বাস থেকে নেমে হকচকিয়ে গেলাম। বৃষ্টিতে ভেসে গেছে সব। রাস্তায় পানির ধারাস্রোত। লােকজন চলাচল করছে না, লাইটপােস্টের বাতি নিভে আছে। অথচ দশ মিনিট আগেও যেখানে ছিলাম, সেখানে বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। শুকনাে খটখট করছে চারদিক। কেমন অবাক লাগে ভাবতে, বৃষ্টি এসেছে, ঝুপ ঝুপ করে একটা ছােট্ট জায়গা ভিজিয়ে চলে গেছে। আর এতেই আশৈশব পরিচিত এ অঞ্চল কেমন ভৌতিক লাগছে। হাঁটতে গা ছমছম্ করে।
রাত নটাও হয় নি, এর মধ্যেই রশীদের চায়ের স্টল বন্ধ হয়ে গেছে। মডার্ণ লওি ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে। এক বার মনে হল হয়তাে আমার নিজের ঘড়িই বন্ধ হয়ে আছে। রাত বাড়ছে ঠিকই, টের পাচ্ছি না। কানের কাছে ঘড়ি ধরতেই ঘড়ির আওয়াজ ছাপিয়ে মন্টুর গলা শােনা গেল।
রাস্তার পাশে নাপিতের যে–সমস্ত ছােট ছােট টুলকাঠের বাক্স থাকে, তারই একটায় জড়সড় হয়ে বসে আছে। আলাে ছিল না বলেই এতক্ষণ নজরে পড়ে নি। চমকে বললাম, ‘মন্টু কী হয়েছে রে?
‘কিছু হয় নি।
স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল হাতে নিয়ে মন্টু টুলবাক্স থেকে উঠে এল। কাদায় পানিতে মাখামাখি। ধরা গলায় বলল, ‘পা পিছলে পড়েছিলাম, স্যাণ্ডেলের ফিতে ছিড়ে গেছে।
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১
‘এত রাতে বাইরে কী করছিলি? ‘তােমার জন্যে বসে ছিলাম, এত দেরি করেছ কেন?
বাসায় কিছু হয়েছে মন্টু?
‘না, কিছু হয় নি। মা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, বলেছে ভিক্ষে করে খেতে।
মন্টু শার্টের লম্বা হাতায় চোখ মুছতে লাগল। ‘টুনুদের বাসায় ছিলাম, টুনুর মাষ্টার এসেছে। সে জন্যে এখানে বসে আছি। ‘কেউ নিতে আসে নি?
‘রাবেয়া আপা এসে চার আনা পয়সা দিয়ে গিয়েছে, বলেছে তুমি আসলে তােমাকে নিয়ে বাসায় যেতে।
মন্টু আমার হাত ধরল। দশ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে সন্ধ্যা থেকে বসে আছে বাইরে, এর ভেতর ঝড়–বৃষ্টি হয়েছে, বাতিটাতি নিভিয়ে লােকজন ঘুমিয়েও পড়েছে। সমস্ত ব্যাপারটার ভেতরই বেশ খানিকটা নির্মমতা আছে। অথচ মাকে এ নিয়ে কিছুই বলা যাবে না। বাবা রাত দশটার দিকে ঘরে ফিরে যখন সব শুনবেন, তখন তিনি আরাে চুপ হয়ে যাবেন। মুখ কালাে করে ঘুরে বেড়াবেন এবং একদিন ক্ষতিপূরণ হিসেবে চুপি চুপি হয়তাে একটি সিনেমাও দেখিয়ে আনবেন।
“দাদা, রুনুকেও মা তালা বন্ধ করে রেখেছে। ট্রাঙ্ক আছে যে ঘরটায় সেখানে। ‘রুনু কী করেছে? ‘আয়না ভেঙেছে।
আর তুই কী করেছিলি? ‘আমি কিছু করি নি।
ঝুনু বারান্দায় মােড়া পেতে চুপচাপ বসেছিল। আমাদের দেখে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল।
“দাদা, এত দেরি করলে কেন? যা খারাপ লাগছে। “কী হয়েছে, ঝুনু?” ‘কত কি হয়েছে, তুমি রাবেয়া আপাকে জিজ্ঞেস কর।‘
শঙ্খনীল কারাগার খন্ড-১
গলার শব্দ শুনে “বেয়া বেরিয়ে এল। চোখে ভয়ের ভাবভঙ্গি প্রকট হয়ে উঠেছে। চাপা গলায় বলল, ‘মার ব্যথা শুরু হয়েছে রে খােকা, বাবা তাে এখনাে আসল না, কী করি বল তাে?
কখন থেকে?
‘আধ ঘন্টাও হয় নি। মার কাছ থেকে চাবি এনে দরজা খুলে দেব রুনুর, সেই জন্যে গিয়েছি—দেখি এই অবস্থা।
ভেতরের ঘরে পা দিতেই রুনু ডাকল, ‘ও দাদা, শুনে যাও। মার কী হয়েছে দাদা?
‘কিছু হয় নি। ‘কাঁদছে কেন? ‘মার ছেলে হবে। ‘অ। দাদা তালাটা খুলে দাও, আমার ভয় লাগছে।
একটু দাঁড়া, রাবেয়া চাবি নিয়ে আসছে।
Read More