‘খুব মনে আছে। আমি চুপচাপ বসে আছি ছাদে। তােমরা তাে কেউ ছাদে খুঁজতে আস নি। সারা দিন একা একা বসেছিলাম। রাত হতেই ভূতের ভয়ে নেমে
এসেছি।‘
‘তারপর কী হল বল তাে রুনু?
‘আরেকটা চড় খেলাম। ‘চড়টা কে দিয়েছিল মনে আছে? ‘হ্যাঁ, তুমি। সশব্দে দু‘ জনে হেসে উঠলাম।
‘কে? কে হাসছে ? তাকিয়ে দেখি রাবেয়া টলতে টলতে আসছে। ‘ও তােরা! বেশ ভয় পেয়েছি। হঠাৎ করে হাসলি। ধক করে উঠছে বুকটা।‘ ‘বস রাবেয়া, গল্প করি।‘
‘না, ভাের হয়ে আসছে দেখছিস না। সবাই চা–টা খাবে। এত মানুষের ব্যাপার, আমি রান্নাঘরে যাই।
‘চল আপা, আমিও যাই।
আমি একা একা বসে রইলাম। ভােরের কাকের কা–কা শােনা যাচ্ছে। আকাশ ফর্সা হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে।
বুঝতে পারছি মনের ভেতর জমে থাকা অবসাদ কেটে যাচ্ছে। ঠিক ভাের হবার মুহূর্তে মনের গ্লানি কেটে যায়। সুন্দর সুখের স্মৃতিগুলি ফিরে আসে। কিটকি লিখেছে, গতকাল নৌকায় করে ৬ মাইল উত্তরের ‘ক্যানসি সিটিতে গিয়েছিলাম বেড়াতে। ও মা! আমাদের দেশের ময়লা ঘিঞ্জি চাঁদপুরের মতাে দেখতে। এটিকে আবার বাহার করে বলা হচ্ছে সিটি। শহরটা বাজে, বমি আসে। কিন্তু শহর থেকে বেরুলেই চোখ ভরে ওঠে। নীল সমুদ্র, নীল নীল পাহাড়, ঘন নীল আকাশ। উহ কী অদ্ভুত! আপনি যদি আসতেন, তাহলে খুব ভালাে লাগত আপনার। সত্যি বলছি।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২৩
আই. এ পরীক্ষায় রুনু ফেল করল।
বেশ অবাক হলাম আমরা। পড়াশােনায় আমার সব ভাইবােনই ভালাে। রুনু নিজে সাত শ’র উপর নম্বর পেয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেছিল। অঙ্কে আর ভূগােলে | লেটার মার্ক ছিল। পরীক্ষায় একেবারে ফেল করে বসবে, এটা কখনাে ভাবা যায়
কাগজে তার রােল নাম্বার যখন কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না এবং রােল নম্বরটি পাওয়া যাবে না এটিও ধারণা করতে পারছি না, তখন রুনু বলল, ‘খুঁজে লাভ হবে
দাদা, আমি ফেল করেছি। ‘ফেল করবি কেন ?
‘খাতায় যে কিছুই লিখি নি। ইতিহাসের খাতায় সম্রাট বাবরের ছবি এঁকে দিয়ে এসেছি।‘
‘কার ছবি? ‘সম্রাট বাবরের।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। রুনু অবশ্যি বদলে যাচ্ছিল। কিন্তু পরিবর্তনটা এত ধীর গতিতে হচ্ছিল যে আমি ঠিক ধরতে পারি নি। হয়তাে বই নিয়ে পড়তে বসেছে, আমি যাচ্ছি পাশ দিয়ে––হঠাৎ ডাকল, ‘দাদা, শােন একটু।
‘কি? ‘মানুষের গােস্ত যদি বাজারে বিক্রি হ‘ত হলে তােমার গােস্ত হ‘ত সবচে
সস্তা, তুমি যা রােগা।
এই জাতীয় কথাবার্তা রুনু আগে বলত না। কিংবা আরেকটি উদাহরণ সরা যাক।
এক দিন রাবেয়াকে গিয়ে সে বলছে, ‘আপা, একটা কথা শুনবে? ‘বল।
তােমার মাথাটা কামিয়ে ফেলবে? রাবেয়া বিস্মিত হয়ে বলল, কেন রে?‘ ‘এমনি বলছি! ঠাট্টা করছি।‘
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২৩
রুনুর এ জাতীয় কথাবার্তা কোনাে বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। রুনু বদলে যাচ্ছিল। কথাবার্তা কমিয়ে দিচ্ছিল। অথচ তার মতাে হৈচৈ করা মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি। বাসায় যতক্ষণ আছে, গুনগুন করে গান গাইছে। রেডিও কানের কাছে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়।
সিনেমার তাে কথাই নেই, প্রতি সপ্তায় দেখা চাই। তার হাতে টাকা পড়তে না পড়তে ধোঁয়ার মতাে উড়ে যাচ্ছে। যখনই দেখতাম রাতের খাওয়ার পর রুনু আমার ঘরে ঘুরঘুর করছে কিংবা আমার পরিষ্কার করে সাজান বিছানা আবার নতুন করে ঝাড়ছে, তখনি বুঝতাম তার কিছু টাকার প্রয়ােজন।।
“কি রে রুনু, টাকা দরকার ?
–না।‘ ‘সেদিন যে দশ টাকা দিলাম, খরচ করে ফেলেছিস?
‘আরাে চাই?
Read More