হুমায়ূন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৪

শোঁ শোঁ আওয়াজ দিচ্ছেমন্টু বলল, বাবা, গল্প বলেন। 

কিসের গল্প, ভূতের? নিনু বলল, না, আমি ভয় পাচ্ছি, হাসির গল্প বলেনবাবা বললেন, রাবেয়া, তুই একটা হাসির গল্প বল

শঙ্খনীল কারাগার 

রাবেয়ার হাসির গল্পটা তেমন জমল নাবাবা অবশ্যি অনেকক্ষণ ধরে হাসলেন। 

রুনু বলল, মনে পড়ে আপা, মা এক দিন এক কানা সাহেবের গল্প বলেছিল? সেদিনও এমন ঝড়বৃষ্টি। 

কোন গল্পটার কথা বলছিস

যে, সাহেব বাজারে গেছে গুড় কিনতেমনে নেই তাে গল্পটা, বল তাে

রুনু চোখ বড়াে বড়াে করে গল্প বলে চললরুনুটা অবিকল মায়ের চেহারা পেয়েছেএই বয়সে হয়তাে মা দেখতে এমনিই ছিলেনকেমন অবাক লাগেএকদিন মা যেগল্প করে গেছেন, সেই গল্পই তাঁর এক মেয়ে করছে। 

পরিবেশ বদল হয় নি একটুও, সেদিন ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল, আজও হচ্ছে। 

গল্প শেষ হতেই বাবা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেনটানা গলায় বললেন, শুয়ে পড় সবাই। 

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৪

শুয়ে শুয়ে আমার কেবলই মায়ের কথা মনে পড়তে লাগল, বেশ কিছুদিন আগেও এক দিন এরকম মনে পড়েছিলসেকেণ্ড ইয়ারের ক্লাস নিচ্ছি, হঠাৎ দেখি বারান্দায় একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন গল্প করছেদেখামাত্র ধক কর উঠল বুকের ভেতরঅবিকল মায়ের মতাে চেহারাতেমনি দাঁড়াবার ভঙ্গি, বিরক্তিতে কুঁচকে নিচের ঠোট কামড়ে ধরা

আমি এত বেশি বিচলিত হলাম যে, ক্লাসে কী বলছি নিজেই বুঝতে পারছিলাম নাক্লাস শেষ হলেই মেয়েটি সঙ্গে আলাপ করব, এই ভেবে প্রাণপণে ক্লাসে মন দিতে চেষ্টা করলাম। ক্লাস একসময় শেষ হল, মেয়েটিকে খুঁজে পেলাম নাসেদিনও সমস্তক্ষণ মায়ের কথা ভেবেছিলামসেরাতে অনেক দিন পর স্বপ্ন দেখলাম মাকেমা ছােট্ট খুকি হয়ে গেছেনফ্রক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঘরময়আমি বলছি, মা আপনি এত হৈচৈ করবেন না, আমি ঘুমুচ্ছি‘ 

মা বললেন, বারে, আমি বুঝি এক্কাদোক্কাও খেলব না? | খেলুন, তবে শব্দ করে নয়‘ 

তুই খেলবি আমার সঙ্গে খােকা? না, আমি কত বড়াে হয়েছি দেখছেন না? আমার বুঝি এসব খেলতে আছে

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৪

খুব অবাক হয়েছিলাম স্বপ্নটা দেখেএমন অবাস্তব স্বপ্নও দেখে মানুষ

মায়ের চারদিকের রহস্যের মতাে স্বপ্নটাও ছিল রহস্যময়চারদিকে রহস্যের আবরণ তুলে তিনি আ৩াবন আমাদের চেয়ে আলাদা হয়ে ছিলেনশুধু কি তিনিই

তাঁর পরিবারের অন্য মানুষগুলিও ছিল ভিন্ন জগতের মানুষ, অন্তত আমাদে;  

মাঝেমাঝে বড় মামা আসতেন বাসায়বাবা তটস্থ হয়ে থাকতেনসারাক্ষণদৌড়ে মিষ্টি আনতে যেতেনরাবেয়া গলদঘর্ম হয়ে চা করত, নিমকি ভাজতবড় মামা সিকি কাপ চা আর আধখানা নিমকি খেতেন। যতক্ষণ থাকতেন, অনবরত পা নাচাতেন আর সিগারেট ফুকতেনআমাদের দিকে কখনাে মুখ তুলেতাকিয়েছেন বলে মনে পড়ে নাবাবা অবশ্যি এক এক করে আমাদের নিয়ে যেতেন

তাঁর সামনেআমরা নিজেদের নাম বলে জড়ােসড়াে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতামমামা ভীষণ অবাক হয়ে বলতেন, এরা সবাই শিরিনের ছেলেমেয়ে? কী আশ্চর্য!’ আশ্চর্যটা যে কী কারণে, তা বুঝতে না পেরে আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতামমামা রুমাল দিয়ে ঠোমুছতে মুছতে বলতেন, বুঝলেন আজহার সাহেব, শিরিন ছােটবেলায় মােটেই ছেলেমেয়ে দেখতে পারত নাআর তারই কিনা এতগুলি ছেলেমেয়ে

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৪

এই যে, এইটিই কি বড়াে ছেলে? মামা আঙুল ধরে রাখতেন আমার দিকেআমি ঘাড় নাড়তামমামা বলতেন, কী পড়া হয়? নাইনে পড়ি। 

বাবা অতিরিক্ত রকমের খুশি হয়ে বলতেন, খােকা এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছেজ্বর নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলস্কুল থেকে একটা মেডেল দিয়েছেগােল্ড মেডেলরাবেয়া, যাও তাে মা, মেডেলটা তােমার মামাকে দেখাওছােট ট্রাঙ্কে আছে‘ 

ব্লেডের মতাে পাতলা মেডেলটা মামা ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখতেনআবেগশূন্য গলায় বলতেন, শিরিনের মতাে মেধাবী হয়েছে ছেলেশিরিন মেট্রিকুলেশনে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছিল‘ 

বলতে বলতে মামা গম্ভীর হয়ে যানঅপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলেন, আমাদের পরিবারটাই ছিল অন্য ধরনেরহাসিখুশি পরিবারবাড়ির নাম ছিল কারা কাননদেয়ালের আড়ালে ফুলের বাগানশিরিন নিজেই দিয়েছিল নাম‘ 

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৫

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *