রুমালী নাম আমার বাবা রেখেছিলেন। ভাল কথা মনে করেছ। তােমার বাবা প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। কথাটা তােমার বাবা প্রসঙ্গে না— তােমার মা প্রসঙ্গে। তুমি বাবার কথা বলায় মনে পড়ল ।
বলুন। ‘তােমার মা সবচে অপছন্দের কাজ যেটা করেন সেটা হচ্ছে দুঃখের কাঁদুনী শুরু করেন । তােমার মা‘র কাছ থেকে এই পর্যন্ত তিনবার আমি শুনেছি তােমার বাবা তােমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তােমরা কী ভয়ঙ্কর কষ্টের মধ্যে পড়েছিলে, খেয়ে না খেয়ে ছিলে । সবাইকে এইসব বলে বেড়ানাের অর্থ কী ? এটাতাে কোন আনন্দের ঘটনা না যে পৃথিবী শুদ্ধ সবাইকে জানাতে হবে ? সহানুভূতি পাবার জন্যে বলা ? সহানুভূতির দরকার কী? আর শােন রুমালী, মানুষ সহানুভূতির বস্তা খুলে বসে নি যে দুঃখের কাঁদুনি শুনলেই সহানুভূতির বস্তা থেকে পাঁচ কেজি সহানুভূতি নিয়ে দেবে । সহানুভূতি হচ্ছে––খুবই ফাইনার ফিলিংস । একমাত্র মহাপুরুষদের মধ্যেই এই ফিলিংস আছে। বুঝতে পারছ কী বলছি ?
‘জ্বি।
‘তুমি কি তােমার মাকে খুব পছন্দ কর ?
জ্বি। ‘তােমাকে জরুরি একটা কথা বলি— কাউকে খুব বেশি পছন্দ করবে না ।। খুব বেশি পছন্দ করলে কী হয় জান ?‘
‘জি না।‘
খুব বেশি পছন্দ যাকে করবে সে তােমাকে গ্রাস করে ফেলবে । কখন যে গ্রাস করবে তুমি বুঝতেই পারবে না। মানুষের মধ্যে আছে ঝিনুক স্বভাব । ঝিনুক কী করে ? মুখ খুলে হা করে থাকে । ধরা যাক তুমি কোন একটা ঝিনুককে খুব বেশি পছন্দ করে ফেললে—তুমি তখন করবে কী, তার পেটের ভেতর গিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়বে। ওন্নি ঝিনুক তার ডালা বন্ধ করে ফেলবে। সেই ডালা খুলে তুমি আর কখনাে বের হতে পারবে না। চির জীবনের জন্যে ঝিনুকের ভেতর আটকা পড়ে যাবে। তুমি কি আমার কথায় রাগ করছ ?
জি না ।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
শােন রুমালী আমি কথা খুব কম বলি । আবার মাঝে মাঝে যখন মেজাজ খারাপ হয় তখন প্রচুর কথা বলি। প্রচুর কথা বলায় আমার নিজের লাভের মধ্যে লাভ এই হয়— যার সঙ্গে কথা বলি সে যায় রেগে।‘
‘আমি রাগি নি, রাগ করার মত কোন কথা আপনি বলেন নি।
‘এখন বলব— কথাটা হচ্ছে- তুমি আমার পেছনে পেছনে ঘুর ঘুর করবে না। বড় জাহাজের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছােট্ট একটা নৌকা থাকে। জাহাজ যেখানে যায় নৌকা জাহাজের পেছনে পেছনে সেখানে যায় । এই নৌকাকে বলে ‘গাধাবােট‘। আমি জাহাজ কি না জানি না, কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি আমার সঙ্গে সব সময় চার পাচটা গাধবােট থাকে। গাধাবােট আমার কাছে অসহ্য
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম । পাপিয়া ম্যাডাম এগিয়ে যাচ্ছেন। তার শেষ কথাগুলিতে আমি কী রকম কষ্ট পেলাম তা দেখার জন্যেও একবার পেছনে ফিরলেন না। মজার ব্যাপার হল আমি একেবারেই কষ্ট পাই নি। বরং আমার একটু হাসি পাচ্ছে। কাউকে কষ্ট দেব এটা আগে ভাগে ঠিক করে কেউ যখন কিছু করে তখন আর কষ্ট লাগে না। আরেকটা ব্যাপার হতে পারে মা’র সঙ্গে
থেকে থেকে আমার গায়ের চামড়াও হয়ত খানিকটা শক্ত হয়েছে।
বকুল শুনে যাও।’
আমি পেছন ফিরলাম। ডিরেক্টর সাহেব আমাকে ডাকছেন। তিনি বেশ আয়েশ করে বসেছেন। পাপিয়া ম্যাডাম যে চেয়ারে বসেছিলেন সেই চেয়ারে পা তুলে দিয়েছেন। এতক্ষণ চোখে সানগ্লাস ছিল না, এখন চোখে সানগ্লাস । পাপিয়া ম্যাডামের ফেলে যাওয়া সানগ্লাসটাই তার চোখে। তাঁর মুখ আকাশের দিকে ফেরানাে। গা এলানাে গা এলানাে ভাব ।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
ব্রেন ট্রলীতে কোন একটা সমস্যা হচ্ছে। ট্ৰলী খােলা হচ্ছে । মনে হয় সমস্যা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত শুটিং শুরু হবে না।
আমি ডিরেক্টর সাহেবের পাশে এসে দাঁড়াতেই তিনি চেয়ার থেকে পা সরিয়ে নিয়ে বললেন, বােস । আমি বসলাম ।
‘তুমি কেমন আছ ? ‘জি ভাল ।
চন্ডিগড় জায়গাটা সুন্দর না ? ‘জি।‘
‘আমার কাছে তত সুন্দর লাগছে না। আমার মনে হচ্ছে আউটডাের বান্দরবানে ফেললে ভাল হত। তুমি বান্দরবানে কখনাে গিয়েছ?
