হুমায়ূন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২০

আয় যাই। 

বেশ কেটে যাচ্ছে দিনকিটকির চিঠি হঠাৎ মাঝে মাঝে এসে পড়েকেমন আছেন ভালাে আছি গােছেরএকঘেয়ে জীবনের মধ্যে এইটুকুই যেন ব্যতিক্রমহঠাৎ করে এক দিন সবার একঘেয়েমী কেটে গেল

মনসুরের বাবা এক সন্ধ্যায় বেড়াতে এসে অনেক ভণিতার পর বাবাকে বললেন, আপনার মেয়ে রুনুকে যদি দেন আমাদের কাছে, বড়াে খুশি হইমনসুরের নিজের খুব ইচ্ছামনসুরকে আপনি ছােটবেলা থেকেই দেখেছেনচাকরিও পেয়েছে চিটাগাং স্টীল মিলে, নয় টাকার মতাে বেতন, কোয়ার্টার আছেতা ছাড়া আপনার মেয়েরও মনে হয় কোনাে অমত নেই

শঙ্খনীল কারাগার 

বাবা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেনবারােই আশ্বিন বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেলএক মিনিটে বদলে গেল সারাটা বাড়িবাবার সমস্ত অসুস্থতা কোথায় যে পালাল! বিয়ে নিয়ে এর সঙ্গে আলাপ করা, ওর কাছে যাওয়া, বাজারের হাল অবস্থা দেখা

মেয়েকে কী দিয়ে সাজিয়ে দেবেন সে সম্বন্ধে খােজ নেওয়াএক মুহূর্ত বিশ্রামরইল না তাঁর। 

মন্টু তার বন্ধুদের নিয়ে এসে সারাক্ষণই হৈচৈ করছে। গেট কোথায় হবে, ইলেকট্রিকের বাল্বে সাজান হবে কি না, কার্ড কয়টি ছাপাতে হবে, নিমন্ত্রণের ভাষাটা কী রকম হবে, নিয়ে তার ব্যস্ততা প্রায় সীমাহীনরাবেয়াকে নিয়ে আমি কেনাকাটা করতে প্রায় প্রতিদিনই বেরিয়ে যাইঝুনুটা সারাক্ষণ আহ্লাদী করে বেড়ায়শীতের শুরুতে ঠাণ্ডা আবহাওয়াতে এমনিতেই একটু উৎসবের ছোঁয়াচ থাকে, বিয়ের উৎসবটা যুক্ত হয়েছে তার সাথে। 

 শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২০

রুনুর চাঞ্চল্য কমে গেছেহৈচৈ করার স্বভাব মুছে গেছে একেবারেসারা দিন শুয়ে শুয়ে গান শােনেএকটু যে কোথাও যাবে, আমাদের সঙ্গে কিংবা বাইরের বারান্দায় এসে বসবেতাও নয়। দুপুরটা কাটায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়েবড় ভালাে লাগে দেখেযদি বলি, কিরে রুনু, বিয়ের আগেই বদলে গেছিস দেখি। 

যাও দাদা, ভালাে লাগে নাতাের চিটাগাংএর বাড়িতে বেড়াতে গেলে খাতিরযত্ন করবি তাে? না, করব নাতােমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখব। 

রুনুর চোখ জ্বলজ্বল করেসারা শরীরে আসন্ন উৎসবের কী গভীর ছায়ামনসুর দেখি প্রায়ই আসেএক দিন সিনেমার টিকেট নিয়ে এল রুনুঝুনুর জন্যেরুনু কিছুতে যাবে নারুনু বলে, নিনুকে নিয়ে যাকনিও যাবে না, আমার জন্যে 

তাে আনে নিআমি কেন যাব?’ 

এই বয়সেই পাকা পাকা কথা| এক দিন সে মনসুরের সঙ্গে হেসে হেসে সারা দুপুর গল্প করেছে, আজকে তার সাড়া পেলেই রুনু বন্দী হয়ে যায় নিজের ঘরেরাবেয়া হেসে হেসে বলে, বেচারা বসে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিঝি ধরিয়ে ফেলেছে, রুনু যা, বেচারাকে দর্শন দিয়ে আয়। 

থাকুক বসে, আমি যাচ্ছি না‘ 

কেন যাবি না? রােজ রােজ বেহায়ার মতাে আসবে, লজ্জা লাগে না বুঝি? ঝুনু আর নিনুকে নিয়ে গল্প করে বেচারা সময় কাটায়। 

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২০

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এসে পড়লবাবার দুজন ফুফু এলেন, তাঁর চাচাত ভাইও ছেলেমেয়ে নিয়ে এলেনবাড়ি লােকজনে গমগম করতে লাগলমন্টু 

কোথেকে একটি রেকর্ডপ্লেয়ার এনেছেসেখানে তারস্বরে রাতদিন আশুনিক গান হচ্ছেফুফুর ছেলেমেয়ে টির হল্লায় কান পাত যাচ্ছে না, আশেপাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরাও যােগ দিয়েছে তাদের সঙ্গেপাড়ার ছেলেরা নিজেরাই বাঁশ কেটে ম্যারাপ বাঁধার যােগাড় করছেবেশ লাগছেউৎসবের নেশাধরান আমেজকলেজ থেকে সাত দিনের ছুটি নিয়ে নিলাম। 

তিন দিন পর বিয়েদম ফেলার ফুরসৎ নেইদুপুরের ঘুম বিসর্জন দিয়ে কিসের যেন হিসেব কষছিরাবেয়া পাশেই বসেরুনু, ঝুনু আর ফুফুর দুমেয়ে লুডু খেলছে বসে বসেবাবা গেছেন নানার বাড়িনিনুটা এল এমন সময়হাসিমুখে বলল, দাদা, তােমাকে ডাকে। 

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২০

কে? নতুন দুলাভাই ইঞ্জিনীয়ার সাহেব। 

রুনু লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। রাবেয়া বলে বসে, আহা, বেচারার আর তর সইছে নাআমি স্যাণ্ডেল পায়ে নিচে নামিবসার ঘরে মনসুর মুখ নিচু করে বসেআমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। 

কী ব্যাপার ভাই? কিছু বলবে

ঝুনু দরজার ফাঁক দিয়ে উকি দিতে লাগলমনসুর বলল, আপনি যদি একটু বাইরে আসেন, খুব জরুরী। 

আমি চমকে উঠলামকিছু কি হয়েছে এর মধ্যে? ঘরে না, আসেন চায়ের দোকানটায় বসি। 

মনুসুরের মুখ শুকনােচোখের নিচে কালি পড়েছেঅপ্ৰকৃতস্থের মতাে চাউনিচায়ের দোকানে বসে সে কাশতে লাগলআমি বললাম, কী ব্যাপার, খুলে বল। 

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২১

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *