যখন আসতে বলে তখন আসতে হয় । একটা ঝামেলায় আটকে পড়েছিলাম । উপলক্ষটা কী ? রিনকির বিয়ের কথা পাকা হলো ।
বাহ্ – ভালো তো । ফুপু গভীর হয়ে গেলেন । আমি খেয়েই যাচ্ছি । টক গন্ধ পোলাও এত খাওয়া ঠিক হচ্ছে না, সেটাও বুঝতে পারছি । তবু নিজেকে সামলাতে পারছি না । যা হবার হবে । ফুপু শীতল গলায় বললেন, একবার তো জিজ্ঞেস করলি না কার সঙ্গে বিয়ে, কী সমাচার । তোমরা নিশ্চয় দেখেশুনে ভালো বিয়েই দিচ্ছ ।
তুই একবার জিজ্ঞেসও করবি না ? তোর কোনো কৌতূহলও নেই ? আরে কী বল, কৌতূহল নেই । আসলে এত ক্ষুধার্ত যে কোনোদিকে মন দিতে পারছি না । দুপুরে খাওয়া হয়নি । ছেলে করে কী ? মেরিন ইঞ্জিনিয়ার । বল কী তাহলে তো মালদার পাটি । ফুপু রাগী গলায় বললেন, ছোটলোকের মতো কথা বলবি না তো, মালদার পাটি আবার কী ? পয়সাআলা পার্টি, এই বলছি ।
ময়ূরাক্ষী উপন্যাসের খন্ড-৪
হ্যাঁ, টাকাপয়সা ভালোই আছে । শর্ট না তো ? আমার কেন জানি মনে শর্ট টাইপের ছেলেদের সাথে রিনকির বিয়ে হবে । ছেলের হাইট কত ? ফুপুর মুখটা কাল হয়ে গেল । তিনি নিচু গলায় বললেন, হাইট একটু কম । উঁচু জুতা পড়লে বোঝা যায় না । বোঝা না গেলে তো কোনো সমস্যাই নেই । তাছাড়া বেঁটে লোক খুব ইন্টেলিজেন্ট হয় । যত লম্বা হয় বুদ্ধি তত কম । আমি এখন পর্যন্ত কোনো বুদ্ধিমান লম্বা মানুষ দেখিনি । সত্যি বলছি । ফুপুর মুখ আর অন্ধকার হয়ে গেল ।তখন মনে পড়ল-কী সর্বনাশ! ফুপা নিজেই বিরাট লম্বা ।
প্রায় ছ-ফুট ।আজ দেখি একের-পর-এক ঝামেলা বাধিয়ে যাচ্ছি । তুই যাবার আগে তোর ফুপার সঙ্গে দেখা করে যাবি । তোর সঙ্গে নাকি জরুরি কথা আছে । নো প্রবলেম । আর রিনকির সঙ্গে কথা বলার সময় জামাই লম্বা কি বেঁটে এ জাতীয় কোনো কথাই বলবি না । বেঁটে লোকেরা যে জ্ঞানী হয় এই কথাটা ঠিকই কায়দা করে বলব ? তোর কিছুই বলার দরকার নেই ।
ঠিক আছে ঠাণ্ডা পেপসি-টেপসি থাকলে দাও । তোমরা তো কেউ পান খাও না । কাউকে দিয়ে তিনটা পান আনাও তো?
রিনকির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম । এই মেয়ে নাইন-টেনে পড়ার সময় রোগা-ভোগা ছিল- এখন দিন দিনই মোটা হচ্ছে । আজ অবশ্যি সেরকম মোটা লাগছে না । ভালোই লাগছে । মনে হচ্ছে এরচেয়ে কম মোটা হলে তাকে মানাত না । কী রে, ক্লাস ওয়ান একটা বড় জোগাড় করে ফেললি ? কনগ্রাচুলেশনস । রিনকি অসম্বব খুশি হলো । অবশ্যি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট উল্টে বলল, ক্লাস ওয়ান বর না ছাই । ক্লাস থ্রি হবে বড়জোর । মেয়েদের আমি কখনো খুশি হলে সেই খুশি প্রকাশ করতে দেখিনি । একবার একটা মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল, সে ইন্টারমিডিয়েটে ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে ফাস্ট হয়েছে ।
ময়ূরাক্ষী উপন্যাসের খন্ড-৪
আমি বললাম, কী খুকী, খুশি তো ? সে ঠোঁট উল্টে বলল, উহু, বাংলা সেকেন্ড পেপারে যা পুওর নাম্বার পেয়েছি । জানেন, মার্কসিট দেখে কেঁদেছি । রিনকিরও দেখি সেই অবস্থা । খুশিতে মুখ ঝলমল করছে অথচ মুখে বলছে ক্লাস থ্রি । হিমুভাই, ও কিন্ত্ত দারুণ শর্ট । মনে হয় কলিংবেল হাত দিয়ে নাগালে পাবে না । আমি অত্যন্ত খুশি হবার ভঙ্গি করলাম । খুশি গলায় বললাম, তাহলে তো তুই লাকি । ভাগ্যবতী মেয়েদের বর খাটো হয়, খনার বচনে আছে ।
যাও । সত্যি – খনা বলেছেনঃ খাটো গাছের পেয়ারা ভালো । কাটো স্বামীর মন…তারপর আরো কী কী যেন আছে মনে নেই । বানিয়ে বানিয়ে কী যে মিথ্যা কথা তুমি বল । এই ছড়াটা তুমি এক্ষুনি বানালে, তাই না ? হু । কেন বানালে বল তো ? তোকে খুশি করবার জন্যে । খুশি করবার দরকার নেই, আমি এমনিতেই খুশি । সেটা তোর মুখ দেখেই বুঝতে পারছি । বর পছন্দ হয়েছে ? হু । তবে খুব বিরক্ত করছে । বিরক্ত করছে মানে ? আজই মাত্র কথাবার্তা ফাইনাল হলো । এর মধ্যে তিনবার টেলিফোন করেছে । তারপর বলেছে রাত এগারোটার সময় আবার করবে । লজ্জা লাগে না ? তার ওপর টেলিফোন বাবার ঘরে । বাবা সন্ধে থেকে তার ঘরে বসে আছে । আমি কি বাবার সামনে তার সঙ্গে কথা বলব ? লম্বা তার আছে । তুই টেলিফোন তোর ঘরে নিয়ে আয় । আমি কী করে আনব ? আমার লজ্জা লাগে না ? আচ্ছা যা আমি এনে দিচ্ছি ।
পরে কিন্ত্ত তুমি এই নিয়ে ঠাট্টা করতে পারবে না । আমি তোমাকে আনতে বলিনি । তুমি নিজ থেকে আনতে চেয়েছ । তা তো বটেই । ঐ ভদ্রলোক টেলিফোনে কী বলে – কী আর বলবে, কিছু বলে না । আহা বল না, শুনি । উফ তুমি বড় যন্ত্রণা কর – আমি কিছু বলতে-টলতে পারব না ।
ময়ূরাক্ষী উপন্যাসের খন্ড-৪
রিনকি লজ্জায় লাল-নীল হতে লাগল । মনে হচ্ছে সে এখন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা কাটাচ্ছে । বড় ভালো লাগছে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে । রিনকির সঙ্গে আর কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছা ছিল । থাকা গেল না । ফুপা ডেকে পাঠালেন । ফুপার ঘর অন্ধকার । জিরো পাওয়ারের একটা বাতি জ্বলছে । লক্ষণ সুবিধার না ।
ফুপার মাঝেমধ্যে মদ্যপানের অভ্যাস আছে । এই কাজটা বেশিরভাগ সময় বাইরেই সারেন । বাসায় ফুপুর জন্যে তেমন সুযোগ পান না । ফুপুর শাসন বেশ কঠিন । হঠাৎ হঠাৎ কোনো বিশেষ উপলক্ষে বাসায় মদ্যপানের অনুমতি পান । আজ পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে । মদ্যপান করছে এরকম লোকের সঙ্গে কথাবার্তা খুব সাবধানে বলতে হয় । কারণ তাদের মুড মদের পরিমাণ এবং কতক্ষণ ধরে মদ্যপান করা হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে । ফুপার তরল অবস্থায় তার সঙ্গে আমার কর্তাবার্তা বিশেষ হয়নি । কাজেই তরল অবস্থায় তার মেজাজ-মর্জি কেমন থাকে তাও জানি না ? ফুপা আসব ?
হিমু এসো । দরজা ভিড়িয়ে দাও । তে খুব জরুরি কথা আছে । বস, সামনের চেয়ারটায় বস । আমি বসলাম । তিনি গ্লাস দেখিয়ে বললেন, আশা করি এইসব ব্যাপারে তোমার কোনো প্রিজুডিস নেই । জি না। তারপর বল, কেমন আছ । ভালো ? জি । রিনকির বিয়ে ঠিক হয়ে গেল শুনেছ বোধহয় ? জি । ছেলে ভালো, তবে খুবই খাটো । আমাদের সঙ্গে এরকম একটা ছেলে পড়ত – স্কু । এই ছেলেরও নিশ্চই কোনো নাম-টাম আছে । বেটে ছেলেদের নাম সাধারনত স্কু হয় কিংবা বল্টু হয় ।
ময়ূরাক্ষী উপন্যাসের খন্ড-৪
আমি চুপ করে রইলাম । ফুপাকে নেশায় ধরেছে বলে মনে হচ্ছে । না ধরলে নিজের জামাই সম্পর্কে এধরনের কথা বলতে পারতেন না । আমার ছেলে পছন্দ হয়নি ? আরে পছন্দ হবে কী ? মার্বেল সাইজের এক ছেলে । পছন্দ হয়নি তবে বিয়েতে মত দিলেন কেন ? আমার মতামতের প্রশ্নই তো ওঠে না । আমি হচ্ছি এই সংসারে টাকা বানানোর মেশিন । এর বেশি কিছু না । আমি কী বলছি না বলছি তা কেউ জানতে চায় না । তারপরেও বললাম । কিন্ত্ত দেখি, মেয়ে এবং মেয়ের মা দুজনেই খুশিতে বাকবাকুম । তার গ্লাস খালি হয়ে গিয়েছিল । তিনি আরো খানিকটা ঢাললেন ।
আমি তাকিয়ে আছি দেখে বললেন -এটা পঞ্চম পেগ, আমার লিমিট হচ্ছে সাত । সাতের পর লজিক এলোমেলো হয়ে যায় । সাতের আগে কিছুই হয় না । আমি বললাম, ফুপা, এক মিনিট । আমি টেলিফোনটা রিনকির ঘরে দিয়ে আসি । ও কোথায় যেন টেলিফোন করবে । ফুপা মুখ বিকৃত করে বললেন, কোথায় করবে বুঝতে পারছ না ? ঐ মার্বেলের কাছে করবে । টেলিফোন করে করে অস্তির করে তুলল । আমি রিনকির টেলিফোন দিয়ে এসে বললাম, আপনি কী যেন জরুরি কথা বলবেন ? ও হ্যাঁ, জরুরি কথা, বাদল সম্পর্কে । জি বলুন । ও তোমাকে কেমন অনুকরণ করে সেটা লক্ষ্য করেছ ? তুমি তোমার মুখে দাড়ি-গোঁফের চাষ করেছ – কর । সেও তোমার পথ ধরেছে । আজ তুমি হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে এসে, আমি এক হাজার টাকা বাজি রাখতে পারি কাল দুপুরের মধ্যে সে হলুদ পাঞ্জাবী কিনবে ।
আমি কি ভুল বললাম ? না- ভুল বলেননি । তুমি যদি আজ মাথা কামাও, আমি সিওর ব্যাটা কাল মাথা কমিয়ে ফেলবে । এরকম প্রভাব তুমি কী করে ফেললে এটা তুমি আমাকে বল । YOU BETTER TO EXPLAIN IT.
Read more
হুমায়ূন আহমেদের লেখা ময়ূরাক্ষী উপন্যাসের খন্ড- ৫