জ্বি না। ‘খুব সুন্দর। একটা পাহাড়ি নদী আছে। নদীর নাম–— শংখ নদী। খুব সুন্দর ।
ডিরেক্টর সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে আমার ভাল লাগছে না। কারণ তিনি। সানগ্লাস পরে আছেন। সানগ্লাস পরা মানুষ কোন দিকে তাকিয়ে আছে তা বােঝা যায় না বলে কথা বলে ভাল লাগে না। তা ছাড়া ডিরেক্টর সাহেবও আমার সঙ্গে দায়সারা ভাবে কথা বলছেন। এই মুহুর্তে তার কিছু করার নেই বলেই কথা বলে সময় কাটানাে ; কথা বলার জন্যে তার সবসময় কাউকে না কাউকে দরকার । পাপিয়া ম্যাডাম নেই কাজেই আমাকে দরকার । আমি না থাকলে তিনি অন্য কাউকে ডেকে নিতেন। ফিল আপ দ্যা ব্ল্যাংক। শূন্যস্থান পূরণ ।
‘বকুল! জ্বি। ‘দেখি একটা প্রশ্নের জবাব দাও– তােমার বুদ্ধি কেমন পরীক্ষা করা যাক। ব্যাপারটা হচ্ছে কী- তিনটা পিপড়া সারি বেঁধে যাচ্ছে। একজনের পেছনে একজন। সবার প্রথম যে পিপড়াটা যাচ্ছে সে বলল, আমার পেছনে আছে দু’টা পিঁপড়া। মাঝখানের পিপড়াটা বলল, আমার সামনে আছে একটা পিঁপড়া, পেছনে আছে একটা পিপড়া। মজার ব্যাপার হচ্ছে সবচে পেছনে যে পিপড়াটা যাচ্ছে সে বলল — আমার সামনে কোন পিঁপড়া নেই, আমার পেছনে আছে দু‘টা পিপড়া। সে এ রকম বলছে কেন ? | আমি চুপ করে রইলাম। এই ধাধার উত্তর আমি জানি। এর উত্তর হচ্ছে–— সবচে পেছনের পিপড়াটা চালবাজ এবং মিথুক। সে মিথ্যা কথা বলছে। কেউ যদি ধাধা জিজ্ঞেস করে তার মনে মনে আশা থাকে ধাধার জবাব কেউ পারবে । যদি কেউ পেরে যায় তাহলে প্রশ্নকর্তার মন খারাপ হয়ে যায় ।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
আমি ডিরেক্টর সাহেবের মন খারাপ করতে চাইলাম না। আমি এমন ভাব করলাম যে, ধাঁধার জবাব আমার জানা নেই। আমি আকাশ পাতাল ভাবছি। ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছি না ।
‘পারছ না?‘ ‘পারব । আমার একটু সময় লাগবে।’ ‘কোন অসুবিধা নেই। সময় নাও! যত ইচ্ছা সময় নাও। ‘আচ্ছা পিপড়া তিনটা কি আসলেই একটার পর একটা যাচ্ছিল ? ‘অবশ্যই।
এরা হঠাৎ উল্টো দিকে চলা শুরু করে নিতাে? ‘না।’ ‘আমি পারছি না।‘
‘পারছ না ? খুব সহজ, শেষের পিঁপড়াটা দারুণ মিথুক। সে মিথ্যা কথা বলছিল। মানুষের মধ্যে যেমন মিথ্যুক আছে পিঁপড়াদের মধ্যেও আছে হা হা হা হা।।
ডিরেক্টর সাহেব উচ্চ স্বরে হাসতে লাগলেন । উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখে পানি এসে গেল। হঠাৎ করেই এসে গেল। উনি ভাবলেন—ধাধার জবাব দিতে না পারার কারণে লজ্জায় এবং অপমানে আমার চোখে পানি এসেছে। তিনি খুবই অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।
আরে বােকা মেয়ে কঁদছ কেন ? এটা একটা ফালতু ধরনের ধাধা। তােমাকে জিজ্ঞেস করাই ভুল হয়েছে। আচ্ছা যাও প্রতিজ্ঞা করছি—এই জীবনে তোমাকে আর ধাধা জিজ্ঞেস করব না। প্লীজ চোখ মােছ।