জাহেদ মহাবিপদে পড়েছে। মিজান সাহেব দেশের বাড়িতে পৌঁছে ঘােষণা দিয়েছেন – এখানেই থাকবেন – আর শহরে ফিরবেন না। গ্রামে থাকার ব্যবস্থা নেই বললেই হয়। টিনের ঘর দু’টির ভগ্নদশা। ভিটের ভেতর মানুষ সমান ঘাস গজিয়েছে। বাড়ির দরজা জানালা লােকজনে খুলে নিয়েছে। খাট–চৌকি কিছুই নেই। মেঝেতে বিছানা করে ঘুমুতে হবে। মেঝেময় গর্ত। সাপের না ইদুরের, কে বলবে?
জাহেদ বলল, এর মধ্যে কি থাকবে? চল কোন আত্মীয়–স্বজনের বাড়ি গিয়ে উঠি। খাওয়া–দাওয়াতাে করতে হবে। খাব কি? এখানেতাে আর হােটেল নেই।
মিজান সাহেব বললেন, নিজের বাড়ি থাকতে পরের বাড়িতে থাকব, তাের কি ব্রেইন ডিফেক্ট হয়েছে, নিজের ভাঙ্গা বাড়িই হচ্ছে অট্টালিকা। এইখানেই থাকব।
‘আর খাওয়া–দাওয়া?
‘হাড়িকুড়ি কিছু আন। ইট পেতে আগুন করে রান্না হবে। পিকনিক হবে, বুঝলি ? রােজ পিকনিক। নিজের বাড়ি থাকতে অন্যের বাড়ি আমি খাব না। শেষে বিষ–টিষ মিশিয়ে দেবে।
‘বিষ মিশাবে কেন?”
“আরে গাধা, চারদিকে শত্রু। জমিজমা সব বেদখল হল কি জন্যে? কারা এইসব নিল? তবে এসেছি যখন সব শায়েস্তা করে যাব। দরকার হলে মার্ডার করব। মামা ভাগ্নে যেখানে বিপদ নেই সেইখানে। কিরে, পারবি না। আমাকে সাহায্য করতে?
জাহেদ চোখে অন্ধকার দেখছে। একি সমস্যা।
মেঘের ছায়া খন্ড-৩৬
রাতে থাকার জন্যে চৌকি জোগাড় করা হয়েছে। চৌকির উপর তােষক বিছিয়ে বিছানা। খাবার ব্যবস্থা জাহেদের দূর সম্পর্কের এক খালার বাসায়। মিজান সাহেব কিছুতেই সেখানে খেতে যাবেন না। জাহেদ একা গিয়ে খেয়ে এল। বাটিতে করে খাবার নিয়ে এল। মিজান সাহেব সেই খাবারও মুখে দিলন না। চোখ কপালে তুলে বললেন, অসম্ভব। তুই কি আমাকে মারতে চাস? স্বপাক আহার করব। নিজে বেঁধে খাব।
তৃতীয় দিনের দিন সে প্রায় জোর করেই মামাকে নিয়ে ঢাকায় এসে নামল। ট্রেন থেকে তিনি নামলেন বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায়। রিকশায় উঠে রিকশাওয়ালাকে করুণ গলায় বললেন, এরা আমাকে খুন করতে নিয়ে যাচ্ছে, বুঝলেন ভাই সাহেব। গ্রামের বাড়িতে সুখে ছিলাম, ভুলিয়ে ভালিয়ে এনেছে। গরু জবেহ করার বড় ছুরি আছে ? ঐটা দিয়ে জবেহ করবে। ঘুমের মধ্যে কাম সারবে। আল্লাহ হু আকবর বলে গলায় পােচ।
তিনি বাসায় ঢুকলেন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। মনােয়ারাকে দেখে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কি রে মাগী – স্বামীকে খুন করাতে চাস? বেশ, খুন কর। কিছু বলব না। চিৎকারও দিব না। তবে খিয়াল রাখিস, আল্লাহর কাছে জবাব দিহি করতে হবে। খুনের সময় আমাকে কিন্তু উত্তর দক্ষিণে শােয়াবি। ভালমত গােসল দিবি। নাপাক অবস্থায় আল্লাহর কাছে যেতে চাই না।
মেঘের ছায়া খন্ড-৩৬
মনােয়ারা মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে গেলেন। মিজান সাহেবের মেয়ে দু’টি ভয়ে থরথর করে কাপতে লাগল। তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন – খুকীরা, ভয়ের কিছু নেই। নির্ভয়ে থাক।
জাহেদ পাড়ার ডাক্তার সাহেবকে ডেকে আনল। তিনি ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। জাহেদকে বললেন, রুগীর অবস্থা ভাল দেখছি না। যে কোন সময় ভায়ােলেন্ট পর্যায়ে চলে যেতে পারে। আপনি বরং কোন একটা ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দেন। বাচ্চা কাচ্চার সংসার। একটা দুর্ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ? ইনজেকশনের এফেক্ট বিকেল পর্যন্ত থাকবে। এরমধ্যে একটা ব্যবস্থা করে ফেলুন। বনানীতে একটা ক্লিনিক আছে – নাম হল মেন্টাল হােম। ইলেকট্রিক শক দেবার ব্যবস্থা আছে। ঠিকানা আছে আমার কাছে — চার্জ বেশি। কিন্তু টাকার দিকে তাকালেতাে এখন হবে না। দেব ঠিকানা ?
Read More
হুমায়ূন আহমেদের লেখা মেঘের ছায়া শেষ খন্ড