বাবা মন্টুকে নিয়ে মহা উৎসাহে রান্না শুরু করেন।
ঝুনু চলে যাবার পরপরই আমি একলা পড়ে গেছি।
সবাই সবার কাজ নিয়ে আছে। বাসায় আমার তেমন কোনাে কাজ নেই। শুয়ে বসে সময় কাটাতে হয়। কাজেই আমি দেরি করে বাসায় ফিরি। সেদিন রাত এগারটার দিকে ফিরেছি, দেখি রাবেয়া মুখ কালাে করে বসে আছে আমার ঘরে।
কী হয়েছে রাবেয়া ? ‘কিছু হয় নি। তুই হাত–মুখ ধুয়ে আয়, বলছি। ‘বল শুনি কী ব্যাপার। ‘তুই কলেজে যাবার পরপরই খালা এসেছিলেন। কী জন্যে ? ‘তুই জানিস না কিছু?
না তাে।‘
‘কিটকির বিয়ে। আগামী কাল রাতেই সব সেটেল হবে। খালা সবাইকে যেতে বলেছেন। গাড়ি পাঠাবেন।
‘এক রিটায়ার্ড ডিস্ট্রিক্ট জজের ছেলে। ফরেন সার্ভিসে আছে। ফ্রান্সে পােস্টেড। ছুটিতে এসেছে, বিয়ে করে ফিরবে। ম্যানিলাতেই নাকি কিটকির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ছেলে গিয়েছিল সেখানে কী কারণে যেন। কিটকির সঙ্গে জানাজানি হয়। কিটকিরও ছেলে খুব পছন্দ।
‘এসব আমাকে শুনিয়ে কী লাভ রাবেয়া ? ‘কোনাে লাভ নেই? এ রকম হল কেন? চুপ করে আছিস যে?
আমি চুপ করেই রইলাম। আমার কী করার আছে? আমি কী করতে পারতাম? রাবেয়া একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কেঁদে ফেলবে কিনা কে জানে। রাবেয়া ফিসফিস করে বলল, ‘আমার আর এখানে থাকতে ভালাে লাগছে।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৩১
আমি পাশ করলেই বাইরে কোথাও চলে যাব। থাকব একা একা। আর খােকা, শােন।
‘বল।‘ ‘তুই একটা গাধা, ইডিয়েট। আমি তাের মুখে থুথু দিই।‘
আমি গায়ের শার্ট খুলে কলঘরের দিকে যাই। রাবেয়া আসে আমার পিছনে পিছনে। এক সময় ধরা গলায় বলে, ‘খােকা, তুই রাগ করলি? ছিঃ, রাগ করবি না। আমার কথায় রাগ করতে আছে বােকা?
খােকা,
গত পরশু সন্ধ্যাবেলা পৌছেছি এখানে। স্টেশনে স্কুলের সুপারিনটেনডেট এসেছিলেন নিজেই। ভারি ভালােমানুষ। সারাক্ষণই মা মা বলে ডাকছেন। তার নিজের টাকায় স্কুল, নিজের জমির উপর দোতলা স্কুলঘর। নিজের সমস্ত সঞ্চয় ঢেলে দিয়েছেন বলেই প্রতিটি জিনিসের ওপর অসাধারণ মমতা। আর যেহেতু আমি স্কুলের এক জন, কাজেই তার ভালােবাসার পাত্রী।
ট্রেন থেকে খুব ভয়ে ভয়ে নেমেছিলাম। নতুন জায়গা––কাউকে চিনি না, জানি না। কিন্তু তাঁকে দেখে সব ভয় কেটে গেল। কাউকে কাউকে দেখলে মনে হয় যেন অনেক দিন আগে তার সঙ্গে গাঢ় পরিচয় ছিল, ঠিক সে–রকম। তিনি প্রথমে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন।
বাসায় তিনি আর সুরমা––এই দু’টিমাত্র প্রাণী। সুরমা তাঁর মেয়ে। রাতের খাওয়া সেরে তিনি আমাকে হােস্টেলে পৌছে দিলেন। সতের জন ছাত্রী থাকে সেখানে। আমি হয়েছি তাদের হােস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট। ছােট্ট একটা লাল ইটের দালান। সামনে গাঁদা ফুলের এক টুকরাে বাগান। পেছনেই পুকুর। সমস্ত মন জুড়িয়ে গেছে আমার।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৩১
খােকা, তােদের সঙ্গে যখন থাকতাম তখন এক ধরনের শান্তি পেয়েছি, এ অন্য ধরনের। এখানে মনে হচ্ছে জীবনের সমস্ত বাসনা কামনা কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। আর বেশি কিছু চাইবার নেই। কাল রাতে ছাদে বসে ছিলাম একা একা। কেন যেন মনে হল, একটু কাঁদি নির্জনে। মার কথা ভেবে, রুনুর কথা ভেবে দু এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলি। কিন্তু একটুও কান্না আসল না! কেন কাঁদব, বল ? প্রচুর দুঃখ আছে আমার।
এত প্রচুর যে কোনাে দিন কেউ জানতেও পারবে না। কিন্তু তবুও আমি খােকার মতাে ভাই পেয়েছি, কিটকির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনে যে–ভাই আমাকেই সান্ত্বনা দিতে আসে। রুনু, ঝুনু, মন্টু, নি––এরা আমার পারুল বােন, চম্পা ভাই। চারদিকে এমন চাঁদের হাটে কি কোনাে দুঃখ থাকে? মন্টু একটি কবিতার বই উৎসর্গ করেছে আমাকে। সবগুলি কবিতা হতাশা আর বেদনা নিয়ে লেখা। আমার ভেতরের সবটুকু সে কী করে দেখে নিল ভেবে অবাক আমি। সেই যে দু’টি লাইন ।
‘দিতে পারাে একশাে ফানুস এনে?
Read More