‘আহ্ বাবা, কি বলেন, লজ্জা লাগে।‘ ‘তাহলে থাক। মনে মনে তাের গুণ গাই।‘ ‘বাবা চুপ করেন।‘
সবচেয়ে ছােট যে নিনু সেও দেখতে দেখতে বড়াে হয়ে গেল। মার চেয়েও রূপসী হয়েছে সে। পাতলা ঠোট, একটু থ্যাবড়া নাক, বড়াে বড়াে ভাসা চোখ সব সময় ছলছল করছে। ঐ তাে সেদিন হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াত। থ থ থ বলে আপন মনে গান করত, আর আজ একা একা স্কুলে যায়। সাবলীল গর্বিত হাঁটার ভঙ্গি। একটু পাগলাটে হয়েছে সে। স্কুল থেকে ফিরে এসেই বই–খাতা ছুঁড়ে ফেলে মেঝেতে, তারপর জাপটে ধরে রাবেয়াকে।
‘ছাড় ছাড়, কি করিস? ছাড়। ‘না, ছাড়ব না।‘ ‘কী বাজে অভ্যেস হয়েছে তাের! ‘হােক।‘
‘হাত–মুখ ধুয়ে চা খা। ‘পরে খাব, এখন তােমাকে ধরে রাখব।
বেশ থাক ধরে। ‘রাবেয়া আপা। ‘কি? ‘কোলে নাও। ‘এত বড়াে মেয়ে, কোলে নেব কি রে বোেকা! ‘না–না, নিতেই হবে।
তারপর দেখি নিনু রাবেয়ার কোলে উঠে লাজুক হাসি হাসছে। আমার সঙ্গেও বেশ ভাব হয়েছে তার। রাতের খাওয়া–দাওয়া হয়ে গেলে আমার বিছানায় উঠে এসে বালিশ নিয়ে কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে।
‘কি হচ্ছে রে নিনু? ‘যুদ্ধ–যুদ্ধ খেলছি। দাদা। ‘কি?‘ ‘গল্প বলবে কখন? ‘আরাে পরে, এখন পড়াশােনা কর। ‘না, আমি পড়ব না, যুদ্ধ–যুদ্ধ খেলব।‘
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৯
বেশ খেল। ‘তুমি খেলবে, দাদা?
আস না? এই বালিশটা তুমি নাও। হ্যাঁ, এবার মার তাে দেখি আমাকে?
রাবেয়ার আগের হাসিখুশি ভাব আর নেই। সারাক্ষণ দেখি একা একা থাকে। অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘরে বাতি জ্বলে। রাত জেগে সে কী করে কে জানে? রাবেয়াটার জন্যে ভারি কষ্ট হয়। বিয়ে করল না শেষ পর্যন্ত। মেঘে মেঘে বেলা তাে আর কম হয় নি। আমি মনে–প্রাণে চাই তাকে হাসিখুশি রাখতে। মাঝে মাঝে বলি, ‘রাবেয়া সিনেমা দেখবি?”
“না।” ‘চল না, যাই সবাই মিলে। কত দিন ছবি দেখি না। ‘তুই যা রুনু–ঝুনুদের নিয়ে––কত কাজ ঘরের। ‘যা কাজ, রুনু–ঝুনুই করতে পারবে। আয়, তুই আর আমি দু জনে যাই। ‘না রে, ইচ্ছে করছে না। ‘তাহলে চল, একটু বেড়িয়ে আসি।
কোথায়?
‘তুই যেখানে বলিস। ‘আজ থাক।
আমি অস্বস্তিতে ছটফট করি। রাবেয়ার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও সাজ্জা হয়। যেন তার মানসিক দুঃখ–কষ্টের অনেকটা দায়ভাগ আমার।
এক দিন রাবেয়া নিজেই বলল, ‘চল খােকা, বেড়িয়ে আসি।
আমি খুশি হয়ে বললাম, ‘চল, সারা দিন আজ ঘুরব। বল কোথায় কোথায় যাবি?
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১৯
‘প্রথম যাব আমার এক বন্ধুর বাসায়। একটা রিক্সা নে।”
রিক্সা যে–বাড়ির সামনে থামল, তা দেখে চমকালাম। রাজপ্রাসাদ নাকি? বাড়ির সামনে কি প্রকাণ্ড ফুলের বাগান। আমি বললাম, রাবেয়া, তুই ঠিক জায়গায় এসেছিস তাে? কার বাড়ি এটা?
‘আবিদ হােসেনের, ঐ যে ছােটবেলায় আমাকে গাড়িতে করে স্কুলে পৌছে
‘বাসা কী করে চিনলি ? ‘এসেছিলাম তাে তাঁর সঙ্গে বাসায়।
আবিদ হােসন বাসায় ছিলেন না। এক জন বিদেশিনী মহিলা খুব আন্তরিকভাবে আমাদের বসতে বললেন। কী দরকার, বারবার জিজ্ঞেস করলেন। চমৎকার বাংলা বলেন তিনি।
রাবেয়া বলল, ‘কোনাে প্রয়ােজন নেই। এমনি বেড়াতে এসেছি। ছােটবেলায় তিনি আমার খুব বন্ধু ছিলেন।
ভদ্রমহিলা কফি করে খাওয়ালেন। বেরিয়ে আসবার সময় মস্ত বড়াে বড়াে ক’টি গােলাপ তুলে তােড়া করে দিলেন রাবেয়ার হাতে। এক জন অপরিচিত বিদেশিনীর এমন ব্যবহার সত্যিই আশা করা যায় না।
রাবেয়া বেরিয়ে এসে বলল, ‘চল খােকা, এই ফুলগুলি মার কবরে দিয়ে আসি। এই তিনটা দিবি তুই, বাকি তিনটা দেব আমি।
Read More