হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-১৫

মনােয়ারা বিরক্ত গলায় বললেন, তাের ধারণা আমি যা করি সব তাের বাবাকে খুশি করার জন্যে? 

‘হ্যা আমার তাই ধারণী। আগের জন্মে তুমি কী ছিল জানাে মা? আগের জন্মে তুমি ছিলে কোনো মহারাজার প্রধান চাটুকার। ইয়েস ম্যান। এই জন্যেও সেই ভাব রয়ে গেছে।’

মীরার গ্রামের বাড়ি 

চুপ করবি?” 

না চুপ করব না। তােমার উপর আমার খুব রাগ লাগে মা । তােমার কোনাে স্বাধীন সূত্রা কেন থাকবে না। 

আমার স্বাধীন সত্তা নেই। 

না নেই। এই যে আমি বললাম, তুমি আমার সঙ্গে ঘুমাও—ওমনি তুমি বাবাকে ছেড়ে চলে এল যদিও তোমার মন পড়ে আছে বাবার কাছে । দুজলে শুয়ে থাকতে, বাবা বস্তাপচা কোনাে বােরিং গল্প শুরু করত। তুমি রােমাঞ্চিত 

মীরা কথাগুলি বলল ঠাট্টা করে কিন্তু মনোয়ারা সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে নেমে গেলেন। মীরা উঠে বসল । সে অবাক হয়ে মার দিকে তাকিয়ে আছে । মনােয়ারা মেয়ের দিকে ফিরলেন না বলে মেয়ের অবাক দৃষ্টি দেখলেন না। 

এবং শিহরিত হবার ভান করতে । তুমি হঠাৎ করে মরে গেলে বাবার কী হবে তাই ভাবছি। 

মনােয়ারা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, মানুষটা অচল হয়ে পড়বে। মীরা বলল, মােটেই অচল হবে না। পুরুষমানুষ কখনাে অচল হয় না । 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-১৫

মেয়ের কঠিন কঠিন কথা শুনতে মনােয়ারার ভালাে লাগছে না। অনেক দিন পর তিনি বড় মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে এসেছেন। কোথায় গভীর রাত পর্যন্ত দুজনে মিলে মজা করে গল্প করবেন, তা না মেয়ে কঠিন কঠিন সব কথা বলা শুরু করেছে। মনােয়ারার ইচ্ছা করছে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে থাকতে সাহসে কুলুদেই না।

মেয়ে হয়তাে রেগে যাবে। বড় হলে মেয়েরা খুব আশ্চর্যরকম ভাবেই বদলে যায় । মীরা যখন ছোট ছিল তাকে জড়িয়ে ধরে না থাকলে ঘুমুতে পারত না। শুধু যে জড়িয়ে ধরা তা না, তার হাতের মুঠিতে মনােয়ারার শাড়ির আঁচল ধরা থাকত। রাতে বাথরুমে যাওয়া ও সমস্যা। মেয়ের হাত থেকে শাড়ির আঁচল খুলতে গেলেই মেয়ে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করত। 

| মনােয়ারা নিজের মনে ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বললেন, খুব শীত লাগছে। শরীর গরম হচ্ছে না। মনে হচ্ছে জেলের ভেতর কেউ বরফগলা পানি ঢেলে দিয়েছে। 

মীরা বলল, এক কাজ কর মা । আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকে। 

মনোয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তাের কাছে আসতেই আমার ভয় লাগে না। তুই আমার শরীরে গােলারের গন্ধ, ঘাসের গন্ধ। এইসব 

আজহার সাহেব সত্যি সত্যি বই পড়ছেন। স্ত্রীকে ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক হলেন না। তিনি জানতেন মনােয়ারা আরেকবার খোঁজ নিতে আসবেন। ঘরের দরজা খুলে রেখেছেন এইজন্যেই। মনােয়ার হাত থেকে বই নিয়ে নিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, রাত একটা বাজে। এই বয়সে অনিয়ম করা একদম ঠিক না। দরজা লাগাও, দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়। 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-১৫

“তােমরা অনিয়ম করতে পারবে আর আমি পারব না? ‘আমরা কী অনিয়ম করছি? 

এই যে মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে যাচ্ছ। সারা রাত গল্প করবে। করবে না?” না। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে, গিয়েই শুয়ে পড়ল। ‘আমার উপর মীরার যে রাগ ছিল, সেটা কি একটু কমেছে? 

তােমার উপর রাগ থাকবে কেন? মীরার হাত থেকে বই নিয়ে পানিতে ফেলে দিলাম। “কী যে তুমি বল । এইসব কি সে মনে করে রেখেছে? মেয়েটা তােমাকে কী যে পছন্দ করে যদি জানতে তাহলে আজেবাজে প্রশ্ন করতে না। 

‘খুব পছন্দ করে? 

মুখে বলে না কিন্তু “কে বেশি পছন্দ করে—মীরা না শেফা? 

“দুজনই তােমার জন্যে পাগল, তবে আমার ধারণা তোমার দিকে মীরার টানটাই বেশি। আমি তাে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। মীরাই আমাকে পাঠাল দেখে আসার জন্যে তুমি এখনাে বই পড়ছ কি-না। আমাকে বলল, তুমি অবশ্যই বাবার হাত থেকে বই কেড়ে নিয়ে বাবাকে শুইয়ে দেবে। বাবা মােজা পরেছে কি-না দেখবে। ভালাে কথা, তুমি মোজা পরেছ? 

যা হালত হালত বলল, তােমাকে রাবার ইন্যে এজিল মা। তােমার গায়ে খুব সুন্দর গন্ধ। সদর | টাটকা গন্ধ। 

*টাটকা গন্ধ আবার কী? নতুন বই খুললে যেমন গন্ধ পাওয়া যায় তেমন গন্ধ। 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-১৫

“তাের অদ্ভুত কথাবার্তার আমি কিছুই বুঝি না । আমার গায়ে বইএর গন্ধ। আসবে কেল বই এর সঙ্গে কি আমার কোনো সম্পর্ক আছে। তার বাবার গা থেকে বই এর গন্ধ এলেও একটা কথা ছিল। সে দিনরাত বই নিয়ে থাকে। তোর এখানে আসার সময় দেখেছি এত মােটা এক বই নিয়ে বসেছে।

আমি বললাম, শুয়ে পড়। রাত হয়েছে। সে বলেছে দুটা পাতা পড়েই শুয়ে পড়বে। আমার ধারণা এখনাে বই পড়ছে। | মা যাও লেখে আস বাবা এখনাে বই পড়ছে কি-না। যদি দেখ এখনাে পড়স্থ হলে হাত থেকে বই কেড়ে নিয়ে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দেবে। এবং চেক করবে পায়ে মােজা পলেছে কি-না। 

“এসাে দরজা বন্ধ কর। আমি চলে যাব। 

আজহার সাহেব বিছানা থেকে নামতে নামতে বললেন, সারাক্ষণ বকাবকি করি, তারপরেও মেয়ে দুটা আমাকে এত পছন্দ করে কেন এই রহস্যটাই বুবলি না। 

আনন্দে আজহার সাহেবের চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে তার চেয়ে সুখী মানুষ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। পৃথিবীর দশজন সুখী মানুষের তালিকা করা হলে তার নাম সেই তালিকায় থাকবে। উপরের দিকেই থাকবে। 

মনোয়ারা মেয়ের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, কিরে তুই বসে আছিস 

মীরা হাসিমুখে বলল, তােমার সঙ্গে গল্প করার জন্যে বসে আছি। “আমার তো এম আসিছে।’ “ঘম এলে ঘুমিয়ে পড়। সারাদিন পরিশ্রম করেছ। ছােটাছুটি-রান্নাবান্না।’ 

মনোয়ারা লেপের ভেতর ঢুকতে ঢুকত্রে হালকা চালায় বললেন, সাবের ছেলেটার সঙ্গে তাের কি ঝগড়া ঢাজ হয়েছে? 

না। আমার সঙ্গে কারাের ঝগড়া হয় না।’ 

মাঝে মাঝে ঝগড়া হওয়া ভালাে। ঝগড়া হচ্ছে ঝড়ের মতাে ঝড়ে যেমন ধুলা ময়লা উড়ে যায়, বাড়াতেও মলের ধুলা ময়লা উড়ে যায়। 

– মা প্লিজ জ্ঞানের কথা বলবে না। বাবার সঙ্গে থেকে তােমারও দেখি জ্ঞানের কথা অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।’

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-১৬

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *