হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড-৫

আমি পাঁচশ’ টাকার নােট নিয়ে বাসায় চলে এলাম। একটু ভুল বললাম, বাসায় না, বাসার সামনেই ভিডিও’র দোকান দি ইমেজে’ চলে এলাম । জহির ভাই বেশির ভাগ সময় এই দোকানেই বসে থাকেন। দোকানের মালিক ফারুক ভাই উনার জানি দোস্ত। দোকানে একটা পার্টিশান আছে।

পার্টিশানের ওপাশে বড় ডিভান পাতা আছে । জহির ভাই এই ডিভানে শুয়ে ঘুমান কিংবা ম্যাগাজিনের ছবি দেখেন। যে-কোনাে ম্যাগাজিনের নায়ক-নায়িকার ছবির দিকে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকতে পারেন।

লিলুয়া বাতাস 

জহির ভাই ডিভানে পা ঝুলিয়ে বসে ছিলেন। কিছুক্ষণ আগে তার ঘুম ভেঙেছে। চোখে-মুখে এখনাে ঘুম লেগে আছে। তার কানের ওপর একটা সিনেমা ম্যাগাজিন। একহাতে সিগারেট অন্য হাতে ম্যাচ। সিগারেট এখনো ধরানাে হয় নি। ঘুম কাটলেই সিগারেট ধরাবেন। জহির ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাই তুললেন। আমি বললাম, নাশতা করেছ? 

জহির ভাই বিরক্ত গলায় বললেন, না। চল নাশতা করে আসি। টাকা আছে ? 

কত ? 

পাঁচশ’ পনের। 

জহির ভাই আবারাে হাই তুললেন। সিগারেট ধরালেন। বিরক্ত ভঙ্গিতে ধােয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, আমার সন্ধ্যার মধ্যে দুই হাজার টাকা দরকার। মা’কে বলে টাকা জোগাড় করে দে।। 

আমি চাইলে দিবে না। তুমি চেষ্টা করে দেখ। 

আমাকেও দিবে না। তাের নীলা ফুপুর কাছে আছে ? নাটক-ফাটক করে যখন টাকা থাকার তাে কথা। 

থাকতে পারে । চেষ্টা করে দেখবি ? চেষ্টা করতে পারি। এই পাঁচশ’ রাখ। 

খুচরা-খাচরা নিয়ে লাভ নাই। পুরা দুই হাজার জোগাড় করতে পারলে দিবি, না পারলে নাই। ফ্লাক্স নিয়ে যা, আমার জন্যে চা নিয়ে আয়। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৫

বাসার চা, না দোকানের চা ? মজিদের দোকানের চা। মজিদকে বলবি যেন স্পেশাল করে বানায়। 

জহির ভাই শুয়ে পড়লেন। ম্যাগাজিন খুলে বুকের ওপর ধরলেন। তাঁর দুই হাতে ম্যাগাজিন ধরা, ঠোটে সিগারেট। তিনি হাত দিয়ে সিগারেট ধরছেন না। মাঝেমাঝে মাথা ঝাঁকি দিচ্ছেন সিগারেটের ছাই ফেলার জন্যে। ছাই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি নির্বিকার। 

আমি জহির ভাইকে খুবই পছন্দ করি । কেন করি নিজেও জানি না। পছন্দ করার মতাে তেমন কোনাে গুণ তার নেই। অপছন্দ করার মতাে অনেক কিছুই আছে। কোনাে মানুষই সারাক্ষণ মেজাজ খারাপ করে থাকতে পারে না । জহির ভাই পারেন। কেউই ময়লা কাপড় পরতে পছন্দ করে না, জহির ভাই করেন। 

তাঁর সার্বক্ষণিক পােশাক স্যান্ডেল, জিনসের প্যান্ট এবং হলুদ শার্ট। শার্টে ময়লা জমতে জমতে ছাতা পড়ে গেছে। হলুদ শার্ট এখন আর হলুদ না— কালচে সবুজ। 

সমস্যা হচ্ছে, সেই নােংরা কাপড়েও তাকে মানায়। তার চেহারা রাজপুত্রের মতাে। ময়লা জামা-কাপড়ে তিনি যখন বের হন তখন মনে হয় ছবির শুটিং হচ্ছে। ছবির নায়ক ভ্যাগাবণ্ড সেজে অ্যাকটিং করছে। জহির ভাইকে নিয়ে একটা মজার গল্প বললে বিষয়টা আরাে পরিষ্কার হবে। তিনি আর আমি মােহাম্মদপুর বাজারে গিয়েছি। মাসের বাজার করা হবে। চাল, ডাল, তেল এইসব কেনা হবে ।

জহির ভাইয়ের মেজাজ খুবই খারাপ। তিনি বললেন, বাজার সদাই যা করার তুই করতে থাক। আমি এর মধ্যে নেই। আমি এখানে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা সিগারেট খেতে থাকব। বাজার শেষ হলে আমাকে নিয়ে যাবি। বাজারের টাকা থেকে আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দিয়ে যা। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৫

জহির ভাইয়ের কথা শেষ হবার আগেই এক লােক এসে তার সামনে দাঁড়াল। থলথলে ভুড়িওয়ালা এক লােক। এক হাতে চারটা মুরগি, অন্যহাতে বাজারের থলে। লােকটার পেছনে এক মিন্তি। মিন্তির মাথায় ঝাঁকা ভর্তি কাঁচা বাজার । লােকটা জহির ভাইয়ের দিকে এগিয়ে এসে পরিচিত ভঙ্গিতে বলল, ভালাে আছেন ? 

জহির ভাই জবাব দিলেন না। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। লােকটা বলল, আমার নাম আজিজুর রহমান খােকন। আমি চিত্রপরিচালক। দূর থেকে আপনাকে দেখে ভালাে লেগেছে। আপনি কী করেন? 

থুথু ফেলতে ফেলতে জহির ভাই বললেন, কিছু করি না। ছবি করবেন ? রােল কী ? নায়কের বন্ধু । 

জহির ভাই বললেন, আমাকে নায়কের বন্ধু করলে আপনার নায়ক মার খাবে। সেটা কি ঠিক হবে ? 

আজিজুর রহমান খােকন সাহেব বললেন, হাটে বাজারে তাে এইসব আলাপ চলে না, আপনি একদিন অফিসে আসুন। আমার অফিস কাকরাইলেসিনেমা পাড়ায়। 

জহির ভাই বললেন, আমি অফিসে যাই না । খােকন সাহেব বললেন, মােবাইল নাম্বার দেন আমি যােগাযােগ করব। 

জহির ভাই বললেন, মােবাইল নাই । আচ্ছা শুনুন, আপনি তাে ভালাে বাজার করেন। মুরগি ভালাে কিনেছেন। দুইটা মুরগি আমাদের দিয়ে যান। এতগুলাে দিয়ে কী করবেন ?

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড-৬

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *