হুমায়ূন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৫

তাের মাকে মনে হয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই ভালােকেন? হঠাৎ করে? না, মানে সুহাসিনী বললএখন বয়স হয়েছে কিনাতা ছাড়াতা ছাড়া কী?| না, মানে কিছু নয়আমার কেন যেন খারাপ লাগছে স্বপ্নটা দেখার পরদেখলাম যেন আমি একটা ঘরে...। 

একটা ঘরে কী?

শঙ্খনীল কারাগার 

না না, রাতের বেলায় স্বপ্ন বলে নাকি কেউ। 

বাবা থতমত খেয়ে চুপ করলেনমায়ের সেই ভয়ধরান চিল্কার আর শােনা যাচ্ছে নাকোথা থেকে দুটি বেড়াল এসে ঝগড়া করছেঅবিকল শিশুদের কান্নার আওয়াজবাবা বললেন, খােকা আমি হাসপাতালে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দিই‘ 

আপনার যেতে হবে না, আমি যাইবরঞ্চ পাশের বাড়ি থেকে ফোন করে দিই* নানা, ফোন করলে কাজ হবে নাআসতে দেরি করবে, বাসা চিনবে 

অনেক ঝামেলাতুই থাক| বাবা চাদর গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেনএত রাতে রিক্সাটিক্সা কিছু পাওয়া যাবে না, হেঁটে হেঁটে যেতে হবেমি ইজিচেয়ারে চুপচাপ বসে রইলামযেশিশুটি জন্মাবে, সে এত আয়ােজন, এত প্রতীক্ষা যন্ত্রণার কিছুই জানছে না, এই জাতীয় চিন্তা হতে লাগলঅন্ধকার মাতৃগর্ভের কোনাে স্মৃতি কারাের মনে থাকে নাযদি থাকত, তবে কেমন হত সেস্মৃতি কে জানে! জন্মের সমস্ত ব্যাপারটাই বড়ো নােংরা। 

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৫

রাবেয়া এসে দাঁড়াল আমার কাছেনিচু গলায় বলল, খােকা, বাবা কি হাসপাতালে গেছেন

বাবা খুব ভয় পেয়েছেন, নারে

হু, পেয়েছেনআমারাে ভয় লাগছে খােকাভয় কিসের? আমি কিছুতেই বিয়ে করব না, দেখিস তুইমাগাে কী কষ্টমায়ের কাছে গিয়েছিলি রাবেয়া? হ্যাঁমা কী করছে? চিৎকার করছেন নাচিৎকার করার শক্তি নেইখুব কষ্ট পাচ্ছেনকী বাজে ব্যাপার

মাসি কী করছে

ঘুমাচ্ছেবাজনার মতাে নাক ডাকছেমেয়েমানুষের নাক ডাকা কী বিশ্রীবাঁশির সরু আওয়াজের মতাে তালে তালে বাজছেঘেন্না লাগে‘ 

মসজিদ থেকে ফজরের আজান হল, ভাের হয়ে আসছেঅ্যাম্বুলেন্স এল, টার দিকেড্রাইভারটা মুশকো জোয়ানসঙ্গের হেল্পার দুটিরও গুণ্ডার মতাে চেহারাহৈচৈ করে স্ট্রেচার বের করল তারাসাতসকালেই অনেক লােকজনজড়াে হয়ে গেলপাড়ার মেয়েদের প্রায় সবাই এসেছেউকিল সাহেবের বউ আমাকে ইশারায় ডাকলেন, খােকা, তাের মার অবস্থা নাকি খুব খারাপ? হেড ক্লার্কের বউ বললেন। 

না, তেমন কিছু নয়দেখে আসুন না গিয়ে। 

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৫

এই যাচ্ছি বলে তিনি অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরটা দেখতে চেষ্টা করতে লাগলেন। হেড ক্লার্কের বউও এসেছেন, তাঁর সঙ্গে একটি সুন্দর মতাে মেয়েকমবয়সী কয়েক জন ছেলেমেয়ে দেখি হৃষ্টচিত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেমন্টু ভীষণ ভয় পেয়েছে, আমার একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখেছেমাঝে মাঝে সে যে কাঁপছে, তা বুঝতে পারছি। রুনু আর ঝুনুকে দেখছি নারাবেয়া উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একা একা। 

মন্টু বলল, দাদা, তােমাকে ডাকছে। 

ওভারশীয়ার কাকু। 

মন্টুর হাত ধরে ওপাশে গেলামহয়তাে হাজারাে কথা জিজ্ঞেস করবেনপুরুষ মানুষের মেয়েলি কৌতূহলে বড়াে খারাপ লাগেওভারশীয়ার কাকু খালি পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। 

আমাকে দেখে বললেন, খােকা, তােমাকে একটু ডাকছিলাম। 

কী জন্যে চাচা

না, মানে তেমন কিছু নয়, ঘুম থেকে উঠেই অ্যাম্বুলেন্স দেখে... মানেইয়ে... ধর তাে খােকামাসের শেষ, কতরকম দরকার হয়, লজ্জা করাে না সােনা, রাখ। 

কথা বলবার অবসর না দিয়ে চাচা সরে গেলেনঐদিকটায় হৈচৈ হচ্ছেস্ট্রেচারে করে মাকে তুলছে গাড়িতে, ছুটে গেলাম। 

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৫

বাবা, সঙ্গে কে যাচ্ছে? আমি আর তাের সুহাসিনী মাসি‘ 

রাবেয়াকে নিয়ে যান। 

না না, ছেলেমানুষখােকা, তাের ছােটখালাকে খবর দিস| গাড়ি স্টার্ট নিতেই বাবা আবার ডাকলেন, খােকা, খােকা, তাের মা ডাকছে, আয় একটু। 

গাড়ির ভেতর আবছা অন্ধকারগলা পর্যন্ত চাদর জড়িয়ে মা পড়ে আছেনসারা শরীর কেঁপে উঠছে একএক বারমা নরম স্বরে বললেন, খােকা, আয় এদিকে। 

অস্পষ্ট আলােয় চোখে পড়ল যন্ত্রণায় তাঁর ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠছেঅদ্ভুত ফর্সা মুখের অদৃশ্য নীল শিরা কালাে হয়ে ফুলে উঠছেবিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে সারা মুখে। 

মা, কী জন্যে ডেকেছেন? কী?

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৬

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *