বারােই আশ্বিন ঝুনুর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল মনসুরের।
বাবা আর রাবেয়ার প্রবল মতের সামনে টিকতে পারলাম না। বনু বেশ অবাক হয়েছিল। তাকে কিছু বলা হয় নি, তবে সে যে আচ করতে পেরেছে–––তা বােঝা যাচ্ছিল। ঝুনু যতটা আপত্তি করবে মনে করেছিলাম, ততটা করে নি দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছি।
আত্মীয়স্বজনরা কী বুঝল কে জানে, বিশেষ উচ্চবাচ্য করল না। শুধু মন্টু বিয়ের আগের দিন বাসা ছেড়ে চলে গেল। তার নাকি কোথায় যাওয়া অত্যন্ত প্রয়ােজন, বিয়ের পর ফিরবে। বাবা স্থবির আলস্যে ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে সিগারেট
টানতে লাগলেন।
বিয়েতে রুনুটা আহ্লাদ করল সবচেয়ে বেশি। গান গেয়ে গল্প বলে আসর জমিয়ে রাখল। তার জন্যে ফুফুর ফাজিল মেয়েটা পর্যন্ত ঢং করার সুযােগ পেল না। আসর ভাঙল অনেক রাতে। ছােট ছােট ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েরা আড়ি পেতেছে বাসরঘরে। বরযাত্রীরা হৈচৈ করে করে তাস খেলছে। সারা দিনের পরিশ্রমে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।
সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে রুনুর ঘরে এসে দাঁড়ালাম। টেবিল ল্যাম্পে শেড দিয়ে রেখেছে। ঘরে আড়াআড়িভাবে একটা লম্বা ছায়া পড়েছে। আমার। রুনুর মুখ দেখা যাচ্ছে না। এলােমেলাে হয়ে পড়ে থাকা তার অবসন্ন শরীর চুপচাপ পড়ে আছে। আমি নিঃশব্দে বসলাম রুনুর পাশে। রুনু চমকে উঠে বলল, ‘কে? ও, দাদা। কখন এসেছ? কী হয়েছে?
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২২
‘না, কিছু হয় নি। ভাবলাম তাের সঙ্গে একটু গল্প করি।‘
রুনু অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। হঠাৎ করেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলতে লাগল, তােমার গা ছুঁয়ে বলছি দাদা, আমার একটুও খারাপ লাগছে না। আমি বেশ আছি।‘
‘সবুজকে বিয়ে করবি রুনু? ‘না। ছিঃ !‘
না কেন?‘ ‘না–কক্ষনাে না, ওটা একটা বদমাশ।‘
তবে যে চিঠি লিখেছিলি? এমনি, তামাসা করতে, ও যে লিখত খালি খালি। ‘আয় রুন, বাইরে হাঁটি একটু, দেখ কি জোছন।‘
রুনু জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। সত্যি অপরূপ জোছনায় সব যেন ভেসে যাচ্ছে। চারদিক চিকচিক করছে নরম আলােয়। আপনাতেই মনের ভেতর একটা বিষন্নতা জমা হয়। আমি বললাম, ‘এটা কী মাস বল তাে রুনু।
‘অক্টোবর মাস। ‘বাংলা বল।‘ ‘বাংলাটা জানি না। ফাল্গুন?
‘না, আশ্বিন। আশ্বিন মাসে সবচেয়ে সুন্দর জোছনা হয়। আয়, বাইরে গিয়ে দেখি।‘
ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াতেই মন জুড়িয়ে গেল। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে। ফুটফুটে জোছনা চারদিকে। সব কেমন যেন স্বপ্নের মতাে মনে হয়। বড়াে ভালাে লাগে। | ‘ওটা কে দাদা? ঐ যে চেয়ারে বসে?
তাকিয়ে দেখি কে যেন ইজিচেয়ারে মূর্তির মতাে বসে আছে। একটা হাত অবসন্নভাবে ঝুলছে। অন্য হাতটি বুকের উপর রাখা। বসে থাকার সমস্ত ভঙ্গিটাই কেমন দীন–হীন, কেমন দুঃখী। আমি বললাম, ও হচ্ছে রাবেয়া। চিনতে পারছিস ?
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২২
‘না তাে। চল, আপার কাছে যাই। “না, ও থাকুক একা একা। আয়, এদিকে আয়।‘
রুনু হাঁটতে হাঁটতে আমার একটা হাত ধরল। ছােটবেলায় যেমন করত, তেমনিভাবে হাতের আঙুল নিয়ে খেলা করতে করতে হাল্কা গলায় বলল, ‘দাদা, তােমরা কি আমার ওপর বিরক্ত হয়েছ?
‘কেন? “চিঠি লিখেছি বলে ? ‘তাের কী মনে হয়?
রুনু কথা বলল না। চুপচাপ হাঁটতে থাকল। আমি বললাম, রুনু, ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে?
কোন কথা? ‘তুই যে এক দিন পালিয়েছিলি?
‘ও মনে আছে। ঝুনু একটা কাপ ভেঙে ফেলেছে। ভেঙেই দৌড়ে পালাল, আর আম্মা এসে আমার গালে ঠাস করে এক চড়।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২২
রুনু বলতে বলতে হাসতে লাগল। আমি বললাম, তারপর কি ঝামেলায়। পড়লাম সবাই। তাের কোনাে খোঁজ নেই। সকাল গেল, দুপুর গেল, সন্ধ্যা গিয়ে রাত, তবু তাের খবর নেই। বাসায় খাওয়াদাওয়া বন্ধ। বাবা সারা দিন খুঁজেছেন এখানে ওখানে। আড়ালে আড়ালে চোখের পানি ফেলেছেন। আমি থানায় খবর দিতে গেছি।
মা কিন্তু বেশ স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয় নি। আর ঝুনুটা করল কি, সন্ধ্যাবেলায় রাবেয়াকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে সে কী কান্না। কোনােমতে বলল, ‘আপা আমিই ভেঙেছি কাপটা, রুনু ভাঙে নি।‘
‘তাের সব মনে আছে রুনু?
Read More