তবে কলেজে যাবে না কেন? এমনি।‘ ‘না, এমনি না। বল তােমার কী হয়েছে?
রাবেয়া হঠাৎ ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, “মা, ছেলেরা আমাকে মা কালী বলে ডাকে।
আমাদের ভেতর রাবেয়াই শুধু মার রং পায় নি। যতটুকু কালাে হলে মায়েরা মেয়েদের শ্যামলা বলেন, রাবেয়া তার চেয়েও কালাে। কিন্তু ছেলেরা শুধু গায়ের রংটাই দেখল?
ও ছেলে। | তাকিয়ে দেখি সুহাসিনী মাসি। ধবধব করছে গায়ের রং, ফোলা ফোলা চোখে
এক বেমানান চশমা। আমি উঠে দাঁড়ালাম।
‘খামাখা তােমার বাবা আমার ঘুম ভাঙিয়ে এনেছে, এখনাে অনেক দেরি। নটার আগে নয়।”
আমি চুপ করে রইলাম। সুহাসিনী মাসি বললেন, মেয়েটি কই? লম্বামত মেয়েটি?
আসবে এক্ষণি, কেন? ‘এক কাপ চা করে দিতে বলতাম।––এই যে, ও খুকি, মাসিকে চা করে দাও এক কাপ।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৪
রাবেয়া হাসিমুখে বলল, ‘দিই, আপনি বসবেন এখানে? ‘না, আমি একটু শােব ভেতরের ইজিচেয়ারে। রাবেয়া তাকাল আমার চোখে চোখে, তাের লাগবে নাকি এক কাপ?
‘তাহলে পাঁচ কাপ দি। বাবাকে এক কাপ, আমার নিজের দু কাপ।
রাবেয়া চায়ের সরঞ্জাম সাজাতে লাগল। অভ্যস্ত নিপুণ হাত, দেখতে ভালাে লাগে। আমি বললাম, ‘মাসির বয়স কত রে ?
‘অনেক। আমি ছাড়া সবাই তাে তাঁর হাতে। দেখলে মনে হয় না, তাই না? ‘। মার ব্যথাটা একটু কম মনে হয়।
‘ছ‘ বার মা এমন কষ্ট পেলেন! তােরা তাে সুখে আছিস, কষ্ট যা তা তাে মেয়েদেরই। পেটে ছেলে–মেয়ে আসা মানেই এক পা কবরে রাখা।
আমি বললাম, ‘কষ্টটা যদি পুরুষরাও পেত, তাহলে তুই খুশি হতি?
“জানি না।‘
বলেই রাবেয়া হঠাৎ কী মনে করে হাসতে লাগল। হাসির উচ্ছ্বাসে পেয়ালার দুধ গেল উন্টে, আঁচল খসে পড়ল মেঝেয়।
অবাক হয়ে বললাম, ‘হাসির কী হয়েছে? এত হাসছিস কেন? ‘একটা গল্প মনে পড়ছে, তাই হাসছি।‘
কী গল্প? ‘বাজে গল্প, তবে খুব মজার। শুনলে তুই নিজেও হাসবি। শুনবি? ‘বল।
একদল মেয়ে আল্লাহর কাছে নালিশ করল। তাদের বক্তব্য ছেলেমেয়ে হওয়ার ব্যথাটা শুধু মেয়েদেরই হবে কেন? এবার থেকে ছেলেদেরও হতে হবে, ব্যথার ভাগও সমান সমান। আল্লাহ্ বললেন, ঠিক আছে, তাই হবে। তারপর হল কি শােন।
মেয়েদের এই দলটির যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন তাঁর ব্যথা শুরু হল। কিন্তু কি আশ্চর্য স্বামী বেচারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কোনাে ব্যথা–ফ্যতা নেই। এদিকে তাদের গাড়ির ড্রাইভার ছুটির দরখাস্ত করেছে, তার নাকি হঠাৎ ভীষণ ব্যথা শুরু হয়েছে পেটে।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৪
তারপর?‘
তারপর আবার কি? মেয়েরা বলল, আল্লাহ্ তােমার পায়ে পড়ি। ব্যথার ভাগাভাগি আর চাই না। আমাদের কষ্ট আমাদেরই থাক। তুই হাসলি না একটুও, আগে শুনেছিস নাকি?”
“তবে? ‘নােংরা গল্প, তাই হাসলাম না। ‘ওঃ।
রাবেয়া চায়ের পেয়ালা হাতে বেরিয়ে গেল। সে খুব অপ্রস্তুত হয়েছে। চোখ লজ্জায় ভিজে উঠেছে। আমার খারাপ লাগতে লাগল। অন্য সময় হলে ঐ গল্পেই প্রচুর হাসতাম। আজ পারি নি। হয়তাে মায়ের কথা ভাবছিলাম বলে। চায়ের পেয়ালা হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দেখি মন্টু গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এসেছে।
“কিরে মন্টু? ‘ঘুম আসছে না দাদা।
কেন? ‘রুনু ঝুনু ঘুমিয়ে পড়েছে, আমার একা একা ভয় লাগছে। ‘কিসের ভয়?
রাবেয়া রান্নাঘরে ফিরে যাচ্ছিল, মন্টু ডাকল, ‘আপা, আমি চা খাব।‘
‘এক ফোঁটা ছেলের রাত তিনটের সময় চা চাই। সিগারেটও লাগবে নাকি বাবুর? দিই বাবার কাছ থেকে এনে?‘
‘আপা, ভালাে হবে না বলছি।
ও ঘর থেকে কাপ নিয়ে আয় একটা। দেখিস, ফেলে দিয়ে একাকার করিস।
ভাের হয়ে আসছে, কাক ডাকছে। মুরগির ঘরে মুরগিগুলি সাড়াশব্দ দিচ্ছে, চাঁদের আলােও ফিকে হয়ে এসেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাের হওয়া দেখছি। ভেতরের ঘর থেকে বাবা বেরিয়ে এলেন, ভীত গলায় ডাকলেন, ‘খােকা।
Read More