হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড-৮

যূথী, তােমার কি অনেক খেলনা ? হু। আমার একশ’ কোটি খেলনা । কোন খেলনাটা তােমার সবচে’ প্রিয় ? আমার একটা তুলার হাতি আছে— সবচে’ প্রিয়। দেখি হাতিটা । কীভাবে দেখবে! হারিয়ে গেছে তাে। তুমি খেলনা দিয়ে খেলা ছাড়া আর কী কর ? আর কিছু করি না। কেন, টিভি দেখ না ? লিলুয়া বাতাস

আমাদের টিভি নেই। বাবা গরিব তাে, এই জন্যে টিভি নেই। গরিবদের টিভি থাকে না। 

গরিবদের আর কী থাকে না ? 

ফ্রিজ থাকে না। কিন্তু আমাদের ফ্রিজ আছে। তুমি ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি খাবে ? 

খাব। 

আচ্ছা আমি এনে দেব । আমার ঠাণ্ডা পানি খাওয়া নিষেধ। ঠাণ্ডা পানি খেলে আমার গলা ব্যথা হয়, এই জন্যে নিষেধ। 

যূথী উঠে চলে গেল এবং গ্লাস ভর্তি করে ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এলাে । যূথীর মা তখন ঢুকছেন চা নিয়ে। চায়ের কাপ আমার সামনে রাখতে রাখতে চাপা গলায় বললেন, বাবা, চা খাও। 

তাঁর মুখে ‘বাবা’ ডাক শুনতে অস্বস্তি লাগছে। তাঁরও মনে হয় অস্বস্তি লাগছে। তিনি একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছেন না। আমি বললাম, ঘরে কি থার্মোমিটার আছে ? যূথীর জ্বর কত দেখতাম। 

ভদ্রমহিলা উঠে গেলেন এবং আমাকে থার্মোমিটার এনে দিলেন। তাঁর চোখে কৌতূহল । তিনি থেমে থেমে বললেন (এখনাে আমার দিকে তাকাচ্ছেন ), মেয়েটার প্রায়ই জ্বর হয় । তােমার বাবাকে প্রায়ই বলি, ভালাে একজন ডাক্তার দেখাতে। সে সময় পায় না। 

আমি যূথীর জ্বর দেখলাম, একশ’ এক। যূথীর মা যূথীকে শােবার ঘরে নিয়ে গেলেন। বসার ঘরে আমি একা বসে আছি। বাবা দশ মিনিটের কথা বলে গেছেন। আধাঘণ্টা পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে যূথীর মা এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন। তাঁর দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিতে অস্বস্তি, লজ্জা এবং কিছুটা ভয় । আমি বললাম, কিছু বলবেন ? 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৮

উনি বললেন, তােমাদের বাসায় কি সব জানাজানি হয়ে গেছে ? আমি বললাম, জি। আল্লাগাে, এখন কী জানি হয়! এই ফ্ল্যাট বাড়িটা কি আপনাদের ? 

এক অ্যাডভােকেট সাহেবের বাড়ি। তােমার বাবা ভাড়া নিয়েছেন। ভাড়া কত ? 

সবকিছু নিয়ে চার হাজার টাকা। তুমি কি আরেক কাপ চা খাবে? বানিয়ে দিব ? 

আমি ঘনঘন চা খাই না। এই ফ্ল্যাটের বারান্দা আছে। বারান্দাটা সুন্দর । বারান্দায় বসবে ? বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখতে ভালাে লাগবে। বারান্দায় বসাে, আমি আরেক কাপ চা বানিয়ে দেই, চা খাও। তােমার বাবার আসতে অনেক দেরি হবে। বাজার করতে উনার খুব দেরি হয়। 

ভদ্রমহিলার আগ্রহের কারণেই বারান্দায় বসলাম। ছােট্ট বারান্দা। পাশাপাশি দু’টা মােড়া পাতা। বেশ কিছু টব । একটা টবে নীল অপরাজিতার লতানাে গাছ। গাছ অনেক বড় হয়েছে। আরেকটা টবে সাদা সাদা ছােট ফুল । নাম জানি না কিন্তু সুন্দর গন্ধ। বারান্দা সুন্দর না ? 

যূথীকে এই বারান্দায় আসতে দেই না। কেন ? 

আমাদের ঠিক উপরের তলার বারান্দা থেকে একটা ছেলে নিচে পড়ে গেছে। চারতলা থেকে পড়েছে, কিন্তু কিছুই হয় নি। নিচে কনস্ট্রাকশানের জন্যে বালি রাখা হয়েছিল। ছেলেটা পড়েছে বালিতে, এই জন্যে কিছু হয় নি। 

আমি বারান্দার মােড়ায় বসে আছি— দ্রমহিলা ঠিক আমার পেছনে দরজা ধরে দাঁড়ানাে। তাঁর দ্বিধা এবং সংকোচ মনে হয় সামান্য কমেছে। 

ঐ ছেলেটার নাম টগর। খুব দুরন্ত ছেলে। আমাদের বাসায় প্রায়ই আসে। যূথীর সঙ্গে খেলে। 

আমি ও আচ্ছা’ বলে চুপ করে গেলাম। ভালােই বৃষ্টি হচ্ছে। বারান্দা থেকে বৃষ্টি দেখতে ভালাে লাগছে। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৮

তােমার বাবাকে অনেকদিন বলেছি তােমার মা’র কাছে সব স্বীকার করতে। সে রাজি না। তার এক পীর সাহেব আছে, সেই পীর সাহেব বলেছে সব আপনা আপনি মিটমাট হবে। 

ও আচ্ছা। 

উনার মন দুর্বল তাে, এই জন্যে শুধু পীর-ফকির করে। প্রায়ই শুনি অমুক পীরের কাছে গেছে, তমুক পীরের কাছে গেছে। আপনি পীর-ফকির বিশ্বাস করেন না ? 

এখন উনার এক পীর জুটেছে, সেই পীরের কাজ না-কি শুধু হাঁটা। পীর সাহেব হাঁটেন, পীর সাহেবের সঙ্গে তার লােকজন হাঁটে। তােমার বাবা উনার কাছে যখন যান তখন বিরাট ঝামেলা হয়। 

কী ঝামেলা ? 

ছয়-সাত মাইল হেঁটে আসেন তাে । পা ফুলে যায়। পায়ে সঁাক দিতে হয়। পা টিপে দিতে হয়। তােমার মা’র রান্না না-কি খুব ভালাে ? 

জি ভালাে। 

তােমার বাবা আমাকে বলেছেন। আমি রাঁধতে পারি না। কখনােই আমার লবণের আন্দাজ হয় না। হয় বেশি হবে নয় কম হবে। 

ও আচ্ছা। 

বাসায় ফিরলাম রাত বারােটার দিকে। বাবা নিউ বিরানি হাউজ পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। গলা নিচু করে বললেন, My son, বাকি রাস্তা একা একা যেতে পারবি ? আমি বললাম, পারব। 

বাবা বললেন, That’s good, এই মুহূর্তে ওদের সামনে পড়তে চাই না। বিসমিল্লাহ বলে চলে যা। আল্লাহু শাফি। আল্লাহু কাফি। 

বাসায় এসে দেখি হুলস্থুল কাণ্ড । দি ইমেজ’-এর সামনে অনেক লােকজন হাঁটাহাঁটি করছে। পুলিশও আছে। আমাদের বাসার সব লাইটও জ্বলছে। বারান্দায় ভাইয়া এবং মা হাঁটাহাঁটি করছেন। আমি গেটে হাত রাখতেই ভাইয়া ছুটে এসে আমার হাত ধরল। 

কই ছিলি এত রাত পর্যন্ত ? বাসা খুঁজে পেয়েছিলি ? 

খুঁজে না পেলে চলে আসবি। গাধা না-কি ? এত রাত পর্যন্ত কেউ বাইরে থাকে ? দিনকাল খারাপ। এদিকে বিরাট গণ্ডগােল । 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৮

কী গণ্ডগােল ? 

ঘরে আয় সব শুনবি। বারান্দার লাইট সব নিভিয়ে দে। গেটে তালা লাগাতে হবে। 

ভাইয়া ব্যস্ত হয়ে তালা লাগাতে গেল। মা আমাকে টেনে বাড়িতে ঢুকালেন। খাবার টেবিলে বসিয়ে বললেন, বাবলু, আয় আগে ভাত খা । 

আমি বললাম, ভাত খেয়ে এসেছি মা।। ভাত কোথায় খেয়ে এসেছিস ? 

ভাত খাই নি। ভুল বলছি। শরীর খারাপ লাগছে। বাসা খুঁজতে গিয়ে অনেক হাঁটাহাঁটি। বৃষ্টিতে ভিজেছি, এই জন্যে বােধহয় শরীর খারাপ করেছে। বমি আসছে। 

বাসা খোঁজাখুঁজির কোনাে দরকার নাই। আমরা পাকা খবর পেয়েছি। যে অ্যাডভােকেট সাহেবের বাসায় সে থাকে, উনিই খবর দিয়েছেন। 

আমি বললাম, ভাইয়া বলছিল, এদিকে গণ্ডগােল । কী গণ্ডগােল ? সকালে শুনিস। রাতে শােনার দরকার নেই। এখনি বলে । ভিডিওর দোকানে গণ্ডগােল হয়েছে। গােলাগুলি। খুনাখুনি । 

কে করেছে গােলাগুলি ? 

