হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-৬

বােঝা যাচ্ছে সে তার বাবার ভয়ে চুপ করেছিল।  দুপুরবেলা দেলােয়ার নদীতে নেমে চশমা উদ্ধার করে। মেয়েটাকে চশমাটা দেয়ার পর সে চশমা রেখে পরতে পরতে বলে—আচ্ছা ঠিক আছে। যেন সে জানতই দেলােয়ার চশমা নিয়ে আসবে। চশমার জন্যে ধন্যবাদটা এই মেয়ে এখন দিচ্ছে।মীরার গ্রামের বাড়ি

দেলােয়ার ভাই।’ 

“চশমাটা নদীতে পড়ে গেল। সারাদিন চশমা ছাড়া ঘুরছি অথচ কেউ বুঝতেই পারছে না। মা, বাবা, আপা কেউ একবার বুঝতেও পারল না যে ‘আমার চশমা হারিয়েছে। অথচ আপার গালে যদি একটা মশা কামড় দিত, সবাই বুঝতো। মা চমকে উঠে বলত—কী সর্বনাশ তাের গায়ে কি মশা কামড়েছে। বাবা বলত, মীরা মা তােমার লাল দাগ কিসের । আমার বেলা ঠিক উল্টা। আমার যদি ডাকুলার মতাে দুটা দাত বড় হয়ে ঠোটের বাইরেও চলে আসে কেউ বুঝবে না। সবাই ভাববে জন্ম থেকেই আমার দাঁত এ-রকম।’ | ‘ছােট আপা চলেন ঘরে যাই, চাচাজী ডাকেন।” । 

‘ডাকুক আমি ঘরে যাব না। আপনার কাজ থাকলে আপনি চলে যান। আপনি যদি ভাবেন একা থাকলে আমি ভয় পাব—আপনি খুবই ভুল করছেন। আর আপনি যদি আমার সঙ্গে বসে গল্প করতে চান গল্প করতে পারেন। 

দেলােয়ার বসল। ভেতরে ভেতরে সামান্য উসখুস করতে লাগল। ঘরে যাওয়ার পানি আছে কি-না বুঝতে পারছে না। এই গ্রামে একটা টিউবওয়েল দিয়ে ভালাে পানি আসে মুনশিবাড়ির টিউবওয়েল । বাকি সবগুলিতে আয়রন । পানি কিছুক্ষণ রাখতেই লাল হয়ে যায়। ভাবে, আর দুই কলসি পানি এনে দিতে  ‘দুপুরবেলা আপনি যখন আমাকে চশমাটা দিলেন তখন আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। আপনি যে নদীতে চশমা পড়াটা লক্ষ্য করেছেন আমি বুঝতে পারি নি। আপনি বােধহয় আমার চেহারা দেখে বুঝতে পারেননি যে আমি ভয়ংকর অবাক হয়েছি। বুঝতে পেরেছিলেন ? 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-৬

দেলােয়ার ভাই! 

‘আমার হচ্ছে স্টোন-ফেস। আমার চেহারা দেখে কেউ বুঝতে পারে না, আমি অবাক হচ্ছি না-কি দুঃখিত হচ্ছি। না-কি খুশি হচ্ছি। আমার ফেস এক্সপ্রেশন লেখ। 

‘পােনা ছাড়া হয় না। তবে মাছ আছে । পুরানা পুকুর তাে, বিরাট বিরাট মাছ আছে । ঘাই দেয় । 

“ঘাই দেয় মানে কী? “পানির মধ্যে শব্দ করে । জানান দেয়। “কাল আমাকে একটা বড়শি এনে দেবেন আমি মাছ ধরব।’ 

“এক্সপ্রেশন লেখ ফেস মানুষের কখন হয় জানেন ? “জ্বি না।। 

“জি আচ্ছা। 

‘আমি যখন খুব ছােট ছিলাম তখন একবার বঁড়শি দিয়ে একটা টেংরা মাছ ধরেছিলাম। টেংরা মাছটার রঙ ছিল সবুজ আমার পরিষ্কার মনে আছে। বড় আপা কী বলে জানেন? বড় আপা বলে—মাছ ধরার এই ব্যাপারটা নাকি আমার স্বপ্নে ঘটছে। কারণ মা খালা সবুজ হয় না।” 

টেংরা মাছের শরীরে সবুজ দাগ থাকে।’ “আমার মাছটা পুরােটাই ছিল সবুজ। 

ও আচ্ছা। দেলোয়ার ভাই!” 

শেফা ভয় পাচ্ছে। দেলোয়ার ভাই চলে যাবার পর থেকে ভয়ে তার শরীর কাপছে। মস্ত বড় বােকামি হয়ে গেছে। তার উচিত ছিল দেলােয়ার ভাইয়ের সলে চলে যাওয়া। এই পুকুরের মাছ খাওয়া নিষিদ্ধ। নিশ্চয়ই এর ও ভয়ংকর কোনাে কারণ আছে। আচ্ছা ভূত-প্রেত এরা কি মাছ খায়? শেফার মাথার উপরের কামরাঙ্গা গাছের পাতা দুলছে। শেফা আতঙ্কে অস্থির হয়ে গেল। বাতাস নেই, কিছু নেই, পাতা দুলছে কেন ? 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-৬

“আমার শেফা নামটা কি আপনার পছন্দ?  “জি পছন্দ । খব সুন্দর নাম।” 

মােটেই সুন্দর নাম না। খুব খাৱাপ নাম। শেফা মানে জানেন ?” 

শেফা মানে হল আরােগ্য । আমাকে দেখলেই লোকদের আরোগ্যের কথা মনে হবে। সেখান থেকে মনে হবে অসুখের কথা। 

‘আমার সে-রকম মনে হচ্ছে না। 

ঢাকায় গেলে অনেক ক্লিনিকের নাম দেবেন—শো নার্সিং হােম। শেফা ক্লিনিক। বিশ্রী ব্যাপার। 

ছােট আপা আমি যাই, আমার পানি আনতে হবে।’ কাল মনে করে আমার বঁড়শি আনবেন। 

জ্বি, আচ্ছা । কিন্তু বড়শি দিয়ে মাছ ধরলেও এই পুকুরের মাছ খেতে পারবেন না।’ 

খেতে পারব না কেন?” “আপনার দাদা এই পুকুরের মাছ তার বংশের কারাের খাওয়া নিষিদ্ধ করে গেছেন। অন্যরা খেতে পারবে। কিন্তু তার বংশের কেউ খেতে পারবে না।’ 

‘সেকি! কেন ? “আমি জানি না ছােট আপা। “আমার বাবা কি কারণটা জানেন ?” 

জানতে পারেন । বেশিক্ষণ থাকবেন না আপা। ভয় পেতে পারেন। “শুধু শুধু ভয় পাব কেন ? 

আজহার সাহেব রোদের আশায় বারান্দায় বসে আছেন। রােদ উঠছে না। ঘন হয়ে কুয়াশা পড়েছে। এমন ঘন যে দশহাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। তাঁর ইচ্ছা মেয়েদের নিয়ে বাগানে বসে খেজুরের রস খাবেন। নিজের গাছের রস। কলসি ভর্তি রস দেলােয়ার নামিয়ে এনেছে। সেই রস কাপড়ের ছাঁকনিতে ছাকা হচ্ছে। রসের মিষ্টি গন্ধটাও মনে হয় শীত বাড়িয়ে দিচ্ছে। গন্ধের সঙ্গে কি শীতের সম্পর্ক আছে ?

 

হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-৭

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *