বাসায় ফিরে দেখি বাবা এসে গেছেন। ওভারশীয়ার কাকুর বউ এসেছেন, ধাই সুহাসিনীও এসেছে। রান্নাঘরে বাতি জ্বলছে। রাবেয়া ব্যস্ত হয়ে এঘর–ওঘর করছে। বাবা ভেতরের বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে ঘন ঘন সিগারেট খাচ্ছেন। আমাকে দেখে যেন একটু জোর পেলেন। তাের ছােটখালাকে খবর দিয়েছিস খােকা?
‘জ্বি দিয়েছি। আপনি কখন এসেছেন?
‘আমার একটু দেরি হয়ে গেল। তাের আজিজ খাকে মনে আছে? ঘড়ির দোকান ছিল যে, আমার খুব বন্ধুমানুষ। সে হঠাৎ মারা গেছে। গিয়েছিলাম তার বাসায়।
বাবা যেন আমার কাছে কৈফিয়ৎ দিচ্ছেন, এমন ভাব–ভঙ্গি করতে লাগলেন, ‘আজিজ খাঁর বউ ঘন ঘন ফিট হচ্ছে। এক বার মনে করলাম থেকেই যাই।ভাগ্য ভালাে থাকি নি, নিজের ঘরে এত বড়াে বিপদ।
‘বিপদ কিসের বাবা? | ‘না। বিপদ অবশ্যি নয়। কিন্তু রাতে এমন একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছি। যত বারই মনে হয়, হাত–পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। কিছুক্ষণ আগে রাবেয়াকে বলেছি সে–কথা।
‘কী স্বপু?
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৩
‘না–না, রাতের বেলা কেউ স্বপ্ন বলে নাকি রে? যা তুই, রাবেয়ার কাছে গিয়ে বস একটু।
ঘরে যদিও অনেকগুলি প্রাণী জেগে আছি তবু চারদিক খুব বেশিরকম নীরব। রান্নাঘরে দু–একটি বাসনকোশন নাড়ার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শােনা যাচ্ছে না। বাবা অবশ্যি মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। তাঁর একা একা কথা বলার অভ্যাস আছে। মাঝে মাঝে যখন মেজাজ খুব ভালাে থাকে, তখন গুনগুন
করে গানও গান। কথা বোেঝা যায় না, ও মন মন রে এই লাইনটি অস্পষ্ট শোন। যায়। রাবেয়া বলে, ‘বাবার নৈশ সংগীত। রাবেয়াটা এমন ফাজিল।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখি একটা মস্ত এলুমােনিয়ামের সসপ্যানে পানি ফুটছে। রাবেয়ার ঘুম ঘুম ফোলা মুখে আগুনের লাল আঁচ এসে পড়েছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে কি ভেবে অল্প হাসল। আমি বললাম, ‘হাসছিস যে?
এমনি। সুহাসিনী মাসির আমি কী নাম দিয়েছি জানিস? কী নাম ? ‘কুহাসিনী মাসি। ওর হাসি শুনলেই আমার গা জ্বলে। একটু আগে কী বলেছে জানিস?
‘কী বলেছে?
থাক, শুনে কাজ নেই। বল না?
বলে, আজ তােমার মার জন্যে এসেছি, এক দিন তােমার জন্যেও আসব খুকি।‘ বলতে বলতে রাবেয়া মুখ নিচু করে হাসল। সে মনে হল কথাটা বলে ফেলে বেশ লজ্জা পেয়েছে। হঠাৎ করে ব্যস্ত হয়ে কী খুঁজতে লাগল মিটসেফে। আমি বললাম, তাের ভাবভঙ্গি দেখে তাে মনে হচ্ছে বেশ খুশিই হয়েছিস শুনে।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৩
‘তুই একটা গাধা।
লজ্জায় রাবেয়া লাল হয়ে উঠল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, “লজ্জা পাওয়ার কী হয়েছে?
‘যা! লজ্জা পেলাম কোথায়, তাের যে কথা! যাই, দেখে আসি রুনু–ঝুনুরা মশারি ফেলে ঘুমিয়েছে কি না, যা মশা।
রাবেয়া আমার পাঁচ বৎসরের বড়। এই বয়সে মেয়েরা খুব বিয়ের কথা ভাবে। তাদের অন্তরঙ্গ সখীদের সাথে বিয়ে নিয়ে হাসাহাসি করে। রাবেয়ার একটি বন্ধুও নেই। আমিই তার একমাত্র বন্ধু। সুহাসিনী মাসির সেই কথাটি হয়তাে এই জন্যেই বলেছিল আমাকে।
আর আমি এমন গাধা, তাকে উল্টো লজ্জা দিয়ে ফেললাম। মেয়েরা লজ্জা পেলে এত বেশি অপ্রস্তুত হয় যে, যে লজ্জা দিয়েছে তার অস্বস্তির সীমা থাকে না।
ঘরে খুব হৈহৈ করে বেড়ালেও রাবেয়া ভীষণরকম লাজুক। কলেজে যাওয়া বন্ধ করার ব্যাপারটিই ধরা যাক। তিন বছর আগে হঠাৎ এক দিন এসে বলল, “বাবা, আমি আর কলেজ করব না।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, ‘কেন মা? ‘এমনি। মা বললেন, রাবেয়া, তােমাকে কি কেউ কিছু বলেছে?
‘না মা, কেউ কিছু বলে নি।‘ ‘কোনাে চিঠিফিটি দিয়েছে নাকি কোনাে ছেলে? “না মা। আমাকে চিঠি দেবে কেন?
Read More