হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী -(পর্ব-১৯)

‘সেলিম ভাই একজন বিখ্যাত অভিনেতা। তিনি এই ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছেনফরহাদ সাহেবের যে চরিত্রটা করার কথা সেটা উনি করছেন। 

‘পাগলের মত কথা বলবি না বকু‘ 

মােটেই পাগলের মত কথা বলছি নাপুরাে ব্যাপারটা সিক্রেট।

হুমায়ুন আহমেদ রুমালীকাল যখন সেলিম ভাইয়ের উপর ক্যামেরা ওপেন হবে তখনই জানতে পারবে, তাঁর অভিনয় দেখেও তােমাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবেতােমাদের সময়কার হিট নায়ক উত্তমকুমারকে তিনি কেঁাৎ করে গিলে ফেলতে পারেন | মা কম্বল ফেলে উঠে বসলেনকিশােরীদের মত কৌতূহলী গলায় বললেন সত্যি ? 

‘সত্যিতাে বটেই। তিনি যে সে লােক না তিনি হলেন– সেলিমকুমার।’ 

অদ্ভুত শব্দে একটা পাখি ডাকছে। কেমন ভয় ধরানাে গলার স্বর আমি পাখির ডাক শুনছি। কী পাখি ডাকছে মাকে জিজ্ঞেস করে জানা যাবে নামা এইসব জানেন নাসেলিম ভাইকে জিজ্ঞেস করলে জানা যেত। 

‘মা! “কিরে ব্যথা আবার বেড়েছে ? । ঘুম আসছে না, একটা গল্প বলতাে মাভুতের গল্প । ভূতের গল্প আমি জানি নাকি?ছােটবেলায় কিংবা বড় বেলায় ভূত ত কিছু দেখ নি ? মা হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ভূত একটাই দেখেছি – তাের বাবাকেবেশতাে বাবাভূতের গল্পই বল । 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

মা চুপ করে গেলেনআমি বললাম, ভূতের সঙ্গে তােমার বিয়ের গল্পটা বলতাে মা। 

‘নিজের বাবাকে ভূত বলছিস লজ্জা লাগছে না? তুমি বলছ বলেই আমি বলছিআমার কথা ভিন্ন। 

ভিন্ন হবে কেন ? তুমিও যা, আমিও তা – বল মা, তােমাদের গল্প শুনিপ্রেম করে বিয়ে হয়েছিল না বিয়ের পর প্রেম ? ‘প্রেম ফ্রেম আমাদের জীবনে ছিল নাশুরুতে নিশ্চয়ই ছিল— সেটা বল। আচ্ছা শােন – একটা ভূতের গল্প শােন, মনে পড়েছে । আমার মায়ের কাছ 

থেকে শুনেছি – আমার মায়ের বাড়ি ছিল কলসহাটি । মা তখন খুব ছােট, তিন চার মাস বয়স । হয়েছে কী তাঁকে তেল মাখিয়ে রােদে শুইয়ে রাখা হয়েছে । আমার নানি গিয়েছেন পাকঘরে কী একটা আনতে। ফিরে এসে দেখেন মেয়ে নেই। নেই তাে নেই। কোথাও নেই। চারদিকে কান্নাকাটি পড়ে গেল । কেউ বল শিয়ালে নিয়ে গেছে, কেউ বলল বাঘডাসায় নিয়ে গেছে।’ 

‘আসলে কি ভূতে নিয়ে গেছে? 

দিনে দুপুরে ভূত এসে তােমার মাকে নিয়ে গেল ? এই গল্প শুনব না মা।। থুক্কু তােমার সঙ্গে খেলব না।’ 

‘তুই এমন অদ্ভুত ভাবে কথা বলিস কেন ? থুতু তােমার সাথে খেলব না।’ তুই কি আমার সঙ্গে খেলছিস ? | খেলছিতাে বটেই। আমরা সবাই সবার সঙ্গে খেলি। কারাে খেলা ভাল হয়। কারাে খেলা ভাল হয় না। খেলার মধ্যে ঝগড়া হয়। খামচা খামচি হয়। কেউ | খেলা ফেলে রাগ করে উঠে চলে যায় ।। 

‘পাগলের মত কথা বলবি নাতাে বকু। তাের পাগলের মত কথা শুনতে অসহ্য লাগছে।’ 

‘আচ্ছা কথা বলব না। তুমি কি আমার কাছ থেকে একটা ভূতের গল্প শুনতে চাও?’ 

‘তাের কাছ থেকে ভূতের গল্প শুনব ? তুই ভূতের গল্প জানিস না-কি ? 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

‘হাঁ জানি। শােন— অনেককাল আগে আমাদের দেশের ধনবান মানুষরা তাদের ধনরত্ন কী করতেন জান ? ধনরত্নের একটা অংশ মাটির নীচে গর্ত করে রেখে দিতেন, যেন দুঃসময়ে ব্যবহার করা যায়। কিংবা তাদের মুত্যুর পর তাদের সন্তান সন্ততিরা ব্যবহার করতে পারে । তখনতাে আর ব্যাংক ছিল না। মাটির নীচের গুপ্ত ঘরই হল ব্যাংক। 

‘কী হাবিজাবি শুরু করলি ? ঘুমােতাে।’ | ‘আহা শােন না – ঐ সব ধনরত্ন টাকা পয়সা পাহারা দেয়ার জন্যে থাকতাে যখ।’ 

‘যখ কী ? 

‘যখ হচ্ছে যক্ষ । শােন নি — যক্ষের ধন? যখ বানানাে হত কী ভাবে জান মা? যখ বানানাের প্রক্রিয়াটা মজার । নয় থেকে দশ বছর বয়সের একটা ছেলেকে যখ বানানাে হতাে। তাকে গােসল করিয়ে নতুন জামা-কাপড় পরিয়ে সাজানাে হত। চোখে সুরমা দিয়ে চুল আচড়ে দেয়া হত। কোলে বসিয়ে দুধ ভাত 

খাওয়ানাে হত। তারপর নিয়ে যাওয়া হত গুপ্ত ঘরেসেখানকার ধনরত্ন তার সামনে রাখা হতএকজন পুরােহিত মন্ত্র পড়তে পড়তে ধনরত্ন তার হাতে জিম্মা করে দিতেনপুরােহিত বলতেন– হে যখ, তােমার হাতে এইসব রত্নরাজি তুলে দিলাম । তােমার দায়িত্ব হল এর রক্ষণাবেক্ষণ করাআইনানুগ উত্তরাধিকারী ছাড়া তুমি এই ধনরত্ন কখনাে হস্তান্তর করবে নাযে ছেলেটা যখ হবে সে সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে একসময় কোলেই ঘুমিয়ে পড়ততখন তাকে সেখানে শুইয়ে সবাই চুপি চুপি উঠে আসতগুপ্ত ঘরে জ্বলতে একটা ঘিয়ের প্রদীপ। তারা উপরে উঠে এসেই ঘরের মেঝের গুপ্ত কুঠুরি চিরদিনের মত বন্ধ করে দিত। এক সময় ছেলেটির ঘুম ভাঙ্গতােআতংকে অস্থির হয়ে সে ছােটাছুটি করতমাকে ডাকতাে, বাবাকে ডাকততার কান্না তার আর্ত চিৎকার কেউ শুনতে পেত নাছেলেটার মৃত্যু হত সেই ধনরত্নপূর্ণ গুপ্ত কুঠুরিতে।’ 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

আমি থালাম। মা হতভম্ব হয়ে বললেন – এই ভয়ংকর গল্প তুই কোথায় শুনলি

আমি বললাম, এটা কোন ভয়ংকর গল্প না মাপুরানাে ভারতের সাধারণ একটা গল্প ভারতবর্ষের যেখানেই মাটির নীচে ধনরত্ন পাওয়া গেছে সেখানেই ছােট বালকের কংকাল পাওয়া গেছে। 

কে বলেছে তােকে ? ‘ঘুমাও মা। আমার ঘুম পাচ্ছে। 

এইসব আজে বাজে গল্প কখনাে বলবি না ‘আচ্ছা আর বলব না‘ ‘এই গল্পটা তােকে কে বলেছে

আমি জবাব দিলাম নাঘুমের ভান করলামমা আরাে কয়েকবার এই বকু, এই বকু বলে আমার গায়ে ধাক্কা দিলেনআমি চমৎকার ঘুমের অভিনয় করলামমা চুপ করে গেলেন। 

আমার ঘুম আসছে না। আমি জেগে আছি। গল্পটা আমাকে বলেছেন আমাদের ডিরেক্টর মঈন সাহেব। 

যখ বানানাের প্রক্রিয়া নিয়ে তাঁর ছবি বানানাের শখছবিটি কেমন হবে তাই তিনি পাপিয়া ম্যাডামকে বুঝাচ্ছিলেনআমি দূর থেকে শুনছিলাম। পাপিয়া ম্যাডাম বললেন, এই ছবি বানিয়ে লাভ কী

ডিরেক্টর সাহেব বললেন, মানুষ যে কত ভয়ংকার হতে পারে তা দেখানাে । 

পাপিয়া ম্যাডাম বললেন, এখনতাে আর কেউ যখ বানাচ্ছে না। সেই ভয়ংকার মানুষরাতাে নেই । 

ডিরেক্টর সাহেব বললেন, যারা যুখ বানাতাে তারা কিন্তু ভয়ংকর ছিলেন না। সাধারণ মানুষই ছিলেন। তাদের সংসার ছিল, ছেলেমেয়ে ছিল। তাঁরা ধর্ম-কর্ম করতেন, দান ধ্যান করতেন। তার পরেও ভয়ংকর ব্যাপারটা কোন না কোন ভাবে – তাদের চরিত্রে ছিল । ছিল না ?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *