হুমায়ূন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৮

 আর আমাদের আশ্চর্য ফর্সা, ভীষণ রােগা মা হাইফোরসেপ ডেলিভারিতে অপারেশন টেবিলে চুপচাপ মারা গেছেন। 

তেইশ বছর আগে মা এসেছিলেন আমাদের ঘরেতেইশ বছরে একটি বারের জন্যও নিজের বাবার প্রকাণ্ড বাড়িতে যান নিকতইবা দূর, বাসে চার আনার বেশি লাগে

শঙ্খনীল কারাগার 

 এত কাছাকাছি থেকেও যেন তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরের গৃহে তেইশ বছর কাটিয়ে দিলেন। 

হাসপাতালে মার চারপাশে তাঁর পরিচিত আত্মীয়স্বজনেরা ভিড় করলেননানাজানকে প্রথম দেখলাম আমরাসােনালি ফ্রেমের হাল্কা চশমা, ধবধবে গায়ের রংশাজাহান নাটকে বাদশা শাজাহানের চেহারা যেমন থাকে, ঠিক সেরকম  

চেহারানানাজান বাবাকে বললেন, মেয়েকে আমি আমার বাড়ি নিয়ে যাই, তােমার আপত্তি আছে? | বাবা চুপ করে রইলেননানাজান কথা বলছিলেন এমন সুরে যেন তাঁর বাড়ির কোনাে কর্মচারীর সঙ্গে বৈষয়িক কথা বলছেনতিনি আবার বললেন, সেখানেমেয়ের মার কবর আছে, তার পাশেই সেও থাকবে‘ 

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৮

তেইশ বছর পর মা আবার তাঁর নিজের ঘরে ফিরে গেলেনএকদিন যেমন সব ছেড়েছুড়ে এসেছিলেন, কোনাে পিছুটান ছিল না, ফিরেও গেলেন তেমনি। 

সুর কাটল না কোথাওঘর সংসার চলতে লাগল আগের মতােইবয়স বাড়তে লাগল আমাদেররুনু ঝুনু আর মন্টু ব্যস্ত থাকতে লাগল তাদের পুতুলের মতো ছােট্ট বােনটিকে নিয়ে, যার একটিমাত্র দাঁত উঠেছেমুখের নাগালের কাছে যাপাচ্ছে তাকামড়ে বেড়াচ্ছে সেই দাঁতেসে সময়েঅসময়ে বলে আপন মনে গান গায়আর রাবেয়া ? অপূর্ব মমতা আর ভালােবাসায় ডুবিয়ে রেখেছে আমাদেরসমুদ্রের মতাে এত স্নেহ কী করে সে ধারণ করেছে কে জানে

বাবা রিটায়ার করেছেন কিছুদিন হলদশটাপাঁচটা অফিসের বাঁধা জীবন শেষ হয়েছেফেয়ারওয়েলের দিন রুনুঝুনু বাবার সঙ্গে গিয়েছিল। অফিসের কর্মচারীরা বাবাকে একটি কোরাণ শরীফ, একটি ছাতা আর এক জোড়া ফুলদানি উপহার দিয়েছেএতেই বাবা মহা খুশি। 

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৮

মার অবর্তমানে যতটা শূন্যতা আসবে মনে করেছিলাম, তা আসে নিসমস্তই আগেমতাে চলছেসব মৃত্য সম্বন্ধেই কথা হয়তাে খাটেঅতি প্রিয়জন যদিপাশে না থাকে, তবে কি করে বেঁচে থাকা যাবেভাবনাটা অর্থহীন মনে হয়মৃতার জন্যে মানুষ শােক করে ঠিকই, কিন্তু সেশােক স্মৃতির শােক, এর বেশি কিছু নয়। 

কোনাে কোনাে রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মার কথা মনে পড়েতখন অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসে নাকিটকির কথা প্রাণপণে ভাবতে চেষ্টা করি তখনযেন সে এসে বসেছে আমার পাশেআমি বলছি, কি কিটকি, এত রাতে আমার ঘরে ভয় করে না

কিসের ভয়, ভূতের? আমি বুঝি আগের মতাে ছেলেমানুষ আছি? না, তুই কত বড়াে হয়েছিস, সবাই বড়াে হচ্ছি আমরাহ্যাঁ, দেখেছেন আমার চুল কত লম্বা হয়েছে ? তােকে বব চুলে এর চেয়ে ভালাে দেখাতসত্যি

কচি আছে আপনার কাছে

কী করবি

বব করে ফেলি আবার। 

রাতে এ জাতীয় অসংলগ্ন ভাবনা ভাবি বলেই হয়তাে কিটকিকে দিনের বেলায় দেখলে লজ্জা সংকোচ বােধ করিযেন একটা অপরাধ করে ধরা পড়েছিকিটকি অবশ্যি আগের মতোই আছেহৈচৈ করার নেশাটা একটু বেড়েছে মনে হয়রুনুঝুনুর সঙ্গে খুব ভাব হয়েছেপ্রায়ই এদের দু’ জনকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যায়। 

শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৮

আমার নিজের স্বভাবচরিত্রে বেশ পরিবর্তন এসেছেযখন ছাত্র ছিলাম, রাত জেগে পড়তে হত, আর দুচোখে ভিড় করত রাজ্যের ঘুমকষ্ট করে রাত জাগাএখন ঘুমুবার অবসর আছে, কিন্তু চেপে ধরেছে ইনসমনিয়ায়থানার ঘড়িতে বড়াে বড়াে ঘন্টা বেজে ছােটগুলিও বাজতে শুরু করে, ঘুম আসে না এক ফোঁটাবিছানায় গড়াগড়ি করিভাের হয়সকালের আলাে দু চোখে পড়তেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়িআটটা বাজার আগেই রুনু ঝাঁকায়, দাদা ওঠ, চা জুড়িয়ে পানি হয়ে 

গেল” 

হােক, তােরা খাশরীর খারাপ, আমি আরেকটু ঘুমুই। 

রুনু চলে যেতেই রাবেয়া আসেপ্রবল ঝাঁকুনিতে চমকে উঠে শুনি, তিন মিনিটের মধ্যে না উঠলে দিচ্ছি মাথায় পানি ঢেলেএকদুইতিনচারএই দিলাম, এই দিলাম– 

রাবেয়াকে বিশ্বাস নেই, উঠে পড়তে হয়বারান্দায় মুখ ধুতে ধুতেই বাবা সকালের দীর্ঘ ভ্রমণ সেরে ফিরে আসেন

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-৯

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *