‘তাের মাকে মনে হয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই ভালাে। ‘কেন? হঠাৎ করে? ‘না, মানে সুহাসিনী বলল। এখন বয়স হয়েছে কিনা। তা ছাড়া––– ‘তা ছাড়া কী?‘ | ‘না, মানে কিছু নয়। আমার কেন যেন খারাপ লাগছে স্বপ্নটা দেখার পর। দেখলাম যেন আমি একটা ঘরে...‘।
‘একটা ঘরে কী?
না না, রাতের বেলায় স্বপ্ন বলে নাকি কেউ।
বাবা থতমত খেয়ে চুপ করলেন। মায়ের সেই ভয়–ধরান চিল্কার আর শােনা যাচ্ছে না। কোথা থেকে দু‘টি বেড়াল এসে ঝগড়া করছে। অবিকল শিশুদের কান্নার আওয়াজ। বাবা বললেন, ‘খােকা আমি হাসপাতালে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দিই।‘
‘আপনার যেতে হবে না, আমি যাই। বরঞ্চ পাশের বাড়ি থেকে ফোন করে দিই। * না–না, ফোন করলে কাজ হবে না। আসতে দেরি করবে, বাসা চিনবে
––অনেক ঝামেলা। তুই থাক। | বাবা চাদর গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এত রাতে রিক্সাটিক্সা কিছু পাওয়া যাবে না, হেঁটে হেঁটে যেতে হবে। আমি ইজিচেয়ারে চুপচাপ বসে রইলাম। যে। শিশুটি জন্মাবে, সে এত আয়ােজন, এত প্রতীক্ষা ও যন্ত্রণার কিছুই জানছে না‘, এই জাতীয় চিন্তা হতে লাগল। অন্ধকার মাতৃগর্ভের কোনাে স্মৃতি কারাের মনে থাকে না। যদি থাকত, তবে কেমন হত সে–স্মৃতি কে জানে! জন্মের সমস্ত ব্যাপারটাই বড়ো নােংরা।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৫
রাবেয়া এসে দাঁড়াল আমার কাছে। নিচু গলায় বলল, ‘খােকা, বাবা কি হাসপাতালে গেছেন?
‘বাবা খুব ভয় পেয়েছেন, নারে ?
‘হু, পেয়েছেন। ‘আমারাে ভয় লাগছে খােকা। ‘ভয় কিসের? ‘আমি কিছুতেই বিয়ে করব না, দেখিস তুই। মাগাে কী কষ্ট। ‘মায়ের কাছে গিয়েছিলি রাবেয়া? ‘হ্যাঁ। ‘মা কী করছে? ‘চিৎকার করছেন না। চিৎকার করার শক্তি নেই। খুব কষ্ট পাচ্ছেন। ‘কী বাজে ব্যাপার!
‘মাসি কী করছে?
‘ঘুমাচ্ছে। বাজনার মতাে নাক ডাকছে। মেয়েমানুষের নাক ডাকা কী বিশ্রী। বাঁশির সরু আওয়াজের মতাে তালে তালে বাজছে। ঘেন্না লাগে।‘
মসজিদ থেকে ফজরের আজান হল, ভাের হয়ে আসছে। অ্যাম্বুলেন্স এল, ছ’টার দিকে। ড্রাইভারটা মুশকো জোয়ান। সঙ্গের হেল্পার দু’টিরও গুণ্ডার মতাে চেহারা। হৈচৈ করে স্ট্রেচার বের করল তারা। সাত–সকালেই অনেক লােকজন। জড়াে হয়ে গেল। পাড়ার মেয়েদের প্রায় সবাই এসেছে। উকিল সাহেবের বউ আমাকে ইশারায় ডাকলেন, ‘খােকা, তাের মার অবস্থা নাকি খুব খারাপ? হেড ক্লার্কের বউ বললেন।
‘না, তেমন কিছু নয়। দেখে আসুন না গিয়ে।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৫
‘এই যাচ্ছি বলে তিনি অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরটা দেখতে চেষ্টা করতে লাগলেন। হেড ক্লার্কের বউও এসেছেন, তাঁর সঙ্গে একটি সুন্দর মতাে মেয়ে। কমবয়সী কয়েক জন ছেলেমেয়ে দেখি হৃষ্টচিত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মন্টু ভীষণ ভয় পেয়েছে, আমার একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে সে যে কাঁপছে, তা বুঝতে পারছি। রুনু আর ঝুনুকে দেখছি না। রাবেয়া উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একা একা।
মন্টু বলল, “দাদা, তােমাকে ডাকছে।
‘ওভারশীয়ার কাকু।
মন্টুর হাত ধরে ওপাশে গেলাম। হয়তাে হাজারাে কথা জিজ্ঞেস করবেন। পুরুষ মানুষের মেয়েলি কৌতূহলে বড়াে খারাপ লাগে। ওভারশীয়ার কাকু খালি পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
আমাকে দেখে বললেন, ‘খােকা, তােমাকে একটু ডাকছিলাম।
কী জন্যে চাচা?
‘না, মানে তেমন কিছু নয়, ঘুম থেকে উঠেই অ্যাম্বুলেন্স দেখে... মানে। ইয়ে... ধর তাে খােকা। মাসের শেষ, কতরকম দরকার হয়, লজ্জা করাে না সােনা, রাখ।
কথা বলবার অবসর না দিয়ে চাচা সরে গেলেন। ঐদিকটায় হৈচৈ হচ্ছে। স্ট্রেচারে করে মাকে তুলছে গাড়িতে, ছুটে গেলাম।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৫
‘বাবা, সঙ্গে কে যাচ্ছে? ‘আমি আর তাের সুহাসিনী মাসি।‘
রাবেয়াকে নিয়ে যান।
না না, ও ছেলেমানুষ। খােকা, তাের ছােটখালাকে খবর দিস। | গাড়ি স্টার্ট নিতেই বাবা আবার ডাকলেন, খােকা, ও খােকা, তাের মা ডাকছে, আয় একটু।
গাড়ির ভেতর আবছা অন্ধকার। গলা পর্যন্ত চাদর জড়িয়ে মা পড়ে আছেন। সারা শরীর কেঁপে উঠছে এক–এক বার। মা নরম স্বরে বললেন, খােকা, আয় এদিকে।
অস্পষ্ট আলােয় চোখে পড়ল যন্ত্রণায় তাঁর ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠছে। অদ্ভুত ফর্সা মুখের অদৃশ্য নীল শিরা কালাে হয়ে ফুলে উঠছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে সারা মুখে।
‘মা, কী জন্যে ডেকেছেন? কী?
Read More