হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী -(পর্ব-২০)

‘হা ছিল।’ 

‘যদি তখন থাকে তাহলে এখনাে আছে। মানুষ জন্মসূত্রে তার চরিত্রে এই ভয়ংকর ব্যাপারটি নিয়ে এসেছে। আমার ছবিটা মানুষের মনের ঐ দিকটাই দেখাবে। 

হুমায়ুন আহমেদ রুমালীছবির নাম কী হবে? নাম ঠিক করি নি। ছবিটা কি সত্যি সত্যি বানানাে হবে ? ‘াও জানি না। অনেক কিছু করতে ইচ্ছা করে। করতে পারি কোথায় ? টাকা নেই। টাকা নেই।’ 

‘আপনার স্ত্রী টাকা দেয়া বন্ধ করেছে ? 

ডিরেক্টর সাহেব জবাব দিলেন না। হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বকুল যখের গল্পটা তােমার কাছে কেমন লাগল। প্রশ্নটা এমন আচমকা করা হল যে আমি হকচকিয়ে গেলাম। আমি যে গল্পটা এত আগ্রহের সঙ্গে শুনছি তা তিনি লক্ষ্য করবেন আমি ভাবি নি। এক পলকের জন্য আমার মনে হল আসলে গল্পটা তিনি আমাকেই শুনাতে চাচ্ছিলেন। পাপিয়া ম্যাডাম উপলক্ষ্য। মাত্র। তার পরেই মনে হল – আরে না। 

বিছানায় এপাশ ওপাশ করছি- ঘুম আসছে না ! এক সময় আমার নিজেকেই যখের মত মনে হল। আমি যেন একটা যখ – পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য আমার কাছে গচ্ছিত রাখা হয়েছে। অথচ এই সৌন্দর্য আমি উপভােগ করতে পারছি না। আমি শুধু পাহারা দিচ্ছি । 

আচ্ছা সব মানুষই কি খানিকটা যখের মত না ? তাদের কাজ অন্যের ধনরত পাহারা দেয়া। মা যেমন আমার ধনরত পাহারা দিচ্ছেন, আমি অন্য একজনেরটা পাহারা দিচ্ছি। দূর পাগলের মত কী ভাবছি! আমার ঘুমিয়ে পড়া দরকার। মানুষের ইচ্ছাঘুমের ক্ষমতা থাকার খুব প্রয়ােজন ছিল। ইচ্ছা করা মাত্র 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

আনন্দময় ঘুম চোখে নামবে – আর কী শান্তি তা-না ঘুমের জন্যে অন্য একজনের উপর নির্ভর করতে হচ্ছেসেই অন্য একজন ঘুম পাড়িয়ে দিলে ঘুম আসবে ঘুম পাড়াতে না চাইলে বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে হবেমওলানা মেরাজ মাস্টার সাহেবকে জিজ্ঞেস করতে হবে – ঘুম আসার কোন দোয়া তাঁর জানা আছে কি-না। 

মা ঘুমিয়ে পড়েছেনতাঁর ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ পাচ্ছিআজ তিনি বাতি জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছেন। উঠে গিয়ে বাতি নিভিয়ে আসব না বাতি জ্বালানােই থাকবে ? বুঝতে পারছি নাডাইরি লেখা যেতে পারে। মাঝে মাঝে আমি যখন পুরােপুরি নিশ্চিত হয়ে যাই — আর ঘুম আসবে না, তখন ডাইরি লিখতে বসিআজ সারাদিনে লেখার মত অনেক কিছুই ঘটেছেমনে মনে রাফ করে ফেললে কেমন হয়রাফ করতে করতে এক সময় হয়ত ঘুম এসে যাবে। আমি মনে মনে ডাইরি লেখা শুরু করলাম। 

হাতি পিঁপড়া সংবাদ 

হাতি এবং পিপড়া বিষয়ক একটা গল্প ডিরেক্টর সাহেব আমাকে বলেছেনগল্পটা আমি আগেও শুনেছিতবে তিনি অনেক মজা করে বলেছেন। এই মানুষটার গল্প বলার ক্ষমতা ভাল। তবে তিনি যে খুব ভাল গল্প বলেন তা তিনি জানেন। একজন যখন জেনে ফেলে সে খুব ভাল গল্প করতে পারে তখন তার গল্প বলায় ওস্তাদী একটা ভাব এসে পড়েউনার মধ্যেও তা এসেছে। আমার মামাও খুব ভাল গল্প বলতে পারেন। তবে তিনি তাঁর এই ক্ষমতা সম্পর্কে জানেন না

