‘আচ্ছা আচ্ছা, প্যান্টের পকেটে হাত দে, মানি ব্যাগ পেয়েছিস? খােল। নে একটা নােট, নিয়ে যা। আরে আরে, দশ টাকারটাই নিলি ? ডাকাত একেবারে।‘ রুনু খিলখিল হেসে পালিয়ে যায় দ্রুত।
সেই রুনু এমন বদলে গেল। আমরা কেউ বুঝতেই পারলাম না। পরীক্ষার রেজাল্ট শুনে তার কোনােই ভাবান্তর নেই। সেদিন শুনি জানালা দিয়ে মুখ বের করে ওভারশীয়ার চাচাকে বলছে, ‘ও চাচাজি, শুনছেন?
কি মা? ‘আমার পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। ‘কি রেজাল্ট? ‘আমি ফেল করেছি চাচাজি।
একমাত্র বাবাই রুনুকে ধরতে পেরেছিলেন। প্রায়ই বলতেন, ‘রুনুটার কি কোনাে অসুখ করেছে? এমন দেখায় কেন? এক দিন রুনকে আসমানী রঙের
একটি চমৎকার শাড়ি এনে দিলেন। সিনেমা দেখাতে নিয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত মন ভালাে থাকবে বলে পাঠালেন ঝুনুর কাছে।
ঝুনুর বাসা থেকে ফিরে এসেই রুনু অসুখে পড়ল। প্রথমে একটু জ্বর–জ্বর ভাব, সর্দি, গা ম্যাজম্যাজ। শেষটায় একেবারে শয্যাশায়ী।
এক দিন দু‘ দিন করে দিন পনের হয়ে গেল, অসুখ আর সারে না। ডাক্তার কখনাে বলে দুর্বলতা, কখনাে বলে রক্তহীনতা, কখনাে–বা লিভার ট্রাবল। সঠিক রােগটা আর ধরা পড়ে না।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২৪
রাতে সে বড়াে ঝামেলা করে। নিজে একটুও ঘুমােয় না, কাউকে ঘুমুতেও দেয় না। রাবেয়া প্রায় সারা রাত জেগে থাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, গল্প পড়ে। শােনায়, পিঠ চুলকে দেয়। অনেক রাতে যখন রাবেয়া বলে, আমি একটু শুই,
‘না–না, শুলেই তুমি ঘুমিয়ে পড়বে। ‘তাের বালিশে একটু মাথাটা রাখি, ভীষণ মাথা ধরেছে।
উঁহু, তুমি বরং এক কাপ চা খেয়ে আস। ঘুমুতে পারবে না।‘ খােকাকে ডাকি, ও বসবে তাের পাশে। ‘না, তুমি বসে থাকবে। কলেজ থেকে ফিরে আমি এসে বসি রুনুর পাশে। “কি রে, জ্বর কমেছে। ‘হ্যাঁ, কমেছে?
কপালে হাত দিয়েই প্রবল জ্বরের অচি পাই। রুনু ঘােলাটে চোখে তাকায়। আমি বলি, বেশ জ্বর তাে। কি রে, খারাপ লাগে ?
‘না, লাগে না। ‘মাথায় হাত বুলিয়ে দেব? ‘দাও।‘ ‘চিটাগাং ভালাে লেগেছিল রুনু?
‘সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলি?
‘আচ্ছা, এক বার তােদের সবাইকে নিয়ে সমুদ্র দেখতে যাব। কক্সবাজারে হােটেল ভাড়া করে থাকব। খুব ফুর্তি করব, কি বলিস?
‘হু করব।‘
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২৪
জ্বরের ঘােরে রুনু ছটফট করতে লাগল। হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলে উঠল, ‘দাদা, ঝুনু এখন আর আমাকে একুটুও দেখতে পারে না।‘
‘কেন দেখতে পারে না?
কী জানি কেন। আমার সঙ্গে কথা বলে নি। কিন্তু আমার কী দোষ?
রুনুর জ্বর বাড়তেই থাকে। মন্টু চলে যায় ডাক্তার আনতে। রুনু আচ্ছ; ? পড়ে থাকে। ভাত খেতে খেতে রাবেয়া বলে, ‘খােকা শশান, তােকে একটা কথা বলি।‘
‘কী কথা? রুটা বাঁচবে না রে। “কী বলছিস আবােল–তাবােল!
‘আমার কেন জানি শুধু মনে হচ্ছে। কাল রাতে রুনুর জন্যে গরম পানি করে নিয়ে গেছি, দেখি ওর মাথার পাশে কে এক জন মেয়ে বসে আছে।
কী বলছিস এ সব!
‘হ্যা সত্যি। কে যে বসে ছিল, ঠিক বলতে পারব না। তবে আমার মনে হয়, তিনি মা। অল্প কিছুক্ষণের জন্যে দেখেছি।‘
‘যত সব রাবিশ।’ ‘না রে, ঠিকই। আমি ভয় পেয়ে বাবাকে ডেকে আনি। ‘বাবাকে বলেছিস কিছু? ‘না, বলি নি।
দেখতে দেখতে রুনুর জ্বর খুব বাড়ল। ছটফট করতে লাগল সে। ডাক্তার এসে দু’টি ইনজেকশন করলেন। মাথায় পানি ঢালতে বললেন। জ্বরের ঘােরে রুনু ভুল বকতে লাগল, ‘বেশ করেছেন আপনি! হ্যাঁ, বেশ তাে। ঠিক আছে ঠিক আছে।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২৪
‘কী বলছিস রুনু?
রুনু স্বাভাবিক মানুষের মতাে বলল, কই দাদা, কিছু বলছি না তাে।‘ রাবেয়াকে বলল, ‘আপা এক গ্লাস পানি আন। কানায় কানায় ভরা থাকে যেন। আমি সবটা চুমুক দিয়ে খাব।‘
রুনু এক চুমুক পানি খেল। খুব স্বাভাবিক গলায় ডাকল, ‘বাবা।‘
এই তাে আমি। কী মা? একটু কোলে নেন না।
বাবা রুনুকে কোলে নিলেন। বাবার পা কাঁপছিল। আমি বাবার একটা হাত ধরলাম। রুনুটা এই ক’দিনে ভীষণ রােগা হয়েছে। বাবার পিঠের ওপর তার দু’টি শীর্ণ হাত আড়াআড়ি ঝুলছে। রুনু বলল, ‘বাবা বাইরে চলেন। বাইরে যাব।’
Read More