মা আসতেন আরাে কিছু পরে। খুব কম সময় থাকতেন। আমরা বেরিয়ে আসতাম সবাই। একসময় দেখতাম মুখ কালাে করে মামা উঠে যেতেন। মা শুয়ে শুয়ে কাঁদতেন সারা দুপুর। আমরা মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। কিছুই ভালাে। লাগত না। সেই অল্পবয়সেই মাকে কি গভীর ভালােই না বেসেছিলাম!
অথচ তিনি ছিলেন খুবই নিরাসক্ত ধরনের। কথাবার্তা বলতেন কম। নিঃশব্দে হাঁটতেন। নিচু গলায় কথা বলতেন। মাঝে মাঝে মনে হত, বড় রকমের হতাশায় ডুবে গেছেন। তখন সময় কাটাতেন বিছানায় শুয়ে শুয়ে। প্রয়ােজনের কথাটিও বলতেন না। ঘরের কাজ রাবেয়া আর একটা ঠিকে ঝি মিলে করত। বিষন্নতায় ডুবে যেত সারা বাড়ি।
বাবা অফিস থেকে এসে চুপচাপ বসে থাকতেন বারান্দায়। রাবেয়া চা এনে দিত। বাবা ফিসফিস করে বলতেন, ‘তাের মাকে দিয়েছিস?
‘না, মা খাবে না। ‘আহা, দিয়েই দেখ না।‘ ‘ভাতই খায় নি দুপুরে।
রুনু–ঝুনু সকাল সকাল বই নিয়ে বসত। গলার সমস্ত জোর দিয়ে পড়ত দু’ জনে। বাবা কিছুক্ষণ বসতেন তাদের কাছে, আবার যেতেন রান্নাঘরে রাবেয়ার কাছে। কিছুক্ষণ পরই আবার উঠে আসতেন আমার কাছে। ইতস্তত করে নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপার উথাপন করতেন, ‘খােকা, তােদর কলেজে মেয়ে–প্রফেসর আছে?
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৫
‘আছে।‘ ‘বিয়ে হয়েছে নাকি?
হয়েছে কারাে কারাে।‘ ‘সবগুলির নিশ্চয়ই হয় নি। কলেজের মেয়ে–প্রফেসরদের বিয়ে হয় না।
কিংবা হয়তাে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোের কোনাে দিন রাতের বেলা পানির পিপাসা পায়?
পায় মাঝে মাঝে। “কী করিস তখন?”. ‘পানি খাই। আর কী করব?
খালি পেটে পানি খেতে নেই, এর পর থেকে বিস্কুট এনে রাখবি। আধখান খেয়ে এক ঢােক পানি খাবি, বুঝলি তাে?
‘বুঝেছি।‘
কথা বলার জন্যেই কথা বলা। মাঝে মাঝে মার উপর বিরক্ত লাগত। কেন, আমরা কী দোষ করেছি? এমন করবেন কেন আমাদের সাথে?
অবশ্যি বিপরীত ব্যাপারও হয়! অদ্ভুত প্রসন্নতায় মা ভরে ওঠেন। বেছে বেছে। শাড়ি পরেন। লম্বা বেণী করে চুল বাঁধেন। মন্টু অবাক হয়ে বলে, ‘মা, তােমাকে অন্য বাড়ির মেয়ের মতাে লাগছে।‘
মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী বললি মন্টু?‘
বললাম, তােমাকে অন্যরকম লাগছে। তুমি যেন বেড়াতে এসেছ আমাদের বাড়ি।‘
রুনু বলে ওঠে, ‘মন্টুটা বড়াে বােকা, তাই না মা?’
মা হেসে হেসে রাবেয়াকে জিজ্ঞেস করেন, ও রাবেয়া, তাের গান ভালাে লাগে ? | ‘হ্যাঁ মা, খুউব।”
‘আমার বড়দাও ভারি গানপাগল ছিলেন। রােজ রাতে আমরা ছাপে •সে ৬ বাজাতাম। চিন্ময়ের রবীন্দ্রসংগীত যা ভালােবাসত বড়দা!”
‘মা, তুমিও তাে গান জান! তােমার নাকি রেকর্ড আছে গানের?‘
মা রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে অল্প অল্প হাসেন, খুশি খুশি গলায় বলেন, ‘স্কুলে যখন পড়ি, তখন রেকর্ড হয়েছিল। মেসবাহউদ্দিন ছিলেন তখন রেডিওর রিজিওনাল ডাইরেক্টর। তিনিই সব করিয়েছিলেন। এক পিঠে আমার, এক পিঠে পিনু হকের। পিনু হককে চিনিস না? এখন তাে সিনেমায় খুব প্লেব্যাক গায়। খুব নাকি নামডাক। তখন এতটুকু মেয়ে, আমার চেয়েও ছােট।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৫
যদিও আমরা সবাই জানতাম, গানের একটা রেকর্ড আছে, তবু গানটি শুনি নি কেউ। পুরনাে রেকর্ড বাজারে পাওয়া যেত না। নানার বাড়িতে যে–কপিটি আছে, সেটি আনার কথা কখনাে মনে পড়ে নি। মা কিন্তু কোনাে দিন গান গেয়ে শােনান নি, এমন কি ভুল করেও নয়। | মার প্রসন্ন দিনগুলির জন্যে আমরা আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। কি ভালােই না ল‘ণ‘ বা নিজে তাে মহাখুশি, কি যে করবেন ভেবেই যেন পাচ্ছেন না। অফিসের কোন কলগ কি করেছে, তাই কমিক করে হাসাতেন আমাদের। বাবা খুব ভালাে
ব করতে পারতেন। অফিসের ছােটাবু কেমন করে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বড়াে বার চেম্বারে হাজিরা দিতেন––তা এত সুন্দর দেখাতেন! হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তাম আমরা। মা বলতেন, আর নয়, পেট ব্যথা করছে আমার। ঝুনু চোখ বড়াে বড়াে করে বলত, রাবেয়া আপা, বাবা খুব ভালাে জোকার, তাই না?
Read More