আর আমাদের আশ্চর্য ফর্সা, ভীষণ রােগা মা হাইফোরসেপ ডেলিভারিতে অপারেশন টেবিলে চুপচাপ মারা গেছেন।
তেইশ বছর আগে মা এসেছিলেন আমাদের ঘরে। তেইশ বছরে একটি বারের জন্যও নিজের বাবার প্রকাণ্ড বাড়িতে যান নি। কতই–বা দূর, বাসে চার আনার বেশি লাগে
এত কাছাকাছি থেকেও যেন তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরের গৃহে তেইশ বছর কাটিয়ে দিলেন।
হাসপাতালে মার চারপাশে তাঁর পরিচিত আত্মীয়স্বজনেরা ভিড় করলেন। নানাজানকে প্রথম দেখলাম আমরা। সােনালি ফ্রেমের হাল্কা চশমা, ধবধবে গায়ের রং। শাজাহান নাটকে বাদশা শাজাহানের চেহারা যেমন থাকে, ঠিক সে–রকম
চেহারা। নানাজান বাবাকে বললেন, ‘মেয়েকে আমি আমার বাড়ি নিয়ে যাই, তােমার আপত্তি আছে? | বাবা চুপ করে রইলেন। নানাজান কথা বলছিলেন এমন সুরে যেন তাঁর বাড়ির কোনাে কর্মচারীর সঙ্গে বৈষয়িক কথা বলছেন। তিনি আবার বললেন, ‘সেখানে। মেয়ের মার কবর আছে, তার পাশেই সেও থাকবে।‘
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৮
তেইশ বছর পর মা আবার তাঁর নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। একদিন যেমন সব ছেড়েছুড়ে এসেছিলেন, কোনাে পিছুটান ছিল না, ফিরেও গেলেন তেমনি।
সুর কাটল না কোথাও। ঘর সংসার চলতে লাগল আগের মতােই। বয়স বাড়তে লাগল আমাদের। রুনু ঝুনু আর মন্টু ব্যস্ত থাকতে লাগল তাদের পুতুলের মতো ছােট্ট বােনটিকে নিয়ে, যার একটিমাত্র দাঁত উঠেছে। মুখের নাগালের কাছে যা–ই পাচ্ছে তা–ই কামড়ে বেড়াচ্ছে সেই দাঁতে। সে সময়ে–অসময়ে থ থ থ থ বলে আপন মনে গান গায়। আর রাবেয়া ? অপূর্ব মমতা আর ভালােবাসায় ডুবিয়ে রেখেছে আমাদের। সমুদ্রের মতাে এত স্নেহ কী করে সে ধারণ করেছে কে জানে?
বাবা রিটায়ার করেছেন কিছুদিন হল। দশটা–পাঁচটা অফিসের বাঁধা জীবন শেষ হয়েছে। ফেয়ারওয়েলের দিন রুনু–ঝুনু বাবার সঙ্গে গিয়েছিল। অফিসের কর্মচারীরা বাবাকে একটি কোরাণ শরীফ, একটি ছাতা আর এক জোড়া ফুলদানি উপহার দিয়েছে। এতেই বাবা মহা খুশি।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৮
মার অবর্তমানে যতটা শূন্যতা আসবে মনে করেছিলাম, তা আসে নি––সমস্তই আগের মতাে চলছে। সব মৃত্য সম্বন্ধেই এ কথা হয়তাে খাটে। অতি প্রিয়জন যদি। পাশে না থাকে, তবে কি করে বেঁচে থাকা যাবে’ ভাবনাটা অর্থহীন মনে হয়। মৃতার জন্যে মানুষ শােক করে ঠিকই, কিন্তু সে–শােক স্মৃতির শােক, এর বেশি কিছু নয়।
কোনাে কোনাে রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মার কথা মনে পড়ে। তখন অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসে না। কিটকির কথা প্রাণপণে ভাবতে চেষ্টা করি তখন। যেন সে এসে বসেছে আমার পাশে। আমি বলছি, ‘কি কিটকি, এত রাতে আমার ঘরে ভয় করে না?
‘কিসের ভয়, ভূতের? আমি বুঝি আগের মতাে ছেলেমানুষ আছি? ‘না, তুই কত বড়াে হয়েছিস, সবাই বড়াে হচ্ছি আমরা। ‘হ্যাঁ, দেখেছেন আমার চুল কত লম্বা হয়েছে ? তােকে বব চুলে এর চেয়ে ভালাে দেখাত। ‘সত্যি ?
‘কচি আছে আপনার কাছে?
কী করবি?
‘বব করে ফেলি আবার।
রাতে এ জাতীয় অসংলগ্ন ভাবনা ভাবি বলেই হয়তাে কিটকিকে দিনের বেলায় দেখলে লজ্জা ও সংকোচ বােধ করি। যেন একটা অপরাধ করে ধরা পড়েছি। কিটকি অবশ্যি আগের মতোই আছে। হৈচৈ করার নেশাটা একটু বেড়েছে মনে হয়। রুনু–ঝুনুর সঙ্গে খুব ভাব হয়েছে। প্রায়ই এদের দু’ জনকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যায়।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৮
আমার নিজের স্বভাব–চরিত্রে বেশ পরিবর্তন এসেছে। যখন ছাত্র ছিলাম, রাত জেগে পড়তে হত, আর দু‘ চোখে ভিড় করত রাজ্যের ঘুম। কষ্ট করে রাত জাগা। এখন ঘুমুবার অবসর আছে, কিন্তু চেপে ধরেছে ইনসমনিয়ায়। থানার ঘড়িতে বড়াে বড়াে ঘন্টা বেজে ছােটগুলিও বাজতে শুরু করে, ঘুম আসে না এক ফোঁটা। বিছানায় গড়াগড়ি করি। ভাের হয়। সকালের আলাে দু চোখে পড়তেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। আটটা বাজার আগেই রুনু ঝাঁকায়, ‘দাদা ওঠ, চা জুড়িয়ে পানি হয়ে
গেল।”
‘হােক, তােরা খা। শরীর খারাপ, আমি আরেকটু ঘুমুই।
রুনু চলে যেতেই রাবেয়া আসে। প্রবল ঝাঁকুনিতে চমকে উঠে শুনি, ‘তিন মিনিটের মধ্যে না উঠলে দিচ্ছি মাথায় পানি ঢেলে। এক–দুই–তিন–চার– এই দিলাম, এই দিলাম––
রাবেয়াকে বিশ্বাস নেই, উঠে পড়তে হয়। বারান্দায় মুখ ধুতে ধুতেই বাবা সকালের দীর্ঘ ভ্রমণ সেরে ফিরে আসেন।
Read More