হুমায়ূন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২৫

সবাই বাইরে এসে দাঁড়ালামসে রাতেখুব জোছনা হয়েছিলজামগাছের পাতা চিকচিক করছিল জোছনায়উঠোনে চমৎকার সব নকশা হয়েছিল গাছের পাতার ছায়ায়রুনু ফিসফিস করে বলল, বাবা, কাল রাতে আমি মাকে দেখেছিমা আমার মাথার পাশে এসে বসেছিলেনআমি কি মারা যাচ্ছি বাবা

শঙ্খনীল কারাগার

না মা, ছিঃ ! মারা যাবে কেন

তােমরা কি রাগ করেছ আমার ওপর? রাগ করব কেন? মিষ্টি মা আমার। 

বাবা চুমু খেলেন রুনুর পিঠেরুনু বলল, আমি যে আরেকটি ছেলেকে চিঠি লিখেছিলাম। 

রাবেয়া রুনুকে কোলে নিয়ে বসে আছেবাবা আর মন্টু গেছে ডাক্তার ডেকে আনতে। রুনু চোখ বড়াে বড়াে করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকেতার ফর্সা সরু আঙুল থরথর করে কাঁপছেসবাই বুঝতে পারছি, রুনু মারা যাচ্ছে। 

রুনু মারা যাবার পর আমার মনে হল মায়ের মৃত্যু আমি ঠিক অনুভব করতে পারি নিমা যখন মারা যান তখন অনেক রকম দুশ্চিন্তা ছিল, নিনুকে কে মানুষ করবে, ঘরসংসার কী করে চলবেকিন্তু এখন কোনাে দুশ্চিন্তা নেইরুনুর জন্যে কোনাে কিছু আটকে থাকার কথা ওঠে না, কিন্তু সমস্তই যেন আটকে গেল

রুনুর কথা মুহুর্তের জন্যেও ভুলতে পারি নামনে হয় গভীর শূন্যতায় ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছিঅসহ্য বােধ হওয়ায় লম্বা ছুটি নিয়েছিদীর্ঘ অবসর সময়ও কাটে না কিছুতেইএকবার ভাবলাম বাইরে কোথাও যাইকত দিন রুনুকে নিয়ে বাইরে যেতে চেয়েছি, সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়, কক্সবাজার, দিনাজপুরের পঞ্চগড়কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠে নিআজ একা একা কি করে যাব। 

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২৫

কিছুই ভালো লাগে নাশুয়ে শুয়ে দীর্ঘ সময় কাটেবাবা তার ছােট ঘর থেকে কখনই বের হন নাতাঁর হাঁপানি বডড বেড়েছেমন্টু যে কখন আসে কখন যায়, বুঝতে পারি না। শুধু নিনুর দাপাদাপি শােনা যায়সে খেলে আপন মনেপাগলের মতাে কথা বলে একা একা। 

এক দিন রুনুর ছােট ট্রাঙ্কটা খুলে ফেললামকত কি সাজিয়ে রেখেছেসেখানেপ্রথম বেতন পেয়ে তাকে দশ টাকার নােট দিয়েছিলাম একটা নােটের উপর লিখে দিয়েছিলাম, প্রিয় রুনুকে ইচ্ছে মতাে খরচ করতেরুনু সেটি খরচ করে নিযত্ন করে রেখে দিয়েছেএকটি অতি চমৎকার মােমের পুতুল

আগে কখনাে দেখি নিকোথেকে এনেছিল কে জানে! তার নিজের ফটো কয়েকটি , কিটকির ক্যামেরায় তােলাস্কুলের ক্রীড়াপ্রতিযােগিতায় পাওয়া দুটি ছােট কাপএকটি কবিতার বই, তাতে লেখা রাবেয়া আপাকেরুনুপাঁচটি সাদা রুমালপ্রতিটির কোণায় ইংরেজি লেখাতার নিজের নামের আদ্যক্ষর! পুরানাে ডায়রি পেলাম একটা, পড়তে পড়তে চোখ ভিজে ওঠে। 

১৭৭১ 

আজ রাবেয়া আপা আমাকে বকেছেমিটসেফ খােলা রেখেছিলাম, আর বিড়ালে দুধ খেয়ে গেছেপ্রথম খুব খারাপ লাগছিলআপা সেটি বুঝতে পারলবিকেলে আমাকে ডেকে এমন সব গল্প বলতে লাগল যে হেসে বাঁচি নাএকটি গল্প এই রকমএক মাতাল রাতের বেলা মদ খেয়ে উল্টে পড়েছে নর্দমায়বিরক্ত হয়ে বলছেওরে ব্যাটা নর্দমা, তুই দিনের বেলা থাকিস রাস্তার পাশে আর রাত হলেই এসে যাস রাস্তার মাঝখানে?আপাটা কি হাসাতেই না পারে

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২৫

১৪১ 

 কিটকি আপা আমাকে এমন একটি কথা বলেছেন যে আমি অবাকসবাইকে সেকথাটি বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু বলা যাবে নাআপা আল্লার কসম দিয়ে দিয়েছেন। 

৩০৭১ 

আজ একটা মজার ব্যাপার হয়েছেদুপুরে আমি শুয়ে আছি, বাবা চুপি চুপি এসে ঘরে ঢুকে বলতে লাগলেনরাবেয়া, রুনুটার কি হয়েছে? এমন মনমরা থাকে কেন? আমি উঠে বললাম, আপা তাে এখানে নেই বাবাআর কই, আমার তাে কিছুই হয় নিবাবার মুখের অবস্থা যা হয়েছিল না

২২৭১ 

আজ দুপুরে লুকিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলামআল্লা, গিয়ে দেখি সিনেমা হলের লবিতে দাদা ঘুরছেআমাকে দেখে বলল, কি রুনু মিয়া, সিনেমা দেখবেনাকি? তারপর নিজেই টিকেট কাটলছবিটা বড় ভালাে

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২৫

৭১ 

মন্টুটা তলে তলে এত! আমাকে বলছে, তিন তিনটা ডি. সিতে সিনেমা দেখাবেযদি না দেখায় তাহলে সব ফাঁস করে দেবতখন বুঝবেমন্টুর একটি কবিতা ছাপা হয়েছেকবিতাটি সে শুধু আমাকেই দেখিয়েছেখুব অশ্লীল কিনা, তাই কাউকে দেখাতে সাহস হয় নি

৭১ 

আজ সন্ধ্যাবেলা দেখি রাবেয়া আপা শুয়ে শুয়ে কাঁদছেখুব চাপা মেয়েকাউকে বলবে না তার কী হয়েছেআমার যা খারাপ লাগছেকাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে

৭১ 

নিনুটার কাণ্ড দেখেশুনে অবাক হয়েছিসেদিন স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছেআমি বললাম, কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন

ছেলেরা এক প্রফেসরকে মেরে ফেলেছেআপামনি বলেছে ক্লাসে‘ 

তাতে তাের কী

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২৬

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *