এখান থেকে মায়ের অস্পষ্ট কান্না শােনা যাচ্ছে। কিছু কিছু কান্না আছে, যা শুনলেই কষ্টটা সম্বন্ধে শুধু যে একটা ধারণাই হয় তাই নয়, ঠিক সেই পরিমাণ কষ্ট নিজেরও হতে থাকে। আমার সেই ধরনের কষ্ট হতে থাকল।
রাবেয়া এসে রুনুর ঘরের তালা খুলে দিল। রাবেয়া বেচারি ভীষণ ভয় পেয়েছে।
‘তুই এত দেরি করলি খােকা, এখন কী করি বল? ওভারশীয়ার কাকুর বউকে খবর দিয়েছি, তিনি ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে আসছেন। তুই সবাইকে নিয়ে। খেতে আয়, শুধু ডালভাত। যা কাণ্ড সারা দিন ধরে, রাঁধব কখন? মার মেজাজ এত খারাপ আগে হয় নি।
হড়বড় করে কথা শেষ করেই রাবেয়া রান্নাঘরে চলে গেল। কলঘরে যেতে হয় মার ঘরের সামনের বারান্দা দিয়ে। চুপি চুপি পা ফেলে যাচ্ছি, মা তীক্ষ্ণ গলায় ডাকলেন, ‘খােকা।
কি মা? ‘তাের বাবা এসেছে?
‘আয় ভেতরে, বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২
ব্যথাটা বােধহয় কমেছে। সহজভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মার মুখে বিন্দু বিন্দু। ঘাম আর ফ্যাকাশে ঠোট ছাড়া অসুস্থতার আর কোনাে লক্ষণ নেই। ‘খােকা, মন্টু এসেছে? ‘এসেছে।
আর রুনুর ঘর খুলে দিয়েছে রাবেয়া? ‘দিয়েছে।‘ ‘যা, ওদের নিয়ে আয়।
রুনু ঝুনু আর মন্টু জড়সড় হয়ে দাঁড়াল সামনে। কিছুক্ষণ চুপ থেকেই মা বললেন, ‘কাঁদছ কেন রুনু?
‘কাঁদছি না তাে।‘ ‘বেশ, চোখ মুছে ফেল। ভাত খেয়েছ?
‘যাও, ভাত খেয়ে ঘুমাও গিয়ে। মন্টু বলল, ‘মা, আমি বাবার জন্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকব? ‘না–না। ঘুমাও গিয়ে। রুনু মা, কাঁদছ কেন তুমি? ‘কাঁদছি না তাে।‘ ‘আমার কিছু হয় নি, সবাই যাও, ঘুমিয়ে পড়। যাও, যাও।
ঘর থেকে বেরিয়েই কেমন যেন খারাপ লাগতে লাগল আমার। আমাদের এই গরিব ঘর, বাবার অল্প মাইনের চাকরি। এর ভেল মা যেন সম্পূর্ণ বেমানান।
বাবার সঙ্গে তাঁর যখন বিয়ে হয় তিনি এখন ইতিহাসে এম. এ. পরীক্ষা দেবেন। আর বাবা তাঁদের বাড়িরই আশ্রিত। গ্রামের কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করে চাকরি খুঁজতে এসেছেন শহরে। তাঁদের কী–যেন আত্মীয় হন।
বিয়ের পর এই বাড়িতে এসে ওঠেন দু জন। মার পরীক্ষা দেওয়া হয় নি। কিছু দিন কোনাে এক স্কুলে মাষ্টারি করেছেন। সেটি ছেড়ে দিয়ে ব্যাঙ্কে কী–একটা চাকরিও নেন। সে চাকরি ছেড়ে দেন আমার জন্মের পরপর। তারপর একে একে রুনু হল, ঝুনু হল, মন্টু হল––মা গুটিয়ে গেলেন নিজের মধ্যে।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২
সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে মা আমাদের গরিব ঘরে এসেছেন বলেই তাঁর সামান্য রূপের কিছু কিছু আমরা পেয়েছি। তার আশৈশব লালিত রুচির কিছুটা (ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ হলেও) সঞ্চারিত হয়েছে আমাদের মধ্যে। শুধু যার জন্যে ভূষিত হয়ে আছি, সেই ভালােবাসা পাই নি কেউ। রাবেয়ার প্রতি একটি গাঢ় মমতা ছাড়া আমাদের কারাে প্রতি তার কোনাে আকর্ষণ নেই। মার অনাদর খুব অল্প বয়সে টের পাওয়া যায়, যেমন আমি পেয়েছিলাম। রুনু ঝুনুও নিশ্চয়ই পেয়েছে। অথচ আমরা সবাই মিলে মাকে কী ভালােই না বাসি।
উকিল সাহেবের বাসায় টেলিফোন আছে। সেখান থেকে ছােট খালার বাসায় টেলিফোন করলাম। ছােট খালা বাসায় ছিলেন না, ফোন ধরল কিটকি।
‘কী হয়েছে বললেন খােকা ভাই?”
‘মার শরীর ভালাে নেই। “কী হয়েছে খালার?”
কী হয়েছে বলতে গিয়ে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল, এদিকে উকিল সাহেব আবার কান খাড়া করে শুনছেন কী বলছি। কোনাে রকমে বললাম, ‘মার ছেলে হবে কিটকি।
‘আপনাদের তাে ভারি মজা, কতগুলি ভাই–বােন। আমি একদম একা। ‘কিটকি, খালাকে সকাল হলেই বাসায় এক বার আসতে বলবে। ‘হ্যাঁ বলব। আমিও আসব––
মার বাড়ির লােকজনের ভেতর এই একটিমাত্র পরিবারের সঙ্গে আমাদের কিছুটা যােগাযােগ আছে। ছােট খালা আসেন মাঝে মাঝে। কিটকির জন্মদিন, পুতুলের বিয়ে––এই জাতীয় উৎসব গুলিতে দাওয়াত হয় রুনু–ঝুনুর।
Read More