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

জানেন না বলেই নিজের মনে মজা করে গল্প করেন শুনতে অসম্ভব ভাল লাগে। হাতি এবং পিপড়ার এই গল্পটা মামাকে বললে তিনি আরাে অনেক বেশি মজা করে এই গল্প অন্যদের করবেনতবে সমস্যা হচ্ছে কী, যারা খুব ভাল গল্প করতে পারে তারা শুধু নিজেরই গল্প করতে চায়অন্যদের গল্প শুনতে চায় না । আমি নিজেও খুব ভাল গল্প করতে পারি । ডিরেক্টর সাহেবকে আমি একদিন আমার গল্প শুনাবসেই একদিনটা কবে আমি জানি না। আজ উনাকে গল্প শুনাবার একটা সুযােগ আমার ছিল। আমি সেই সুযােগ গ্রহণ করি নি। 

হাফিজ আলির স্ত্রী 

হাফিজ আলির স্ত্রীর নাম, আমি এখনাে জানি না। আমি কেন কেউই জানে 

এই মহিলা না-কি ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। ইউনিটের সবাই এই মহিলার ব্যাপারে উৎসাহী। আমি উৎসাহী বােধ করছি না – তবে ভদ্রমহিলাকে আমার খুব দেখার শখ। একটা কাজ করলে কেমন হয় — একদিন চুপি চুপি ভদ্রমহিলার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়ে যদি বলি, শুনুন আমার নাম রেশমী । আমি ভবিষ্যৎ বলতে পারি। আজ আমি এসেছি আপনার ভবিষ্যৎ বলতে। আপনি কি আপনার নিজের ভবিষ্যৎ জানতে চান ? তাহলে ভদ্রমহিলার মুখের ভাব কেমন হবে ? তিনি কি নিজের 

ভবিষ্যৎ জানতে আগ্রহী হবেন ? 

সেলিম ভাই 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

আমার ধারণা সেলিম ভাই খুব ভাল অভিনয় করবেন। তাকে ভাল অভিনয় করার ব্যাপারে আমি সাহায্য করতে পারি। তার ভেতরে আত্মবিশ্বাসের ভাব জাগিয়ে তুললেই হবে, আর কিছু লাগবে না। একজন যুবক ছেলের আত্মবিশ্বাস মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তখনই যখন সে হঠাৎ দেখে একটা তরুণী রূপবতী মেয়ে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে । তখন সমস্ত পৃথিবীটা মনে হয় তার হাতের মুঠোয়। আমি অনায়াসেই সেলিম ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাবার অভিনয় করতে পারি। তবে এখন এই অভিনয় করলে লাভ হবে না। কারণ সেলিম ভাই নিজে আমার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছেন। আমার দিকে তাঁর তাকানাের ভঙ্গি, কথা বলার ভঙ্গি সবই পালটে গেছে। এখন আমি আর তাকে সাহায্য করতে পারব না। 

মা ঘুমের মধ্যে বিড় বিড় করে বললেন, “বাবু ও বাবু । বাবু।” তিনি তার। বাবাকে ডাকছেন। আহা বেচারী। আমি মার গায়ে হাত রাখলাম, কোমল গলায় ডাকলাম, মা মা। মা ঘুমের মধ্যেই বললেন, হুঁ। আমি বললাম, তুমি আরাম করে ঘুমাও। আমি কখনাে, কোনদিনও তােমাকে ছেড়ে যাব না। আমি তােমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করি, তােমাকে রাগিয়ে দেই, কাদাই। কিন্তু তােমাকে 

যে আমি কত ভালবাসি তা তুমি জান না জানলে তােমার খুব ভাল লাগতাে। 

মা পাশ ফিরলেন । মনে হচ্ছে ঘুমের মধ্যেও তিনি আমার কথা শুনতে পেলেন।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *