মিয়া কেন তাকে বাবু ডাকে, কেনইবা তার জন্য এতটা ব্যস্ত হয় তা তিনি জানেন না। জিজ্ঞেসও করেন নি। প্রশ্ন করে কারণ জানতে তার ভালো লাগে না।
কোনো একদিন কারণটা নিজেই ধরতে পারবেন। আর ধরতে না পারলেও ক্ষতি নেই। কারণ ধরতেই হবে এমন কথা নেই।আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যে কোনো মুহুর্তে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি নামার আগে আগে প্রকৃতি কিছু বোধ হয় করে। চারদিকে এক ধরনের অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয়।রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমারও কি অস্থির লাগছে?
তিনি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রিকশাওয়ালা বলল, আসমানের অবস্থা দেখছেন? আইজ এক্কেবারে ভাসাইয়া দিব।মিসির আলি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, ভাসিয়ে দেবার প্রবণতা প্রকৃতির ভেতর আছে। সে জোছনা দিয়ে ভাসিয়ে দেয়, বৃষ্টি দিয়ে ভাসিয়ে দেয়, তুষারপাত দিয়ে ভাসিয়ে দেয়। আবার প্রবল প্রেম, প্রবল বেদনা দিয়েও তার সৃষ্ট জগৎকে ভাসিয়ে দেয়। প্রকৃতি যে খেলা খেলে তার নাম ‘ভাসিয়ে দেওয়া খেলা’।
প্রকৃতি ভাসিয়ে দিতে পছন্দ করে। আঁখিতারা মেয়েটা যদি সত্যি সত্যি মারা যায়, প্রবল দুঃখবোধ মিসির আলিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।আঁখিতারাকে দেখে মিসির আলি চমকালেন। সে হাসপাতালের বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে। তার কোলে হাসপাতাল থেকে দেওয়া খাবার। হলুদ রঙের প্লাস্টিকের ট্রেতে ভাত, এক টুকরা মাছ, ভাজি, ডাল। আঁখিতারা আগ্ৰহ নিয়ে খাচ্ছে। মনে হলো মিসির আলিকে দেখে সে লজ্জা পেয়েছে।মেয়েটা হাসিমাখানো লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, ভালো।জ্বর চলে গেছে?
হরতন ইশকাপন পর্ব – ৮
হুঁ।হাসপাতালে থাকতে ভয় লাগছে? না।একা একা রাতে থাকতে পারবে? হুঁ।খাওয়া বন্ধ করেছ কেন, খাও।আঁখিতারা বলল, বাবা, আপনে খাইছেন? মিসির আলি বললেন, না। তোমার এখান থেকে যাবার পথে হোটেলে খেয়ে নেব। হাসপাতালের খাবার কেমন? আঁখিতারা বলল, লবণ কম।লবন দিয়ে বলব? না।
মেয়েটা যে তাকে দেখে খুবই আনন্দ পাচ্ছে তা তিনি বুঝতে পারছেন। আনন্দিত মানুষের পাশে বসে থাকাও আনন্দের ব্যাপার। একজনের দুঃখ অন্যজনকে তেমন স্পর্শ করে না, কিন্তু আনন্দ করে।আঁখিতারা বলল, বড় বাবা আপনি চলে যান। হোটেলে গিয়া ভাত খান।মিসির আলি বললেন, হঠাৎ করে তোমার এত জ্বর! আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এ রকম জ্বর কি তোমার আগেও হয়েছে? হুঁ।বলো কী!! তুমি ভয় পেয়েছিলে? হুঁ।ভয় পেয়েছিলে কেন?
আঁখিতারা নিচু গলায় বলল, রাইতে আমার কাছে একটা জিন আসছিল। জিন দেইখা ভয় পাইছি।মিসির আলি বললেন, তুমি ভয়ের স্বপ্ন দেখছিলে। স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছ।স্বপ্ন দেখি নাই। জিন আমার বিছানার ধারে বসছে। আমার শইল্যে হাত দিছে। আমারে চিমটি দিছে।কোথায় চিমটি দিয়েছে? ঘাড়ে।দেখি তোমার ঘাড় দেখি। কোন জায়গায় চিমটি দিয়েছে?
আঁখিতারা দেখাল। জায়গাটা লাল হয়ে ফুলে আছে।মিসির আলি বললেন, এটা চিমটি না। কাঁকড়া-বিছার কামড়। কাঁকড়াবিছার বিষের কারণে তোমার জ্বর এসেছে। ওই বাড়িতে কাঁকড়া-বিছা আছে। আমি নিজে দেখেছি। তুমি এরপর থেকে সব সময় মশারি ফেলে ঘুমাবে।
হরতন ইশকাপন পর্ব – ৮
আঁখিতারা বলল, বিছানার ধারে জিন বসছিল। আমি দেখছি।মিসির আলি বললেন, আচ্ছা থাক, এই বিষয় নিয়ে আমরা পরে কথা বলব। ডাক্তার তোমাকে কবে ছাড়বে কিছু বলেছেন? কাল সকালে ছাড়বেন।আমি সকালে এসে তোমাকে নিয়ে যাব। ঠিক আছে? হ্যাঁ।একা একা থাকতে পারবে তো? হুঁ।তোমার কি কিছু লাগবে?
