হুমায়ূন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৫

মা আসতেন আরাে কিছু পরেখুব কম সময় থাকতেনআমরা বেরিয়ে আসতাম সবাইএকসময় দেখতাম মুখ কালাে করে মামা উঠে যেতেনমা শুয়ে শুয়ে কাঁদতেন সারা দুপুরআমরা মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াতামকিছুই ভালােলাগত নাসেই অল্পবয়সেই মাকে কি গভীর ভালােই না বেসেছিলাম!

অথচ তিনি ছিলেন খুবই নিরাসক্ত ধরনেরকথাবার্তা বলতেন কমনিঃশব্দে হাঁটতেননিচু গলায় কথা বলতেনমাঝে মাঝে মনে হত, বড় রকমের হতাশায় ডুবে গেছেনতখন সময় কাটাতেন বিছানায় শুয়ে শুয়েপ্রয়ােজনের কথাটিও বলতেন নাঘরের কাজ রাবেয়া আর একটা ঠিকে ঝি মিলে করতবিষন্নতায় ডুবে যেত সারা বাড়ি। 

শঙ্খনীল কারাগার

বাবা অফিস থেকে এসে চুপচাপ বসে থাকতেন বারান্দায়রাবেয়া চা এনে দিতবাবা ফিসফিস করে বলতেন, তাের মাকে দিয়েছিস

না, মা খাবে নাআহা, দিয়েই দেখ নাভাতই খায় নি দুপুরে। 

রুনুঝুনু সকাল সকাল বই নিয়ে বসতগলার সমস্ত জোর দিয়ে পড়ত দুজনেবাবা কিছুক্ষণ বসতেন তাদের কাছে, আবার যেতেন রান্নাঘরে রাবেয়ার কাছেকিছুক্ষণ পরই আবার উঠে আসতেন আমার কাছেইতস্তত করে নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপার উথাপন করতেন, খােকা, তােদর কলেজে মেয়েপ্রফেসর আছে

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৫

আছেবিয়ে হয়েছে নাকি

হয়েছে কারাে কারােসবগুলির নিশ্চয়ই হয় নিকলেজের মেয়েপ্রফেসরদের বিয়ে হয় না। 

কিংবা হয়তাে জিজ্ঞেস করেন, তোের কোনাে দিন রাতের বেলা পানির পিপাসা পায়

পায় মাঝে মাঝেকী করিস তখন?. পানি খাইআর কী করব

খালি পেটে পানি খেতে নেই, এর পর থেকে বিস্কুট এনে রাখবিআধখান খেয়ে এক ঢােক পানি খাবি, বুঝলি তাে

বুঝেছি‘ 

কথা বলার জন্যেই কথা বলামাঝে মাঝে মার উপর বিরক্ত লাগতকেন, আমরা কী দোষ করেছি? এমন করবেন কেন আমাদের সাথে

অবশ্যি বিপরীত ব্যাপারও হয়! অদ্ভুত প্রসন্নতায় মা ভরে ওঠেনবেছে বেছেশাড়ি পরেনলম্বা বেণী করে চুল বাঁধেনমন্টু অবাক হয়ে বলে, মা, তােমাকে অন্য বাড়ির মেয়ের মতাে লাগছে‘ 

মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী বললি মন্টু?‘ 

বললাম, তােমাকে অন্যরকম লাগছেতুমি যেন বেড়াতে এসেছ আমাদের বাড়ি‘ 

রুনু বলে ওঠে, মন্টুটা বড়াে বােকা, তাই না মা?’ 

মা হেসে হেসে রাবেয়াকে জিজ্ঞেস করেন, রাবেয়া, তাের গান ভালাে লাগে ? | হ্যাঁ মা, খুউব”  

আমার বড়দাও ভারি গানপাগল ছিলেনরােজ রাতে আমরা ছাপে •সে বাজাতামচিন্ময়ের রবীন্দ্রসংগীত যা ভালােবাসত বড়দা!” 

মা, তুমিও তাে গান জান! তােমার নাকি রেকর্ড আছে গানের?‘ 

মা রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে অল্প অল্প হাসেন, খুশি খুশি গলায় বলেন, স্কুলে যখন পড়ি, তখন রেকর্ড হয়েছিলমেসবাহউদ্দিন ছিলেন তখন রেডিওর রিজিওনাল ডাইরেক্টরতিনিই সব করিয়েছিলেনএক পিঠে আমার, এক পিঠে পিনু হকেরপিনু হককে চিনিস না? এখন তাে সিনেমায় খুব প্লেব্যাক গায়খুব নাকি নামডাকতখন এতটুকু মেয়ে, আমার চেয়েও ছােট

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৫

 যদিও আমরা সবাই জানতাম, গানের একটা রেকর্ড আছে, তবু গানটি শুনি নি কেউপুরনাে রেকর্ড বাজারে পাওয়া যেত নানানার বাড়িতে যেকপিটি আছে, সেটি আনার কথা কখনাে মনে পড়ে নিমা কিন্তু কোনাে দিন গান গেয়ে শােনান নি, এমন কি ভুল করেও নয়| মার প্রসন্ন দিনগুলির জন্যে আমরা আগ্রহে অপেক্ষা করতামকি ভালােই না বা নিজে তাে মহাখুশি, কি যে করবেন ভেবেই যেন পাচ্ছেন নাঅফিসের কোন কলগ কি করেছে, তাই কমিক করে হাসাতেন আমাদেরবাবা খুব ভালাে 

করতে পারতেনঅফিসের ছােটাবু কেমন করে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বড়াে বার চেম্বারে হাজিরা দিতেনতা এত সুন্দর দেখাতেন! হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তাম আমরামা বলতেন, আর নয়, পেট ব্যথা করছে আমারঝুনু চোখ বড়াে বড়াে করে বলত, রাবেয়া আপা, বাবা খুব ভালাে জোকার, তাই না

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৬

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *