শোঁ শোঁ আওয়াজ দিচ্ছে। মন্টু বলল, ‘বাবা, গল্প বলেন।
‘কিসের গল্প, ভূতের? নিনু বলল, ‘না, আমি ভয় পাচ্ছি, হাসির গল্প বলেন। বাবা বললেন, ‘রাবেয়া, তুই একটা হাসির গল্প বল।
রাবেয়ার হাসির গল্পটা তেমন জমল না। বাবা অবশ্যি অনেকক্ষণ ধরে হাসলেন।
রুনু বলল, ‘মনে পড়ে আপা, মা এক দিন এক কানা সাহেবের গল্প বলেছিল? সেদিনও এমন ঝড়–বৃষ্টি।
‘কোন গল্পটার কথা বলছিস?
ঐ যে, সাহেব বাজারে গেছে গুড় কিনতে। ‘মনে নেই তাে গল্পটা, বল তাে!
রুনু চোখ বড়াে বড়াে করে গল্প বলে চলল। রুনুটা অবিকল মায়ের চেহারা পেয়েছে। এই বয়সে হয়তাে মা দেখতে এমনিই ছিলেন। কেমন অবাক লাগে––একদিন মা যে–গল্প করে গেছেন, সেই গল্পই তাঁর এক মেয়ে করছে।
পরিবেশ বদল হয় নি একটুও, সেদিন ঝড়–বৃষ্টি হচ্ছিল, আজও হচ্ছে।
গল্প শেষ হতেই বাবা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। টানা গলায় বললেন, ‘শুয়ে পড় সবাই।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৪
শুয়ে শুয়ে আমার কেবলই মায়ের কথা মনে পড়তে লাগল, বেশ কিছুদিন আগেও এক দিন এরকম মনে পড়েছিল। সেকেণ্ড ইয়ারের ক্লাস নিচ্ছি, হঠাৎ দেখি বারান্দায় একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন গল্প করছে। দেখামাত্র ধক কর উঠল বুকের ভেতর। অবিকল মায়ের মতাে চেহারা। তেমনি দাঁড়াবার ভঙ্গি, বিরক্তিতে কুঁচকে নিচের ঠোট কামড়ে ধরা।
আমি এত বেশি বিচলিত হলাম যে, ক্লাসে কী বলছি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। ক্লাস শেষ হলেই মেয়েটি সঙ্গে আলাপ করব, এই ভেবে প্রাণপণে ক্লাসে মন দিতে চেষ্টা করলাম। ক্লাস একসময় শেষ হল, মেয়েটিকে খুঁজে পেলাম না। সেদিনও সমস্তক্ষণ মায়ের কথা ভেবেছিলাম। সে–রাতে অনেক দিন পর স্বপ্ন দেখলাম মাকে। মা ছােট্ট খুকি হয়ে গেছেন। ফ্রক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঘরময়। আমি বলছি, মা আপনি এত হৈচৈ করবেন না, আমি ঘুমুচ্ছি।‘
মা বললেন, ‘বারে, আমি বুঝি এক্কা–দোক্কাও খেলব না? | খেলুন, তবে শব্দ করে নয়।‘
‘তুই খেলবি আমার সঙ্গে খােকা? ‘না, আমি কত বড়াে হয়েছি দেখছেন না? আমার বুঝি এসব খেলতে আছে?
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৪
খুব অবাক হয়েছিলাম স্বপ্নটা দেখে। এমন অবাস্তব স্বপ্নও দেখে মানুষ!
মায়ের চারদিকের রহস্যের মতাে স্বপ্নটাও ছিল রহস্যময়। চারদিকে রহস্যের আবরণ তুলে তিনি আ৩াবন আমাদের চেয়ে আলাদা হয়ে ছিলেন। শুধু কি তিনিই ?
তাঁর পরিবারের অন্য মানুষগুলিও ছিল ভিন্ন জগতের মানুষ, অন্তত আমাদে;
মাঝে–মাঝে বড় মামা আসতেন বাসায়। বাবা তটস্থ হয়ে থাকতেন। সারাক্ষণ। দৌড়ে মিষ্টি আনতে যেতেন। রাবেয়া গলদঘর্ম হয়ে চা করত, নিমকি ভাজত। বড় মামা সিকি কাপ চা আর আধখানা নিমকি খেতেন। যতক্ষণ থাকতেন, অনবরত পা নাচাতেন আর সিগারেট ফুকতেন। আমাদের দিকে কখনাে মুখ তুলে। তাকিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। বাবা অবশ্যি এক এক করে আমাদের নিয়ে যেতেন।
তাঁর সামনে। আমরা নিজেদের নাম বলে জড়ােসড়াে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মামা ভীষণ অবাক হয়ে বলতেন, ‘এরা সবাই শিরিনের ছেলেমেয়ে? কী আশ্চর্য!’ আশ্চর্যটা যে কী কারণে, তা বুঝতে না পেরে আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতাম। মামা রুমাল দিয়ে ঠোট মুছতে মুছতে বলতেন, ‘বুঝলেন আজহার সাহেব, শিরিন ছােটবেলায় মােটেই ছেলেমেয়ে দেখতে পারত না। আর তারই কিনা এতগুলি ছেলেমেয়ে!
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৪
‘এই যে, এইটিই কি বড়াে ছেলে? মামা আঙুল ধরে রাখতেন আমার দিকে। আমি ঘাড় নাড়তাম। মামা বলতেন, কী পড়া হয়? ‘নাইনে পড়ি।।
বাবা অতিরিক্ত রকমের খুশি হয়ে বলতেন, ‘খােকা এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। জ্বর নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল। স্কুল থেকে একটা মেডেল দিয়েছে। গােল্ড মেডেল। রাবেয়া, যাও তাে মা, মেডেলটা তােমার মামাকে দেখাও। ছােট ট্রাঙ্কে আছে।‘
ব্লেডের মতাে পাতলা মেডেলটা মামা ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখতেন। আবেগশূন্য গলায় বলতেন, শিরিনের মতাে মেধাবী হয়েছে ছেলে। শিরিন মেট্রিকুলেশনে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছিল।‘
বলতে বলতে মামা গম্ভীর হয়ে যান। অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলেন, ‘আমাদের পরিবারটাই ছিল অন্য ধরনের। হাসিখুশি পরিবার। বাড়ির নাম ছিল ‘কারা কানন। দেয়ালের আড়ালে ফুলের বাগান। শিরিন নিজেই দিয়েছিল নাম।‘
Read More