হুমায়ূন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২

এখান থেকে মায়ের অস্পষ্ট কান্না শােনা যাচ্ছেকিছু কিছু কান্না আছে, যা শুনলেই কষ্টটা সম্বন্ধে শুধু যে একটা ধারণাই হয় তাই নয়, ঠিক সেই পরিমাণ কষ্ট নিজেরও হতে থাকে। আমার সেই ধরনের কষ্ট হতে থাকল

শঙ্খনীল কারাগার 

রাবেয়া এসে রুনুর ঘরের তালা খুলে দিলরাবেয়া বেচারি ভীষণ ভয় পেয়েছে। 

তুই এত দেরি করলি খােকা, এখন কী করি বল? ওভারশীয়ার কাকুর বউকে খবর দিয়েছি, তিনি ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে আসছেনতুই সবাইকে নিয়েখেতে আয়, শুধু ডালভাতযা কাণ্ড সারা দিন ধরে, রাঁধব কখন? মার মেজাজ এত খারাপ আগে হয় নি। 

হড়বড় করে কথা শেষ করেই রাবেয়া রান্নাঘরে চলে গেলকলঘরে যেতে হয় মার ঘরের সামনের বারান্দা দিয়েচুপি চুপি পা ফেলে যাচ্ছি, মা তীক্ষ্ণ গলায় ডাকলেন, খােকা। 

কি মা? তাের বাবা এসেছে

আয় ভেতরে, বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?” 

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২

ব্যথাটা বােধহয় কমেছেসহজভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছেনমার মুখে বিন্দু বিন্দুঘাম আর ফ্যাকাশে ঠোট ছাড়া অসুস্থতার আর কোনাে লক্ষণ নেই। খােকা, মন্টু এসেছে? এসেছে। 

আর রুনুর ঘর খুলে দিয়েছে রাবেয়া? দিয়েছেযা, ওদের নিয়ে আয়। 

রুনু ঝুনু আর মন্টু জড়সড় হয়ে দাঁড়াল সামনেকিছুক্ষণ চুপ থেকেই মা বললেন, কাঁদছ কেন রুনু

কাঁদছি না তােবেশ, চোখ মুছে ফেলভাত খেয়েছ

যাও, ভাত খেয়ে ঘুমাও গিয়েমন্টু বলল, মা, আমি বাবার জন্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকব? নানাঘুমাও গিয়েরুনু মা, কাঁদছ কেন তুমি? কাঁদছি না তােআমার কিছু হয় নি, সবাই যাও, ঘুমিয়ে পড়যাও, যাও। 

ঘর থেকে বেরিয়েই কেমন যেন খারাপ লাগতে লাগল আমারআমাদের এই গরিব ঘর, বাবার অল্প মাইনের চাকরিএর ভেল মা যেন সম্পূর্ণ বেমানান। 

বাবার সঙ্গে তাঁর যখন বিয়ে হয় তিনি এখন ইতিহাসে এম. এ. পরীক্ষা দেবেনআর বাবা তাঁদের বাড়িরই আশ্রিতগ্রামের কলেজ থেকে বি. . পাশ করে চাকরি খুঁজতে এসেছেন শহরেতাঁদের কীযেন আত্মীয় হন। 

বিয়ের পর এই বাড়িতে এসে ওঠেন দু জনমার পরীক্ষা দেওয়া হয় নিকিছু দিন কোনাে এক স্কুলে মাষ্টারি করেছেনসেটি ছেড়ে দিয়ে ব্যাঙ্কে কীএকটা চাকরিও নেনসে চাকরি ছেড়ে দেন আমার জন্মের পরপরতারপর একে একে রুনু হল, ঝুনু হল, মন্টু হলমা গুটিয়ে গেলেন নিজের মধ্যে। 

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২

সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে মা আমাদের গরিব ঘরে এসেছেন বলেই তাঁর সামান্য রূপের কিছু কিছু আমরা পেয়েছিতার আশৈশব লালিত রুচির কিছুটা (ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ হলেও) সঞ্চারিত হয়েছে আমাদের মধ্যেশুধু যার জন্যে ভূষিত হয়ে আছি, সেই ভালােবাসা পাই নি কেউরাবেয়ার প্রতি একটি গাঢ় মমতা ছাড়া আমাদের কারাে প্রতি তার কোনাে আকর্ষণ নেইমার অনাদর খুব অল্প বয়সে টের পাওয়া যায়, যেমন আমি পেয়েছিলামরুনু ঝুনুনিশ্চয়ই পেয়েছেঅথচ আমরা সবাই মিলে মাকে কী ভালােই না বাসি। 

উকিল সাহেবের বাসায় টেলিফোন আছেসেখান থেকে ছােট খালার বাসায় টেলিফোন করলামছােট খালা বাসায় ছিলেন না, ফোন ধরল কিটকি। 

কী হয়েছে বললেন খােকা ভাই?” 

মার শরীর ভালাে নেইকী হয়েছে খালার?” 

কী হয়েছে বলতে গিয়ে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল, এদিকে উকিল সাহেব আবার কান খাড়া করে শুনছেন কী বলছিকোনাে রকমে বললাম, মার ছেলে হবে কিটকি। 

আপনাদের তাে ভারি মজা, কতগুলি ভাইবােনআমি একদম একাকিটকি, খালাকে সকাল হলেই বাসায় এক বার আসতে বলবেহ্যাঁ বলবআমিও আসব– 

মার বাড়ির লােকজনের ভেতর এই একটিমাত্র পরিবারের সঙ্গে আমাদের কিছুটা যােগাযােগ আছেছােট খালা আসেন মাঝে মাঝেকিটকির জন্মদিন, পুতুলের বিয়েএই জাতীয় উৎসব গুলিতে দাওয়াত হয় রুনুঝুনুর। 

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৩

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *