‘বল।‘ | ‘বিয়ে–টিয়ে করতে আমার একটুও ইচ্ছে হয় না। ওটা একটা বাজে ব্যাপার। অজানা–অচেনা একটা ছেলের সঙ্গে শুয়ে থাকা, ছিঃ।
রিক্সা দ্রুত চলছে। রাবেয়া চুপ করে বসে। রােদের লালচে আঁচে রাবেয়ার মুখটাও লালচে হয়ে উঠেছে। কী ভাবছে সে কে বলবে।
রুনু টেবিল–ল্যাম্প জ্বালিয়ে কী যেন একটা লিখছিল। আমাকে দেখেই হকচকিয়ে উঠে দাঁড়াল। লেখা কাগজটা সন্তর্পণে আড়াল করে বলল, ‘কি দাদা?
‘কোথায় কি ? কী করছিলি?‘
রুনু টেনে টেনে বলল, ‘অঙ্ক করছিলাম।‘ বলতে গিয়ে যেন কথা বেধে গেল মুখে। একটু বিস্মিত হয়েই বেরিয়ে এলাম। রুনু কি কাউকে ভালােবাসার কথা। লিখছে? বিচিত্র কিছু নয়। ওর যা স্বভাব, অকারণেই একে–ওকে চিঠি লিখে।
ফেলতে বাধবে না। রুনু–ঝুনু দু’ জনেই মস্ত বড়াে হয়েছে। আগের চেহারার কিছুই অবশিষ্ট নেই। স্বভাবও বদলেছে কিছুটা। দুজনেই অকাতরে হাসে। সারা দিন ধরেই হাসির শব্দ শুনি। কিছু–না–কিছু নিয়ে খিলখিল লেগেই আছে।
‘ও মাগাে, ঝুনুকে এই শাড়িতে কাজের বেটির মতাে লাগছে! হি হি হি!’
ও রুনু, দেখ দেখ, রাবেয়া আপা কী করছে, হি হি হি।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৮
‘আপা শােন, আজ সকালে কি হয়েছে, আমি––হি হি হি, রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি––হি হি হি
আবার অতি সামান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। কিছুক্ষণের ভেতর আবার মিটমাট। লুকিয়ে লুকিয়ে ম্যাটিনিতে সিনেমা দেখা। সাজগােজের দিকে প্রচণ্ড নজর। সব মিলিয়ে বেশ একটা দ্রুত পরিবর্তন। আগের যে রুনু–ঝুনুকে চিনতাম, এরা যেন সেই রুনু–ঝুনু নয়। বিশেষ করে সেই গােপন চিঠিলেখার
ভঙ্গিটা খট করে চোখে লাগে।
রাবেয়া মােড়ায় বসে সােয়েটার সেলাই করছিল। তাকে বললাম, আচ্ছা, কোনাে ছেলের সঙ্গে কি রুনুর চেনাজানা হয়েছে নাকি?‘
রাবেয়া কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘কিটকির কথা রাত দিন ভেবে ভেবে তাের এমন হয়েছে। কিটকির চিঠি পাস নি নাকি?”
‘না, আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। শরীফ সাহেবের ছেলেটা দেখি প্রায়ই আসে, মনসুর বােধ হয় নাম।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৮
‘আসে আসুক না। যখন ন্যাংটা থাকত, তখন থেকে এ বাড়িতে এসে খেলেছে রুনু–ঝুনুর সঙ্গে।
‘যখন খেলেছে তখন খেলেছে। এখন রুনু–ঝুনুও বড়াে হয়েছে, ও নিজেও বড়াে হয়েছে।‘
‘কি বাজে ব্যাপার নিয়ে ফ্যাচ ফ্যাচ করছিস! বেশ তাে, যদি ভালােবাসাবাসি হয়, বিয়ে হবে। মনসুর চমৎকার ছেলে। ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করে কোথায় যেন চাকরিও পেয়েছে।
এক কথায় সমস্যার সমাধান করে রাবেয়া সেলাই–এ মন দিল।
মটারও ভীষণ পরিবর্তন হয়েছে। মস্ত জোয়ান। পড়াশােনায় তেমন মন নেই। প্রায়ই অনেক রাতে বাড়ি ফেরে। কি এক কায়দা বের করেছে, বাইরে থেকেই টুকুস করে বন্ধ দরজা খুলে ফেলে।
পত্রিকায় নাকি মাঝে মাঝে তার কবিতা ছাপা হয়। যেদিন ছাপা হয়, সেদিন লজ্জায় মুখ তুলে তাকায় না। যেন মস্ত অপরাধ করে ফেলেছে এমন হাব–ভাব। চমৎকার গানের গলা হয়েছে। গানের মাষ্টার রেখে শেখালে হয়তাে ভালাে গাইয়ে। হ‘ত। মাঝে মাঝে আপন মনে গায়। কোনাে কোনাে দিন নিজেই অনুরােধ করি,
মন্টু একটা গান কর তাে৷‘
কোনটা? ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে। ‘রবীন্দ্রসংগীত না, একটা আধুনিক গাই, শােন। ‘বাতি নিবিয়ে দে, অন্ধকারে গান জমবে।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৮
বাতি নিবিয়ে গান গাওয়া হয়। এবং গানের গলা শুনলেই বাবা টুকটুক করে হাজির। বাবার শরীর ভীষণ দুর্বল হয়েছে। হাঁপানি, বাত––সব একসঙ্গে চেপে ধরেছে। বিকেলবেলায় একটু হাঁটেন, বাকি সময় বসে বসে কাটে। রাবেয়া রাত আটটা বাজতেই গরম তেল এনে বুকে মালিশ করে দেয়। তখন বাবা বিড়বিড় করে আপন মনে কথা বলেন। রাবেয়া বলে, ‘একা একা কী বলছেন বাবা?
না মা, কিছু বলছি না, কী আর বলব।‘ একটু আরাম হয়েছে?
‘হবে না কেন মা? তাের মতাে মেয়ে যার আছে, তার হাজার দুঃখ–কষ্ট থাকলেও কিছু হয় না। লক্ষ্মী মা আমার। আমার সােনার মা।
Read More