মৌলানা সাবের কাছ থাইকা আমারে একটা তাবিজ আইন্যা দিয়েন। তাবিজ থাকলে জিন আসব না।মিসির আলি বললেন, আমি অবশ্যই তাবিজ নিয়ে আসব। তাবিজ ছাড়া আসব না।আঁখিতারা হাসছে। সে খুবই আনন্দিত।বৃষ্টি শুরু হলো মিসির আলি বাসায় ফেরার পর। যত গর্জে তত বর্ষে না টাইপ বৃষ্টি। তেমন কোনো ভাসিয়ে দেওয়া ধরনের বৃষ্টি না।
ভ্যাপসা গরম ছিল, বৃষ্টিতে গরমটা কেটেছে। সামান্য শীত-শীতও লাগছে। ঘুমের জন্য এ ধরনের বৃষ্টিমাখা রাত খুব ভালো। ঠাণ্ড ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় মাথার ওপর ফ্যান ঘুরবে। গায়ে থাকবে পাতলা চাদর। হাতে বই। বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে এক সময় চোখে ঘুম জড়িয়ে আসবে। তখন একসঙ্গে দুটা ব্যাপার হবে–বই পড়তে ইচ্ছা করবে, আবার ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করবে। মিসির আলির জন্য এই সময়টাই শ্রেষ্ঠতম সময়।
সায়েন্স অ্যান্ড প্যারাডক্স বইটি এমন যে, কয়েক পাতা পড়লেই ঘুম কেটে যায়। লেখক বইটির তৃতীয় চ্যাপ্টারে প্রমাণ করেছেন গ্যালাক্সির ভর শূন্য। পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা এটমকে ভেঙে পাওয়া যাচ্ছে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। এদেরকেও ভাঙা যাচ্ছে। এক পর্যায়ে পাওয়া যাচ্ছে লেপটন। লেপটনের কোনো ভর নেই, কাজেই বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডেরও কোনো ভর নেই।গভীর মনোযোগে বই পড়তে পড়তে তিনি কখন ঘুমিয়ে পড়লেন জানেন না। তাঁর ঘুম ভাঙল খুঁটিখাট শব্দে। কেউ একজন বিছানার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
হরতন ইশকাপন পর্ব – ৮
যে হেঁটে যাচ্ছে তাকে তিনি দেখতে পারছেন না। কারণ ঘর অন্ধকার। ঘুমানোর আগে তিনি বাতি নেভাননি। ঘর অন্ধকার থাকার কারণ নেই। হয়তো ঝড়-বৃষ্টির কারণে ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে।বিছানার পাশ দিয়ে যে হেঁটে যাচ্ছে সে একবার ব্যস্ত ভঙ্গিতে রান্নাঘরে ঢুকাল। দরজার পাশে রাখা টুলের সঙ্গে ধাক্কা লাগল। মিসির আলি একবার সুইচ স্পর্শ করলেন। কেউ একজন সুইচ টিপে বাতি নিভিয়ে দিয়েছে। সেই কেউ একজনটা কে? চোর?
যে ঘরে ঢুকেছে সে এখনো ঘরেই আছে। মিসির আলি ইচ্ছা করলেই বাতি জ্বালাতে পারেন। তিনি বাতি জ্বালালেন না। হঠাৎ করেই তাঁর মনে হলো যে, এখন ঘরে ঢুকে সাবধানে হাঁটছে আঁখিতারা। সে কি তাকেই দেখেছে? তাকে দেখেই ভেবেছে জিন? যে ঘরে ঢুকেছে সে পুরুষ না রমণী? বাতি জ্বলিয়ে কে কে করে চিৎকার করার চেয়ে এই সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা ভালো।
ঘরে যে ঢুকছে সে পুরুষ না রমণী তা অতি সহজেই বের করে ফেলা যায়। একটি রমণীর পায়ের স্টেপ ছোট। লম্বা রমণীও পুরুষদের মতো দীর্ঘ কদমে হাঁটে না। তাদের গায়ে থাকে প্রসাধন সামগ্ৰীীর সুগন্ধ। চুলের তেলের গন্ধ, মুখে মাখা ক্রিমের গন্ধ। পুরুষদের গায়ে ঘামের গন্ধই প্রবল।
রমণীরা হাতে চুড়ি পরে। অতি সাবধানে যে রমণী হাঁটবে তার হাতের চুড়িতেও কখনো না কখনো রিনঝিন করে উঠবে। রিনঝিন শব্দের সঙ্গে পুরুষ সম্পর্কিত না।আগন্তুক পুরুষ না রমণী তার মীমাংসা হবার আগেই মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যেই বিচিত্র স্বপ্ন দেখলেন।
Read more