হুমায়ূন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২২

বারােই আশ্বিন ঝুনুর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল মনসুরের। 

বাবা আর রাবেয়ার প্রবল মতের সামনে টিকতে পারলাম নানু বেশ অবাক হয়েছিলতাকে কিছু বলা হয় নি, তবে সে যে আচ করতে পেরেছেতা বােঝা যাচ্ছিলঝুনু যতটা আপত্তি করবে মনে করেছিলাম, ততটা করে নি দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছি

শঙ্খনীল কারাগার

আত্মীয়স্বজনরা কী বুঝল কে জানে, বিশেষ উচ্চবাচ্য করল নাশুধু মন্টু বিয়ের আগের দিন বাসা ছেড়ে চলে গেলতার নাকি কোথায় যাওয়া অত্যন্ত প্রয়ােজন, বিয়ের পর ফিরবেবাবা স্থবির আলস্যে ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে সিগারেট 

টানতে লাগলেন। 

বিয়েতে রুনুটা আহ্লাদ করল সবচেয়ে বেশিগান গেয়ে গল্প বলে আসর জমিয়ে রাখলতার জন্যে ফুফুর ফাজিল মেয়েটা পর্যন্ত ঢং করার সুযােগ পেল নাআসর ভাঙল অনেক রাতেছােট ছােট ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছেমেয়েরা আড়ি পেতেছে বাসরঘরেবরযাত্রীরা হৈচৈ করে করে তাস খেলছেসারা দিনের পরিশ্রমে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম

সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে রুনুর ঘরে এসে দাঁড়ালামটেবিল ল্যাম্পে শেড দিয়ে রেখেছেঘরে আড়াআড়িভাবে একটা লম্বা ছায়া পড়েছেআমাররুনুর মুখ দেখা যাচ্ছে নাএলােমেলাে হয়ে পড়ে থাকা তার অবসন্ন শরীর চুপচাপ পড়ে আছে। আমি নিঃশব্দে বসলাম রুনুর পাশেরুনু চমকে উঠে বলল, কে? , দাদাকখন এসেছ? কী হয়েছে

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২২

না, কিছু হয় নিভাবলাম তাের সঙ্গে একটু গল্প করি‘ 

রুনু অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকেহঠাৎ করেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলতে লাগল, তােমার গা ছুঁয়ে বলছি দাদা, আমার একটুও খারাপ লাগছে নাআমি বেশ আছি‘ 

সবুজকে বিয়ে করবি রুনু? নাছিঃ !‘ 

না কেন?নাকক্ষনাে না, ওটা একটা বদমাশ‘ 

তবে যে চিঠি লিখেছিলি? এমনি, তামাসা করতে, যে লিখত খালি খালিআয় রুন, বাইরে হাঁটি একটু, দেখ কি জোছন‘ 

রুনু জানালা দিয়ে বাইরে তাকালসত্যি অপরূপ জোছনায় সব যেন ভেসে যাচ্ছেচারদিক চিকচিক করছে নরম আলােয়আপনাতেই মনের ভেতর একটা বিষন্নতা জমা হয়আমি বললাম, এটা কী মাস বল তাে রুনু। 

অক্টোবর মাসবাংলা বলবাংলাটা জানি নাফাল্গুন

না, আশ্বিনআশ্বিন মাসে সবচেয়ে সুন্দর জোছনা হয়আয়, বাইরে গিয়ে দেখি‘ 

ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াতেই মন জুড়িয়ে গেলঝিরঝির করে বাতাস বইছেফুটফুটে জোছনা চারদিকেসব কেমন যেন স্বপ্নের মতাে মনে হয়বড়াে ভালাে লাগে| ‘ওটা কে দাদা? যে চেয়ারে বসে

তাকিয়ে দেখি কে যেন ইজিচেয়ারে মূর্তির মতাে বসে আছেএকটা হাত অবসন্নভাবে ঝুলছেঅন্য হাতটি বুকের উপর রাখাবসে থাকার সমস্ত ভঙ্গিটাই কেমন দীনহীন, কেমন দুঃখীআমি বললাম, হচ্ছে রাবেয়াচিনতে পারছিস 

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২২

না তােচল, আপার কাছে যাইনা, থাকুক একা একাআয়, এদিকে আয়‘ 

রুনু হাঁটতে হাঁটতে আমার একটা হাত ধরলছােটবেলায় যেমন করত, তেমনিভাবে হাতের আঙুল নিয়ে খেলা করতে করতে হাল্কা গলায় বলল, দাদা, তােমরা কি আমার ওপর বিরক্ত হয়েছ

কেন? চিঠি লিখেছি বলে ? তাের কী মনে হয়

রুনু কথা বলল নাচুপচাপ হাঁটতে থাকলআমি বললাম, রুনু, ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে

কোন কথা? তুই যে এক দিন পালিয়েছিলি

মনে আছেঝুনু একটা কাপ ভেঙে ফেলেছেভেঙেই দৌড়ে পালাল, আর আম্মা এসে আমার গালে ঠাস করে এক চড়। 

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২২

রুনু বলতে বলতে হাসতে লাগল। আমি বললাম, তারপর কি ঝামেলায়পড়লাম সবাইতাের কোনাে খোঁজ নেইসকাল গেল, দুপুর গেল, সন্ধ্যা গিয়ে রাত, তবু তাের খবর নেইবাসায় খাওয়াদাওয়া বন্ধবাবা সারা দিন খুঁজেছেন এখানে ওখানেআড়ালে আড়ালে চোখের পানি ফেলেছেনআমি থানায় খবর দিতে গেছি

মা কিন্তু বেশ স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয় নিআর ঝুনুটা করল কি, সন্ধ্যাবেলায় রাবেয়াকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে সে কী কান্নাকোনােমতে বলল, আপা আমিই ভেঙেছি কাপটা, রুনু ভাঙে নি‘ 

তাের সব মনে আছে রুনু?

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২৩

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *