রাবেয়া রেগে গিয়ে বলত, মারব থাপ্পড়। বাবাকে জোকার বলছে! দেখছ বাবা–মেয়ের কেমন ফিচলে বুদ্ধি হয়েছে?
বাবা বলতেন, ‘ঝুনুর আমার এই এতটা বুদ্ধি। যাও তাে রুনু–ঝুনু, একটু নাচ দেখাও।
কিটকির কাছে শেখা আনাড়ি নাচ নাচত দু‘ জনে। মা মুখে মুখে তবলার বােল দিতেন। বাবা বলতেন, ‘বাহা রে বেটি, বাহা। কী সুন্দর শিখেছে, বাহ্ বাহ! এবার মন্টু সােনা, একটি গান গাও।
বলার অপেক্ষামাত্র––মন্টু যেন তৈরি হয়েই ছিল, সঙ্গে সঙ্গে শুরু––
কাবেরী নদীজলে.–। শুধু এই গানটির সে ছয় লাইন জানে! ছয় লাইন শেষ হওয়ামাত্র বাবা বলতেন, ঘুরেফিরে ঘুরেফিরে!‘
মন্টু ঘুরেফিরে একই কলি বার বার গাইত। ভালাে গানের গলা ছিল। ছেলেমানুষ হিসেবে গলা অবশ্যি মােটা, চড়ায় উঠতে পারত না, তবে চমৎকার সুরজ্ঞান ছিল। | মাঝামাঝি সময়ে দেখা যেত রাবেয়া এক ফাঁকে চা বানিয়ে এনেছে। বিশেষ উপলক্ষ বলেই রুনুঝুনু–মন্টু আধ কাপ করে চা পেত সেদিন। সুখের সময়গুলি
খুব ছােট বলেই অসম্ভব আকর্ষণীয় ছিল। ফুরিয়ে যেত সহজেই, কিন্তু সৌরভ থাকত অনেক অ–নে–ক দিন।
ভাবতে ভাবতে রাত বেড়ে গেল। মানুষের চিন্তা যতই অসংলগ্ন মনে হােক, কিন্তু তলিয়ে দেখলে সমস্ত কিছুতেই বেশ একটা ভালাে মিল দেখা যায়। বৃষ্টির রাতে গল্প বলা থেকে ভাবতে ভাবতে কোথায় চলে এসেছি। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। চারদিকে ভিজে আবহাওয়া, ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। বিদ্যুৎ–চমকানিতে ক্ষণিকের জন্য নীলাভ আলাে ছড়িয়ে পড়ছে। গলা পর্যন্ত চাদর টেনে ঘুমিয়ে পড়লাম।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৬
‘মা গাে, এত ঘুমুতেও পারেন ?
কিটকি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। ‘কাল সারা রাত ঘুমান নি, না?
‘দেরিতে ঘুমিয়েছি। তুই যে এত সকালে? শাড়ি পরেছিস, চিনতে পারছি না মােটেই। রীতিমতাে ভদ্রমহিলা।
‘আগে কী ছিলাম? ভদ্রলোেক?
না, ছিলি ভদ্রবালিকা। বেশ লম্বা দেখাচ্ছে শাড়িতে, কত লম্বা তুই? ‘পাঁট ফুট এক ইঞ্চি। ‘বস, মুখ ধুয়ে আসি।‘ কলঘরে যাওয়ার পথে রাবেয়ার সঙ্গে দেখা, চায়ের ট্রে নিয়ে যাচ্ছে ভেতরে।
ও খােকা, কিটকি বেচারি কখন থেকে বসে আছে, ঘুম ভাঙে না তাের। রাতে কি চুরি করতে গিয়েছিলি?
হাত–মুখ ধুয়ে এসে বসলাম কিটকির সামনে। সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে। ঠোঁটে হালকা করে লিপিষ্টিক, কপালে জ্বলজ্বল করছে নীল রঙের টিপ। কিটকি বলল, ‘বলুন তাে, কী জন্যে এই সাত–সকালে এসেছি?
‘কোনাে খবর আছে বােধ হয়?
বলুন না, কী খবর? দল বেঁধে পিকনিকে যাবি, তাই না? ‘কিছুটা ঠিক। আমরা ম্যানিলা যাচ্ছি।
কোথায় যাচ্ছিস?‘
‘ম্যানিলা। পাঁচ বৎসরের চুক্তিতে আৱা যাচ্ছেন এই ডিসেম্বরে। কী যে ভালাে লাগছে আমার।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৬
খুশিতে ঝলমল করে উঠল কিটকি। বুকে ধক করে একটা ধাক্কা লাগল আমার। খুব খুশি লাগছে তাের?
‘হ্যাঁ, খুব। ‘আমাদের জন্যে খারাপ লাগবে না? ‘লাগবে না কেন, খুব লাগবে। আমি চিঠি লিখব সবাইকে। ‘কিটকি, দেখি তাের হাত। ‘হাত কি দেখবেন ? ইতস্তত করে হাত বাড়িয়ে দেয় কিটকি। লাল টুকটুকে এতটুকু ছােট্ট হাত।
‘হাত দেখতে জানেন আপনি? এত দিন বলেন নি তাে? ভালাে করে দেখবেন কিন্তু। সব বলতে হবে।
কিটকির নরম কোমল হাতে হাত রেখে আমি আশ্চর্য যাতনায় ছটফট করতে থাকি।।
‘কী দেখলেন বলুন? বলুন না।
ও এমনি, আমি হাত দেখতে জানি না।‘ তবে যে দেখলেন?‘ ‘কি জন্যে দেখলাম, বুঝতে পারিস নি? তুই তাে ভারি বােকা। কিটকি হাসিমুখে বলল, ‘বুঝতে পারছি। ‘কী বুঝতে পারলি? ‘বুঝতে পারছি যে, আপনিও বেশ বােকা।
কিটকিরা ডিসেম্বরের ন’ তারিখে চলে গেল। এ্যারােড্রামে অনেক লােক হয়েছিল। রাবেয়াকে নিয়ে আমিও গিয়েছিলাম
Read More