ভিডিওর দোকানের ম্যানেজার। কাদের নাম । মালিককে গুলি করেছে— মালিকের সঙ্গে তার জানি দোস্ত আমাদের ছাগলটা ছিল সে-ও গুলি খেয়েছে । 

জহির ভাই গুলি খেয়েছে ? 

কেউ মারা গেছে না-কি ? 

দু’জনই বােধহয় মারা গেছে। লােকজন তাই বলছে। অ্যাম্বুলেন্স এসে নিয়ে। গেছে। পুলিশ এই বাড়িতেও এসেছিল ! খােকনের সঙ্গে কথাবার্তা বলল । 

কী কথা বলল ? | জানি না । জিজ্ঞেস করি নি। 

আমি মার দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পান খাচ্ছেন। ঠোটে চুন লেগে আছে। তার চেহারায় চোখে-মুখে শান্তি শান্তি ভাব । 

জহির ভাই অনেকদিন এ বাড়িতে আছেন। তিনি পালক পুত্র হন যাই হন তিনি। তাে আমাদেরই একজন। তিনি গুলি খেয়েছেন। লােকজন বলছে সম্ভবত মারা গেছেন। এ নিয়ে তার কোনাে মাথাব্যথা নেই।সত্যি ভাত খাবি না ? 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৮

দুধ খাবি ? এক কাপ দুধ দেই, খা। 

তাহলে যা হাত-মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়। জহির ভাইয়ের কোনাে খোঁজ নেব না ? 

এই নাম এখন কিছুদিন মুখেও আনবি না। পুলিশের তদন্ত-টদন্ত শেষ হােক। তারপর যদি মারা গিয়ে থাকেন? 

মারা গেলে পুলিশ খবর দিবে । শহরের মাঝখানে জোড়াখুন বিরাট ঘটনা। চ্যানেল আই-এর নিউজে দেখিয়েছে। জহিরকেও দেখিয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল, চেহারা বােঝা যায় নাই। তুই এইসব নিয়ে চিন্তা করিস না । ঘুমােতে যা। সকালে পুলিশের এসবি’র লােক আসবে। খােকনকে বলে গেছে। তাের সঙ্গে হয়তাে কথাবার্তা বলবে। জহির তাের ঘরে ঘুমাত এই জন্যে। কী বলবি  থােকন তােকে শিখিয়ে দেবে । 

শিখিয়ে দিতে হবে কেন ? 

কোনটা বলতে গিয়ে কী বলে কোন ঝামেলায় পড়বি! পুলিশের চেষ্টাই থাকে ঝামেলা তৈরি করা। ঝামেলা হলে তারা দু’টা পয়সা পায় । সবার পয়সার দরকার। পুলিশের দরকার সবচে’ বেশি । তুই এক কাজ কর, ঘুমুতে যাবার আগে খােকনের কাছ থেকে সব জেনে যা। সে যা শিখিয়ে দেবে তার বাইরে একটা কথা বলবি না ।। 

ভাইয়া যা শিখিয়ে দিল তা হচ্ছে- জহির ভাই আমাদের পরিবারের কেউ । আমার বড়খালু দয়াপরবশ হয়ে তাকে বাড়িতে আশ্রয় দেন। সেই থেকেই সে আমাদের সঙ্গে আছে। তবে সে এখন আর আমাদের সঙ্গে থাকে না। দি ইমেজে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ আসে। রাত বেশি হলে আমার ঘরে থেকে যায়। এর বেশি আমরা কিছু জানি না । ভাইয়া বিশেষ করে বলে দিল যেন ভুলেও না বলি বড়খালু জহির ভাইকে পালক এনেছিলেন । 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-৮

 ভাইয়ার সঙ্গে কথাবার্তার এক পর্যায়ে আমি মিনমিন করে বললাম, ভাইয়া, চল না জহির ভাইয়ের অবস্থা কী একটু খোঁজ নিয়ে আসি ? 

ভাইয়া শান্ত গলায় বলল, অনেকগুলি কারণে এই কাজটা করা যাবে না । প্রথম কারণ, পুলিশ তাকে কোন হাসপাতালে নিয়ে গেছে আমরা জানি না। রাতদুপুরে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘােরা সম্ভব না। দ্বিতীয় কারণ, খুনখারাবি যখন ঘটে তখন পুলিশের সন্দেহভাজনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দেখানাে যায় না। তৃতীয় কারণ, জহির ভাই আমাদের এমন কেউ না যে তার খোঁজে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে হবে। চতুর্থ কারণ,… 

ভাইয়া এমনভাবে কথা বলছে যেন পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। পয়েন্ট বাই পয়েন্ট উত্তর। কোনাে পয়েন্ট যেন বাদ না পড়ে। পরীক্ষায় যে প্রশ্ন এসেছে সেটা হলাে— জহিরের খোঁজে না যাওয়ার পেছনে তােমার যুক্তিগুলি উদাহরণসহ ব্যাখ্যা কর। 

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড-৯

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *