সবাই বাইরে এসে দাঁড়ালাম। সে রাতে–খুব জোছনা হয়েছিল। জামগাছের পাতা চিকচিক করছিল জোছনায়। উঠোনে চমৎকার সব নকশা হয়েছিল গাছের পাতার ছায়ায়। রুনু ফিসফিস করে বলল, ‘বাবা, কাল রাতে আমি মাকে দেখেছি। মা আমার মাথার পাশে এসে বসেছিলেন। আমি কি মারা যাচ্ছি বাবা?
‘না মা, ছিঃ ! মারা যাবে কেন?
তােমরা কি রাগ করেছ আমার ওপর? ‘রাগ করব কেন? মিষ্টি মা আমার।
বাবা চুমু খেলেন রুনুর পিঠে। রুনু বলল, আমি যে আরেকটি ছেলেকে চিঠি লিখেছিলাম।
রাবেয়া রুনুকে কোলে নিয়ে বসে আছে। বাবা আর মন্টু গেছে ডাক্তার ডেকে আনতে। রুনু চোখ বড়াে বড়াে করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। তার ফর্সা সরু আঙুল থরথর করে কাঁপছে। সবাই বুঝতে পারছি, রুনু মারা যাচ্ছে।
রুনু মারা যাবার পর আমার মনে হল মায়ের মৃত্যু আমি ঠিক অনুভব করতে পারি নি। মা যখন মারা যান তখন অনেক রকম দুশ্চিন্তা ছিল, নিনুকে কে মানুষ করবে, ঘর–সংসার কী করে চলবে। কিন্তু এখন কোনাে দুশ্চিন্তা নেই। রুনুর জন্যে কোনাে কিছু আটকে থাকার কথা ওঠে না, কিন্তু সমস্তই যেন আটকে গেল।
রুনুর কথা মুহুর্তের জন্যেও ভুলতে পারি না। মনে হয় গভীর শূন্যতায় ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছি। অসহ্য বােধ হওয়ায় লম্বা ছুটি নিয়েছি। দীর্ঘ অবসর সময়ও কাটে না কিছুতেই। একবার ভাবলাম বাইরে কোথাও যাই। কত দিন রুনুকে নিয়ে বাইরে যেতে চেয়েছি, সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়, কক্সবাজার, দিনাজপুরের পঞ্চগড়––কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠে নি। আজ একা একা কি করে যাব।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২৫
কিছুই ভালো লাগে না। শুয়ে শুয়ে দীর্ঘ সময় কাটে। বাবা তার ছােট ঘর থেকে কখনই বের হন না। তাঁর হাঁপানি বডড বেড়েছে। মন্টু যে কখন আসে কখন যায়, বুঝতে পারি না। শুধু নিনুর দাপাদাপি শােনা যায়। সে খেলে আপন মনে। পাগলের মতাে কথা বলে একা একা।
এক দিন রুনুর ছােট ট্রাঙ্কটা খুলে ফেললাম। কত কি সাজিয়ে রেখেছে। সেখানে। প্রথম বেতন পেয়ে তাকে দশ টাকার নােট দিয়েছিলাম একটা নােটের উপর লিখে দিয়েছিলাম, প্রিয় রুনুকে ইচ্ছে মতাে খরচ করতে।‘ রুনু সেটি খরচ করে নি। যত্ন করে রেখে দিয়েছে। একটি অতি চমৎকার মােমের পুতুল।
আগে কখনাে দেখি নি। কোথেকে এনেছিল কে জানে! তার নিজের ফটো কয়েকটি , কিটকির ক্যামেরায় তােলা। স্কুলের ক্রীড়া–প্রতিযােগিতায় পাওয়া দুটি ছােট কাপ। একটি কবিতার বই, তাতে লেখা “রাবেয়া আপাকে––রুনু। পাঁচ–ছ‘টি সাদা রুমাল। প্রতিটির কোণায় ইংরেজি লেখা––তার নিজের নামের আদ্যক্ষর! পুরানাে ডায়রি পেলাম একটা, পড়তে পড়তে চোখ ভিজে ওঠে।
১৭–১–৭১
আজ রাবেয়া আপা আমাকে বকেছে। মিটসেফ খােলা রেখেছিলাম, আর বিড়ালে দুধ খেয়ে গেছে। প্রথম খুব খারাপ লাগছিল। আপা সেটি বুঝতে পারল। বিকেলে আমাকে ডেকে এমন সব গল্প বলতে লাগল যে হেসে বাঁচি না। একটি গল্প এই রকম––এক মাতাল রাতের বেলা মদ খেয়ে উল্টে পড়েছে নর্দমায়। বিরক্ত হয়ে বলছে– ওরে ব্যাটা নর্দমা, তুই দিনের বেলা থাকিস রাস্তার পাশে আর রাত হলেই এসে যাস রাস্তার মাঝখানে?‘ আপাটা কি হাসাতেই না পারে।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২৫
১৪–২–৭১
কিটকি আপা আমাকে এমন একটি কথা বলেছেন যে আমি অবাক। সবাইকে সে–কথাটি বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু বলা যাবে না। আপা আল্লার কসম দিয়ে দিয়েছেন।
৩০– ৩–৭১
আজ একটা মজার ব্যাপার হয়েছে। দুপুরে আমি শুয়ে আছি, বাবা চুপি চুপি এসে ঘরে ঢুকে বলতে লাগলেন––রাবেয়া, রুনুটার কি হয়েছে? ও এমন মন–মরা থাকে কেন? আমি উঠে বললাম, আপা তাে এখানে নেই বাবা। আর কই, আমার তাে কিছুই হয় নি। বাবার মুখের অবস্থা যা হয়েছিল না।
২২–৫–৭১
আজ দুপুরে লুকিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। ও আল্লা, গিয়ে দেখি সিনেমা হলের লবিতে দাদা ঘুরছে। আমাকে দেখে বলল, কি রুনু মিয়া, সিনেমা দেখবে। নাকি? তারপর নিজেই টিকেট কাটল। ছবিটা বড় ভালাে।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-২৫
৫–৬–৭১
মন্টুটা তলে তলে এত! আমাকে বলছে, তিন তিনটা ডি. সি–তে সিনেমা দেখাবে। যদি না দেখায় তাহলে সব ফাঁস করে দেব। তখন বুঝবে। মন্টুর একটি কবিতা ছাপা হয়েছে। কবিতাটি সে শুধু আমাকেই দেখিয়েছে। খুব অশ্লীল কিনা, তাই কাউকে দেখাতে সাহস হয় নি।
১–৬–৭১
আজ সন্ধ্যাবেলা দেখি রাবেয়া আপা শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। খুব চাপা মেয়ে। কাউকে বলবে না তার কী হয়েছে। আমার যা খারাপ লাগছে। কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।
৯–৭–৭১
নিনুটার কাণ্ড দেখেশুনে অবাক হয়েছি। সেদিন স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছে। আমি বললাম, ‘কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন?
ছেলেরা এক প্রফেসরকে মেরে ফেলেছে। আপামনি বলেছে ক্লাসে।‘
‘তাতে তাের কী
Read More